আমি হলে কী করতাম সেটা বাদ দিন। আপনি কী করেছেন সেটা বলুন।
দাঁড়ান, আরো খানিকটা অ্যালকোহল গলায় ঢেলে নিই। তা না হলে বলতে পারব না।
ভদ্রলোক ঢকঢক করে অনেকখানি কাঁচা-হুইসকি গলায় ঢেলে দিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তিনি স্থির গলায় বললেনআমি সেদিন যা করেছিলাম একজন বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী মানুষ তা-ই করবে। আমি ছুটে গিয়েছিলাম সেখানে। প্রচণ্ড ভয়াবহ কোনো ঘটনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালে মানুষের ভয় থাকে না। একজাতীয় এনজাইম শরীরে চলে আসে। তখন প্রচুর গুকোজ ভাঙতে শুরু করে। মানুষ শারীরিক শক্তি পায়। ভয় কেটে যায়।
আমার কোনো ভয় ছিল না। আমি দ্রুত গেলাম ঐ জায়গায়। কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম।
তারপর কী দেখলেন?
কী আর দেখব? কিছুই দেখলাম না। আপনি কি ভেবেছেন গিয়ে দেখব ইয়াকুব তার স্ত্রীর ডেডবডি নিয়ে বসে আছে?
না, তা ভাবিনি।
নেচার বলুন বা ঈশ্বর বলুন বা প্রকৃতি বলুন-এরা কোনোরকম অস্বাভাবিকতা সহ্য করে না, এই জিনিসটি খেয়াল রাখবেন। কাজেই আমি কিছুই দেখলাম না। বৃষ্টিতে ভিজলাম, কাদায় মাখামাখি হলাম। আমার জিদ চেপে গেল। পাশের বাগানের মালীকে ডেকে এনে সেই রাতেই জায়গাটা খুঁড়লাম। কিছুই পাওয়া গেল না।
পরদিন থানায় খবর দিলাম। পুলিশের সাহায্যে আবারও খোঁড়াখুঁড়ি করা হলো। কিছুই পাওয়া গেল না। সবার ধারণা হলো আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার বাবা খবর পেয়ে আমাকে এসে নিয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন ডাক্তারের চিকিৎসায় থেকে সুস্থ হলাম। শুনে অবাক হবেন, এই ঘটনার পর মাসখানেক আমি ঘুমুতে পারতাম না।
গল্পটা কি এখানেই শেষ, না আরো কিছু বলবেন?
না আর কিছু বলব না। ভাই আগেই তো বলেছি এটা কোনো ভৌতিক গল্প না। ভৌতিক গল্প হলে দেখা যেত ইয়াকুব বউটাকে মেরে ঐখানে কবর দিয়ে রেখেছিল। ভৌতিক গল্প না বলেই ঐটা সত্যি হয়নি। তবে ঐ বাড়ি আমি কিনে নিয়েছি। বর্ষার সময় প্রায়ই ঐখানে একা একা রাত্রিযাপন করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ রাতে ঘটনার অংশবিশেষ আমি দেখেছিলাম। নিজের ওপর কনট্রোল হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে বাকিটা দেখতে পারিনি। কোনো একদিন বাকিটা হয়তো দেখব। ইচ্ছা করলে আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আপনি কি যাবেন?
না আমার ভূত দেখার কোনো ইচ্ছা নেই–আপনার ঐ মালী, ইয়াকুব না কী যেন নাম বললেন ও কি এখনও ঐ বাড়িতে আছে?
হ্যাঁ আছে।
সে আপনার ঘটনা শুনে কী বলে?
এটাও একটা মজার ব্যাপার। সে কিছুই বলে না। হ্যাঁও বলে না, নাও বলে না। চুপ করে থাকে। ভালো কথা এতক্ষণ যে আমাদের ড্রিংকস দিয়ে গেল, কাজু বাদাম দিয়ে গেল তার নামই ইয়াকুব। তাকে আমি সবসময় কাছাকাছি রাখি। আপনি কি তার সঙ্গে কথা বলবেন? ইয়াকুব, এই ইয়াকুব…।
সে
আমার ছোট মেয়ের গলায় মাছের কাঁটা ফুটেছিল।
মাছের কাঁটা যে এমন যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার তা জানা ছিল না। বেচারি ক্রমাগত কাঁদছে। কিছুক্ষণ পরপর বমি করছে, হেঁচকি উঠছে। চোখ-মুখ ফুলে একাকার। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।
অনেক ধরনের লৌকিক চিকিৎসা করানো হলো। শুকনো ভাতের দলা গেলানো, মধু খাওয়ানো, গলায় সেঁক। এক পর্যায়ে আমাদের কাজের মেয়েটি বলল, একটা বিড়াল এনে তার পায়ে ধরলে কাটা চলে যাবে। গ্রামদেশে নাকি এইভাবে গলার কাঁটা দূর করা হয়।
বিপদে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। হাতের কাছে বেড়াল থাকলে হয়তোবা বেড়াল চিকিৎসাও করাতাম। ডাক্তারের কথা একবারও মনে হয়নি। কারণ মনে হলেও লাভ হতো না। আটচল্লিশ ঘণ্টার হরতাল চলছে। ঢাকা শহর অচল। পুলিশের সঙ্গে জনতার কিছু কিছু খণ্ডসংঘর্ষ হচ্ছে বলেও খবর আসছে। দুটো পেট্রোল পাম্পে নাকি আগুন লাগানো হয়েছে। কয়েকজন মারাও গেছে। শহরভরতি গুজব। শোনা যাচ্ছে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে। তিনি তার প্রিয় গলফ সেট বিক্রি করে দিয়েছেন। একটা হেলিকপ্টার নাকি বঙ্গভবনে রেডি অবস্থায় আছে।
এই অবস্থায় মেয়ে কোলে নিয়ে রাস্তায় নামলাম। মেয়ে একটু পর পর কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করছে— বাবা, আমি কি মরে যাচ্ছি?
সাত বছরের মেয়ে এই জাতীয় প্রশ্ন করলে বুক ভেঙে যায়। আমার নিজেরও চোখে পানি এসে গেল।
যখন প্রয়েজন থাকে না তখন মোড়ে মোড়ে ফার্মেসি দেখা যায়। সেইসব ফার্মেসিতে গম্ভীরমুখে ডাক্তার বসে থাকেন। আজ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কোনো ফার্মেসি খোলা নেই। দুজন ডাক্তারের বাসায় গেলাম— একজন বাসায় ছিলেন না, অন্যজন মেয়েকে না দেখেই বললেন, মেডিক্যালে নিয়ে যান।
মেডিক্যালেই নিয়ে যেতাম তবু কেন জানি সাইনবোের্ড দেখে দেখে তৃতীয় একজন ডাক্তার খুঁজে বের করলাম। ইনি তিনতলায় থাকেন। সাইনবোর্ডে লেখা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। গলায় কাঁটা ফোটা নিশ্চয়ই স্ত্রীরোগ নয়, তবু গেলাম যদি কিছু করতে পারেন।
ডাক্তারের নাম হাসনা বানু। ছোটখাটো মানুষ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ভদ্রমহিলার মধ্যে মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। একদল মানুষ আছে যাদের দেখলেই আপনজন মনে হয়। প্রথম দর্শনেই তাকে এরকম মনে হলো। তিনি আমার মেয়েকে চেয়ারে বসিয়ে হাঁ করালেন। গলায় টর্চের আলো ফেলে চিমটা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে এক ইঞ্চি লম্বা একটা কাঁটা বের করে ফেললেন। অতি কোমল গলায় বললেন, মামণি ব্যথা কমেছে?
আমার মেয়ে চুপ করে রইল। সে বোধহয় তখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। ডাক্তার হাসনা বানু বললেন, কী মেয়ে, আমার সঙ্গে কথা বলবে না? আমার মেয়ে হেসে ফেলল।