এইজাতীয় লোকদের সঙ্গে সহজে বন্ধুত্ব হয় না। আমি লক্ষ করেছি এরা সচরাচর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে থাকে। এই লোকও দেখা গেল সেইরকম। একদিন বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন, আপনি দেখি মাঝে-মাঝেই আমার কাছে আসেন। বিষয়টা কী বলেন তো?
বিষয় কিছু না।
বিষয় কিছু না বললে তো হবে না। এ পৃথিবীতে কার্যকারণ ছাড়া কিছুই হয় না।
আমি হাসিমুখে বললাম, ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, তাই বলে কিন্তু ভাই মোতালেব সাহেব, হাইজেনবার্গের আনসারটিনিটি প্রিন্সিপ্যাল আপনি ভুলে যাচ্ছেন। একটি বস্তুকে পুরোপুরি আপনি কিন্তু জানেন না। যখন অবস্থান
জানেন তখন সঠিক গতি কী তা জানেন না…।
আপনার সঙ্গে কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না— আপনি স্পষ্ট করে বলুন কীজন্যে আমার কাছে আসেন মদ্যপানের লোভে?
আমি ঝামেলা এড়াবার জন্যে বললাম, হ্যাঁ।
ভালো কথা। আমার পেছনে অনেকেই ঘোরে এবং তাদের উদ্দেশ্য একটাই–বিনা পয়সায় মদ্যপান। তৃষ্ণার্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি মদ্যপান করতে চায় তবে তা নিজের বাসায় নয় অন্যের বাসায় যাতে স্ত্রী জানতে না পারে। নিজের পয়সায় না, অন্যের পয়সায়, যাতে টাকা-পয়সা খরচ না হয়–অদ্ভুত মধ্যবিত্ত।
আমি বললাম, আপনি মনে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের ওপর খুব বিরক্ত।
অফকোর্স বিরক্ত। মধ্যবিত্ত হচ্ছে সমাজের একটা ফাজিল অংশ। আনকন ট্রোলড গ্রোথ। এই মধ্যবিত্তের প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা হয় কাজিনের সঙ্গে, প্রথম যৌনতার অভিজ্ঞতা হয় বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে। প্রথম মদ্যপানের অভিজ্ঞতা হয় অন্যের পয়সায়। এখন বলুন আপনাকে কী দেব? স্কচ ক্লাব আছে, জিন আছে, ভদকা আছে, কয়েক পদের হুইসকি আছে। আর আপনার যদি মিক্সড ড্রিংক পছন্দ হয় তা হলে তাও বানিয়ে দেব। You name it, I will make it—হা হা হা।
কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম— বিনা পয়সায় মদের লোভে না, আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার লোভেই আমি আসি।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমাকে কি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে হয়?
হ্যাঁ।
আমি এই নিয়ে তিনবার বিয়ে করেছি। কোনো স্ত্রী আমাকে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বলে মনে করেনি। প্রথমজন অনেক কষ্টে দুবছরের মতো টিকে ছিল, বাকি দুজন এক বছরও টেকেনি। হা হা হা।
না টেকায় আপনি মনে হচ্ছে খুশিই হয়েছেন।
হ্যাঁ হয়েছি। স্ত্রীরা স্বামীদের স্বাধীনতায় হাত দিতে পছন্দ করে। শুধু শুধু নানা বায়নাক্কা মদ খেতে পারবে না, রাত জেগে পড়তে পারবে না, জুয়া খেলতে পারবে না— আরে কী মুশকিল, আমার সব কথায় কথা বল কেন? আমি কি তোমার কোনো ব্যাপারে মাথা গলাই? আমি কি বলি— নীল শাড়ি পরতে পারবে না, লাল শাড়ি পরতে হবে। হাইহিল পরতে পারবে না, ফ্ল্যাট স্যাণ্ডেল পরবে। বলি কখনো? না, বলি না। আমি ওদেরকে ওদের মতো থাকতে বলি। আমি নিজে থাকতে চাই আমার মতো। ওরা তা দেবে না।
এই যে এখন একা একা বাস করছেন, আপনি কি মনে করেন আপনি সুখী?
হ্যাঁ সুখী, মাঝে মাঝে একটু দুঃখ-দুঃখ ভাব চলে আসে, তখন মদ্যপান করি। প্রচুর পরিমাণেই করি। পুরোপুরি মাতাল হতে চেষ্টা করি। পারি না। শরীর যখন আর অ্যালকোহল অ্যাকসেপ্ট করতে পারে না তখন বমি করে ফেলে দেয় কিন্তু মাতাল হতে দেয় না। কেন দেয় না তারও একটা কারণ আছে।
কী কারণ?
বলব, আরেকদিন বলব। এখন বলেন কী খাবেন? আজকের আবহাওয়াটা ব্লাডি মেরির জন্যে খুব আইডিয়াল। দেব একটা ব্লাডি মেরি বানিয়ে? জিনিসটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো। প্রচুর টমেটোর রস দেয়া হয়।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ভালোই খাতির হলো। মাসে দুএকবার তাঁর কাছে। যাই। বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে কথা হয়। যেমন ঈশ্বরের অস্তিত্ব, en esta অ্যান্টিম্যাটার, লাইফ আফটার ডেথ। ভদ্রলোকের নাস্তিকতা দেখার মতো, যা বলবেন— বলবেন। কোথাও সংশয়ের কিছু রাখবেন না। আমার মতো আরো অনেকেই আসে। তবে তাদের মূল আগ্রহ জলযাত্রায়।
একবার আমাদের আড্ডায় এক ভদ্রলোক একটি ব্যক্তিগত ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তার বক্তব্য ছিল এরকম–শ্রাবণ মাসে একবার তিনি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। বাড়ি স্টেশন থেকে অনেকখানি দূর। সন্ধ্যাবেলা ট্রেন এসে পৌঁছার কথা। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা বেজে গেল। গ্রামদেশে রাত নটা মানে নিশুতি রাত। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। স্টেশনে একটাও লোক নেই। একা একাই রওনা হলাম। কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ দেখি আমার আগে-আগে কে যেন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ কাউকে দেখিনি। এখন এই সাইকেলে করে কে যাচ্ছে? আমি বললাম–কে কে কে? কেউ জবাব দিল না। লোকটা একবার শুধু মুখ ফিরিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চিলাম। যে সাইকেলে বসে আছে তার নাম পরমেশ। আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। বছর তিনেক আগে নিউমোনিয়া হয়ে মারা যায়…
গল্পের এই পর্যায়ে মোতালেব সাহেব বাজখাই গলায় বললেন— স্টপ। আপনি বলতে চাচ্ছেন— আপনার এক মৃত বন্ধু সাইকেল চালিয়ে আপনার পাশে পাশে যাচ্ছিল?
হ্যাঁ।
মনে হচ্ছে আপনাকে সাহস দেবার জন্যেই সে আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিল।
হতে পারে।
মোতালেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তর্কের খাতিরে স্বীকার করে নিলাম যে, আপনার বন্ধু মরে ভূত হয়েছেন। আপনাকে সাহস দেবার জন্যে আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন। এখন সমস্যা হলো— সাইকেল। একটা সাইকেল মরে সাইকেল-ভূত হবে না, যদি না হয় তা হলে আপনার ভূত-বন্ধু সাইকেল পেল কোথায়?