এখন বলল তুমি কী খাবে? আইসক্রিম খাবে? দিই একটু আইসক্রিম?
ভ্যানিলা আইসক্রিম থাকলে খাব। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ভ্যানিলা আইসক্রিম আছে।
ভদ্রমহিলার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে গেল। আমি তাকে চিকিৎসার জন্যে কিছু টাকা দিতে গেলাম, তিনি শান্ত গলায় বললেন, ডাক্তারি যখন করি তখন চিকিৎসার টাকা তো নেই, কিন্তু তাই বলে বাচ্চা একটা মেয়ের গলার কাঁটা বের করারও ফি দাবি করব এটা কী করে ভাবলেন? কাঁটাটা বের করার পর আপনার মেয়ের হাসি আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন। এই হাসির দাম লক্ষ টাকা। তা-ই না?
মিসেস হাসনা বানুর সঙ্গে এই হচ্ছে আমার পরিচয়ের সূত্র। পরিচয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি নিউক্লিয়ার মেডিসিন গবেষণায় একটি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন যে গল্পটি বলব সেটি তার কাছ থেকে শোনা। যেভাবে শুনেছি অবিকল সেইভাবে গল্পটি বলার চেষ্টা করছি—
মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বেরুবার পরপর আমি একটা ক্লিনিকে চাকরি নিই। এখন যেমন চারদিকে ক্লিনিকের ছড়াছড়ি, তখন তেমন ছিল না। অল্প কয়েকটা ক্লিনিক ছিল— সবই মাতৃসদন। আমি যে ক্লিনিকে চাকরি নিই সেটা সেই সময়ের খুব নামী ক্লিনিক। ধনী পরিবারের মারাই শুধু আসতেন। সুযোগ-সুবিধা ভালো ছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ক্লিনিক। সর্বসাকুল্যে পনেরোটা বেড ছিল। দশটি এ ক্যাটাগরির, পাঁচটি বি ক্যাটাগরির। এ ক্যাটাগরির ঘরগুলিতে এয়ারকুলার বসানো ছিল। আমরা ডাক্তার ছিলাম তিনজন। প্রধান ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপক। আমি এবং নাসিমা আমরা দুজন সদ্য পাস করা ডাক্তার। অবিশ্যি সব কাজ আমরা দুজনই দেখতাম। যেহেতু ছোট্ট ক্লিনিক আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের ক্লিনিকে আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ভরতি হলো। প্রথম মা হতে যাচ্ছে। ভয়ে অস্থির। আমি প্রাথমিক পরীক্ষা করে দেখলাম এখনও অনেক দেরি। একেকটা কনট্রেকসানের ভেতর গ্যাপ অনেক বেশি। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, ভয়ের কিছু নেই।
মেয়েটি করুণ গলায় বলল, তুমি তো বাচ্চা মেয়ে। তুমি পারবে? তুমি জান সবকিছু?
আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম, আমি বাচ্চা নই, তা ছাড়া আমি একজন খুব ভালো ডাক্তার। আপনার কোনো ভয় নেই। আমি ছাড়াও এখানে ডাক্তার আছেন। একজন প্রফেসর আছেন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেখবেন।
রুগিণী বললেন, ভাই তোমাকে তুমি করে বলেছি বলে রাগ করনি তো?
না।
আমার এমন বদভ্যাস, যাকে পছন্দ হয় তাকেই তুমি বলে ফেলি।
আমি কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য ভদ্রমহিলার স্বামীকে নিয়ে অফিসে চলে এলাম। দেখা গেল খুবই ক্ষমতাবান পরিবারের বউ। সাতআটটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হোমড়া-চোমড়া ধরনের কিছু মানুষ বিরক্তমুখে হাঁটাহাঁটি করছে। একজন অতি বিরক্ত গলায় বলছে, আপনাদের ব্যবস্থা তো মোটেই ভালো না। ইমার্জেন্সি হলে পেশেন্টকে আপনারা কী করবেন? এখানে কি অপারেশন করার ব্যবস্থা আছে?
জী আছে।
আপনাদের নিজস্ব জেনারেটর আছে? ধরুন হঠাৎ যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তখন? তখন কী করবেন? মোমবাতি জ্বালিয়ে তো নিশ্চয়ই অপারেশন হবে না?
লোকগুলি আমাদের বিরক্ত করে মারল। দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক বললেন, আপনাদের এখান থেকে আমরা বেশকিছু টেলিফোন করব। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। সব পেমেন্ট করা। মানি উইল নট বি এ প্রবলেম।
রুগিণী ভরতি হয়েছেন বিকেলে, রাত নটা বাজার আগেই স্রোতের মতো মানুষ আসতে লাগল। অনেকের হাতে ফুলের গুচ্ছ, অনেকের হাতে উপহারের প্যাকেট। বিশ্রী অবস্থা।
আমি সহজে ধৈর্য হারাই না। আমারও শেষ পর্যন্ত মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনারা কী শুরু করেছেন? এটাকে একটা বাজার বানিয়ে ফেলেছেন। দয়া করে ভিড় পাতলা করুন। একজন শুধু থাকুন। ডেলিভারি হোক তখন আসবেন।
আমার কথায় একজন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত মেয়ের শাশুড়ি হবেন— চোখ-মুখ লাল করে বললেন, আপনি কি জানেন এই মেয়ে কোন বাড়ির TU?
আমি বললাম, আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। সে আমার পেশেন্ট এইটুকু শুধু জানি। আর দশটা পেশেন্টকে আমি যেভাবে দেখব তাকেও একইভাবে দেখা হবে।
আর দশটা বউ এবং আমার ঘরের বউ এক? আমার কাছে এক। জান, আমি এই মুহূর্তে তোমার চাকরি খেতে পারি।
আমি শীতল গলায় বললাম, আপনি আমার চাকরি খেতে পারেন না। চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনো ব্যর্থতা পাওয়া গেলে তবেই চাকরি যেতে পারে, তার আগে নয়। আপনি শুধু-শুধুই চাচামেচি করছেন।
ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে স্কাউনড্রেল, লোফার এইসব বলতে লাগলেন। একজন ভদ্রমহিলা এমন কুৎসিত ভাষায় কথা বলতে পারেন আমার জানা ছিল না। বিরাট হইচই বেধে গেল। আমাদের প্রফেসর এলেন। ভেবেছিলাম তিনি আমার পক্ষে কথা বলবেন। তা বললেন না। আমার ওপর অসম্ভব রেগে গেলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে উঁচু গলায় বললেন-~–হাসনা, তোমাকে এখানে চাকরি করতে হবে না। ইউ ক্যান লিভ।
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার প্রফেসর জানেন কত আগ্রহ, কত যত্ন নিয়ে আমি এখানে কাজ করি; অথচ তিনি…
আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম। সহজে আমার চোখে পানি আসে না। কিন্তু রিকশায় ফিরবার পথে খুব কাঁদলাম। তখন বয়স অল্প। মন ছিল খুব স্পর্শকাতর।