জমির সাহেব রাস্তায় ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান হলো হাসপাতালে। তার বাম পা হাটুর নিচে ভেঙেছে। এক জায়গায় না–দুজায়গায়। মিতু এবং শাহানা মাথার কাছে বসে আছে। দুজনই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ডাক্তার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কাঁদছেন কেন? বললাম তো তেমন সিরিয়াস কিছু হয়নি। দিন পনেরোর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় যাবে। দুটা ফ্রাকচার হয়েছে তবে সিরিয়াস কিছু না।
ডাক্তারের কথামতো পনেরো দিনের মাথাতেই জমির সাহেব বাড়ি ফিরলেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নয়। বাঁ পা অচল হয়ে গেল। এদেশে নাকি কিছু করা সম্ভব না, বিদেশে যদি কিছু হয়। চাকরি শেষ হবার আগেই জমির সাহেব রিটায়ার করলেন। তিনি এবং তার পরিবারের কেউ ঐ হলুদ চিঠির কথা একবারও তুলল না। যেন ঐ চিঠি একটা অভিশপ্ত চিঠি। তার কথা তোলা উচিত না। চিঠিটা জমির সাহেবের শোবার ঘরের টেবিলের তিন নম্বর ড্রয়ারে পড়ে রইল। মাঝে মাঝে জমির সাহেব চিঠিটা বের করে পড়েন এবং তাঁর অচল পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেই রাতে তাঁর একফোঁটা ঘুম হয় না। কেমন ভয়-ভয় লাগতে থাকে।
নতুন বছরের গোড়াতে ঝিকাতলার বাসা উঠিয়ে উত্তর শাহজাহানপুরে সস্তায় একটা ফ্ল্যাটে তারা চলে গেলেন। রোজগার কমেছে, এখন টাকাপয়সা সাবধানে খরচ করতে হবে। নতুন ফ্ল্যাটে দুটা মাত্র শোবার ঘর। একটিতে জমির সাহেব শাহানাকে নিয়ে থাকেন, অন্যটিতে মিতু আর তার ছোট বোন ইরা থাকে। জমির সাহেবের বড় ছেলে থাকে বসার ঘরে। একটা খাট ঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। এই বাড়িতে মাস তিনেক কাটানোর পর আরেকটি বেয়ারিং চিঠি এল। আগের মতো গোটাগোটা হরফে লেখা। মোটা কলমের নিব দিয়ে মেয়েলি অক্ষরে সুস্মিতা লিখেছে—
প্রিয়তমেষু,
তুমি কেমন আছ? এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখলে আমার ভালো লাগে না। সংসারে দুঃখ কষ্ট সমস্যা থাকেই। এতে বিচলিত হলে চলে? মনে সাহস রাখো। আচ্ছা একটা কথা, তোমার বড় ছেলেটাকে কিছুদিন ঢাকা শহরের বাইরে রাখতে পার না? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলায় পড়ে যাবে। তোমাদের গ্রামের বাড়িতে ওকে কিছুদিনের জন্যে পাঠিয়ে দাও না। ও যেতে চাইবে না। বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করাও।
বিনীতা
তোমার সুস্মিতা
এবার আর সুস্মিতার চিঠি নিয়ে কেউ হাসাহাসি করল না। চিঠি পড়ার সময় শাহানার হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। জমির সাহেব অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেলেন। বড় ছেলে সুমনকে গ্রামের বাড়িতে পাঠানোর প্রশ্নই ওঠে না। কারণ তার বি.এ. ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে। দুটা পেপার হয়ে গেছে। তবু শাহানা বললেন, থাক, পরীক্ষা দিতে হবে না। ওকে পাঠিয়ে দাও।
জমির সাহেব বললেন, দরকার আছে বলে তো মনে হয় না। চিঠি পাওয়ার পরেও তো পনেরো দিন হয়ে গেল।
হোক পনেরো দিন, পাঠিয়ে দাও। আমার ভালো লাগছে না।
আচ্ছা বলে দ্যাখো। যদি যেতে রাজি হয় তাহলে যাক।
সুমন যেতে রাজি হলো। শুধু যে রাজি হলো তা-ই না, তৎক্ষণাৎ যেতে রাজি। টাকা দিলে আজ রাতের ট্রেনেই রওনা হয়ে যায় এমন অবস্থা। ঠিক হলো সে সোমবার সকালের ট্রেনে যাবে। জমির সাহেবও সঙ্গে যাবেন। পৈতৃক বাড়ি ঠিকঠাক করবেন, জমিজমার খোঁজখবর করবেন। সম্ভব হলে কিছু জমি বিক্রি করে আসবেন। টাকা-পয়সার খুব টানাটানি যাচ্ছে।
তাদের যাবার কথা সোমবার। তার আগের দিন অর্থাৎ রোববার ভোররাতে পুলিশ এসে জমির সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করে সুমনকে ধরে নিয়ে গেল। হতভম্ব জমির সাহেবকে পুলিশ সাবইন্সপেক্টর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন–আপনার ছেলের বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ আছে। সাত দিন আগে চারজনে মিলে খুনটা করেছে। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। আপনার ছেলে এই চারজনের একজন। আপনি বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেলেকে রাজসাক্ষী হতে রাজি করান। এতে আপনারও লাভ, আমাদেরও লাভ। না হলে কিন্তু ফাঁসিটাসি হয়ে যাবে। পলিটিক্যাল প্রেশারও আছে।
সুমন রাজসাক্ষী হতে রাজি হলো না। দীর্ঘদিন মামলা চলল। রায় বেরুতে লাগল দুবছর। তিনজনের সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, একজনের ফাঁসি। সেই একজন সুমন। অন্য তিনজন ছেলেটাকে ধরে রেখেছিল। খুন করেছে সুমন। ধারালো ক্ষুর দিয়ে রগ কেটে দিয়েছে।
পাঁচ বছর কেটে গেছে। পরবর্তী বেয়ারিং চিঠিটা এল পাঁচ বছর কাটার পর। এই পাঁচ বছরে জমির সাহেবের সংসারে বড়রকমের ওলটপালট হয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মিতুর বিয়ে হয়েছে কৃষিখামারের এক ম্যানেজারের সঙ্গে। সে স্বামীর সঙ্গে গোপালপুর থাকে। ছোট মেয়ে ইরার বিয়ে হয়েছে ওষুধ কোম্পানির এক কেমিস্টের সঙ্গে। তারা ঢাকা শহরেই থাকে। প্রায়ই বাবা-মাকে দেখতে আসে। বড় মেয়ের কোনো ছেলেপুলে হয়নি। ছোট মেয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম ফরহাদ। এই ছেলেটি জমির সাহেবের খুব ভক্ত। তাঁর কাছে এলেই কোলে উঠে বসে থাকে, কিছুতেই কোল থেকে নামানো যায় না।
পাঁচ বছর পর একদিন পিওন এসে বলল, স্যার আপনার একটা বেয়ারিং চিঠি আছে, রাখবেন? জমির সাহেব শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
সেদিন ইরারা বেড়াতে এসেছে। জমির সাহেবের কোলে ফরহাদ। তিনি ফরহাদকে মাটিতে নামিয়ে চিঠি হাতে নিলেন। হাতের লেখা চিনতে তার অসুবিধা হলো না। সেই হাতের লেখা। সেই ন্যাপথালিনের গন্ধ!
পিওন বলল, চার টাকা লাগবে।