জমির সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন, চিঠি রাখব না। তিনি তা বলতে পারলেন না।
যন্ত্রের মতো পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করলেন। চিঠি পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন, কাউকে কিছু বললেন না। তাঁর বমি-বমি ভাব হলো। মাথা ঘুরতে লাগল।
রাতে তিনি কিছু খেলেন না। ইরাদের আসা উপলক্ষে ভালোমন্দ রান্না হয়েছিল, তিনি কিছুই মুখে দিলেন না। ইরা বলল, বাবা তোমার কী হয়েছে?
তিনি ক্ষীণস্বরে বললেন, কিছু হয়নি। শরীরটা ভালো না।
রোজই তুমি বল শরীর ভালো না, অথচ একজন ভালো ডাক্তার দেখাও না। একজন ভালো ডাক্তার দেখাও বাবা।
দেখাব।
আর মাকেও একজন ভালো ডাক্তার দেখাও।
আচ্ছা।
আচ্ছা না বাবা। দেখাও।
মেয়ে-জামাই রাত নটার দিকে চলে গেল। ফরহাদ গেল না। সে নানার সঙ্গে থাকবে।
সারারাত জমির সাহেবের ঘুম হলো না। পরদিন হুহু করে গায়ে জ্বর এসে গেল। জুরের মূল কারণ কাউকে বলতে পারলেন না। বেলা যতই বাড়তে লাগল জুর ততই বাড়তে লাগল। দুপুরের পর ঘাম হতে লাগল। ইরা হতভম্ব হয়ে বলল, বাবা চলো তোমাকে ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করি। আমার কিছু ভালো লাগছে না। তুমি এরকম ঘামছ কেন? হার্টের কোনো সমস্যা না তো?
জমির সাহেব ক্ষীণস্বরে বললেন, চিঠি পেয়েছি।
চিঠি পেয়েছি মানে? কার চিঠি?
বেয়ারিং চিঠি।
ইরা দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, কী লেখা এবারের চিঠিতে?
চিঠি পড়িনি।
পড়ে দ্যাখো। না পড়েই এরকম করছ কেন? হয়তো এবার কোনো ভালো খবর আছে।
জমির সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, ভয় লাগছে রে ইরা!
ইরা চিঠি খুলে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল। অন্যদের সেই চিঠি দেখাল। যারা দেখল প্রত্যেকেই গম্ভীর হলো, কারণ চিঠিতে কিছু লেখা নেই। সাদা একটা পাতা, শেষে নাম সই করা বিনীত, তোমার সুস্মিতা। এই সাদা একটা পাতা, শেষে নাম সই করা—বিনীত, তোমার সুস্মিতা। এই সাদা না-লেখা অংশে কী বলতে চাচ্ছে সুস্মিতা? কে সে? কেনইবা সে চিঠি লেখে? আবার আজ কেনইবা লিখল না?
শবযাত্রা
পুরোপুরি নাস্তিক মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে খুবই কম। ঘোর নাস্তিক যে-মানুষ তাকেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খুব দুর্বল দেখা যায়। আমি একজন ঘোর নাস্তিককে চিনতাম, তার ঠোটে একবার একটা গ্রোথের মতো হলো। ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন ক্যানসার। সঙ্গে সঙ্গে সেই নাস্তিক পুরোপুরি আস্তিক হয়ে গেলেন। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্যে মসজিদে যান। মালিবাগের পীর সাহেবের মুরিদও হলেন।
বায়েপসির পর ধরা পড়ল যে গ্রোথের ধরন খারাপ নয়। লোকালাইজড গ্রোথ। ভয়ের কিছু নেই। অপারেশন করে ফেলে দিলেই হবে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আবার নাস্তিক হয়ে পড়লেন। ভয়াবহ ধরনের নাস্তিক। অঙ্ক করে প্রমাণ করে দিলেন যে ঈশ্বর = ০^২ এবং আত্মা = ০^১/৫ ।
যাই হোক, মানুষের চরিত্রের এই দ্বৈত ভাব আমাকে বিস্মিত করে না। প্রচণ্ডরকম ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের মধ্যেও আমি অবিশ্বাসের বীজ দেখেছি। আমার কাছে এটাই স্বাভাবিক মনে হয়। এর বাইরে কিছু দেখা মানে অস্বাভাবিক কিছু দেখা।
আমি এরকম একজন অস্বাভাবিক চরিত্রের কথা এই গল্পে বলব। চরিত্রের নাম মোতালেব (কাল্পনিক নাম)। বয়স পঞ্চাশ থেকে পাঁচপঞ্চাশ। ভীষণ রোগী এবং প্রায় তালগাছের মতো লম্বা একজন মানুষ। চেইন স্মােকার। মাথায় কিছু অসুবিধা আছে বলেও মনে হয়। নিতান্ত অপরিচিত লোককেও এই ভদ্রলোক শীতল গলায় বলে ফেলতে পারেন— ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি একজন মহামুর্খ।
মোতালেব সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় এক বিয়েবাড়িতে। সেদিন ঐ বিয়েবাড়িতে কী-একটা সমস্যা হয়েছে কাজি পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা এইজাতীয় কিছু।
বরপক্ষীয় এবং কনেপক্ষীয় লোকজন বিমর্ষ মুখে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে গল্প করছে। আমি একটা দলের সঙ্গে জুটে গেলাম। সেখানে জনৈক অধ্যাপক বিগ ব্যাং এবং এক্সপানডিং ইউনিভার্স সম্পর্কে কথা বলছেন। শ্রোতারা চোখ বড় বড় করে শুনছে। ভদ্রলোক ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন, তখন একটা নাটকীয় ব্যাপার ঘটল। রোগা এবং লম্বা একজন শুকনো মানুষ বললেন, ভাই কিছু মনে করবেন না, আপনি একজন মহামুর্খ।
অধ্যাপক ভদ্রলোক নিজেকে সামলাতে কিছু সময় নিলেন। পুরোপুরি সামলাতে পারলেন না— কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কী আমাকে মহামূর্খ বললেন?
জী।
কেন বললেন জানতে পারি?
অবশ্যই জানতে পারেন। আপনি আপনার বক্তৃতা শুরুই করেছেন ভুল তথ্য দিয়ে বলছেন ব্যাকগ্রাউণ্ড রেডিয়েশন ধরা পড়েছে ইনফ্রারেডে। তা পড়েনি। ধরা পড়েছে মাইক্রোওয়েভে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির একটি স্বীকার্যই হচ্ছে স্পেস এবং টাইমের জন্ম বিগ ব্যাং সিংগুলারিটিতে। আপনি বললেন ভিন্ন কথা। কোনোকিছুই না জেনে
একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে কী সব উলটাপালটা কথা বলছেন।
অধ্যাপক ভদ্রলোক রাগে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আমি তো ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিচ্ছি না— একটু এদিক-ওদিক হতেই পারে।
বিজ্ঞান ঠাকুরমার ঝুলি না যে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বলবেন।
ভদ্রলোক সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে অন্যদিকে সরে গেলেন। আমি গেলাম তার পেছনে পেছনে। মজার চরিত্র। কথা বলা দরকার।
যতটুকু মজার চরিত্র ভেবে ভদ্রলোকের কাছে গেলাম দেখা গেল চরিত্র তারচেয়েও মজার। ভদ্রলোকের বিষয় পদার্থবিদ্যা নয়— সাইকোলজি। পদার্থবিদ্যা হচ্ছে তাঁর শখ। এই শখ মেটানোর জন্যে রীতিমতো শিক্ষক রেখে অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা শিখেছেন।