.
দুই
দ্বিতীয় পক্ষের তরুণী ভার্যার দেহ রক্ষার জন্য শিবচরণ কেবলমাত্র নিজের দেহ ভিন্ন আর সমস্তই দিতে পারিত। হরিলক্ষ্মীর সেই দেহ বেলপুরে সারিতে চাহিল না। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন হাওয়া বদলাইবার। শিবচরণ সাড়ে-পনর আনার মর্যাদামত ঘটা করিয়া হাওয়া বদলানোর আয়োজন করিল। যাত্রার শুভদিনে গ্রামের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল, আসিল না কেবল বিপিন ও তাহার স্ত্রী। বাহিরে শিবচরণ যাহা না বলিবার, তাহা বলিতে লাগিল এবং ভিতরে বড়পিসী উদ্দাম হইয়া উঠিলেন। বাহিরেও ধুয়া ধরিবার লোকাভাব ঘটিল না, অন্তঃপুরেও তেমনই পিসীমার চীৎকারের আয়তন বাড়াইতে যথেষ্ট স্ত্রীলোক জুটিল। কিছুই বলিল না শুধু হরিলক্ষ্মী। মেজবৌয়ের প্রতি তাহার ক্ষোভ ও অভিমানের মাত্রা কাহারও অপেক্ষাই কম ছিল না, সে মনে মনে বলিতে লাগিল, তাহার বর্বর স্বামী যত অন্যায়ই করিয়া থাক, সে নিজে ত কিছু করে নাই, কিন্তু ঘরের ও বাহিরের যে-সব মেয়েরা আজ চেঁচাইতেছিল, তাহাদের সহিত কোন সূত্রেই কণ্ঠ মিলাইতে তাহার ঘৃণা বোধ হইল। যাইবার পথে পালকির দরজা ফাঁক করিয়া লক্ষ্মী উৎসুক চক্ষুতে বিপিনের জীর্ণ গৃহের জানালার প্রতি চাহিয়া রহিল, কিন্তু কাহারও ছায়াটুকুও তাহার চোখে পড়িল না।
কাশীতে বাড়ি ঠিক করা হইয়াছিল, তথাকার জলবাতাসের গুণে নষ্ট-স্বাস্থ্য ফিরিয়া পাইতে লক্ষ্মীর বিলম্ব হইল না, মাস-চারেক পরে যখন সে ফিরিয়া আসিল, তাহার দেহের কান্তি দেখিয়া মেয়েদের গোপন ঈর্ষার অবধি রহিল না।
হিম-ঋতু আগতপ্রায়, দুপুরবেলায় মেজবৌ চিররুগ্ন স্বামীর জন্য একটা পশমের গলাবন্ধ বুনিতেছিল, অনতিদূরে বসিয়া ছেলে খেলা করিতেছিল, সে-ই দেখিতে পাইয়া কলরব করিয়া উঠিল, মা, জ্যাঠাইমা।
মা হাতের কাজ ফেলিয়া তাড়াতাড়ি একটা নমস্কার করিয়া লইয়া আসন পাতিয়া দিল; স্মিতমুখে প্রশ্ন করিল, শরীর নিরাময় হয়েছে দিদি ?
লক্ষ্মী কহিল, হাঁ, হয়েছে। কিন্তু না হতেও পারত, না ফিরতেও পারতাম, অথচ যাবার সময়ে একটিবার খোঁজও নিলে না। সমস্ত পথটা তোমার জানলার পানে চেয়ে চেয়ে গেলাম, একবার ছায়াটুকুও চোখে পড়ল না। রোগা বোন চলে যাচ্ছে, একটুখানি মায়াও কি হ’ল না মেজবৌ? এমনি পাষাণ তুমি !
মেজবৌয়ের চোখ ছলছল করিয়া আসিল, কিন্তু সে কোন উত্তরই দিল না।
লক্ষ্মী বলিল, আমার আর যা দোষই থাক মেজবৌ, তোমার মত কঠিন প্রাণ আমার নয়। ভগবান না করুন, কিন্তু অমন সময়ে আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারতাম না।
মেজবৌ এ অভিযোগের কোন জবাব দিল না, নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল।
লক্ষ্মী আর কখনও আসে নাই, আজ এই প্রথম এ বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছে। ঘরগুলি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিয়া বেড়াইতে লাগিল। শতবর্ষের জরাজীর্ণ গৃহ, মাত্র তিনখানি কক্ষ কোনমতে বাসোপযোগী রহিয়াছে। দরিদ্রের আবাস, আসবাবপত্র নাই বলিলেই চলে, ঘরের চুন-বালি খসিয়াছে, সংস্কার করিবার সামর্থ্য নাই, তথাপি অনাবশ্যক অপরিচ্ছন্নতা এতটুকু কোথাও নাই। স্বল্প বিছানা ঝরঝর করিতেছে, দুই-চারিখানি দেবদেবীর ছবি টাঙ্গানো আছে, আর আছে মেজবৌয়ের হাতের নানাবিধ শিল্পকর্ম। অধিকাংশই পশম ও সূতার কাজ, তাহা শিক্ষানবীশের হাতের লাল ঠোঁটওয়ালা সবুজ রঙের টিয়াপাখী অথবা পাঁচরঙা বেড়ালের মূর্তি নয়। মূল্যবান ফ্রেমে আঁটা লাল-নীল বেগুনি-ধূসর-পাঁশুটে নানা বিচিত্র রঙের সমাবেশে পশমে বোনা ‘ওয়েলকম’ ‘আসুন বসুন’ অথবা বানান-ভুল গীতার শ্লোকার্ধও নয়। লক্ষ্মী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল, ওটি কার ছবি মেজবৌ, যেন চেনা চেনা ঠেকচে ?
মেজবৌ সলজ্জে হাসিয়া কহিল, ওটি তিলক মহারাজের ছবি দেখে বোনবার চেষ্টা করেছিলাম দিদি, কিন্তু কিছুই হয়নি। এই কথা বলিয়া সম্মুখের দেয়ালে টাঙ্গানো ভারতের কৌস্তুভ মহাবীর তিলকের ছবি আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল।
লক্ষ্মী বহুক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, চিনতে পারিনি, সে আমারই দোষ মেজবৌ, তোমার নয়। আমাকে শেখাবে ভাই ? এ বিদ্যে শিখতে যদি পারি ত তোমাকে গুরু বলে মানতে আমার আপত্তি নেই।
মেজবৌ হাসিতে লাগিল।
সেদিন ঘণ্টা তিন-চার পরে বিকালে যখন লক্ষ্মী বাড়ি ফিরিয়া গেল, তখন এই কথাই স্থির করিয়া গেল যে, কলা-শিল্প শিখিতে কাল হইতে সে প্রত্যহ আসিবে।
আসিতেও লাগিল, কিন্তু দশ-পনেরো দিনেই স্পষ্ট বুঝিতে পারিল, এ বিদ্যা শুধু কঠিন নয়, অর্জন করিতেও সুদীর্ঘ সময় লাগিবে।
একদিন লক্ষ্মী কহিল, কৈ মেজবৌ, তুমি আমাকে যত্ন করে শেখাও না।
মেজবৌ বলিল, ঢের সময় লাগবে দিদি, তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি অন্য সব বোনা শিখুন।
লক্ষ্মী মনে মনে রাগ করিল, কিন্তু তাহা গোপন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার শিখতে কতদিন লেগেছিল মেজবৌ ?
মেজবৌ জবাব দিল, আমাকে কেউ ত শেখায় নি দিদি, নিজের চেষ্টাতেই একটু একটু করে—
লক্ষ্মী বলিল, তাইতেই। নইলে পরের কাছে শিখতে গেলে তোমারও সময়ের হিসাব থাকত।
মুখে সে যাহাই বলুক, মনে মনে নিঃসন্দেহে অনুভব করিতেছিল, মেধা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধিতে এই মেজবৌয়ের কাছে সে দাঁড়াইতেই পারে না। আজ তাহার শিক্ষার কাজ অগ্রসর হইল না এবং যথাসময়ের অনেক পূর্বেই সূচ-সূতা-প্যাটার্ন গুটাইয়া লইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। পরদিন আসিল না এবং এই প্রথম প্রত্যহ আসায় তাহার ব্যাঘাত হইল।