আমি জানি আমি যা স্বপ্নে দেখেছি তা-ই হবে, আমার স্বপ্ন অন্য মেয়েদের স্বপ্নের মতো নয়। সবাই যুক্তি করে আমার ছেলেটাকে মারবে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার কোলে যখন ফুটফুটে একটা বাচ্চা দিয়ে দেব, তখন তুমি বুঝবে যে কত বড় মিথ্যা সন্দেহ তোমার মধ্যে ছিল।
মেয়েটার চোখ চিকচিক করতে লাগল। সে গাঢ় স্বরে বলল, সত্যি তুমি তা-ই করবে?
অবশ্যই!
তাহলে তুমি প্রতিজ্ঞা করো। কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলো তুমি বাচ্চাটাকে মারবে না। ওরা যখন মারতে চাইবে তুমি মারতে দেবে না।
তুমি ফেরাবে।
একটা শিশুকে আমি খুন করব এটা তুমি বলছ?
তুমি কোরান শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো। প্রতিজ্ঞার কোনো দরকার নেই।
দরকার থাকুক বা না-থাকুক তুমি প্রতিজ্ঞা করো।
কোরান শরিফ এখানে পাব কোথায়?
আমার সঙ্গে আছে। আমার ঐ কালো ব্যাগটার ভেতর। আমি নিয়ে এসেছি।
রুগীকে শান্ত করার জন্যেই প্রতিজ্ঞা করতে হলো। রুগী শান্ত হলো। তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। সে চাপাগলায় বলল, আমি জানি তুমি প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে না। যদি না রাখ তাহলে আমার অভিশাপ লাগবে। আমি তোমাকে একটা কঠিন অভিশাপ দিচ্ছি।
মেয়েটি সত্যি সত্যি একটা কঠিন অভিশাপ দিয়ে বসল। মেয়েটার মাথার যে ঠিক নেই, সে যে অসুস্থ একটি মেয়ে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। তবে তার এই অসুস্থতা, এই মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একটি হাসিখুশি শিশু তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেবে।
সবকিছুই ঠিকঠাকমতো চলছিল।
রাত দুটায় বাইরের দুজন পুরুষ-ডাক্তার এলেন। ডেলিভারির সময় এঁরা থাকবেন। এঁদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত। ডাক্তার সেন। বড় ডাক্তার এবং ভালো ডাক্তার।
আমাদের রুগিণী নতুন ডাক্তার দুজন দেখেই আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এরা কারা? এরা আমার বাচ্চাকে খুন করবে।
আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত থাকে। আমি সারাক্ষণ এখানে থাকব। এক সেকেন্ডের জন্যে নড়ব না। তাছাড়া ডাক্তার সেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর মতো ডাক্তার কম আছে।
মনে থাকে যেন তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমার মনে আছে।
প্রতিজ্ঞা ভাঙলে আমার অভিশাপ লাগবে।
আমার মনে আছে।
তার কিছুক্ষণ পরই ভদ্রমহিলার স্বামী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। খুবই অল্প বয়স্ক একজন যুবক। তাঁকে বেশ দ্র ও বিনয়ী মনে হলো। তবে যে কোনো কারণেই হোক তাকে বেশ ভীত বলে মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক নরম স্বরে বললেন, আপা, আমার স্ত্রী সম্ভবত আপনাকে কিছু বলেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এসব কেন যে বলছে কিছু বুঝতে পারছি না। আমাদের বাচ্চাটা সংসারের প্রথম সন্তান। আমি আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। অথচ ওর ধারণা…
আমি ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, আপনি এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাবেন না।
সব ঠিকঠাক আছে তো আপা?
সব ঠিক আছে।
সিজারিয়ান লাগবে না?
নরম্যাল ডেলিভারি হবে। তাছাড়া ডাক্তার সেন এসেছেন। উনি খুবই বড় ডাক্তার এবং হাইলি স্কিলড।
তাহলে আপনি বলছেন সব ঠিকঠাক হবে?
হ্যাঁ।
রাত তিনটার পর থেকে দেখা গেল সব কেমন বেঠিক চলছে। বাচ্চা নেমে এসেছে বার্থ চ্যানেলের মুখে। এই সময় ডাক্তার সেন বললেন, বাচ্চার পজিশন তো ঠিক নেই। মাথা উপরের দিকে। এতক্ষণ তোমরা কী মনিটর করেছ?
আমিও দেখলাম তাই। এরকম হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ আগেই সব পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। এই সময় এত রক্তপাতের কারণই নেই। টকটকে লাল রঙের রক্ত যা ধমনি থেকে আসছে। সমস্যাটা কোথায়?
রাড ক্রস ম্যাচিং করা ছিল—–রক্ত দেয়া শুরু হলো, কিন্তু এটা সমস্যার কোনো সমাধান নয়। মনে হলো রুগিণী বাইরের রক্ত ঠিক গ্রহণ করতে পারছে না।
ডাক্তার সেন গম্ভীর গলায় বললেন, সামথিং ইজ ভেরি রং।
আমাদের সবার গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ডাক্তার এসব কী বলছেন!
কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল–হঠাৎ করে কনট্রেকশান বন্ধ হয়ে গেল। অথচ এই সময়ই কনট্রেকশান সবচে বেশি প্রয়েজন। শিশুটি কি বার্থ চ্যানেলে মারা গেছে?
রুগিণী ফিসফিস করে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ডাক্তার সেন ফোরসেপ ডেলিভারির প্রস্তুতি নিলেন আর তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আজকাল বাতি চলে গেলেই ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলে ওঠে, তখনকার অবস্থা তা ছিল না। তবে আমাদের কাছে টর্চ, হ্যাজাক, মোমবাতি সবসময় থাকে। সমস্যার সময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়–কাজেই প্রস্তুতি থাকবেই। দ্রুত হ্যাজাক জ্বালানো হলো।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরিশ্রম করে ডাক্তার সেন ডেলিভারি করালেন–যে জিনিসটি বেরিয়ে এল, আমরা চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কুৎসিত কদাকার একটা কিছু যার দিকে তাকানো যায় না। এ আর যা-ই হোক, মানবশিশু নয়। চেনাজানা পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একতাল মাংসপিণ্ড। এর থেকে হাতির শুড়ের মতো আট-দশটি খুঁড় বেরিয়ে এসেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে এবং ছোট হচ্ছে। তালে তালে মাংসপিণ্ডটিও বড়ছোট হচ্ছে। মানবশিশুর সঙ্গে এর একটিমাত্র মিল— এই জিনিসটিরও দুটি বড় বড় চোখ আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখছে চারদিকের পৃথিবীকে। চোখ দুটি সুন্দর। কাজলটানা।
ডাক্তার সেন হতভম্ব গলায় বললেন, হোয়াট ইজ দিস? হোয়াই ইজ দিস? ফোরসেপ দিয়ে ধরা জন্তুটাকে তিনি মাটিতে ফেলে দিলেন। মেঝেতে সে কিলবিল করতে লাগল। মনে হচ্ছে শুড়গুলিকে পায়ের মতো ব্যবহার করে সে এগুতে চাচ্ছে। আমার সঙ্গের সহকর্মী হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বমি করতে শুরু করল।