ইয়াকুব গম্ভীর মুখে বলল, আমার স্ত্রীর কাছে শিখেছি। খুব ভালো রাঁধতে পারত।
পারত বলছ কেন? এখন কি পারে না?
ইয়াকুব গম্ভীর হয়ে গেল। ভাবলাম নিশ্চয়ই খুব ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার। এখন আর প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না। তবে সহজেই নিজেকে সামলে নিল। সহজ স্বরে বলল, এখন পারে কি পারে না জানি না স্যার। আমার সঙ্গে থাকে না।
কোথায় থাকে?
জানি না কোথায় থাকে। ওর চরিত্র খারাপ ছিল। এর তার সাথে যোগাযোগ ছিল। বিশ্রী অবস্থা। বলার মতো না। অনেক দেনদরবার করেছি, কিছু লাভ হয় নাই। তারপর সাত বছরের দুই মেয়ে ঘরে রেখে পালিয়ে গেছে, বুঝে দেখেন কত বড় হারামি।
কতদিন আগের কথা?
বছর দুই।
কোনো খবর পাওয়া যায়নি?
মোড়লগঞ্জ বাজারে নাকি দেখা গিয়েছিল আমার কোনো আগ্রহ ছিল। খোঁজ নেই নাই।
এদের জীবনের এইজাতীয় কিচ্ছাকাহিনী শুনতে সাধারণত ভালোই লাগে। আমার লাগল না। আমাদের সবার জীবনেই একান্ত সমস্যা আছে। সেইসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। কিন্তু ইয়াকুব মনে হলো কথা বলবেই।
জীবনে বড় ভুল কী করেছিলাম জানেন স্যার? সুন্দরী বিয়ে করেছিলাম। ডানাকাটা পরী বিয়ে করেছিলাম।
বউ খুব সুন্দরী ছিল?
আগুনের মতো ছিল। আগুন থাকলেই পোকামাকড় আসে। তা-ই ভয় আর তা হল অন থাক হয়। আমার জীবন হলো অতিষ্ঠ। একদিন মোড়লগঞ্জের বাজারে গেছি, ফিরে এসে দেখি সদরদরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করলাম, কেউ দরজা খোলে না। শেষে ধুপ করে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে কে যেন দৌড় দিল। আমি বউরে বললাম— এ কে? বউ বলল, আমি কী জানি কে?
ইয়াকুব একের পর এক বউয়ের কীর্তিকাহিনী বলতে লাগল, আমি একসময় বিরক্ত হয়ে বললাম
ঠিক আছে বাদ দাও এসব কথা।
বাদ দিতে চাইলেও বাদ দেয়া যায় না। তিনবার সালিশি বসল। সালিশিতে ঠিক হলো বউরে তালাক দিতে হবে। তালাক দিলাম না। মন মানল না। তার ওপর যমজ মেয়ে আছে। এর ফল হইল এই…
স্ত্রী কোথায় আছে তুমি জান না?
জী না।
কী নাম মেয়েদের?
যমজ মেয়ে হয়েছিল জনাব। তুহিন একজনের নাম, তুষার আরেকজনের নাম। নাম রেখেছিল মেয়ের মা।
ভালো, খুব ভালো।
কোনোকিছু দরকার লাগলে এদের বলবেন। মেয়েরা এইখানেই থাকে, ডাক দিলেই আসবে।
না, আমার কিছু লাগবে না।
বিরক্ত করলেও বলবেন। থাবড়া দিয়ে গাল ফাটায়ে দিব। মেয়েগুলি বেশি সুবিধার হয় নাই। মায়ের খাসলত পেয়েছে। সারাদিন সাজগোজ। এই পায়ে আলতা, এই ঠোটে লিপস্টিক।
স্কুলে পড়ে না?
আরে দূর–পড়াশোনা! এরা যায় আর আসে।
মেয়ে দুটিকে আমার অবিশ্যি খুবই পছন্দ হলো। দুজনই হাস্যমুখ। সারাক্ষণ হাসছে। সবসময় সেজেগুজে আছে। কাজেরও খুব উৎসাহ। যদি বলি, এই এক গ্লাস পানি দাও তো। অমনি ছুটে যাবে। দুজনই দুহাতে দুটা পানিভরতি গ্লাস নিয়ে এসে বলবে, চাচা আমারটা নেন। চাচা আমারটা নেন। আধ গ্লাস পানি খেলেই যেখানে চলত সেখানে বাধ্য হয়ে দুগ্লাস খাই যাতে মেয়ে দুটোর কোনোটাই কষ্ট না পায়।
স্নেহ নিমগামী। যত দিন যেতে লাগল বাচ্চা দুটিকে আমার ততই পছন্দ হতে লাগল। ছোটখাটো কিছু উপহার কিনে দিলাম। দুজনের জন্যে দুটা রং পেন্সিলের সেট, ছোট ছোট আয়না। যা-ই পায় আনন্দে লাফায়। বড় ভালো লাগে দেখতে। ঐ বাড়িতে দেখতে দেখতে এগারো দিন কেটে গেল। বারো দিনের দিন একটা ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা বলার আগে পারিপার্শ্বিক অবস্থার একটা বর্ণনা দিয়ে নিই।
আমার বাড়িটা পশ্চিমমুখী। বাড়ির সামনে এবং পেছনে আমন ধানের মাঠ। বাড়ির উত্তরে জংলা ধরনের জায়গা। একসময় নিবিড় বাঁশবন ছিল, এখন পাতলা হয়ে গেছে। দক্ষিণে উলকিবাড়ির বিশাল বাগান। সেই বাগানে আম, জাম, লিচু থেকে শুরু করে আতাফলের গাছ পর্যন্ত আছে। একজন বেঁটেখাটো দাড়িওয়ালা মালী সেই বাগান পাহারা দেয়। আমার সঙ্গে দেখা হলেই গভীর বিনয়ের সঙ্গে জানতে চায়। স্যারের শইলডা কি ভালো? ঘুমের কোনো ডিসটাব হয় না তো?
আমি প্রতিবারই বিস্মিত হয়ে বলি, ঘুমের ডিসটার্ব হবে কেন?
শহরের মানুষ হঠাৎ গেরামে আইস্যা পড়লেন। এইজন্যে জিগাই।
আমার ঘুম, খাওয়াদাওয়া কোনোকিছুতেই কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
অসুবিধা হইলে কইবেন। ভয়ডর পাইলে ডাক দিবেন। আমার নাম বদরুল। আমি রাইতে ঘুমাই না। জাগান থাকি।
ঠিক আছে বদরুল। যদি কখনো প্রয়েজন বোধ করি তোমাকে ডাকব।
বারো দিনের দিন প্রয়েজন বোধ করলাম। দিনটা সোমবার। সকাল থেকেই মেঘলা ছিল। দুপুর থেকে তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। এর মধ্যে ইয়াকুব এসে বলল, স্যার একটা বিরাট সমস্যা। তুহিনের গলা ফুলে কী যেন হয়েছে, নিশ্বাস নিতে পারছে না। একে তো স্যার ডাক্তারের কাছে। নেয়া দরকার।
আমি তৎক্ষণাৎ মেয়েটাকে দেখতে গেলাম। খুবই খারাপ অবস্থা, শুধু গলা না, সমস্ত মুখ ফুলে গেছে। কী কষ্টে যে নিশ্বাস নিচ্ছে সে-ই জানে। মেয়েটার শরীর এত খারাপ অথচ এরা আমাকে কিছুই বলেনি। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
আমি বললাম, এক মুহূর্ত দেরি করা ঠিক হবে না। তুমি এক্ষুনি মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।
স্যার আপনার খাওয়াদাওয়া।
আমার খাওয়াদাওয়া নিয়ে তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। চাল ফুটিয়ে নিতে পারব। একটা ডিমও ভেজে নেব। তুমি দেরি করবে না।
আমি ইয়াকুবকে কিছু টাকা দিলাম। সে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুই মেয়েকে একটা গরুর গাড়িতে তুলে রওনা হয়ে গেল। আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কেন যেন মনে হলো মেয়েটা বাঁচবে না।