যিনি গল্প করছিলেন তিনি থমকে গেলেন। মোতালেব সাহেব বললেন, স্বীকার করলাম অবশ্যই তর্কের খাতিরে যে মানুষ মরে ভূত হতে পারে, তাই বলে কাপড় মরে তো কাপড়-ভূত হবে না। আমরা যদি ভূত দেখি তাদের ল্যাংটা দেখা উচিত। ওরা কাপড় পায় কোথায়? সবসময় দেখা যায় ভূত একটা সাদা কাপড় পরে থাকে। এর মানে কী?
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ঘোর নাস্তিক, প্রচণ্ড যুক্তিবাদী মানুষের কাছ থেকে আমি অবিশ্বাস্য একটি গল্প শুনি। যেভাবে গল্পটি শুনেছিলাম অবিকল সেইভাবে বলছি। গল্পের শেষে মোতালেব সাহেব কিছু ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অপ্রয়েজনীয় বিধায় সেই ব্যাখ্যা আমি দিচ্ছি না। বৈশাখ মাসের এক ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় মোতালেব সাহেব গল্প শুরু করলেন।
এই যে ভাই লেখক, ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা শুনবেন? একটা কন্ডিশনে ঘটনাটা বলতে পারি। চুপ করে শুনে যাবেন। কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। এবং ঘটনাটা বিশ্বাস করতে পারবেন না।
বিশ্বাস করলে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে। আমার মাধ্যমে কোনো অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার প্রচার পাবে তা হয় না। তা হতে দেয়া যায় না। আপনি যদি ধরে নেন এখন যা শুনছেন তা একটা গল্প, মজার গল্প, তা হলেই আপনাকে বলতে পারি।
এই গল্পটি কোথাও ব্যবহার করতে পারি?
পারেন। কারণ গল্প-উপন্যাসকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। সবাই ধরে নেয় এগুলি বানানো ব্যাপার। তা হলে বলুন শুনি।
ভদ্রলোক পরপর চার পেগ মদ্যপান করলেন। তাঁর মদ্যপানের ভঙ্গিও অদ্ভুত। অষুধের মেজারিং গ্লাস ভরতি করে হুইসকি নেন। এক ফোঁটাও পানি মেশান না। ঢক করে পুরোটা মুখে ফেলে দেন কিন্তু গিলে ফেলেন না। কুলকুচা করার মতো শব্দ হয়। তারপর একসময় ঘোত করে গিলে ফেলে বলেন— কেন যে মানুষ এইসব ছাইপাশ খায়! বলেই আবার খানিকটা নেন। যা-ই হোক, ভদ্রলোকের জবানিতে মূল গল্পে যাচ্ছি—
তখন আমার বয়স চব্বিশ, এম.এ. পাস করেছি। ধারণা ছিল খুব ভালো রেজাল্ট হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার হিসেবে এন্ট্রি পেয়ে যাব। তা হয়নি। এম.এ.-র রেজাল্ট খুবই খারাপ হলো। কেন হলো তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। পরীক্ষা ভালো দিয়েছি। একটা গুজব শুনতে পাচ্ছি জনৈক অধ্যাপক রাগ করে আমাকে খুবই কম নম্বর দিয়েছেন। এই গুজব অমূলক নাও হতে পারে। অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো না। দুএকজন আমাকে বেশ পছন্দ করেন, আবার কেউ-কেউ আছেন আমার ছায়াও সহ্য করতে পারেন না।
যা বলছিলাম, রেজাল্টের পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবা খুব রাগারাগি করলেন। হিন্দি ভাষায় বললেন— নিকালো। আভি নিকালো।
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, চলে যাচ্ছি। হিন্দি বলার দরকার নেই।
এই বলেই সুটকেস গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আমি খুবই সচ্ছল পরিবারের ছেলে। কাজেই খালিহাতে ঘর থেকে বের হলাম না। বেশকিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। কোথায় যাচ্ছি কাউকে বলে গেলাম না। সঙ্গে একগাদা বই, বিশাল একটা খাতা। এক ডজন বলপয়েন্ট। সেই সময় আমার লেখালেখির বাতিক ছিল। একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস শুরু করেছিলাম, যে-উপন্যাসে মূল ডিটেকটিভ খুন করে। ইন্টারেস্টিং গল্প।
যা-ই হোক, বাড়ি থেকে বের হয়েও খুব একটা দূরে গেলাম না। একটা হোটেলে ঘর ভাড়া করে রইলাম। দেখি সেখানে কাজ করার খুব অসুবিধা সারাক্ষণ হইচই। কিছু-কিছু কামরায় রাতদুপুরে মদ খেয়ে মাতলামিও করে। মেয়েছেলে নিয়ে আসে।
হোটেল ছেড়ে দিয়ে শহরতলিতে একটা বেশ বড় বাড়ি ভাড়া করে বসলাম। এক জজসাহেব শখ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তার শখ হয়তো এখনও আছে, ছেলেমেয়েদের শখ মিটে গেছে। এ-বাড়িতে কেউ আর থাকতে আসে না।
একজন কেয়ারটেকার-কাম মালী-কাম দারোয়ান আছে। বাড়ির পুরো দায়িত্ব তার। লোকটিকে দেখেই মনে হয় বদলোক। আমাকে যে বাড়িভাড়া দিয়েছে মনে হচ্ছে নিজ দায়িত্বেই দিয়েছে। ভাড়ার টাকা মালিকের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে হলো না। ওটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। পৌঁছলে পৌঁছবে, না পৌঁছলে নেই। আমার এক মাস থাকার কথা সেটা থাকতে পারলেই হলো। নিরিবিলি বাড়ি, আমার খুবই পছন্দ হলো। লেখালেখির জন্যে চমৎকার।
কেয়ারটেকারের নাম ইয়াকুব। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছে। রিপালসিভ ধরনের চেহারা, তবে গলার স্বরটা অতি মধুর। আমি একাই এ-বাড়িতে থাকব শুনে সে বিস্মিত গলায় বলল, স্যার কি সত্যি সত্যি একা থাকবেন?
হ্যাঁ।
বিষয়টা কী?
বিষয় কিছু না। পড়াশোনা করব। লেখালেখি করব।
আর খাওয়াদাওয়া? হোটেল এইখানে পাবেন কোথায়? সেই যদি শহরে যান। পাঁচ মাইলের ধাক্কা।
রান্না করে দেবে এমন কাউকে পাওয়া যায় না? টাকা-পয়সা দেব।
আপনি বললে আমি রাঁধব। খেতে পারবেন কি না সেটা হলো কথা।
পারব। খাওয়া নিয়ে আমার কোনো খুঁতখুঁতানি নেই।
আরেকটা জিনিস বলে রাখি স্যার। মুরগি ছাড়া কিন্তু কিছু পাওয়া যায় না। হাটবারে মাছটাছ পাওয়া যায়। হাটবারের দেরি আছে। আর চালটা স্যার একটু মোটা আছে। আপনার নিশ্চয়ই চিকন চাল খেয়ে অভ্যাস।
চিকন চাল খেয়ে অভ্যাস ঠিকই, মোটা চালে অসুবিধা হবে না। তবে ভাত যেন শক্ত না হয়। শক্ত ভাত খেতে পারি না।
দেখা গেল লোকটি রান্নায় দ্রৌপদী না হলেও তার কাছাকাছি। দুপুরে খুব ভালো খাওয়াল। রাতেও নতুন নতুন পদ করল। আমি বিস্মিত। রাতে খেতে খেতে বললাম, এত ভালো রান্না শিখলে কোথায়?