Site icon BnBoi.Com

মুসাফির – সৈয়দ মুজতবা আলী

মুসাফির – সৈয়দ মুজতবা আলী

কৈফিয়ত

এ পুস্তকের একটি ক্ষুদ্র মুখবন্ধের প্রয়োজন আছে।

একাধিক খ্যাতনামা ভূপর্যটক পরিণত বয়সে নাকেখৎ দিয়ে অসঙ্কোচে স্বীকার করেছেন, উঠান-সমুদ্র পেরিয়ে বাড়ির বাইরে বেরুনোটাই মূখামির চুড়ান্ত নিদর্শন। খ্যাতনামা লেখক না হয়েও আমি এ সব প্রাতঃস্মরণীয়দের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলছেন কি, ভ্রমণকাহিনী লিখে সে মূখামির চূড়ান্ত পরিচয়টি তারা দিতে গেলেন কেন?

১৯২৭ থেকে আপনাদের বশংবদ এ-লেখক ঘরছাড়া। মাঝে-মধ্যে দু চার বছরের জন্য হেথা হোথা সে আশ্রয় পেয়েছিল বটে কিন্তু গৃহনির্মাণ করার সুযোগ সে কখনও পায়নি। ফের পথে নামতে হয়েছে। সে নিয়ে ফরিয়াদ করিনে। একদা নাবিকজনের অধিকাংশই সমুদ্রে মারা যেত। তাদের যেসব ভীতু ছেলে-ভাইপো সমুদ্রযাত্রা করত না, তারা মরত বাড়িতে। ফল তো একই। আমার বেলা আরও একটা ভয় আছে। উঠান-সমুদ্র পেরিয়ে অপকর্ম করেছি সে পাপ তো এইমাত্র স্বীকার করলুম, কিন্তু বাড়ি থেকে না বেরুলে যে আরও মেলা জব্বর জব্বর ব্রহ্মহত্যা করতুম না সে ভরসা দেবেন কোন গোসাই? অর্বাচীন জনই মন্তব্য করে, হিটলার যদি অমুক ভুলটা না করতেন তবে তিনি আখেরে বিজয়ী হতেন– ওই ভুলটা না করলে তিনি যে পরে গণ্ডা দশেক ততোধিক মহামারাত্মক ভুল করতেন না সে আশ্বাস দেবেন কোন বিধানরাজ!

তবে এ সত্য আমি বার বার বলব, আমি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছি অতিশয় অনিচ্ছায়– গত্যন্তর ছিল না বলে। প্রতি আশ্রয় লাভের পর ফের যে বেরিয়েছি সেটা আরও বেশি অনিচ্ছায়– নিতান্ত বাধ্য হয়ে।

এবং শেষ মোক্ষম পাপাচার স্বীকার করছি, যে পাপ কৃতী পর্যটককে আদৌ স্বীকার করতে হয়নি, কারণ তারা আপন আপন সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করে পুনরায় অপাপবিদ্ধ হতে পেরেছিলেন, আমার তরে সে দুয়ার বন্ধ। আমার মোক্ষমতার গুরুপাপ– আমি ভ্রমণকাহিনী (তথা অন্যান্য সর্ববিধ রচনা) লিখেছি সর্বাধিক অনিচ্ছায়।

অসহিষ্ণু পাঠক শুধোবেন, আমরা ক্যাথলিক পাদ্রি নাকি যে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ তুমি আপন পাপ কনফেস্ করতে আরম্ভ করলে? না, আপনারা অতি অবশ্যই পাদ্রি নন। কারণ শুধু পাদ্রি কেন, সব সম্প্রদায়ের আচার্যগণকেই ধর্মাদর্শ অক্ষত রাখবার জন্য প্রায়ই কঠোর কঠিন হতে হয়। পক্ষান্তরে, যেসব পাঠক এতদিন ধরে আমার রচনা বরদাস্ত করে এসেছেন তারা অকরুণ হবেন কী প্রকারে? আর আমি মোল্লা-পুরুত পাবই-বা কোথায়? এবং অতিশয় শ্লাঘাভরে উচ্চকণ্ঠে স্বীকার করছি আমার পাঠকই আমার মোল্লা, আমার পুরুৎ। একমাত্র তার কাছেই আমার সর্ব অক্ষমতার ভার নামানো যায়।

পূর্বেই নিবেদন করেছি, ১৯২৭-এ আমি গৃহহারা হই। প্রথম দু বৎসরের কাহিনী আমি সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় কীর্তন করিনি। সে ইচ্ছাটার পিছনে যে ছিল সে বহুকাল হল জিন্নবাসিনী। সে করুণ কাহিনী থাক।

তার পরের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বৎসরের প্রতিবেদন আমারই মতো ছন্নছাড়া; দেশকালপাত্র মেনে নিয়ে সেটা মিষ্ট এবং সংরক্ষিত হয়নি কারণ, চিরাচরিত আপ্তবাক্য আছে যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট–কাজেই সংক্ষিপ্ত না হয়ে সে হয়েছে ক্ষিপ্ত।

সে সম্বন্ধে অল্পবিস্তর সবিস্তর আলোচনা করেছি। এ পুস্তকের ত্রেতাপর্বে যারা আমার নতিস্বীকার, অর্ধসিদ্ধ কনফেশন সম্বন্ধে উদাসীন তারা সে যুগটি অবহেলাভরে বর্জন করলে ধূলিপরিমাণও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আর যারা ক্ষিপ্তের তাণ্ডবে কোনও সঙ্গতি আছে কি না (মেথড় ইন্ ম্যাডনেস) সেটা নিজের মুখে ঝাল খেয়ে রগড় দেখতে চান, কিংবা যারা অসংলগ্ন খণ্ড প্রতিবেদন সমষ্টিকে শ্রেণিবদ্ধ করার বন্ধ্যাগমনসুলভ নিষ্ফল প্রয়াস লক্ষ করে তথাকথিত রূঢ় কণ্ঠে, ন্যায়সঙ্গত কটুবাক্য শুনিয়ে পত্রাঘাত করেছেন, অপরঞ্চ যারা বার্লিনি দ্বিরদরদস্তম্ভোপরি সিংহাসন থেকে কিংবা যারা নেটিভ বিদ্যালয়ের গো-অন্বেষণ কর্মে লিপ্তাবস্থায় গলদঘর্ম কলেবরে অশেষ ক্লেশস্বীকার করে আমা হেন দীনহীনজনোপরি মহামূল্যবান উপদেশ অকৃপণভাবে বর্ষণ করেছেন, তারা এ পুস্তকের দ্বিতীয় উল্লাসে আমার অকৃপণতর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভূরিভূরি স্বর্ণোজ্জ্বল নিদর্শন পাবেন।

ভগবৎকৃপায় অব্যবহিত প্রত্যাদেশ লাভ করেছি, আমার ভবলীলা সংহরণ প্রত্যাসন্ন। ঈদৃশ মুখবন্ধের প্রতি রুদ্রের দক্ষিণ মুখ পুনর্বার প্রসন্ন হবেন সে আশা দুরাশা।

কলকাতা, ২০ নভেম্বর,
১৯৭১ নিরানন্দ ঈদ (আনন্দ) দিবস, ১৩৭৮

—কিমধিকমিতি
সৈয়দ মুজতবা আলী

.

.

প্লেন যখন ইংলিশ চ্যানেলের উপর দিয়ে যাচ্ছে তখন ছোকরা মুখুজ্যে শুধালে, চাচা, লন্ডনে গিয়ে উঠব কোথায়, চিন্তা করেছেন কি? ছোকরা এই প্রথম বিলেতে যাচ্ছে, প্রশ্নটা অতিশয় স্বাভাবিক। আমি বললুম, বাবাজি, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না। রসুই বামুন না হলেও তুমি তো ব্রাহ্মণসন্তান বটে। হাটে গিয়ে চাল-ডাল কিনে নিয়ে আসবে; আমি ততক্ষণে বটগাছতলায় হঁটের উনুন জ্বালিয়ে রাখব। শুনেছি লন্ডনের উপর বিস্তর বোমা পড়েছিল, ইঁট পেতে অসুবিধে হবে না।

এ্যারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরও যখন বটগাছ পাওয়া গেল না, তখন বাধ্য হয়ে হোটেলে উঠতে হল।

রসিকতা নয়, একটুখানি সবুর করুন।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায়ই মুখুজ্যের বয়সীই তার এক ইংরেজ বন্ধু এসে উপস্থিত। ছোকরা খাঁটি ইংরেজ, লড়াইয়ের সময় ভারতবর্ষে এসেছিল, এ দেশটাকে এতই ভালোবেসে ফেললে যে শেষ পর্যন্ত দিশি মেম নিয়ে বিলেতে গেল। বললে, এদেশের লোক ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এমনি অগা যে, সেদিন এক গবেট বিবিসিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললে, ভারতবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ লোক বাইরে শোয়। আমি ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বিবিসিতে কড়া চিঠি লিখেছি।

আমি বললুম, এতে চটবার কী আছে? কথাটা তো সত্যি। গরমের দেশের লোক ১১৪ ডিগ্রিতে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে ঘরের ভেতর শোবে নাকি? তোমাদের দেশের লোক মাইনাস দশ ডিগ্রিতে যদি বাইরে শোয় তবে মরে যাবে। আমাদের দেশের লোক গরমে ঘরের ভিতর দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে না বটে, কিন্তু সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হবে। হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।

এই কোল্ড কিলস নিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্য সভ্যতার পার্থক্য, বটগাছতলা আর হোটেলের পার্থক্য।

গরমের দেশে জীবন ধারণের জন্য অত্যধিক সাজ-সরঞ্জাম আসবাবপত্রের প্রয়োজন হয় না; পক্ষান্তরে শীতের দেশে পাকাঁপোক্ত ঘরবাড়ি চাই, মেঝেতে শোয়া যায় না; লেপ-কম্বল গদি-বালিশ চাই। শীতের ছ মাস শাক-সবজি ফলমূল কিছুই ফলে না, ছ মাসের তরে মাংসের শুঁটকি জমিয়ে রাখতে হয়; আমরা দিন আনি দিন খাই, ছ মাসের খাবার-দাবার জমিয়ে রাখার কথা শুনলে নাভিশ্বাস ওঠে। ছ মাসের খাবার কিনতে গেলে বেশকিছু রেস্তোর প্রয়োজন।

তাই বোধহয় ইয়োরোপীয়রা একদিন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ডাকাতি করতে প্রাচ্য দেশে এসেছিল। আজ ডেনমার্ক, জর্মনি, নরওয়ে, সুইডেনের খাবার-দাবার ব্যবসা-বাণিজ্য করেই চলে। ডাকাতিতে জিতেছিল ইংরেজ। আজ সে সব লুণ্ঠনভূমি কজা থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে। চার্চিল ব্রিটিশ রাজত্বের লিকুইডেটর হতে চাননি; আজকের শাসনকর্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হতে হচ্ছে। ওদিকে খাওয়া-দাওয়া থাকা-পরার মান অনেকখানি উঁচু হয়ে গিয়েছে সেটাকে বজায় রাখা যায় কী প্রকারে? আজ না হয় রইল, ভবিষ্যতে হবে কী? সেকুরিটি কোথায়?

এই সেকুরিটি নিয়েই যত শিরঃপীড়া।

সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প। তবে সমঝদারদের মুখে শুনেছি, সেখানেও নাকি গুণীজ্ঞানীরা প্রাণপণ সেকুরিটি খুঁজছেন। ধর্মে বিশ্বাস নেই, আদর্শবাদ গেছে, চরমমূল্য পরমসম্পদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে গভীর সন্দেহ–সেই প্রাচীন ওয়েস্টল্যান্ড নাকি আরও বিস্তীর্ণ হয়ে সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।

তবে কি কার্ল মার্কসের নীতিই ঠিক? দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অভাব-অনটন উপস্থিত হলে সাহিত্যে সেটা প্রতিবিম্বিত হবেই হবে?

তা সে যা হোক, কিন্তু এই সেকুরিটির ব্যাপার আরেক সূত্রে উঠল।

বিদ্যাসাগরকে যে ইংরেজ মহিলা স্ত্রী-শিক্ষার প্রচার-প্রসারে প্রচুর সাহায্য করেন, তাঁরই এক নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হল লন্ডনে। নাম কার্পেন্টার। ইনি জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে। আমি তাঁকে যখন একবার কলকাতাতে শুধাই তিনি কি মিস কার্পেন্টারের কোনও আত্মীয় হন, তখন উত্তরে তিনি বলেন, আমার ঠাকুরদার বোন। তার পর হেসে বলেছিলেন, আমি কিন্তু তাঁর মতো টাকা ছড়াতে আসিনি; তারই কিছুটা কুড়িয়ে নিতে এসেছি।

তিনি নিমন্ত্রণ করে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় মূর পদ্ধতিতে তৈরি বিরিয়ানি (সে কথা পরে হবে) খাওয়াচ্ছিলেন। কথায় কথায় তাকে শুধালাম, এই যে সাদায়-কালোয় দ্বন্দ্ব লেগেছে এদেশে, তার মূল কারণ কী?

তিনি এক কথায় বললেন, গার্লস।

আমি অন্যত্র শুনেছিলুম চিপ লেবার অর্থাৎ কালারা কম মজুরিতে কাজ করতে তৈরি। ম্যানেজাররা তাই তাদের চায়। ইংরেজ মজুর তাই চটে গেছে।

তা হলে গার্লস এল কোত্থেকে?

আসলে দুটোই এক জিনিস।

নিগ্রোদের কথা বলতে পারব না– সিলেট-নোয়াখালির খালাসিদের কথা জানি। তাদের অনেকেই লন্ডনে এসে অন্য খালাসিদের জন্য রাইস-কারির দোকান খোলে। বাঙালি ছাত্রেরাও সেখানে মাঝে মাঝে গোয়ালন্দ চাঁদপুরি জাহাজের রাইস-কারি খাবার জন্য যায়।

গিয়ে দেখবেন মিশকালো খালাসির ইংরেজ বউ! দু জনাই খদ্দেরকে খাবার দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সেই সিলেটি আছমৎ উল্লা বউকে ডেকে খাস সিলটিতে বলছে, ওগো ডুরা (ডোরা), সাবরে আরক কট্টা মুরগির সালন দে (সায়েবকে আরেক কটোরা-বাটি মুরগির ঝোল দে)!

মেমসাহেব সিলেটি শিখে নিয়েছে! কারণ আছমৎ ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেননি।

এখানে প্রশ্ন, এই মেমটি আছমৎ উল্লাকে বিয়ে করল কেন?

সেকুরিটি।

আছমৎ উল্লা মদ খায় না। তাই মাতাল হয়ে বউকে মারপিট করে না এবং তার চেয়েও বড় কথা মদ খেয়ে টাকা ওড়ায় না। রেসে যায় না, তিন পাত্তি তাস খেলেও সর্বস্বান্ত হয় না। সন্ধ্যার পর বাড়িতেই থাকে। এই হল এক নম্বর।

দুই নম্বর বিয়ের পর (আগেও ভোরা ছাড়া) অন্য রমণীর দিকে প্রেমের বাণ হানে না।

এই দুটি সেকুরিটি রমণী মাত্রই খোঁজে। অন্যান্য ছোটখাটো কারণের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই– বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে, কান্নাকাটি করলে বউকে ধমক দিয়ে ড্রইংরুমে লেপকম্বল নিয়ে শুতে চলে যায় না। আছমৎ উল্লার দেশের কুঁড়েঘরে তারা দশজন শুতো, তার দাদার কাচ্চা-বাচ্চা সে সামলেছে, পরিবার বেসামাল বড় ছিল বলেই তো দু মুঠো ভাতের জন্য সে এদেশে এসেছে।

যদি বলেন, কালচারল লেভেল কি এক? নিশ্চয়ই। ডোরা খানদানি ডিউকের মেয়ে নয়, সে এগজিসটেনশিয়ালিজম নিয়ে মাথা ঘামায় না, আর আমাদের আছমৎ উল্লাও জমিদারবাড়ির ছেলে নয়, সে যোগাযোগ পড়েনি।

যদি বলেন, সাদা মেয়ে কি কালোকে পছন্দ করে? উত্তরে বলি, আমাদের ভিতরে যে যত কালা সে-ই তো তত ফর্সা বউ খোঁজে। (এই সাদার তরে পাগলামি এদেশে খুব বেশিদিন হল আসেনি। দুশো বছর আগেকার লেখা বইয়ে ইয়োরোপীয় পর্যটকরাও লিখেছেন, ভারতীয়রা আমাদের ফর্সা রঙ দেখে বেদনাভরা কণ্ঠে শুধায় হায়, ভগবান এদের সবাইকে ধবলকুষ্ঠ দিয়েছেন কেন? কথাটা ঠিক। এদেশের দুই মহাপুরুষ কৃষ্ণ এবং রামের একজন কালো, অন্যজন নবজলধরশ্যাম।)।

এই সেকুরিটির অভাবই মদ্যপানের অন্যতম কারণ।

ইংলন্ডে যে মদ্যপান বেড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

কোনও দেশের গুণীজ্ঞানীরা কী ভাবেন, কী চিন্তা করেন, সে কথা জানবার জন্য সে দেশে যাবার কোনও প্রয়োজন আমি বড় একটা দেখিনে। আপন দেশে বসে বসে সে দেশের উত্তম অধম পুস্তক, মাসিক, খবরের কাগজ পড়লেই সে সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মে! কিন্তু সে দেশের টাঙ্গাওলা-বিড়িওলা ড্রাইভার-কারখানার মজুর কী ভাবে, কী চিন্তা করে সেটা জানতে হলে সে দেশে না গিয়ে উপায় নেই। কারণ তারা বই লেখে না, খবরের সম্পাদককে চিঠি লিখে নালিশ-ফরিয়াদ জানায় না। তাদের কান্নাকাটি গালমন্দ যা কিছু করার সবকিছুই তারা করে এদেশের চায়ের দোকানে, ওদেশে পাবে অর্থাৎ শরাবখানায়। আর শরাবখানায় মস্ত বড় একটা সুবিধা– আমাদের চায়ের দোকানেও তাই কারও সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে চাইলে সে খেঁকিয়ে ওঠে না; গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করতে হলে বিস্তর বয়নাক্কা, আত্মাবমাননাও তাতে কিঞ্চিৎ আছে কিংবা এ চিন্তা মনে উদয় হওয়া অসম্ভব নয়, আমি কে যে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে যাব?

কেনসিংটন গির্জার পাশে ছোট্ট একটি শরাবখানাতে এক কোণে বসেছি। প্রচণ্ড ভিড়। এমন সময় একটি বুড়ি বার থেকে এক গেলাস জিন কিনে এনে আমার পাশে বসতে গেলে তার হ্যান্ডব্যাগটি মাটিতে পড়ে গেল। সেটি কুড়িয়ে টেবিলের উপর রাখলুম। বুড়ি গলে গিয়ে থ্যাঙ্কয়ু থ্যাঙ্কয়ু বলে চেয়ারে বসে খানিকটে আমাকে শুনিয়ে খানিকটে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, আজকালকার ছোঁড়াদের ভদ্রতা বলে কোনও জিনিস নেই, তবু বাকিটা তিনি আর শেষ করলেন না। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না তিনি কী বলতে চান। ছোঁড়াদের ভদ্রতা নেই কিন্তু আমার আছে, এ কী করে হয়, কারণ আমি ছোঁড়া নই। তবে বোধহয় বলতে চান ছোঁড়াদের নেই, কিন্তু এ বুড়োর (অর্থাৎ আমার) আছে। সেটা অনুমান করেও উল্লাস বোধ করি কী প্রকারে? আমি বুড়ো বটে কিন্তু থুথুরে বুড়ির কাছ থেকে সে তত্ত্ব শুনে তো আনন্দিত হওয়ার কথা নয়।

তা সে যাকগে। আমি তখন অবাক হয়ে বারের দিকে তাকিয়ে বার বার তাজ্জব মানছি। হরেক রকম চিড়িয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝপাঝপ বিয়ার, এল, জিন খাচ্ছে– এ কিছু নয়া তসবির নয়, কিন্তু আশ্চর্য, চব্বিশ-ছাব্বিশ বছরের মেয়েরা পর্যন্ত বারে কটাশ করে শিলিঙ রেখে অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে ঢাকাঢ়ক বিয়ার খেয়ে হুট করে বেরিয়ে যায়। যৌবনে যখন লন্ডন গিয়েছি, তখন দুপুরবেলা বারে একা একা খাওয়া মাথায় থাকুন, রাত্রে ডিনারের সময়ও কোনও ভদ্ৰমেয়ে তার বন্ধু বা আত্মীয়ের সঙ্গেও এসব জায়গায় আসতে ইতস্তত করত। নিতান্ত যেতে হলে যেত রেস্তোরাঁয় অর্থাৎ খাবারের জায়গায় যেখানে মদ্যপান করা হয় খাদ্যের অত্যাবশ্যক অঙ্গরূপে আমাদের গ্রামাঞ্চলে যে রকম শুধু জল খেতে দেয় না, সঙ্গে দুটি বাতাসা দেয়।

বুড়ো-বুড়িদের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটাও সত্য যে, যা দেখে তার থেকে অর্থ বের করতে পারে সেই অনুপাতে অনেক বেশি। তাই সেই বুড়ি এক ঢোক জিন খেয়ে আমাকে শুধালে– (এ সব জায়গায় ইংরেজ লৌকিকতার বজ্ৰবাধন কিঞ্চিৎ ঢিলে হয়ে যায়) বাবাজি কি এদেশে এই প্রথম এলে?

বুঝলুম, বাঙালের হাইকোর্ট-দর্শন করে ঘটি যে রকম পত্রপাঠ ঠাহর করে নেয়, লোকটা বাঙাল; আর আমি তো আসলে বাঙাল; কলকাতায় যে রকম প্রথম হাইকোর্ট দেখেছিলুম এখানেও ঠিক তেমনি ক্যাবলাকান্তের মতো সবকিছু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছি। যতই পলস্তরা লাগাই-না কেন, সে বাঙালত্ব যাবে কোথায়? প্রতিজ্ঞা করলুম সাবধান হতে হবে। শহুরেদের মতো সবকিছু দেখব আড়নয়নে ব্রিামদার মতো বাঁকা চোখে।

অপরাধীর সুরে বললুম, তা ম্যাডাম, প্রায় তাই। ত্রিশ বছর পূর্বে এসেছিলুম, আর এই। লন্ডন ইতোমধ্যে পুনর্জন্ম না হোক, অধজন্ম তো লাভ করেছে।

বুড়ি মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলে কী? ত্রিশ বছর পরে। তা হলে তো এর কাছ থেকে অনেককিছু শোনা যাবে। অবশ্য উত্তেজনার কারণ জিনও হতে পারে।

.

সবে দাড়ি-গোঁফ কামাতে শিখেছে এক স্কচ ছোকরা বাড়ি থেকে পালিয়ে মার্কিন মুলুকে উধাও হয়। বহু পয়সা কামিয়ে ত্রিশ বছর পরে সে ফিরছে দেশে। বাড়ি ফেরার সময় এত দিন বাদে এই সে প্রথম চিঠি লিখেছে। স্টেশনে বাপ-চাচা-দাদা সবাই উপস্থিত, সবাই খুশি, প্রচুর পয়সা কামিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে।

চুমোচুমি আলিঙ্গনের পর ছোকরা শুধালে, তোমরা সবাই এ রকম লম্বা লম্বা দাড়ি রেখেছ কেন? এই বুঝি ফ্যাশান!

জ্যাঠা বিড়বিড় করে বললেন, ফ্যাশান না কচু। তুই যে পালাবার সময় ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গেলি!

বুড়ি আরেক ঢোক জিন্ খেয়ে হেসে বললেন, আমার পিতৃভূমি স্কটল্যান্ডে; কাজেই আমার অজানা নয় যে সেখানে কুল্লে পরিবার এক ব্লেডে দাড়ি কামায়। কিন্তু ত্রিশ বছর–?

আমি বললুম, ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম। আমি ত্রিশ বছর পূর্বে লন্ডন ছাড়ার সময় আমার ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম কিন্তু তাই বলে লন্ডনের লোক দাড়ি কামানো বন্ধ করে দেয়নি। ইস্তেক গোঁফ পর্যন্ত কামিয়ে ফেলেছে।

মানে?

মানে মেয়েদের রাজত্ব। আমার ভাইপো এই প্রথম লন্ডনে এসেছে। তার কাছে সবকিছুই নতুন ঠেকছে। সে আজ সকালে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বললে, ফোর টু ওয়ান অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে যদি চারটে মেয়ে চলে যায়, তবে একটা ছেলে। আমি অবশ্য বললুম, এখন আপিস, আদালত, দোকান-পাট খোলা, সেখানে পুরুষরা কাজ করছে। অন্য সময় শুনলে হয়তো অন্য রেশিয়ে বেরোবে। সে বললে, ওসব জায়গায় তো মেয়েরাই বেশি। নিতান্ত বাস আর ট্যাক্সি মেয়েরা চালাচ্ছে না। (পরে অবশ্য ফ্রান্স না জর্মনি কোথায় যেন তা-ও দেখেছি)।।

তার পর বললুম, এক-একটা লড়াই লাগে আর মেয়েদের পায়ের শিকলি খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনের শিকলিও খুলে যায়।

মানে?

আমি বললুম, বেশি দূরে যাওয়ার কী প্রয়োজন? ওই বারের দিকে তাকিয়ে দেখুন না। ত্রিশ বছর আগে উড়ুক্কু বয়সের মেয়েদের দুপুরবেলা বারে মাল গিলতে দেখেছেন?

বুড়ি একটু লজ্জিত নয়নে আমার দিকে তাকালেন।

আমি তাতে পেলুম আরও লজ্জা। আবার বাঙাল-পনা করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি বললুম, না, না, এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তার পর অস্বস্তির কুয়াশা কাটাবার জন্য হাসির রোদ ফুটিয়ে বললুম, সবাই কি ত্রিশ বছরের দাড়ি নিয়ে বসে থাকবে? সময়ের সঙ্গে কদম কদম এগিয়ে যেতে হয়।

বুড়ি যেন আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, এ জন্য আমরাই দায়ী। তবে শুনুন।

এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে লন্ডনের উপর কী রকম বোমা পড়েছে তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। কয়েক বছর আগে এলেও দেখতে পেতেন লন্ডনের সর্বাঙ্গে তার জখমের দাগ। এখনও কোনও কোনও জায়গায় আছে নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু ওসব বাইরের জিনিস। আজ যদি ভূমিকম্পে লন্ডনের আধখানা তলিয়ে যায় তবে তাই নিয়ে বাকি জীবন মাথা থাবড়াব নাকি?

কিন্তু মাটির তলার ঘর সেলারে বসে প্রতি বোমা পড়ার সময় ভয়ে-আতঙ্কে যে রকম কেঁপেছি সেটা হাড়গুলোকে নরম করে দিয়ে গিয়েছে, সে আর সারবার নয়। বম্বিং-এর পর রাস্তায় বেরিয়ে মড়া দেখেছি, জখমিদের কাতর আর্তনাদ শুনেছি— বুকের ওপর তার দাগ সে-ও কখনও মুছে যাবে না। আমার ফ্ল্যাটটা বহুদিন টিকেছিল– অনেককে তাতে আশ্রয় দেবার সুযোগ পেয়েছি, দু চার দিন থেকে তারা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে, কেউ-বা বেশি দিন থেকেছে। একদিন এক মর-মর বুড়োকে আশ্রয় দিলুম। তাকে নিয়ে কী করব সেই কথা ভাবতে ভাবতে যখন কুড়ি ফিরছি তখন জর্মন বারের বাঁশি বাজল। ঘণ্টাখানেক মাটির নিচের আশ্রয়ে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন দেখি স্বয়ং ভগবান আমার সমস্যাটির শেষ সমাধান করে দিয়েছেন। বাড়িটি নেই। সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও গেছে। একটুখানি থেমে বললেন, পরে অবশ্য লাশটা পাওয়া গিয়েছিল।

বুড়ির জিন ততক্ষণে ফুরিয়ে গিয়েছে। কাপড়-চোপড় দেখে মনে হল অবস্থাও খুব ভালো নয়। ফ্রকে হাঁটুর কাছটায় আনাড়ি কিংবা বুড়ো হাতের একটুখানি রিপুও দেখতে পেলুম। এবার কিন্তু বাঁকাচোখে।

এখখুনি আসছি বলে বারে গিয়ে একটা জিন নিয়ে এলুম।

মনে মনে বললুম, সদাশয় ভারত সরকারের যে কটি পাউন্ড ভারতীয় মুদ্রা মারফত কিনতে দিয়েছেন তা দিয়ে এ রকম করলে আর কদিন চলবে? কিন্তু তাই বলে তো আর ছোটলোকামি করা যায় না। আমার ক্যাশিয়ার মুখুজ্যেও পই পই করে বলেছে, কিপ্টেমি করা চলবে না; পাউন্ড যদি ফুরিয়ে যায় তবে তদণ্ডেই দেশে ফিরে যাবে– ফিরতি টিকিট তো কাটাই আছে।

বুড়ি বললেন, না, না। আপনি আবার কেন– আমি এমনিতেই অনেকগুলি খাই।

আমি হেসে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি; একটুখানি পরখ করব না। যদিও স্কচ ছোঁয়ার মতো মিলিয়ন নিয়ে আসিনি।

বুড়ি বললেন, তখনই আমার নার্ভস যায়। অনেকেরই যায়। তার পর ফিসফিস করে বললেন, চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন না, আমার বয়সী ক গণ্ডা বুড়ি মদ গিলছে।

খাবার জোটে না, অহরহ বোমা পড়ছে, কানের পর্দা শব্দের হাতুড়ি পেটা খেয়ে খেয়ে যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে– লক্ষ করেননি, অনেকেরই কান খারাপ হয়ে গিয়েছে, সবাই একটুখানি চেঁচিয়ে কথা কয় (আমি অবশ্য করিনি– তবে কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না-ও হতে পারে)- দিনরাত কেটে যাচ্ছে, চোখের পাতায় ঘুম নেই, এমন সময় পাশের বাড়ি উড়ে যাওয়ার পর তাদের সেলার থেকে বেরুল এক গুদোম মদ।

আগের থেকেই নার্ভস ঠাণ্ডা করার জন্য ধরেছিলুম সিগারেট, এখন পেলুম ফ্রি মদ। মদ খেলে আরেকটা সুবিধে। ক্ষিদেটা ভুলে থাকা যায়, আর, নেশাটা ভালো করে চড়লে দিব্য ঘুমানোও যায় বোমা ফাটার শব্দ সত্ত্বেও।

খাবার নষ্ট হয়ে যায় সহজেই, কিন্তু মদ একবার বোতলে পুরলেই হল। তাই খাবারের চেয়ে মদ জুটত সহজে অন্তত আমার বেলা তাই হয়েছে। সেই যে অভ্যেসটা হয়ে গেল সেটা আর গেল না। এই দেখুন হাত কাঁপছে। গণ্ডাখানেক খাওয়ার পর হাত দড়ো হবে। আর নাই-বা হল দড়ো। কদিনই-বা বাঁচার আর বাকি আছে!

কিন্তু যে কথা বলছিলুম, আমাদের মতো বুড়িদের দেখে দেখে ছুঁড়িরাও মদ খেতে শিখেছে। দোষটা তো আমাদেরই।

বুড়ি থামলেন। খোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ল বৃষ্টি নেমেছে। দেশের মতো গামলা-ঢালা বর্ষণ নয়– সে বস্তু এদেশে কখনও দেখিনি। ঝিরঝিরে ফিনফিনে। তারই ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আরও যেন ঠাণ্ডা হয়ে পাবে ঢুকে আমার হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। ওদের অভ্যাস আছে, বুড়ি পর্যন্ত বিচলিত হল না, কেউ দরজা বন্ধ করে দেবার কথা চিন্তাও করলে না।

পূর্বেই বলেছি বুড়িরা দেখে কম, বোঝে বেশি। বললেন, বাবাজি এদেশে এলেন অক্টোবর মাসে, যেটা কি না ইংলন্ডের ওয়েটেসট মথ, বৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এ বছর আবহাওয়ার কোনও জমা-খরচ পাওয়া গেল না– তেষট্টি বছরের ভিতর এ রকম ধারা কখনও হতে দেখিনি! যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন ঝা ঝা রোদ্দুর, আর যখন রোদ্দুর হওয়ার কথা, ফসল কাটার সময়, তখন হল বৃষ্টি। এ রকম হলে এদেশ থেকে চাষবাসের যেটুকু আছে তা-ও উঠে যাবে।

আমি বললুম, এই অনিশ্চয়তার জন্যই গত একশো বছর ধরে এদেশে গমের চাষ কমে গিয়েছে– কোথায় যেন পড়েছি।

বুড়ি বললেন, এবারের সঙ্গে কিন্তু আদপেই তার তুলনা হয় না। সবাই বলে এটম বম নিয়ে মাতামাতি করার ফলে। হবেও বা। আপনাদের দেশেও তো শুনেছি এবারে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল,– বিস্তর গর্মি, অল্প বৃষ্টি।

একটু আরাম বোধ করলুম। তা হলে বুড়ি এখনও খবরের কাগজটা অন্তত পড়ে। জীবনে আঁকড়ে ধরার মতো অন্তত কিছু একটা আছে। বললুম, সে কথা আর তুলবেন না, ম্যাডাম। দিনের পর দিন ঝাড়া দুটি মাস ধরে ১১৪ ডিগ্রির ১১৪ ন্যাজওলা ক্যাট অ নাইন টেলসের চাবুক খেয়ে পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই ঠাণ্ডায় সে কথা ভাবতে চিত্তে পুলক লাগে, দেহ কদমফুলের মতো—

সে আবার কী ফুল?

খাইছে। এ যেন লন্ডন শহরে মুখুজ্যের বটগাছ সন্ধান করার মতো। বললুম, ম্যাডাম, সে তো বোঝানো অসম্ভব। এদেশের কোনও ফুল তার কাছ ঘেঁষেও যায় না। বোঝাতে গেলে সেই অন্ধের বক খাওয়ার মতো হবে। অন্ধকে শুধালে দুধ খাবে? দুধ কী রকম? সাদা। সাদা কী রকম? বকের মতো। বক কী রকম? লোকটা তার কনুই থেকে বক দেখানোর বাঁকানো হাতের আঙুল পর্যন্ত অন্ধের হাতে বুলিয়ে দিল। অন্ধ ভয় পেয়ে বললে, বাপ! ও আমি খেতে পারব না আমার গলা দিয়ে ঢুকবে না।

তার পর বললুম, কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যে বললেন, হুঁড়িরা আপনাদের অনুকরণে মদ খেতে শিখেছে এ কথাটা আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে না। আমার মনে হয়, যারা মদ খায় তাদের অধিকাংশই দুরন্ত দৌড়-ঝাঁপটার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই ওই কর্ম করে। চাষাবাদের কাজ টিমেতেতালা; তারা মদ খায় কম। কারখানার কাজ জলদ তেতাল; তারা খায় বেশি। আগে শুধু পুরুষেরা যেসব ধুন্দুমারের কাজ করত এখন মেয়েরাও সে-সব কাজ করছে বলে তাদেরও একটু-আধটু পান করতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও বলে রাখছি, এ রেওয়াজ বেশিদিন থাকবে না?

কেন?

আমি বিজ্ঞের ন্যায় বললুম, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পড়িনি, আমি নিজে কোথাও দেখিনি মদ নিয়ে মেয়েদের বাড়াবাড়ি করতে– ও বস্তু যেখানে জলের মতো সস্তা সেখানেও। তার কারণ মেয়েদের বাচ্চা প্রসব করতে হয়। প্রকৃতি চায় না মদের বাড়াবাড়ি করে মেয়েরা স্বাস্থ্য নষ্ট করুক। এবং শেষ কথা পুরুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের আবার ঘরকন্নার দিকে ফিরে যেতে হবে।

বুড়ি বললেন, কী জানি? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু এবার কি তারা যে স্বাধীনতা পেয়েছে সেটা আর ছেড়ে দেবে? সেবারে শুধু তারা পুরুষের কাজ করার অধিকার পেয়েছিল, এবারে তার টাকা ওড়াবার অধিকারও তারা পেয়েছে যে। এই যে তারা পাবে আসে, সেটা কেন? পুরুষের মতো আড্ডা জমাতে তারাও শিখে গিয়েছে।

আমি শুধালুম, বাড়িতে মদ খাওয়া তো অনেক সস্তা!

বুড়ি আনমনে বললেন, অনেক। কিন্তু বাড়িতে আমার আর কে আছে? কর্তা তো আগেই গেছেন। ছেলেটাও ফ্রান্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হল।

তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– গলায় নেশার চিহ্নমাত্র নেই–কিন্তু জানেন, আমি তার আশা এখনও ছাড়তে পারিনি। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পাব মা। শেষে ঘুম ভাঙতেই শুনি, পাশের বাড়ির লক্ষ্মীছাড়া রেডিয়োটা ধর্মসঙ্গীত গাইছে।

মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর
অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।

কোথায় ব্রাহ্মমুহূর্তে প্রসন্নমনে জানালা দিয়ে সবুজ গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সবুজ প্রাণশক্তি আহরণ করব, তা না, তখন স্মরণ করিয়ে দিলে শেষের দিনের কথা। ঘুম তো এক রকমের মৃত্যু, সেই মৃত্যুর থেকে উঠে শুনতে হয় বিভীষিকাময় আরেক মৃত্যুর কথা– তা-ও বিটকেল গানে গানে!

এখানে সকালবেলা খাটের পাশে রেডিয়োটা চালিয়ে দিই আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী শোনার জন্য। এ-দেশে সেটা জানার বড়ই প্রয়োজন। বৃষ্টি হলেই গেছি–বুড়ো হাড় নিয়ে রাস্তাঘাটে ফু, নিউমোনিয়া কুড়োতে ভয় করে। রোদের সামান্যতম আশা পেলে মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

এ দেশের আলিপুর কতখানি নির্ভরযোগ্য! দেশে থাকতে আবহাওয়ার বিলিতি এক ওঝার এক বিবৃতি পড়েছিলুম। তিনি কলকাতায় এসে বেশ মুরুব্বিয়ানার সুরে বললেন, তোমাদের দেশে এখনও আবহাওয়া যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করার মতো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে দফতর নেই বলে প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পার না। আমরা কিন্তু বিলেতে মোটামুটি পারি।

এর পরীক্ষা হাতেনাতে হয়ে গেল।

একদিন ঘুম দেরিতে ভাঙায় বেতার-রিপোর্টটা শুনতে পাইনি। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় বাড়ির বুড়ি ঝিয়ের সঙ্গে দেখা- তার এক হাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অন্য হাতে বালতি। শুধালাম, বেতারে আবহাওয়ার বাণী কিছু শুনেছ?

একগাল হেসে বললে, এবারে যা আবহাওয়া বলে সেই পাবের বুড়ির মতো অনেক কথাই বললে– ইস্তেক এটম বম্ যে এসব গড়বড়ের প্রধান কারণ সেটা বলতেও ভুলল না।

সর্বশেষে বললে, যেন সবকিছু যথেষ্ট বরবাদ হয়নি বলে শেষমেশ এলেন ঝড়, গে। ওহ, তার কী দাপট!

আমি শুধালাম, আবহাওয়া দফতর সতর্ক করে না, ওয়ার্নিং দেয়নি?

গম্ভীরভাবে বললে, ইয়েস স্যর, আফটারওয়ার্ডস, ঝড়ের পরে দিয়েছিল।

রসবোধ আছে বৈকি।

কিন্তু মোদ্দা কথায় ফিরে যাই। আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বে বেতারে হয় ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা উপাসনা। সাতসকালে ওটাও সেই অন্যলোকে কবে কথা তুমি রবে নিরুত্তর গোছের। কিন্তু পাছে আবহাওয়া মিস্ করি তাই সেটা শুনতে হত।

সর্বপ্রথম যেটা কানে ঠেকে সেটা পাদরি সায়েবের ভাষা।

একদা ধর্ম প্রভাব করত সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত তাবৎ রসপ্রকাশ প্রচেষ্টাকে– এখনও করে। একথা ফলাও করে বোঝাবার কিছুমাত্র দরকার নেই কারণ বহু শতাব্দী ধরে রিলিজিয়াস আর্টের সাধনা করার পর মানুষ এই সবে সেকুলার আর্ট আরম্ভ করেছে।

এখন আরম্ভ হয়েছে উল্টো টান। এখন ধর্মযাজকরা আপন-আপন ভাষা সরল, প্রাঞ্জল, ওজস্বিনী, মর্মস্পর্শী করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য থেকে বচনভঙ্গী ধার নিচ্ছেন। আজকের দিনের জীবন যে চরম মূল্যে বিশ্বাস হারিয়ে দেউলে হয়ে গিয়েছে তারই বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পাদরি সায়েব যখন ভোরবেলা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আমার কেমন যেন আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল, কোথায় যেন এটা পড়েছি। তারই সন্ধানে যখন আমার মন আর স্মৃতিশক্তি লুকোচুরি খেলছে তখন, ও হরি, পাদরি সায়েবই মাইকের উপর হাঁড়ি ফাটালেন। বললেন, আজকের দিনের দুনিয়া দেউলে; সর্বভুবন এখন এক বিরাট ওয়েস্টল্যান্ড।

কবিতাটি আমি মাত্র একবার পড়েছি, তা-ও বহু বৎসর পূর্বে এবং সে-ও খামচে খামচে, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে স্কিপ করে করে, কারণ ও কবিতায় একাধিক ভাষায় যে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ভাষা শেখাতে অগা এক-ভাষা-নিষ্ঠ (মনোগ্নট) ইংরেজকে তাক লাগাবার কিশোরসুলভ প্রচেষ্টা আছে, তা দেখে আমি বে-এক্তেয়ার হব কেন আমি তো এ সব-কটা ভাষা এলিয়টের মতোই বিলক্ষণ মিসান্ডারস্টেন্ড করতে পারি। কাজেই কবিতাটি স্মরণ করতে যদি সময় লেগে থাকে তা হলে আশা করি, যাদের কাছে ওই কবিতা রামায়ণ মহাভারতের চেয়েও প্রণম্য তারা অপরাধ নেবেন না।

ইংলন্ডের প্রার্থনার কথা ওঠাতে যদি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এস্থলে কিঞ্চিৎ বাক্যবিন্যাস করি তবে, বিবেচনা করি, সেটা নিতান্ত বেখাপ্পা শোনাবে না, এবং সে-বাসনা যে আমার কিঞ্চিৎ আছেও; সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্য থেকে অনেকখানি দূরে চলে যাব বলে পাঠক হয়তো ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন। তাই শুধু এই প্রশ্নই শুধাই, ভোরবেলার পাদরি সায়েব বেছে বেছে আমাদের এলিয়ট সাহেবকেই স্মরণ করলেন কেন?

মার্কিন মুলুকের লেখককে ইংরেজ সহজে কল্কে দেয় না, কাজেই এই কল্কে পাওয়ার জন্য এলিয়টকে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বহু জায়গায় বিস্তর কল্কে পাওয়ার পর ইংলন্ডের কনসারভেটিভ পার্টিতেও তো জাতে উঠবার জন্য তিনি লিখলেন দি লিটারেচার অব পলিটিক্স–টি এস এলিয়ট ও এম কর্তৃক লিখিত; রাইট অনরেবল স্যর এন্টনি ইডন, কে জি; এম সি; এম পি কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত। এরকম ব্যাপার যে ইংলন্ডে হতে পারে আমি জানতুম না। আজ যদি শ্রদ্ধেয় পরশুরাম শ্রীরাজশেখর বসু রায়সাহেব কর্তৃক লিখিত এবং শ্রীযুক্ত ভূতনাথ ভড় রায়বাহাদুর, বিধানসভার সদস্য, কাইসার-ই হিন্দ দ্বিতীয় শ্রেণি মেডলপ্রাপ্ত কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত পুস্তক প্রকাশ করেন তবে যে রকম বিস্মিত এবং বিরক্ত হব। সাহিত্যজগতে (এলিয়ট যে পলিটিশিয়ান নন, সে সবাই জানে) তিনি তার ও. এম উপাধিটি উল্লেখ করতে ভুললেন না, আর ইডন তো সালঙ্কার থাকবেনই। মুসলমান বলে আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে অনুমান করি চাঁড়াল যদি পৈতে পেয়ে যায়, (স্বগুণেই বলছি) তবে বোধহয় সে সেটা সর্বক্ষণ মাথায় জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়! আশা করি, এর পর যখন বাংলার সাহিত্যিকরা রাজনীতিকদের দাওয়াত করে, সভাপতি বানিয়ে, তাদের দিয়ে সাহিত্য অথবা সাহিত্যিকদের চরিত্রের আনাড়ি সমালোচনা করাবেন, তখন শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ অনাদৃত খাঁটি সাহিত্যিকরা অহেতুক উষ্ণ গোসূসা প্রদর্শন করবেন না। এদের গুরুঠাকুর মহামান্যবর এলিয়ট সাহেব– এঁরা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন মাত্র।

সাহিত্যজগতে কন্ধে পেয়েই এলিয়ট সন্তুষ্ট নন। তিনি আরও বহু কল্কে বহু জায়গায় পেয়েছেন। কিন্তু ইংলন্ডের সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ কল্কে ধর্মচক্রে কে না জানে সে দেশের রাজা বা রানির অন্যতম উঁদরেল উপাধি ডিফেন্ডার অব ফেৎ? স্বয়ং পোপ ইটি অষ্টম হেনরিকে দিয়েছিলেন। সেখানে কল্কে পাওয়া চাই-ই চাই।

এলিয়ট তার ধর্মবিশ্বাস পরিষ্কার ভাষাতেই প্রকাশ করেছেন সেটা তার কবিতার মতো তেষট্টি রকমের বোঝা এবং বোঝানো যায় না, এই রক্ষে। পাসকাল সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধর্মগুলোর ভিতর খ্রিস্টধর্ম, এবং তার ভিতরে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মই জগৎ এবং বিশেষ করে আধ্যাত্মজগতের সমস্যা এবং কার্যকারণ সর্বোত্তমভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে (টু অ্যাকাউন্ট, মোস্ট সেটিসফেকটরিলি ফর দি ওয়ার্লড অ্যান্ড স্পেশালি দি মরাল ওয়ার্ল্ড উইদিন)। যিশুখ্রিস্ট যে জলকে মদ্যরূপে পরিবর্তিত করেছিলেন, মৃতজনে প্রাণ দিয়েছিলেন এসব অলৌকিক কার্যকলাপে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি অ্যাংলো ক্যাথলিক গির্জায় (বিলাতের সরকারি, রাজরানির প্রতিষ্ঠান) গিয়ে পুজোপাঠ করেন, মন্ত্রপূত রুটি এবং মদের মাধ্যমে খ্রিস্টের সঙ্গে অশরীরীভাবে হরিহরাত্ম হন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার নয়। আমাদের মডার্ন কবিরাও হয়তো ইতু ঘেঁটুর পুজো করেন, নজরুল ইসলাম আজ যদি মোল্লার কাছ থেকে পানি-পড়া তাবিজ-কবজ নিয়ে ব্যামো সারাতে চান তবে আমরা উল্লাসই অনুভব করব– ডাক্তার-কবরেজ তো হার মেনেছেন কিন্তু এ বাবদে একটা প্রশ্ন স্বভাবতই উদয় হয়।

গোঁড়া ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন, অ-খ্রিস্টানরা অনন্ত নরকের আগুনে জ্বলবে। গোড়া মুসলমানরা অতখানি ঠিক করেন না তাদের মতে কোনও অনৈসলামিক ধর্মের মূলতত্ত্ব (ফান্ডামেন্টালস্) যদি ইসলামের সঙ্গে মেলে তবে সে ধর্মের লোক স্বর্গে না গেলেও অনন্ত নরকে জ্বলবে না। এখন প্রশ্ন এলিয়ট কি বিশ্বাস করেন, তাঁর বাঙালি হিন্দু-মুসলমান চেলারা অনন্ত নরকের আগুনে রোস্ট মটন কিংবা তন্দুরি মুরগি ভাজা হবে, যারা তাঁর সঙ্গরস পেয়েছেন তারা যদি বাৎলে দেন, তবে উপকৃত হব।

কিন্তু ইহুদিদের সম্বন্ধে এলিয়ট তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। পাঠক স্মরণ রাখবেন, ইহুদির ধর্মগ্রন্থ প্রাচীন নিয়ম (ওল্ড টেসটামেন্ট) খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থও বটে এবং খ্রিস্টানদের একেশ্বরবাদ, প্রতিমাবর্জন, স্বৰ্গনরক, শেষ বিচার, গির্জার প্রার্থনা-পদ্ধতি ইহুদিদের কাছ থেকে নেওয়া, এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট ইহুদিসন্তান– মথিলিখিত সুসমাচারের আরম্ভই যিশুর কুলজি নিয়ে; তিনি ইহুদিদের বংশপিতা আব্রাহামের (ইব্রাহিমের) বংশধর।

এলিয়ট আদর্শ সমাজব্যবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, যে সে আদর্শ সমাজে রক্ত ও ধর্ম এই দুয়ে মিলে মুক্তচিন্তাশীল ইহুদিদের (আদর্শ সমাজে) বেশি সংখ্যায় থাকা অবাঞ্ছনীয়।

(Reasons of race and religion combine to make any large number of free-thinking Jews undesirable)

সোজা বাংলায় প্রকাশ করতে গেলে দাঁড়ায় :- যেমন মনে করুন রবীন্দ্রনাথ যদি বলে যেতেন, পারসিদের ধর্ম এবং রক্ত আলাদা (এবং এটাও লক্ষণীয় যে, ইহুদি ও পারসি উভয় সম্প্রদায়ই বিত্তশালী); এ দুয়ে মিলে গিয়ে এমনই এক বিপর্যয় ঘটেছে যে এদের থেকে বেশি লোক ভারতীয় সমাজে থাকুক এটা বাঞ্ছনীয় নয়!!!

অ্যান্টনি ইডনের ভূমিকাসম্বলিত এলিয়টের যে লিটারেচার অব পলিটিকস্ বইয়ের পূর্বে উল্লেখ করেছি তাতে এলিয়ট চারজন কন্সারভেটিভ সাহিত্যিকের উল্লেখ করেন; বলিং, বার্ক, কোলরিজ এবং ডিজ্বরেলি। ডিজরেলির কথা বলতে গিয়ে এলিয়ট বলেছেন, হ্যাঁ, ইনি (এখানে বোধহয় এলিয়ট একটু থেমে গিয়ে মৃদু গলাখাকারি দিয়েছিলেন) একটা সাদামাটা পাস পেতে পারেন মাত্র; আমি অবশ্য গির্জার সদস্য গ্ল্যাডস্টনকেই পছন্দ করি বেশি।

সমালোচক উইলসন কাষ্ঠহাসি হেসে এ স্থলে বলেছেন, হ্যাঁ, একজন মুক্তচিন্তাশীল ইহুদি চললেও চলতে পারে, অবশ্য তিনি যদি কনসারভেটিভের স্বার্থে কাজ করেন।

অনেকটা রবিঠাকুর যেন বলেছেন, নৌরজী চললেও চলতে পারেন; আমি কিন্তু গোড়া টিলককেই পছন্দ করি।

এ-আলোচনা উঠেছিল যখন বিবিসি দর্শনে যাই-হাজার হোক এ-জীবনের চারটি বছর দিশি বেতারে নষ্ট করেছি তো!

.

পারস্যে প্রখ্যাত কবি মুশাররফ উদ্দীন বিন্ মুসলিহ উদ্দীন শেখ সাদীকে একদিন দেখা গেল ভর সন্ধেবেলা গোরস্তানের দেউড়ির সামনে। এ সময়টা মৃতের সদ্গতি-প্রত্যাশাকামী উপাসনার জন্য প্রশস্ত নয়; তাই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কবির এক বন্ধু তাকে দেখতে পেয়ে শুধালেন, অবেলায় এখানে কী করছেন, শেখ সায়েব? দীর্ঘ দাড়ি দুলিয়ে, দীর্ঘতর নিশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ বললেন, আর বলল না ভাই, গেরো, গেরো। জানো তো অমুককে। আমার কাছ থেকে একশো তুমান ধার নিয়েছিল বছরটাক হয়ে গেল। ফেরত পাইনে। পাড়ায় পাড়ায় খেদিয়ে বেরিয়েও তাকে ধরতে পাইনে। তখন আমার গুরুভাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছে এখানে এসে অপেক্ষা করতে। গোরস্তানে নাকি সবাইকে একদিন আসতে হয়।

বিবিসি লন্ডন তথা ইংলন্ড, এমনকি লন্ডনাগত বিদেশি গুণী-জ্ঞানীর জ্যান্ত গোরস্তান। গাইয়ে, বাজিয়ে, নাট্যকার, বক্তৃতাবাজ, পাহাড়-চড়নে-ওলা, চোরের সেরা, ডাকাতের-বাড়া (এরাও ইন্টারভু দেয়) হেন প্রাণী নেই যে এখানে একদিন না একদিন না-আসে।

আমার জন্মভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষে অবশ্য ভিন্ন ব্যবস্থা। তার সম্বন্ধে অন্য গল্প আছে। সেটা কিন্তু বাজারে চালু হয়নি। আকাশবাণীতে সামান্য যেটুকু প্রোগ্রাম পায় তা-ও কাটা যাবার ভয়ে সে গল্পটি কেউ বলতে চায় না, শুনলেও ভুলে যেতে চায়।

এটম বম পড়লে কী কী কাণ্ড হতে পারে তারই রগরগে বর্ণনা শুনে এক নিরীহ বঙ্গসন্তান তার বৈজ্ঞানিক বন্ধুকে শুধালে, এসব কি সত্যি?

এক দম! বরঞ্চ কমিয়ে সুমিয়ে বলেছে।

তা হলে উপায়? দূর-দূরান্তে, লড়াইয়ের আওতার বাইরে কোনও নির্জন দ্বীপে চলে গেলে হয় না?

হয়। কিন্তু এদেশের সরকার এটম বমের বিরুদ্ধে উত্তম ব্যবস্থা করেছেন। বম ফাটার সম্ভাবনা দেখলেই, আকাশবাণীর কোনও স্টুডিয়োতে ঢুকে পড়ো। সেখানে কোনও রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি নেই।

আমি অবশ্য মৌলানা সাদীর মতো দেনাদারকে পাকড়াবার জন্য বিবিসিতে যাইনি। আমি গিয়েছিলুম আপন ঋণ শোধ করতে। পূর্বেই বলেছি, একদা আমি বেতারে বাঁধা ছিলুম। সে সুবাদে দু একজন কর্মীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এমনকি দহরম-মহরম হয়। দেশে নিষ্কর্মা বিবেচিত হওয়ার পর বিবিসি এদের লুফে নিয়েছে পাড়ার মেধো ওপাড়ার মধুসূদন তুচ্ছার্থে বলা হয়, এখানে কিন্তু সত্যই।

জর্মনির জন্য বিবিসি যে জর্মন প্রোগ্রাম করে তারই বড় কর্তা আসলে ভিয়েনাবাসী জর্মনভাষী ড, ভলফের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে আমাদের সিনহা (আসলে সাদামাটা কায়েতের পো সিঙ্গি, নিতান্ত সম্মানার্থে সিংহ, কিন্তু ছোকরা হামেশাই একটু সায়েবি ঘেঁষা ছিল বলে আমরা বাংলাতে কথা কইবার সময়ও সিনহা বলতুম)। লোকটি অসাধারণ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দৈনন্দিন সর্ব সমস্যা সম্বন্ধে অহরহ সচেতন। এ সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে না।

আশকথা পাশকথার পর আমিই বললুম, বিবিসির জর্মন কর্মচারীদের উচ্চারণ জর্মনি থেকে সম্প্রসারিত খাস জর্মন বেতারবাণীর চেয়ে ভালো। প্রিয় অসত্য আমি যে একেবারেই বলিনে তা নয়, কিন্তু প্রিয় সত্য বলবার সুযোগ পেলে আত্মপ্রসাদ হয় ঢের ঢের বেশি।

হিটলার বরিশালের লোক। অর্থাৎ বরিশালের লোক কলকাতার ভাষা বলতে গেলে যে রকম তার কথায় আড় থেকে যায়, হিটলারের পোশাকি জৰ্মনে তেমনি শুধু আড় নয়, তার জন্মভূমি অস্ত্রীয় উপভাষার বোটকা গন্ধ পাওয়া যেত। হিটলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও যাননি, শিক্ষিত আচার্য পণ্ডিতদের তিনি দু চোখে দেখতে পারতেন না, তদুপরি নতুন ভাষা বাবদে তিনি ছিলেন মোল আনা অগা। (মুসসোলিনি চমৎকার জর্মন বলতে পারতেন এবং একমাত্র তার সঙ্গেই কথা কইতে তাঁর দোভাষীর প্রয়োজন হত না। ওদিকে আবার স্তালিনের রুশ উচ্চারণে ককেশাসের শুরুভার ছিল বলে তিনি লেকচরবাজি করতে ভালোবাসতেন না কিন্তু এৎস্কি ছিলেন বহু ভাষায় অসাধারণ পণ্ডিত। কাজেই এসব উল্টোপাল্টা নমুনা থেকে আমি কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পারিনি। হিটলার যখন রাজ-রাজেশ্বর হয়ে গেলেন তখন যে তার চেলাচামুণ্ডারা শুধু তার উচ্চারণ নকল করতে আরম্ভ করলেন তাই নয়, তারই মতো কর্কশ গলায় (হিটলার টনৃসিলে ভুগতেন) দাবড়ে দাবড়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন– এক গ্যোবেলস্ ছাড়া। জর্মনির খানদানি শিক্ষিত পরিবারে যে ঋজু, স্বচ্ছ, চাঁচাছোলা উচ্চারণ প্রচলিত ছিল, অধ্যাপকরা যে ভাষায় কথা বলতেন, থিয়েটার-অপেরাতে যে উচ্চারণ আদর্শ বলে ধরা হত, সেটা লোপ পাবার উপক্রম করল। যুদ্ধ লাগার পূর্বে এবং পরে যারা লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বিবিসির জর্মন সেকশনের ভার নিল তারা প্রধানত ওইসব শ্রেণির বুদ্ধিজীবী। আজকের দিনে যারা হিটলারি রাজত্বের বারো বৎসরের দুঃস্বপ্ন যত তাড়াতাড়ি পারে ভুলে যেতে চায় তবু পুরনো দিনের অভ্যেস অত সহজে যাবে কেন?

তাই বিবিসি-র জর্মন উচ্চারণ এখন খাস জর্মনির চেয়ে খানদানি।

অভ্যাস যে সহজে যেতে চায় না তার উদাহরণ যত্রতত্র সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাঙলা দেশ থেকেই তার একটা অতি সাধারণ উদাহরণ দিয়ে আরম্ভ করি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে কাপড়ের কী অনটন পড়েছিল সে কথা আমরা ভুলিনি। তারই ফলে পাঞ্জাবির ঝুল কমে কমে প্রায় গেঞ্জির মতো কোমরে উঠে গিয়েছিল। তার পর লড়াই শেষ হওয়ার পর যখন বাজারে আর আদ্দির অভাব রইল না, তখনও কিন্তু স্কুল আর নামে না। ইতোমধ্যে ওইটেই হয়ে গিয়েছে ফ্যাশান!

ইংলন্ডেও তাই। সেই যে যুদ্ধের সময় কাপড়ের অভাবে মেয়েরা অল্প ঘেরের স্কার্ট বানাতে বাধ্য হয়েছিল আজ সেটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং তার ঘের এতই মারাত্মক রকমের অল্প যে বাসের পাদানিতে পা ভোলা যায় না। বাসের হ্যাঁন্ডিল ধরে মেম সায়েবদের লাফ দিয়ে একসঙ্গে দু পা তুলে বাসে উঠতে হয়। আমারই চোখের সামনে একদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। একটু ফুল সিম্ (আজকাল মোটা বলা অসভ্যতা– সেটা সংস্কৃত পদ্ধতিতে ফুল স্লিম বলাটা যে আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন তাঁকে বার বার নমস্কার!) মহিলা বাসে উঠতে গিয়ে লাফ না দিয়ে পুরুষদের মতো পা তুলতেই চড়চড় করে স্কার্টটি প্রায় ই-পার উস্-পার!

যাদের কম ঘেরের লুঙ্গি পরার অভ্যাস আছে তাদের নিশ্চয়ই এ অভিজ্ঞতাটি একাধিকবার হয়েছে প্রধানত লুঙ্গির বার্ধক্যে।

ঘটনাটা নিত্যি নিত্যি এ দেশে হয় কি না বলতে পারব না, কারণ যে কটি লোক কাণ্ডটা দেখলে তারা মৃদু হাস্য করা দূরে থাক, তাদের নয়নের উদাস দৃষ্টি যেন সঙ্গে সঙ্গে উদাসতর হয়ে গেল। আমিও ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ শহুরে হয়ে গিয়েছি। মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজে বরিলের বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই সই পড়তে লাগলুম।

ঘটনাটি প্রচুর ধ্বনি ও ব্যঞ্জনা সহকারে এক ইংরেজ বন্ধুকে যখন বাখানিয়া বললুম, তখন তিনি বললেন, কেন, এ ব্যাপার তো এখন ক্লাসিসের পর্যায়ে উঠে গেছে। শোনো এক কনি আর এক কনিকে উপদেশ দিচ্ছে, মিলের শেয়ার না কিনতে। কী হবে কিনে? কাপড়ের এখন আর কতখানি প্রয়োজন? এই দেখ না, আমি আমার স্ত্রীর গেল বছরের স্কার্ট দিয়ে নেকটাই বানিয়েছি, আর তিনি আমার গেল বছরের টাই দিয়ে এ বছরের স্কার্ট বানিয়েছেন।

কিন্তু এহ বাহ্য। এসব জিনিস দিয়ে ইংরেজ চরিত্রের অদল-বদল হয়েছে কি না সে কথা বলা অসম্ভব না হলেও কঠিন। এক মার্কিন সেপাই যুদ্ধের সময় বাঙলা দেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় দেখে, যেখানেই পুকুর কাটা হয়েছে সেখানেই পুকুরের মাঝখানে মাটির কোনিকাল থাম রাখা হয়েছে। আসলে এটা কতখানি মাটি কাটা হয়েছে তার মাপ রাখবার জন্য এবং মাটি-কাটাদের মজুরি চুকিয়ে দেবার পর এ থামগুলোও কেটে ফেলা হয় কিন্তু মার্কিন তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখলে, বাঙলা দেশের লোকই সবচেয়ে বেশি শিবলিঙ্গ পুজো করে। এন্তের পয়সা খরচ করে বিরাট বিরাট পুকুর খুঁড়ে মাঝখানে শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে।

এটা শুনে আমার মনে শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। না হলে ক্লিয়াপাত্রার নিডল (অবিলিস্ক) ইয়োরোপে যে সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়েছে তার থেকে মীমাংসা করে আমিও বলে দিতাম, ইয়োরোপেও লিঙ্গপূজা হয়।

যতই খবরের কাগজ পড়ি, রেডিয়ো শুনি, টেলিভিশন দেখি, পাবে কথাবার্তা কই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লাঞ্চ-ডিনার খাই, মোটরে করে গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যাই, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে অবরে সবরে রসালাপ করি (তার সুযোগ বিস্তর, কারণ ট্রাফিক জ্যামের ঠেলায় ঘাটে ঘাটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়) বাকা নয়নে সবকিছু দেখি, খাড়া কানে অধর্মাচরণে অন্য লোকের কথাবার্তা শুনি ততই মনে হয়, সেই পুরনো ফরাসি প্রবাদ, প্ল্যু সা শাঁজ প্ল্যু সে লা মেম শোজ (দি মোর ইট চেঞ্জেস, দি মোর ইট ইজ দি সে থিং), খোল-নলচে বদলেও সেই পুরনো হুঁকো।

এই যে জর্মনির হাতে ইংরেজ বেধড়ক বম্ খেল, কই, কথায় কথায় তো জর্মনিকে কটুবাক্য করে না; দু এক জায়গায় যে কালোয়-ধলায় মারামারি হচ্ছে, কই সাধারণ ইংরেজ তো সাদার পিছনে দাঁড়ায়নি; উল্টো প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এমনকি শুনতে পেলুম পার্লিমেন্টে নাকি কে যেন বিল আনবেন, যেসব হোটেল-ওলা কালো-ধলায় ফারাক করে তাদের সায়েস্তা করবার জন্য; নানা প্রকার আমদানি-রপ্তানির ওপর যদিও বাধ্য হয়ে কিছু কিছু আইন জারি করতে হচ্ছে তবু তো ইংরেজ আরও কয়েকটা জাত নিয়ে একটা খোলা বাজার তৈরি করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে। ত্রিশ বছর আগেও মনে হয়েছে, এখনও মনে হল, ইংলন্ডে কনসারভেটিভও লিবরেল, লেবারও লিবরেল হয়ে গিয়েছে। তাই বোধহয় খাস লিবারেল দলের জেল্লাই সেখানে কমে গিয়েছে। যে দেশের সবাই ভাত খায় সেখানে তো আর ভাতখেকোদের আলাদা হোটেল হয় না।

তাই তাজ্জব মানি, এলিয়ট এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন কী করে।

সিনহা না ভলফ শুধিয়েছিলেন সে কথাটা মনে নেই।

আজ যখন অ্যারোপ্লেনে করে অষ্টপ্রহরে কলকাতা থেকে লন্ডনে যেতে পারি, প্যারিসের লোক আর কয়েকদিনের ভিতরেই দেশে খাবে ব্রেকফাস্টনিউইয়র্কে খাবে লাঞ্চ, সর্বদেশের ভৌগোলিক গণ্ডি যায় যায়, শঙ্কর দর্শন আলোচনা করতে হলে প্লাতোর উল্লেখ না করলে সমালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ক্রোচের সমালোচনায় অভিনব গুপ্তের নামোল্লেখ অভিনব বলে মনে হয় না, লন্ডন পাউন্ডের দাম কমালে আর পাঁচটা দেশ পড়িমরি হয়ে সেই কর্ম করে, জর্মনিতে নতুন দাওয়াই বেরোলে সেটা কলকাতার কালোবাজারে ঢোকে সাত দিনের ভিতর, বিলিতি ফিরে মরমিয়া কেঁই কেঁই সুরের দিশি ভেজাল হন্টরওয়ালিতে শোনা যায় পক্ষাধিক কালে, তখন শুনতে হবে খ্রিস্টধর্মের, একমাত্র খ্রিস্টধর্মের তা-ও চার্চ অব ইংলন্ডের খ্রিস্টধর্মের জয়গান? সেইটে বারণ না করলে পৃথিবীর আদর্শ সমাজে আমাদের স্থান নেই?

কারণ এলিয়ট অতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আমাকে যদি ধর্মান্ধ বলা হয় তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি খ্রিস্টীয় সমাজই চাও তবে তাতে মেলা স্বাধীন পন্থা, স্বাধীন মতবাদের ঝামেলা লাগালে চলবে না (ইউ ক্যানোট এলাও কনজেরিজ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট সেকটস)। ইংলন্ডের নৈতিক পন্থা, এবং বৈদেশিক নীতি ঠিক করে দেবে চার্চই। আর তার আদর্শ রাষ্ট্রে ইহুদিদের সংখ্যা যে অতিশয় সীমাবদ্ধ থাকবে সে কথা তো পূর্বেই নিবেদন করেছি। (এখানে বলে দেওয়া ভালো আমি পাপী; সে আদর্শ সমাজে স্থান চাইনে; আমি শুধু তার বাঙালি শিষ্যদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলুম।)

আমি তো আশা করেছিলুম, ভৌগোলিক গণ্ডি যখন জেরিকের দেয়ালের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তখন শিক্ষিত মানুষ সেই ধর্মেরই অনুসন্ধান করবে যে ধর্ম তার বিরাট বাহু মেলে সবাইকে আলিঙ্গন করতে চায়। আমার তো মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ যখন ইংলন্ডে মানবধর্মের জয়গান গেয়েছিলেন তখন তিনি বলদের সামনে বেদপাঠ কিংবা মোষের সামনে বীণা বাজাননি।

.

ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি–অর্থাৎ ইংরেজ বাড়িঘর ছিমছাম রাখে, হিন্দু মেয়েরা জামা-কাপড় (বিশেষ করে গয়না-গাটি) পরে ভালো, আর মুসলমানের কুলে পয়সা যায় তার হাঁড়িতে, উত্তম আহারাদি করে তার দিন কাটে। তাই ব্রিামদা একদিন আপন মনে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, মুসলমানদের ভিতর এত শিক্ষাভাব কেন? তার পর আপন মনেই উত্তর দিয়েছেন, যেখানে শিককাবাব বেশি সেখানে শিক্ষাভাব তো হবেই।

বিবিসির অন্যতম বাঙালি মুসলমান কর্মী আমাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন সম্বন্ধে প্রশ্ন শোধাননি, জর্মন প্রেসিডেন্ট হয়েসের আসন্ন লন্ডনাগমনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমার সুপক্ক মতামত জানতে চাননি, এমনকি ইংরেজ নারীর নমনীয়তা কমনীয়তা সম্বন্ধেও তিনি উদাসীন। আমাকে শুধালেন, আহারাদি?

আমি বললুম, ইংরেজের তো বাড়ি; দুনিয়ার হাঁড়ির খবর রেখেও তার হাঁড়ি শূন্যই থেকে গেছে।

তার পর বিজ্ঞভাবে মাথা নেড়ে জর্মন অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে আরম্ভ করলুম, নরমানরা আলবিয়ন ভূমি জয় করার ফলে ধর্ম, রাজনীতি তথা সাহিত্যজগতে যেসব বহুবিধ ঘূর্ণিবাত্য, ভূমিকম্প, প্লাবনান্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তদ্বিষয়ে বহুতর পুস্তক, সংখ্যাতীত প্রবন্ধ এবং ভূরি ভূরি গবেষণামূলক কোষ লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওহহা হতোস্মি, ইহলোক-লোক উভয় লোকের সঙ্গমভূমি এই যে উদর (পিতৃলোকের একমাত্র কাম্য পিণ্ড, এ তথ্য কুলাঙ্গারও স্মরণ রাখে।) তদ্বিষয়ে অতিশয় যৎসামান্য স্মৃতিশ্রুতি বর্তমান। পরম মনস্তাপের বিষয় অদ্যাবধি আলবিয়ন ভূমির শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় এই সর্বোত্তম সনাতন মার্গ সম্বন্ধে সম্যক সংবিদিত হয়নি।

কর্মী বললেন, বাংলা অভিধান হাতের কাছে নেই।

ত্রিতাল থেকে একতালে যাওয়া অশাস্ত্রীয়। কিন্তু শাস্ত্র মেনে কী হবে? পূর্বেই নিবেদন করেছি, রবীন্দ্রনাথের সর্বশাস্ত্রসম্মত মানবধর্ম শ্বেতভূমিতে অনাদৃত।

আমি বললুম, নরমানরা আসার পূর্বে এদেশের লোক বোধহয় কাঁচা মাংস খেত। এই দেখুন জ্যান্ত ভেড়ার নাম ইংরেজিতে শিপ, তার মাংস রান্না করে খেতে হলে সেটা হয়ে যায় মটন। শিপ শব্দ খাস ইংরেজি, মটন শব্দ ফরাসি, নরমান যা খুশি বলতে পারেন; কাউ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (তোবা, তোবা)! ফরাসি শব্দ বি; কাফ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে ফরাসি শব্দ ভিল; ঠিক সেইরকম সুয়াইন ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (রাম রাম)! ফরাসি শব্দ পোর্ক; ইংরেজি ডিয়ার ফরাসি ভেনজন ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি যেসব রসবস্তু দিয়ে এগুলোকে সুস্বাদু করা হয়, যথা সস, সেভারি, ভিনিগার, মায়োনেজ, সেগুলোও ফরাসি শব্দ। খাবার মেনু ফরাসি; তার প্রধান ভাগ অরদ্যভ্র (অবতরণিকা), কসমে-পতাজ (শুরুয়া বিভাগ), আঁত্রে (প্রবেশ), পিয়েস দ্য রেজিসাস (পিস্ অব রেজিসটেনস্ অর্থাৎ প্রধান খাদ্য যা দিয়ে পেট ভরাবে), স্যালাড, ডেসের (ফলমূল, মিষ্টি), সেভরি (শেষ চাট) সবই ফরাসি। আর পদগুলোর নাম, কসমে জ্বলেয়্যন, পটাজ ও ফেরমিয়ে (চাষাদের(!) সুপ), অমলেট ওর্জেব (পেঁয়াজ পুদিনার অমলেট) এখানেও দেখুন এগ ইংরেজি শব্দ কিন্তু অমলেট ফরাসি। এসব আরম্ভ করলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। আশু ইংলগামী এর কটিঙটা রাখলে উপকৃত হবেন; আমাকে নিমন্ত্রণ করে সঙ্গে নিয়ে গেলে আরও বেশি উপকৃত হবেন; কারণ যেগুলোর নাম করলুম এগুলো ভোজনতীর্থের বিখ্যাত কাশী বৃন্দাবন হিংলাজ গোটাটি করে নিয়ে যেতে হয় হাতে ধরে)।

এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। মহানগরী কলকাতার হিন্দুসন্তান যখন পোশাকি মাংস খায় তখন সে ভাত খায় না, সে তখন বেরোয় খানা খেতে এবং যবনের হাতে কিন্তু স্বেচ্ছায়। কোর্মা, কালিয়া, বিরিয়ানি, কাবাব, দোলমা এবং সবকটি শব্দই বিদেশি; বাংলা প্রতিশব্দ নেই। চপ, কাটলেট, অমলেটও বিদেশি শব্দ। তফাৎ এই যে ইংরেজিগুলো হিন্দু হেঁশেলে ঢুকেছে, মুসলমানিগুলো ঢুকতে পারেনি। তার কারণ, মুসলমানিগুলো রান্না একটু বেশি শক্ত।

শেষোক্তগুলো কলকাতার মুসলমানরাও খেতে শিখেছেন।

এক মুসলমান গেছেন হোটেলে। বয় এক কাটলেস লে আও।

হুজুর আজ মিট-লেস।

সায়েব বললেন, কুছ পরোয়া নাহি; সো হি লাও।

সায়েব ভেবেছেন মিট লেস (দিন) বুঝি কাটলেসের এক নবীন সংস্করণ।

মূল কথায় ফিরে যাই।

নরমান জয়ের পর ক্রমে ক্রমে যেসব বিদেশি খাদ্যরাজি বিলাতে প্রবর্তিত হল, তার ইতিহাস এখনও আমার চোখে পড়েনি– পক্ষান্তরে ফরাসি খাদ্যের সর্বাঙ্গসুন্দর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে উত্তম উত্তম পুস্তক দেখেছি। শুনেছি, মহামান্যবর স্বর্গীয় আগা খান এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোজনরসিক ছিলেন। তাঁর নাকি একখানি বিশাল বিরাট এটলাস ছিল। তাতে পৃথিবীর কোন জায়গায় কোন সময় কোন খাদ্য উত্তমরূপে প্রস্তুত হয় সেগুলো চিহ্নিত ছিল। এ পৃথিবীর সব খাদ্যই যখন তিনি একাধিকবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন তখন নতুন রসের সন্ধানে অন্যলোকে চলে গেলেন। আমার হাজার আপমোস তাঁর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি বলে।

তা সে যাই হোক, একথা, মোটামুটি বলা যেতে পারে বর্বর ইংরেজি রান্নার প্রতীক ছিল ক্রুয়েট স্ট্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি। এতে থাকত সিরকা, অলিভ তেল, উস্টার সস আর সরষে। নুন গোলমরিচ তো আছেই। বস্তুত এর কোনও একটা কিংবা একাধিক বস্তু না মিশিয়ে অধিকাংশই খাওয়া যেত না। নিতান্ত খরগোশ গোত্রজাতরাই ইংরেজের স্যালাড কচর কচর করে চিবুতে পারত। পার্ক সার্কাসের রদ্দিতম ধনে কিংবা পুদিনা স্যালাড এর তুলনায় অমৃতগন্ধী মধুমঞ্জরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেপাইরা ট্রেঞ্চে শুয়ে শুয়ে অখাদ্য খেয়ে খেয়ে স্বপ্ন দেখত, ছুটিতে প্যারিসে ছিমছাম রেস্তোরাঁয় করকরে টেবিলক্লথগুলো ছোট্ট টেবিলের উপর মেডফুড–অর্থাৎ তৈরি খাবারের; ইংরেজি ধরনে নুন লঙ্কা তেল সস মিশিয়ে খেতে হয় না, ফরাসি শে এসব বস্তু রান্নাঘরেই পরিপাটিরূপে তৈরি করে দিয়েছে আমাদের মা-মাসিরা যেরকম মাছের ঝোল কিংবা চালতের অম্বল করে দেন। তারই ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজি রান্নার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন হয়। সেইটে আমি চোখে দেখি ১৯৩০ সালে। অখাদ্য লেগেছিল কারণ, সদ্য গিয়েছি লন্ডনে– প্যারিস থেকে।

ইনভেশনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বসংসারের জাত-বেজাত জড়ো করা হল ইংলন্ডে–আলেকজান্ডারের সময় মেসিডোনিয়ায় কিংবা রোমের মধ্যাহ্ন দীপ্তির সময়ও এ শহরে বোধহয় এরকম সাড়ে বত্রিশ ভাজা কখনও হয়নি। ফলে লন্ডনের রান্না আপাদমস্তক বদলে গিয়েছে।

সেইটে চাখলুম ৫৮-এ।

সবকিছু বেবাক বদলে গিয়েছে। ইস্তেক ক্রুয়েট তার মালমসলাসুদ্ধ গায়েব। যেদিন নুন লঙ্কার শিশিও যাবে, সেদিনই ইংরেজি রান্না তার চরম মোক্ষে পৌঁছবে। কে না জানে, ভালো রাঁধুনি কাউকে ফালতু নুন নিতে দেখলে বেদনা পায়। প্যারিসে শোনা যায়, ভোজরাজ সম্রাট আগা খান এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় মনের ভুলে একটু ফালতু নুন নিয়েছিল বলে রেস্তোরাঁর রাঁধুনি দুঃখে আত্মহত্যা করে। ইংলন্ডে এখন পাঁচকই রান্নাঘরে আহারাদি তৈরি করে। গাহককে ডাইনিং হলে টেবিলের উপর পি সি সরকারের মতো নিপুণ যাদুকরি হস্তে সিরকা সস ঢেলে কাঁচাসে মালকে সুস্বাদু করতে হয় না। পৃথিবীর আর পাঁচটা জাত– মায় বান্টু হটেনটট– এতকাল যা করে আসছে।

এবং জাত-বেজাতের নতুন নতুন পদও তার রান্নাঘরে ঢুকতে দিয়েছে।

ত্রিশ বছর আগে রাইস-কারি খেতে হলে আপনাকে লিভিংস্টোনের মতো ছ মাসের চালচিড়ে পুরনো ধুতিতে বেঁধে বেরোতে হত তারই আবিষ্কারে। বহু বাজে লোক কর্তৃক বেপথে চালিত হয়ে, বহু পুলিশমেনের সক্রিয় সহযোগিতার ফলে, অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জিয়া আপনি যখন মোকামে পৌঁছতেন তখন রাইস-কারি খতম! সেই লক্ষ্মীছাড়া বিফস্টেক খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। মনে পড়ত সেই গরিব মোল্লার কাহিনী। চেয়ে-চিন্তে অতি কষ্টে খেয়ার একটি পয়সা যোগাড় করে সে যখন ওপারে ফাতেহার (শ্রাদ্ধের) ভোজে পৌঁছল তখন সবকিছু ফুরিয়ে গিয়েছে। মেহমানকে তো আর অভুক্ত ফেরানো যায় না– তাড়াতাড়ি ভাত আর মসুর ডাল সেদ্ধ করে তাকে খাওয়ানো হল। মনের দুঃখে সে বললে, ওরে ডাল, আমি না হয় খেয়ার পয়সা ধার করে যোগাড় করলুম; তুই পেলি কোথায়? আপনিও স্টেককে শুধাবেন, এ পথ তুই পেলি কোন পুলিশকে শুধিয়ে?

একদম পয়লা নম্বরি হোটেলে অর্থাৎ যেখানে গ্রস্টারের ডুক, কেন্টের ডাচেস খেতে যান– আমি যাইনি। তার অধিকাংশই দামের ঠেলায় ফাঁকা। বিরাট হলের এখানে দু জন ওখানে চারজন লোক খাচ্ছে, আর বেকার ওয়েটারগুলো ইভনিং ড্রেস পরে হেথা-হোথা জটলা পাকাচ্ছে, বাড়িটা যেন খা খা করছে–এমন জায়গায় খেয়ে সুখ নেই। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল চ্যারিটি ম্যাচে যদি গিয়ে দেখেন মাত্র আপনি আর ওপাড়ার গোবর্ধন উপস্থিত, আর কেউ নেই, তখন কি খেলা দেখাটা জমে? অবশ্য যেখানে এমন ভিড় যে পলায়মান বয়ের কাছাতে হ্যাঁচকা টান না দেওয়া পর্যন্ত একটা হাফ-সিঙ্গিল চা জোটে না সেখানেও গব্বযন্ত্রণা। বাচ্চা এবং চা আসি আসি করে না এলে কী পীড়া তা শুধু পোয়াতি আর গাহকরাই জানে।

অতএব যেতে হয় দুই নম্বরি হোটেলে। এবং সেখানেও হরবকৎ রাইস-কারি পাবেন– পয়লা নম্বরিতে পান আর না-ই পান। আর কোনও কোনও রেস্তোরাঁয় লেখা আছে পাটনা রাইস! পাটনা রাইসের প্রতি এ দুর্বলতা কেন? রাষ্ট্রপতির শহর বলে?

আর যারা খাচ্ছে তারা বাঙালি নয়, ভারতীয় নয়–দুনিয়ার চিড়িয়া।

এইসব খাস বিলিতি রেস্তোরাঁতেই যদি রাইস-কারি জামাইয়ের কদর পাচ্ছে তবে তার আপন বাড়িতে অবস্থাটা কী রকম?

সে এক অভিজ্ঞতা।

লন্ডনের বুকের উপর তবে ঠিক বড় রাস্তায় নয়। ভালোই, হট্টগোল কম। এই আমাদের বড়বাজারে যতখানি। তবে বড় রাস্তায় গোলমাল কত? মুখুজ্যেকে শোধাবেন। সে বেচারি ঘুমুতে পারত না!

ইয়া লম্বা, উর্দি পরা মাথায় পাঠানি পাগড়ি, ছ ফুটি দারোয়ান। যেখানে হ্যাট রেনকোট ছাড়তে হয় সেখানেও তদ্বৎ। ঢুকেই লাউঞ্জ ককটেলটা-আসটা খাবার জন্য; ভাগ্যিস ওটা মুরারজি ভাই চালান না। সাজসজ্জা পুরা ভারতীয়। হেথায় নটরাজের ব্রোঞ্জ, হোথায় পেতলের ভারতীয় অ্যাসট্রে, আরও এটা সেটা, ধূপকাঠিও জ্বলছে।

এগিয়ে এলেন খাপসুরৎ শ্যামাঙ্গী, পরনে মুর্শিদাবাদি, চুলে তেল পড়েছে মেমেদের শনপাটের মতো স্নেহহীন নন– খোঁপাটিও নসিকে বাঙালোরি, ব্লাউজ ব্লাউজেরই কাজ করছে চোলির প্রক্সি দিচ্ছে না– চোখেমুখে খুশি, ভারি চটপটে। একটা নমস্তে ভি পেশ করলে।

বাহ্! এ তো বেড়ে ব্যবস্থা।
গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।
তা হলে উত্তম আহারাদি হবে।

ফরাসি গুণী রশফুকোল বলেছেন, আহার প্রয়োজনীয় বটে; কিন্তু রসিকজনের মতো আহার করা আর্ট। ভোভানার্গ বলেছেন, মহৎ চিন্তা পেটের ভিতর থেকে আসে। গ্রিক দার্শনিক এপিকুর বলেছেন, প্রকৃতিদত্ত বুদ্ধিবৃত্তি উত্তম কর্মে নিযুক্ত করবে এবং সুবুদ্ধিমানের মতো পরিপাটি আহার করবে। এবং ইলেসিয়াসের মাধ্যমে নমস্য বাইবেল গ্রন্থ অনুশাসন দিয়েছেন, পান, আহার ও আনন্দ করার (ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি) চেয়ে মহত্তর কর্ম ত্রিভুবনে নেই।

আর মলিয়ের যখন বলেন, আমরা বাঁচার জন্য খাই; খাওয়ার জন্য বাঁচিনে, তখন তিনি বর্বর জনসুলভ প্রলাপবাক্য ব্যবহার করেছেন। আমরা খাওয়ার জন্য বাঁচি, বাঁচার জন্য খাই না! ভোজনাদি সম্বন্ধে আমি আলোচনা আরম্ভ করলেই কোনও কোনও উন্নাসিক পাঠক বিরক্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, এসব কথা তো আগেও যেন শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। উত্তরে নিবেদন, সব কথা শোনেননি; আর শুনে থাকলেই-বা কী? পুরনো জিনিসের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে নিটশে একদা লিখেছেন, এ কথা আমি পূর্বেই বলেছি, কিন্তু মানুষ শোনা কথাই শুনতে চায়, জানা কথাই বিশ্বাস করে।

একদম খাঁটি কথা। আমাদের মোহর বিবি, কণিকা ব্যানার্জিকে যখন শুধাই, সেই রেকর্ডে দেওয়া তোমার গান ওগো তুমি পঞ্চদশী ফের বেতারে গাইলে কেন? ওটা তো ইচ্ছে করলেই রেকর্ড বাজিয়ে আবার শোনা যায়, তখন সে বলে, কী করব, সৈয়দা লোকে যে পুরনো গানই শুনতে চায়। বুঝলুম, বাচ্চাদের কাছে নতুন গল্প বলতে চাইলে তারা যে রকম চেঁচিয়ে ওঠে, না, মামা কালকের সেই বাঘের গল্পটা বল।

দ্বিতীয়ত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার রচনা বাঙলা দেশে অজরামর হয়ে থাকবে না, আমার রসনির্মাণপ্রচেষ্টা বাণী-সরস্বতীর অঙ্গদে কুন্তলে মাল্যরূপে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে না, কিন্তু এ কথা স্থির-নিশ্চয় জানি, এই বঙ্গসন্তানদের যেদিন কাণ্ডজ্ঞান সম্যক প্রস্ফুরিত হবে, যেদিন তারা ভারতনাট্যম, পিকাসো, সিংহেন্দ্র মাধ্যম কিংবা ভালুকপঞ্চমীর পশ্চাদ্ধাবন কর্ম বর্বরস্য শক্তিক্ষয় বলে সুষ্ঠুরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে সেদিন সে উদমার্গের সন্ধানে নব নব অভিযানের পথে নিষ্ক্রান্ত হবেই হবে। আজ যে রকম চিৎ-জাগরিত বিহঙ্গকাকলির ন্যায় কোনও কোনও বিদ্বজ্জন চৈতন্যচরিতামৃতের ভোজনামৃত খাদ্য-নিঘণ্ট অধ্যয়ন করতে করতে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করেন কিমাশ্চর্য! ছানার সন্দেশের উল্লেখ তো কুত্রাপি নেই?–ঠিক সেইরূপ অম্মদ্দেশে যেদিন রাজত্মে রাজবর্ষে চিৎকার প্রতিধ্বনিত হবে, আমাদের দাবি মানতে হবে। ভোজনা মার্গের-গীতা রচনা কর! ইনকিলাব-জিন্দাবাদ! পেট-কিলাব-ঝাণ্ডা তোল! সেদিন, বলতে লজ্জা করছে, বিনয়ে বাধছে, সেদিন এই অধমের, হ্যাঁ, এই অধমের বইয়ের সন্ধানেই বেরুতে হবে বঙ্গের মামলার মমজেনকে। আফগানিস্তানের সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস নির্মাণে মল্লিখিত দেশে-বিদেশে ব্যবহৃত হবে কি না জানি না, কিন্তু এ বিষয়ে সূচ্যগ্রন সূতিক্ষেণ সন্দেহ নেই যে আজ আমরা যে রকম আমাদের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনার সময় নিরপেক্ষ পর্যটক পরিদর্শক হিউয়েন সাঙের শরণাপন্ন হব, ঠিক সেই রকম ইংলন্ড-সন্তান যেদিন সভ্য হয়ে তার দেশের ভোজনেতিহাস লিপিবদ্ধ করবে সেদিন তাকে বেরোতে হবে– পুনরায় ব্রীড়িত হচ্ছি– এই আমারই বইয়ের সন্ধানে, রাখাল বাঁড়য্যেকে যে রকম মোন-জো-দড়ো সন্ধানে একদা বেরুতে হয়েছিল; আপনাদের রবিঠাকুরের চাঁদ উঠেছিল গগনের সন্ধানে দেশে কেউ আসবে না। রায়গুণাকর অন্নদাশঙ্করের রত্ন ও শ্রীমতীর জন্য তাঁর প্রকাশক মাত্র ইয়োরোপকে চ্যালেঞ্জ করেছে, আমার প্রকাশক বিশ্বভুবনকে ক্রৌঞ্চমুদ্রা প্রদর্শন করবে, কাজী সায়েবের ভাষায় (আল্লা তাঁর বিমারি বরবাদ করে জিন্দেগি দরাজ করুন।) ত্রিভুবনেশ্বরের সিংহাসন নিয়ে আকর্ষণ-বিপ্রকর্ষণ আরম্ভ করবে।

.

সেই রত্নসমা শ্রীমতী তো ফরাসিস পানীয়ের কথা ওঠাতে আরেকবার বিলক্ষণ বলে অন্তর্ধান করলেন; আমি ভাবলুম, ওই য যা। ব্যাকরণে বুঝি গলতি হয়ে গেল। এ যে সম্ভ্রান্ত ভারতীয় ভোজনালয়! এ সব বিদগ্ধ পানীয় বোধহয় এখানে নিষিদ্ধ। আবার বাঙাল বনে গেলুম নাকি?

নাহ! কোনও ভয় নেই। ভাতিজা, চ্যাংড়া মুখুজ্যে ঘটিস্য ঘটি। সে দেখি দিব্য তার টুথব্রাশ গোঁফে আঙুল বুলোতে বুলোতে নিশ্চিন্ত মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে– চোখদুটো যেন ব্লটিং পেপার– সবকিছু শুষে নিচ্ছে। পুরীর সমুদ্রপাড়ে ঢেউ দেখে অবনঠাকুর ভীত হয়ে পালাবার পথ খুঁজছিলেন, তখন তাঁর এক স্যানা বন্ধু তাঁকে বলেন, ভয় কিসের? সায়েব-সুবোরা তো চতুর্দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ তেমন কিছু বিপজ্জনক পরিস্থিতি হলে পুলিশ আগেই তাদের খবর দিতেন, তারাও কাটতেন।

যাক। এদেশে আনকোরা আগত মুখুজ্যে যখন নিশ্চিন্ত তবে আর আমার ভয় কী? তখন কি আর ছাই জানতুম, সে আমারই ভরসায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে।

কিন্তু, সায়েব-সুবোরা তো রয়েছেনই। তেনারা তো পানীয় বেগর ভোজন করতে পারেন না।

এবং সাতিশয় উল্লাসের সঙ্গে লক্ষ করলুম, কোনও ভারতীয় লাউঞ্জে নেই। তারা নিশ্চয়ই মনুনিষিদ্ধ এই পানে লিপ্ত পাপবিদ্ধ হয় না। সোজা ডাইনিংরুমে ভোজন করতে গিয়েছে। তাদের চরিত্রবল দেখে উল্লাস বোধ করলুম।

ওদিকে দেখি শ্রীমতী অন্য খদ্দেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। ভারি বিরক্তিবোধ হল। এ যে দেখি হুবহু বাঙালি দোকানের মতো। আপনাকে জিনিস দেখাতে দেখাতে হঠাৎ অন্য খদ্দের ঢুকছে দেখে দিল ছুট তার দিকে আপনাকে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলিয়ে রেখে, কিংবা যে রকম নির্মল সিদ্ধান্ত জানান যে আপনার পরীক্ষার ফল পরে বেরুবে!

নাহ্। আমারই ভুল। দেখি হেলে-দুলে একটি মোটাসোটা ভারিক্কি ধরনের লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এর গলায় গলাবন্ধ কোটের উপর ঝোলানো মসীকৃষ্ণ উপবীত ও তৎসংলগ্ন কুঞ্চিকা দেখে এর জাতগোত্র বুঝতে আমার কণামাত্র সময় লাগল না। যারা সংস্কৃতে লেখা প্রতিমালক্ষণ সংক্রান্ত অত্যুকৃষ্ট গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করেছেন তারাই জানেন, প্রতিমা দেখে কোনটা কোন দেব না দেবীর জানতে হলে স্মরণ রাখতে হয়, কোন দেবীর দক্ষিণ হস্তে কুবলয় বলয়, কার বাম হস্তে চক্র, কার মস্তকে উষ্ণীষ, কার পদে নূপুর।

কুঞ্চিকাসমন্বিত কৃষ্ণোপবীত ওয়াইন মাস্টারের লক্ষণ।

আপনি যদি চাষাড়ে হুইস্কি বিয়ার রাম জিন্ না খেয়ে উত্তম বিদগ্ধ ফরাসি কিংবা জর্মন অথবা ইতালীয় ওয়াইন খেতে চান তবে এই ভদ্রসন্তান আপনাকে পরম বান্ধবের ন্যায় তাবৎ সন্ধিসুড়ক বাতলে দেবেন। চাণক্য বলেছেন, ব্যসনে (এবং মদ্যপান ব্যসন-বিশেষ) যে সঙ্গে থাকে সে বান্ধব। ইনি তাই করে থাকেন। তবে চাণক্যের বান্ধব আপনাকে কোনওগতিকে ঠেকিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবার চেষ্টা করে; ইনি মোকা পেলে ওস্কাবার চেষ্টা করেন– এই যা তফাৎ।

মৃত্যুঞ্জয় যে রকম কৈলাসে বিহার করেন, রাশান ডিকটেটর যে রকম ক্রেমলিনে বাস করেন, ভেজাল যে রকম খাদ্যে বিরাজ করেন, ওই ওয়াইন মাস্টারটি ঠিক তেমনি বিচরণ করেন অতিশয় পয়লানম্বরি খানদানি ভয়াঙ্কুর রেস্তোরাঁতে। ভয়াঙ্কুর বললুম ইচ্ছে করেই। এখানে অঙ্কুর পর্যন্ত বিনষ্ট হয়। ইনি আপনার সব অপহরণ করেন। পাতলুন বন্ধক দিয়ে বিল্ শোধ করতে হয়।

ভীতকণ্ঠে ভাতিজাকে শুধালুম, ওরে রেস্ত আছে তো?

ভিতরের বুক-পকেটের উপর থাবড়া মারার মুদ্রা দেখিয়ে বললে, কুছ পরোয়া নেই; আপনি চালান।

সোনার চাঁদ ছেলে। একেই বলে বান্ধব। ব্যসনে সঙ্গে থাকে।

এ জীবনে আর যদি কখনও চাকরি নিই তবে উমেদার হব এই ওয়াইন মাস্টারের চাকরির জন্য বেতারের কাজ হয়ে গিয়েছে, সেখানে শুধু খাপসুরৎ কলাবতীর ঝামেলা; তারা আমাকে যথেষ্ট কলচর বলে বিবেচনা করেন না।

খানদানি রেস্তোরাঁর চার ইঞ্চি পুরু মহামূল্যবান ইরানি গালচের উপর মৃদু পদসঞ্চরণ করে কাটবে আপনার জীবন– ভ্রমর যে রকম তঙ্গীর বিশ্বধরে পদক্ষেপ করে ঠিক সেই রকম (বিশ্বাস না হলে কালিদাস পশ্য) একজোড়া চার আউন্স ওজনের ইভনিং শুতে কেটে যাবে ঝাড়া দশটি বছর হাপসোল পর্যন্ত বদলাতে হবে না। এ টেবিলে গিয়ে কাউকে বলবেন, তিপানের নিরেনস্টাইনার- সে একটি স্বপ্ন! ১৯৫৩-এ সেখানকার আঙুর মোলায়েম রৌদ্রে যা রসে টইটম্বুর হয়েছিল, সে রকম ধারা আর কখনও হয়নি। তাই দিয়ে এ সুধা নির্মিত হয়েছে। কখনও-বা অন্য টেবিলে গিয়ে ফিসফিস করবেন, মাদাম, দেখুন, দেখুন এই শ্যাম্পেনের বুদ্বুদ কী রকম লক্ষ লক্ষ পরীর মতো সলোমনের বোতল-বদ্ধ জিনের ন্যায় নিষ্কৃতি পেয়ে লক্ষ লক্ষ হাওয়ার ডানা মেলে উর্ধপানে উড়ে যাচ্ছে। এ বস্তু গলা দিয়ে নাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও ইহলোকের সর্ববন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে নীলাম্বরের মর্মমাঝে উধাও হয়ে যাবেন। তার পর একটু মৃদু হাসি হেসে বলবেন, তাই, মাদাম, এ শ্যাম্পেন যিনি অর্ডার দেন তাঁর কাছ থেকে আমরা আগেভাগেই বিলটা আদায় করে নিই, অবশ্য; আপনাদের বেলা সে কথাই উঠছে না।

এ তো হল। তার পর আপনি ঘড়ি ঘড়ি বারে সেলারে গিয়ে তদারক করবেন, সর্ববস্তু রাজসিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত রয়েছে কি না। রাঁধুনিকে যে রকম সে-সব জিনিস মাঝে মাঝে চেখে দেখতে হয় আপনাকেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে, অতিশয় অনিচ্ছায়–আমাদের বরকর্তারা যে রকম পণ নেন– অল্প-স্বল্প মাঝে-মধ্যে চেখে দেখতে হবে বইকি!

তা-ও হল। ওদিকে আপনাকে প্রতি শরতে ফ্রান্স যেতে হবে, সেখান থেকে নিলামে পানীয় কিনে সেলার পূর্ণ করার জন্য। আপনার কমিশনটা-আসটা ঠেকায় কে? আপনার ভারী ভারী গাহক খদ্দেরের বাড়ির জন্য তাদের প্রাইভেট অর্ডারও সাপ্লাই করবেন। তাতেই-বা কম কী? ওনরা হাত উপুড় করলেই আমাদের পর্বত-প্রমাণ।

আমাদের ওয়াইন মাস্টারটি এসে নমস্তে জানালেন। চমৎকার চেহারা। নেয়াপাতি ভুড়ি, চোখ দুটি জবাকুসুমশঙ্কাসং, যা হওয়ার কথা।

আমি সবিনয়ে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি। ইতোমধ্যে একটা লড়াই হয়ে গিয়েছে। জর্মনরা ফ্রান্স ছাড়ার সময় প্যারিসের নত্র দাম গির্জে সঙ্গে নিয়ে যায়নি বটে, কিন্তু ফ্রান্সের সেলারে সেলারে ঢুকে তার উত্তম-অধম সর্বপানীয় খতম করে যায়। এখন যা ফ্রান্স-ইংলন্ডে পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আপনি পথপ্রদর্শন করুন। তবে এইটুকু বলতে পারি, বর্দো এবং শান্ত।

শান্ত মানে যে বস্তু সোডার মতো বুজবুজ করে না, তেলের মতো শুয়ে থাকে।

চাকুরে যে রকম পেনশনধারীকে খাতির করে, মাস্টার আমাকে সেই রকম কদর করল। আহা, এককালে লোকটা সবকিছু জানত। এখন না হয় আউট অব ডেট! ম্যাক্সমুলার নাকি আমাদের সংস্কৃত শিখে ভশচাযদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, হরিনাথ দে নাকি গ্রিক শিখে গ্রিকদের চিত্তহরণ করেন– এসব শোনা যায়, কিন্তু আমাদের এই পানের প্রভু দেখলুম সত্যিই পেটে এলেম ধরে। দেখলুম হেন পানীয় নেই, যার ঠিকুজিবুলজি তার বিদ্যাচৌহদ্দির বাইরে পড়ে। কবে কোন বৎসরে কোন গায়ের আঙুরে এ জিনিস তৈরি, সে বৎসর আঙুর পাকার সময় সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল না মেঘ ও রৌদ্র, না মোলায়েম মিঠে রোদ্দুরে ছিল, কার চাপযন্ত্রে তার রস বের করা হয়, তাই দিয়ে সবশুদ্ধ ক বোতল তৈরি হয়েছিল, তার কটা গেল মার্কিন মুলুকে কটা এল এ দেশে, এর বডি কী রকম, বুকে (bouquet)-টাই বা রমণীয় কি না– সব-কিছু জিহ্বাগ্রদর্পণে, এবং উভয়ার্থে।

নগণ্য ভারতীয় যে এই বিলিতি বিদ্যে এতখানি হাসিল করেছে তার কাছে মাসমুলারের সংস্কৃতজ্ঞান শিশু।

শুধালুম, ভদ্রে, এ কর্মে কতদিন ধরে আছেন?

সবিনয়ে বললে, আজ্ঞে পঞ্চাশ বছর পূর্বে যখন এ রেস্তোরাঁ খোলা হয় তখন থেকে। সে আমলের আর কেউ নেই।

তবে কি এসব জিনিস খেলে মানুষ দীর্ঘজীবী হয়? অর্থাৎ ওয়াইন– যে বস্তু আঙুরের রস দিয়ে তৈরি হয়েছে; হুইস্কি বিয়ারের কথা উঠছে না।

জানি রসভঙ্গ হবে, তবু হুইস্কি-ওয়াইন কোনও জিনিসই ভালো নয়। অতিশয় শীতের দেশে, কিংবা ডাক্তারের হুকুমে খাওয়া উচিত কি না, সে কথা আমি বলতে পারব না। অতখানি শীতের দেশে আমি কখনও যাইনি বিলেতে গরম দুধ, চা, কফি খেলেই চলে– আর অতখানি অসুস্থও আমি জীবনে কখনও হইনি। মদ্যপান করলে ভালো লেখা বেরোয় এ কথা আমি বিশ্বাস করিনে। মেঘনাদ কাব্য রচনার সময় মাইকেল ক্লান্তি দূর করার জন্য অল্প খেতেন, শেষের দিকে যখন মাত্রা বেড়ে গেল, তখন দু চার পাতা লেখার পরেই বেএক্তেয়ার হয়ে ঢলে পড়তেন– তাঁর গ্রন্থাবলি সে সব অসমাপ্ত লেখায় ভর্তি। এবং তার চেয়েও বড় কথা, আপনি-আমি মাইকেল নই। একখানা মেঘনাদ লিখুন; তার পর না হয় মদ খেয়ে লিভার পচান- কেউ আপত্তি করবে না।

এবং সবচেয়ে মারাত্মক তত্ত্ব শুনেছি কোনও কোনও কলেজের ছোকরার কাছে। বিয়ার নাকি মদ নয়, ওতে নাকি নেশা হয় না, ও বস্তু খেলে নাকি পরীক্ষার পড়া করার সুবিধে!

বটে! বিয়ারে নেশা হয় না? লন্ডন-প্যারিসে রাস্তায় যারা মাতলামো করে তারা কী খায়? কোকা কোলা? অগা আর কারে কয়! ওদের পনেরো আনা বিয়ার খেয়েই মাতাল হয়। আমাকে ওসব বল না; ঠাকুরমাকে ডিম চোষা শেখাতে হবে না।

মূল ফার্সিতে আছে,

গর দস্ত দহজমগজ-ই-গদুম্
নানি,
ওয়াজ ময় দো মনি জু গোসফন্দি
রানি,
ওয়ানগাহ মন্ ওয়া তো নিশতে
দর ওয়েরানি
আয়েশি বোদ আন্ ন্ হ হ।
সুলতানি

এর ইংরেজি–

Here with a loaf of bread
beneath the bough,
A flask of wine, a book of
verse and Thou
Beside me singing in the
Wilderness
And Wilderness is Paradise
enow.

(ফিটসজেরাল্ড)

তার বাংলা—

সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে
শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে
দিনটা যায়।
মৌন ভাঙি তার পাশেতে গুঞ্জে
তব মঞ্জু সুর–
সেই তো, সখী, স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর।– (কান্তি ঘোষ)

কিংবা

বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি
পাই যদি একখানি
পাই যদি এক পাত্র মদিরা আর।
যদি তুমি রানি
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া
গাহো গো মধুর গান
বিজন হইবে স্বর্গে আমার
তৃপ্তি লভিবে প্রাণ। (সত্যেন দত্ত)

যার প্রাণে যা চায় তিনি সেইভাবে অনুবাদ করেছেন। খৈয়ামের খড়বাঁশের কাঠামোর উপর যে যার আপন মানসমূর্তি স্বপ্নপ্রতিমা গড়েছেন; আসলে কিন্তু আছে,

উত্তম ময়দার তৈরি রুটি যদি
হাতে থাকে,
আর যদি থাকে দু মণ মদ এবং
বাচ্চা ভেড়ার আস্ত একখানা ঠ্যাং (রান),
ঘুঘু-চরা পোড়া বাড়িতে কাছাকাছি বসে
তুমি আমি দু জনা।
সে আনন্দ বহু সুলতানেরও ভাগ্যে।
জোটে না।

খৈয়াম এ কবিতায় কবিত্ব করেননি। তিনি সাদামাটা ভাষায় বলেছেন, তার কী কী চাই। মোলায়েম কবিতায় বিলকুল অচল হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভেড়ার একখানা আস্ত ঠ্যাং (রান্ কথাটা আসলে ফারসি এবং তিনি ইটি এ স্থলে নির্ভয়ে ব্যবহার করেছেন) অর্ডার দিয়েছেন এবং পাছে নেশা জমবার আগে মদ ফুরিয়ে যায় তাই পাক্কা দু মণ খাঁটি চেয়েছেন। এবং লক্ষ করার বিষয় তিনি কবিতার বই আদপেই চাননি। যে জিনিস যে পারে সেটা সে চায় না। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে যে দড়ির উপর নাচতে পারে সে প্রিয়াকে নিয়ে বোটানিক্‌সে পিকনিক করতে যাওয়ার সময় ডাণ্ডা-দড়ি বগলে করে নিয়ে যায় না। এবং আসল কথাটা দুই বাঙালি অনুবাদকই ঘুলিয়ে ফেলেছেন। খৈয়াম বলেছেন, যা সব চাইলুম তা পেলে আমি জাহান্নামেও যেতে রাজি আছি; ওরকম জাহান্নাম রাজা-বাদশার কপালেও জোটে না।

যে ইরান-সন্তান চতুষ্পদীটির ফরাসি অনুবাদ করেছেন তিনি মূলতত্ত্বটি ধরতে পেরেছেন বলে খৈয়ামের প্রতি অবিচার করেননি।

Pour celui qui possede un
morceau de bon pain.
Un gigot de mouton, un grand
flacon de vin,
Vivre avec une belle au milieu
des ruines,
Vaut mieux que dun Empire
etre le souverain.   —(এতেসসাম-জাদে)

কিন্তু আমার মূল বক্তব্য এখানে তা নয়।

আমি বলতে চাই, কবিতা বা অন্য কোনও বস্তু অনুবাদ করার সময় এ শুচিবাই কেন? কেন লোকে ধরে নেয় যে কাব্যে ভেড়ার ঠ্যাং চলতে পারে না। ইংরেজ এ শুচিবাই শিখেছে গ্রিকদের কাছে। তাদের ভিনাস মূর্তি দেখে এক সরলা নিগ্রো রমণী শুধিয়েছিল, শরীরের নিচের আধা সম্বন্ধে মেয়েটার অত লজ্জা কেন? ওটা ছালা দিয়ে ঢেকেছে কেন?

যুগে যুগে রুচি বদলায়। অনুবাদ করার সময় যদি আপন যুগের রুচি দিয়ে পূর্ববর্তী যুগের রুচির ওপর সেন্সর চালাই তবে কবির প্রতি তো অবিচার করা হয়ই, পরবর্তী যুগের রসিকজনের প্রতিও অমর্যাদা দেখানো হয়। কোনারকের মন্দির বহু সায়েসুবোর রুচিতে বাধে। তাই বলে আমরা তো আর মূর্তিগুলোর মুণ্ডু বাইরে রেখে বাকি ধড় কম্বল-চাপা দিয়ে রাখিনে।

ওমরের স্মরণে আমি একখানা পুরো রানই অর্ডার করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পরশু রাতের শিক্ষা।

তখন সন্ধে আটটা। দেশের হিসাবে রাত দেড়টা। সবে এদেশে এসেছি; শরীরটা এদেশের টাইমে ধাতস্থ হয়নি। ভাতিজাকে বললুম, বাবাজি, আমি আর বেরুচ্ছিনে। তুমি আলুসেদ্ধ ফেদ্দ কিছু একটা নিয়ে এস–রুটি-মাখন ঘরেই আছে। তাই দিয়ে দিব্য চলে যাবে।

মুখুজ্যে মশাই যখন ফিরে এলেন তখন দেখি তার হাতে এক ঢাউস খলতে বাঙাল দেশে বলে ঢোঙ্কা।

মিনির মতো সরল চিত্তে শুধালুম, এর ভিতর কী, হাতি?

বললে, সব্বনাশ হয়েছে, স্যার।

এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুখুজ্যের সব্বনাশটা খাস কলকাত্তাই। মোকামে পৌঁছে যখন দেখলে তার বহু পয়সার মাল শান্তিনিকেতনের একটা ডকুমেন্টরি ফিলম বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে, তখন টুথব্রাশমুস্টাসে হাত বুলিয়ে বলে, যাকগে, আবার যখন পাতলুনের পকেট খুঁজে পায় না তখন বলে, সব্বনাশ হয়েছে।

আমি তার সব্বনাশে বিলক্ষণ অভ্যস্ত বলে হাই তুলতে তুলতে নিশ্চিন্ত মনে শুধালুম, কী সব্বনাশ হয়েছে। দেশলাই খুঁজে পাচ্ছ না?

কী করে জানব বলুন এদেশে মুরগির সাইজ হয় দেশের খাসির? আপনি তো আলুসেদ্ধ চেয়েছিলেন রেস্তোরাঁওলা বললে, কাবার। আমি বললুম, আলুসেদ্ধ নেই তো নেই চিকেনসেদ্ধ দাও। ভাগ্যিস হাফ-এ-চিকেন বলেছিলুম, তাই রক্ষে। দেখুন।

সেই চিকেন আমরা দুই পুরুষ্ট পাঠায় দেড় বেলায় শেষ করি!

তারই স্মরণে অতখানি অর্ডার না করে যৎসামান্যের হুকুম দিলুম।

চতুর্দিক তাকিয়ে দেখি, সবাই গোরার পাল। একটিমাত্র ভারতীয়ও নেই। মেনুর দিকে নজর যেতেই কারণটা বুঝতে পারলুম। এক-একটি পদের যা দাম তাই দিয়ে যে কোনও লন্ডনবাসী ভারতীয় ছাত্রের আড়াইখানা পুরো লাঞ্চ হয়! মুদ্রার মতো পিসটন না থাকলে এরা এখানে আসতে পারে না।

বিলেতফের্তা বাঙালিদের নিয়ে দেশে বহু আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এককালে এদের অনেকেই আর দিশি ডালভাত ধুতি-চাদরে ফিরতেন না। তার পর বিশেষ করে চিত্তরঞ্জন দাস যে ভেল্কিবাজি দেখালেন তা দেখে আর বিলিতিয়ানা করার সাহস অল্প সায়েবেরই রইল। কিন্তু যেসব ইংরেজ এদেশে বহু বছর কাটিয়ে বিলেত ফিরে যায় তাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে শুনেছি, ড্রাইভার রাখার মতো পয়সা ছিল না বলে লর্ড রোনালড়শেকে ট্রামে-বাসে দেখা যেত। এদের সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো লিখেছেন উডহাইস। তার ধারণা এদের মাথায় ছিট ধরে। কেউ কেউ নাকি ডিনার আরম্ভ করে পুডিং দিয়ে ও শেষ করে সুপ দিয়ে!

তবে একথা বিলক্ষণ জানি এদেশ থেকে তারা দুটো অভ্যাস নিয়ে যায়। স্নান করা ও মশলাদার খাদ্য খাওয়া। এই যে আজ ইংল্যান্ড-জর্মানিতে বাথরুমের ছড়াছড়ি না হোক, ব্যবস্থাটা অন্তত আছে (জর্মনিতে মনিসিপালিটির আইন হয়েছে, কটা শোবার ঘর হলে কটা বাথরুম অবশ্য তৈরি করতে হবে) তার প্রধান বাহক চা-বাগানের ইংরেজ। আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা, তার সময়ে অর্থাৎ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত অক্সফোর্ডে নাকি মাত্র দুটি বাথরুম ছিল। তাই নিয়ে এক বাগিচার সায়েবের ছেলে কর্তৃপক্ষকে ফরিয়াদ জানালে তাঁদের একজন বলেন, তোমরা তো এখানে একনাগাড়ে থাক ছ হপ্তা (তখন বোধহয় এক টার্ম বলতে ওই সময়ই বোঝাত); ছুটিতে বাড়ি ফিরে চান করলেই পার।

অর্থাৎ ছ সপ্তাহে একটা স্নানই ইংরেজ বাচ্চার জন্য যথেষ্ট। ধেড়েদের জন্য বোধহয় ছ বছরে একটা! ফরাসিরা তো শুনেছি চান করে নদীতে আত্মহত্যা করার সময়।

কেন? তারা তাদের কলোনি ইন্দোচীনে চান করতে শিখল না কেন?– এখনও তো ফ্রান্সের চৌদ্দ আনা বাড়িতে চানের ঘর নেই। বলতে পারব না। তবে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের কাছে শুনেছি, তিনি চীন দেশের বিরাট নদী দিয়ে জাহাজে করে গিয়েছেন কিন্তু কোনও চীনাকে নদীর জলে স্নান করতে দেখেননি।

আর এদেশের মশলামাখা রান্না খেয়ে ইংরেজের স্বভাব এমন বিগড়ে যায় যে, দেশে ফিরে তাকে যেতে হয় ভারতীয় রেস্তোরাঁতে। এদের পয়সাও প্রচুর; তাই বোধহয় খাস করে এদেরই জন্য এই তালু-পোড়া দামের রেস্তোরাঁ!

ইংরেজের যে কটি প্যারা স–যথা উস্টার, এইচ বি– এগুলো নাকি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষেই তৈরি হয়েছিল। এগুলো বানাতে যেসব মশলার প্রয়োজন হয়, সেগুলো যে ইয়োরোপে গজায়

সেকথা ভালো করেই জানি। এমনকি আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে যেসব তরকারি গজায় সেগুলো আপন দেশে গজাতে পারে না বলে সাউথ অ্যামেরিকা থেকে আনিয়ে খায়। ঠিক বলতে পারব না, তবে বেগুন খেতে শিখেছে বোধহয় মাত্র ত্রিশ বৎসর।

আবার বলছি, সব তত্ত্বের মাহাত্ম আমার বহু পাঠক দেবেন না। কিন্তু আমি সাধারণ জিনিসের খেই ধরে তত্ত্বচিন্তা করতে ভালোবাসি। যেমন ইংরেজ বেগুন খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু সেটা খায় সেদ্ধ করে যতদূর সম্ভব বিস্বাদ বানিয়ে। বেগুন-পোড়া যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিণতি, সে তত্ত্ব এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। ঠিক তেমনি মার্কিন জাত রেড ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে মুড়ি খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু তেল পেঁয়াজকুচি (পাপরভাজা বাদ দিন) দিয়ে খেতে শেখেনি।

আমি শুধু ভাবি ওসব সামান্য জিনিস আবিষ্কার করতে মানুষের কত শত বৎসর লাগে।

ফার্পোতে যখন কেউ বাঁ হাতে ছুরি নেয় তখন তার কামেল বন্ধুরা ফিসফিস্ করে ভুল বাৎলে দেয়। এখানে দেখি উল্ট-পুরাণ। পোলাও খেয়ে যাচ্ছে তো খেয়েই যাচ্ছে। মাংসের কারিটা পাশে পড়ে আছে। মেশাবার কথা মাথায় আসেনি। কাবাব খাচ্ছে তো খাচ্ছেই– পাশে চাপাতি পড়ে পড়ে জুড়িয়ে হিম হয়ে গেল। ওকিব-হালরা তখন ফিসফিস করে অ্যামেচারদের তালিম দিয়ে দুরস্ত করার চেষ্টা করছেন।

এইবারে রসভঙ্গ করতে হল। আর চেপে রাখতে পারলুম না।

রান্না পছন্দ হল না।

মাদ্রাজি মশলা দিয়ে মোগলাই খানা এই আমি প্রথম খেলুম। এ যে সিমেন্ট দিয়ে তাজমহল বানানো, কিংবা মাইকেলি অমিত্রাক্ষরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, অথবা মাদ্রাজি মোগলাই মালমশলাই থাক– দক্ষিণের রাজগোপাল-আচারীকে উত্তরের চোগা চাকি না পরানো।

কিন্তু তবু খেতে খুব মন্দ না। এত হাড্ডিসার মুরগি ভেজাল দালা দিয়ে রান্না নয়। মুরগিটা যেন চর্বিওলা খাসি আর যে মাখন দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটা এদেশে সত্যযুগে পাওয়া যেত। দেশে থাকতে আমি তো একবার প্রস্তাব করেছিলুম, কোনওগতিকে একটুখানি খাঁটি গাওয়া ঘি যোগাড় করে মিউজিয়ামে রাখার জন্য যাতে করে ভবিষ্যদ্বংশীয়রা জানতে পারে এককালে বাঙলা দেশের লোক কী খেত।

তখন প্রায় রাত দুপুর। রাস্তায় বেরিয়ে পিকাডেলি। সচরাচর যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ব্যবসা বলা হয়, তার সঙ্গে সেখানে মুখোমুখি মোলাকাত।

এ ব্যবসা সম্বন্ধে লিখব কি না মন স্থির করতে পারছিনে।

.

শ্যামবাজারের মামা নাকি হেদো না পেরিয়ে দু বছরে তিন লাখ টাকা খুঁকে দেওয়ার পর বিলেতগামী ভাগনেকে সদুপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাবি বাবা, সেই জল, সেই ঘাস, সেই গাছ। ওগুলো দেখবার জন্য আবার বিদেশ যাবি কেন?

আমাদের গ্রামের ভিতর যখন প্রথম ইঞ্জিন এসে রাতের বাসা বাঁধল, তখন ছেলেবুড়ো সবাই হদ্দমুদ্দ হয়ে সেই কলের গাড়ি দেখতে গেল। ফিরে এসে সবাই যখন ইঞ্জিনের প্রশংসায় অষ্টপ্রহর পঞ্চমুখ তখন মুরুব্বি কলিমুল্লা বলেছিলেন, যা বল যা কও, উই আমাদের আগুন উই আমাদের জল ছাড়া বাবুদের চলে না। আকাষ্টা পবনের নৌকোই বানাও, আর চিল্লীমারা ইঞ্জিলই বানাও সেই আগুন, সেই জল।

এ তো সাধারণ লোকের কথা। স্বয়ং বাইবেল বলেছেন, সেই ঋষির মুখ দিয়েই, যিনি ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি হতে সদুপদেশ দিয়েছেন, যা ছিল তাই হবে, যা করা হয়ে গিয়েছে তা আবার করা হবে; এ সংসারে নতুন কিছু নেই।

বেশিরভাগ লোক দেশভ্রমণে যায় নতুন কিছু দেখবার জন্য। এবং গিয়ে দেখে সেই জল, সেই ঘাস। আবার অন্য অনেক লোক বিদেশে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেশের সন্ধানে লেগে যায়। প্যারিস গিয়ে খবর নেয়, সেখানে আপন দেশের কেউ আছে কি না। তাকে খুঁজে বের করে শুধায়, রাইস-কারি কোথায় পাওয়া যায়? সেই খেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতে বেরুতে বলে, চলো, দাদা, চট করে মোড়ের যদুর দোকান হয়ে যাই।– পাড়ার যদুর পান বিখ্যাত।

আমি দেশভ্রমণে উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই দেখতে পাই বেশি। সে বিষয়ে অন্যত্র সবিস্তর আলোচনা করেছি। তবে এ বাবদে বলতে পারি, ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সবকিছু পুরনো হলেও নতুন। বিলেতের ঘাস ঘাস, কিন্তু সে ঘাস আমাদের ঘাসের মতো ঘন সবুজ নয়, একটুখানি ফিকে, কেমন যেন হলদে ভাগটা বেশি। গাছপালার তো কথাই নেই। জলের স্বাদও অন্যরকম। একমাত্র আগুনে আগুনে কোনও পার্থক্য দেখিনি। তাই বোধহয় পৃথিবীতে অগ্নি-উপাসকের সংখ্যা এখনও প্রচুর।

সেটা অবশ্য প্রথম যৌবনের প্রথম সফরে লক্ষ করিনি।

প্রথমবারের কথা বলছি।

একটানা জর্মনিতে থাকার পর অচেনা জিনিস দেখে দেখে যখন মন ক্লান্ত তখন গিয়েছি নেপলসে– জাহাজে করে দেশে ফিরব বলে। জাহাজ লেট। দু দিনের তরে সেই নির্বান্ধব বন্দরে আটকা পড়ে গেলুম। নিতান্ত কোনও কিছু করবার ছিল না বলে গেলুম পম্পেই দেখতে (এ স্থলে কিঞ্চিৎ অবান্তর এবং নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও বলি, আমি স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কখনও বাড়ি থেকে বেরুইনি– বেরিয়েছি প্রয়োজনের তাগিদে। মাত্র একবার আমি কাইরো থেকে স্বেচ্ছায় পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন দেখতে গিয়েছিলুম। সেখানে ইহুদি খ্রিস্টান ও মুসলমানের সঙ্গম। ধর্মচর্চাতে আচরণে নয় আমার চিরকালের শখ)।

পম্পেই মধ্য কিংবা দক্ষিণ ইতালিতেও বলতে পারেন। আবহাওয়া একটুখানি গরম।

পম্পেই টিলার নিচে বাস থামতে হঠাৎ দেখি সামনে একবন করবী গাছ।

ওহ্! সে কী আনন্দ হয়েছিল! এ-জীবনে প্রথম যে গাছ চিনতে শিখি সেটি করবী। আমাদের দেশে বলে ঘণ্টাফুল। মা আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল। তার পর যখন তিনখানা বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন চাচা বললেন, করবী আর কবরীতে যেন গোবলেট না পাকাই। তার পর নিজের থেকেই শিখলুম, করবী পাঁচ রকমের হয়;– শ্বেত, পীত, রক্ত, কৃষ্ণ এবং পাটল– কৃষ্ণকরবী এখনও দেখিনি। সর্বশেষে শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনলাম যক্ষপুরী। পরে তার নাম হল রক্তকরবী। এখন শিখলুম, ইতালির ভাষাতে ওলে-আন্দ্রো।

এ ফুলটি তাই কত স্মৃতি-বিস্মৃতিতে বিজড়িত। বিস্মৃতি বলার কারণ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলুম, ছেলেবেলায় নানুরে চণ্ডীদাসের ভিটে দেখতে গিয়ে পেলুম ডাকবাংলোর একপাশে অজস্র করবীগাছ– এই শুকনো খোয়াই-ডাঙার দেশ বীরভূমে।

কিন্তু করবীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের দীর্ঘ ফিরিস্তিতে কার কোন কৌতূহল? কৌতূহল তখনই হয় যখন কেউ সেই পম্পেইতে হঠাৎ দেখা করবীকে নৈর্ব্যক্তিক স্তরে তুলে রস স্বরূপে প্রকাশ করতে পারে। যেমন রবীন্দ্রনাথ দেশে বসেই গাইলেন,

আবেশ লাগে বনে
শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে–

সঙ্গে সঙ্গে রসের মাধ্যমে করবী এসে আমাদের হৃদয় দখল করে বসে। সার্থক ভ্রমণকাহিনী-লেখক তাই নতুন পুরাতন উভয় অভিজ্ঞতাকে সমাহিত চিত্তে স্মরণ করে রসম্বরূপ প্রকাশ করেন। ভ্রমণ উপলক্ষ মাত্র।

কিংবা হয়তো তথ্য পরিবেশন করেন। সেটা যদি রসরূপে প্রকাশিত হয়, তবে আরও ভালো। কিন্তু রস নেই, এবং তদুপরি যদি সে তথ্য কারও কোনও কাজে না লাগে তবে সেটা বলে কী লাভ আমি ঠিক বুঝতে পারিনে। কাবুলের অনৈসর্গিক যৌন সম্পর্কের কাহিনী এদেশে কেউ কেউ শুনেছেন, সেখানে অল্পবিস্তর গণিকাবৃত্তিও আছে, কিন্তু সেসব তথ্য কারও কোনও কাজে লাগবে বলে আমার মনে হয়নি। এই নিয়ে আমার চারবার ইউরোপ যাওয়া হয়। গণিকাবৃত্তি চোখে পড়ার কথা। এ নিয়ে সে দেশের ছাত্রসমাজে নানা আলোচনাও হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা আইন ও ডাক্তারি পড়ে। সেগুলো অনেক সময় শুনতে হয়। সতীর্থরা হয়তো-বা জিগ্যেস করে বসে, তোমাদের দেশে কী রকম?

তবু এ সম্বন্ধে আমি কোনও কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যার পর হয়তো অল্পকিছু বলার সময় এসেছে।

গত বৎসর হঠাৎ খবর এল সরকার সোনাগাছির (কথাটা আসলে সোনাগাজী হুতোমে আছে) গণিকাদের প্রতি আদেশ করেছেন, তারা যেন ওপাড়া ছেড়ে চলে যায়।

তা হলে প্রথম প্রশ্ন, তারা যাবে কোথায়? তারা যদি দ্রপাড়াতে একজন কিংবা দু জনে মিলে ঘর ভাড়া নেয়, তবে সরকার কোন আইনে তাদের ধরবেন, কিংবা যে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকার কোনও মোকদ্দমা আনবেন কি না, এসব কথা খবরের কাগজে ভালো করে বেরোয়নি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এরা উদ্বাস্তু হয়ে বেশি ভাড়া দিতে রাজি হবে, এবং কলকাতাতেও লোভী বাড়িওলার অভাব নেই। প্রায় ঠিক এই ধরনের একটা ব্যাপার ঘটে কিছুদিন পূর্বে দিল্লি শহরে। সরকার আইন করে রেস্তোরাঁ এবং মদের দোকানে মদ, অর্থাৎ প্রকাশ্যে মদ্যপান বারণ করে দিলেন, কিন্তু দোকানে মদ কিনে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া নিষিদ্ধ করলেন না। ফলে যে পাপকর্ম সে বাইরে করত, পুত্রকন্যা জানতে পারত না, সেইটে অনেক বাড়ির ভিতরে আরম্ভ হয়ে গেল। ফলে পুত্র এবং কোনও কোনও স্থলে কন্যা যদি মদ খেতে শেখে, তবে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। আমি সমাজসংস্কারক নই তবু তখন কাগজে লিখেছিলুম, মদ্যপান এদেশে এখনও এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি যার জন্য জুজুর ভয় দেখাতে হবে। আসল প্রয়োজন, যেন নতুন কনভার্ট না হয়, অর্থাৎ আজকের ছেলে-ছোকরারা যেন মদ খেতে না শেখে। যে রকম আফিঙের বেলায় নতুন পারমিট না দেওয়ার ফলে আসাম থেকে আফিঙ খাওয়া উঠে যাচ্ছে। দোকানে মদ না খেতে পেয়ে কর্তা যদি বাড়িতে মদ খেতে আরম্ভ করেন, তবে তো কনভার্টের সংখ্যা বাড়বে! এ বাবদে বিধানবাবু সাউথ ক্লাব থেকে মদ তুলে দিয়ে অতি উত্তম কর্ম করেছেন। ছেলে-ছোকরারা সেখানে যেত টেনিস খেলতে। বারে যেত শরবৎ খেতে। শরবৎ থেকে শরাব প্রয়াণ কঠিন কর্ম নয়– দুটো শব্দই আরবি শারাবা = পান করা থেকে এসেছে।

এসব অবান্তর নয়। সরকার যদি মনে করে থাকেন যে, সোনাগাছি-বাসিন্দাদের ভিটেছাড়া করতে পারলেই সর্ব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তবে তাঁরা মারাত্মক ভুল করছেন। ভদ্র গৃহস্থ উদ্বাস্তুদের নিয়েই আমরা কী রকম হিমসিম খাচ্ছি সেটা শেয়ালদাতে নেমেও স্পষ্ট বোঝা যায়। এত সহজে এ সমস্যার সমাধান হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, দীর্ঘতম পন্থা অনুসরণ করলেই স্বল্পতম সময়ে পৌঁছান যায়। এটা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না বলা কঠিন, কারণ গোল্ডেন রুল ইজ দ্যাট দেয়ার ইজ নো গোল্ডেন রুল, কিন্তু সচরাচর যে ব্যবসাকে সংসারের প্রাচীনতম ব্যবসা বলে বহু পণ্ডিত স্বীকার করে নিয়েছেন তার ওষুধ একটি বাড়িতেই হয়ে যাবে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

আসলে আমরা বিলেতের অনুকরণ করছি। বিলেত ব্রথেল বা গণিকালয় তুলে দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। ফলে লন্ডনের গণিকারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ছড়ায়নি। বোঝা গেল, ওষুধ না ধরাতেই আমরা উপকৃত হয়েছি বেশি।

এ স্থলে একটি কথা না বললে কলকাতার প্রতি অবিচার করা হবে।

কলকাতার আপনজন না হয়েও আমি তার শত দোষ স্বীকার করি। কলকাতার শিশুরা সস্তায় খাঁটি দুধ পায় না, রোগীরা হাসপাতালে স্থান পায় না, ওষুধ কালোবাজারে ঢুকেছে, ভেজালের অন্ত নেই, এরকম অবর্ণনীয় নোংরা শহর ত্রিভুবনে নেই, ট্রাম-বাসে পায়লোয়ানরাই শুধু উঠতে পারে, শেয়ালদা-হাওড়াতে ট্রেন যা লেট হয়, তা-ও পানচুয়ালি হয় না– অবস্থা অবর্ণনীয়।

কিন্তু এই যে কলকাতা শহরে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত– এত বেশি পুরুষ এবং এত কম মেয়ে– অনুপাত পৃথিবীর কোনও বড় শহরই দেখাতে পারবে না। এটা কিছু গর্বের বিষয় নয়, কিন্তু আমি বিদেশ থেকে ফিরে বার বার গর্ব অনুভব করেছি যে, এ শহরের লোক যৌনক্ষুধা সম্বন্ধে কতখানি অচেতন, কিংবা তারা সুযোগ পায়নি, সেটা কেন তৈরি করেনি, তা জানিনে।

ইয়োরোপে যখনই যুদ্ধের ফলে বা কোনও কারণে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় এবং বিদেশি সৈন্যের মিত্র বা শত্রুভাবে আগমন হয়, সঙ্গে সঙ্গে জারজ সন্তানের সংখ্যা যে কী অসম্ভব রকম বেড়ে যায়, তা দেখে সমাজসেবীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এবারে সে সংখ্যা এমনই হিসাবের বাইরে চলে গেল যে শেষটায় পাদ্রিসায়েবরাই প্রস্তাব করলেন জারজ শিশুদের যেন সমাজ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠান আইনত ন্যায্য বলে স্বীকার করে নেয়।

শান্তির সময়েও এরকম ধারা হয়। উত্তর ইয়োরোপের কোনও একটি দেশে অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় দেখা গেল বহু পুরুষ একটি স্ত্রী এবং একটি করে রক্ষিতা পুষছে। রক্ষিতা বলা ভুল, কারণ এ রমণী ভদ্রঘরের মেয়ে, বেশ্যাবৃত্তি কখনও করেনি, তার প্রতিপালকের সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, তার পুত্রকন্যা আছে, সমাজে সে অপমানিতা নয়। অনেক স্থলে তার আসল স্ত্রী এ রমণীর খবর জানেন, এবং কোনও কোনও স্থলে পালা-পরবে দুই পরিবার একত্র হয়ে আনন্দোল্লাস করেন। বস্তুত আমাদের দেশে কোনও পুরুষের যদি দুই স্ত্রী থাকে এবং তারা যদি ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে থাকে তা হলে সচরাচর হয়ে থাকে।

কোনও কোনও বুদ্ধিমান সমাজসেবী তাই প্রস্তাব করেছেন, এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার চেয়ে ঢের ভালো নয়, এইসব লোকদের আইনত দুটি বিয়ে করার অধিকার দেওয়া। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে এক স্ত্রীর জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ বেআইনি– তাকে তালাক না দিয়ে। ক্যাথলিক ধর্মে আবার ঠিক তালাকের ব্যবস্থাও নেই সেখানে প্রমাণ করতে হয়, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি থাকায় বিয়েটা আদপেই হয়নি। ধর্মের অনুশাসন এড়াবার জন্যে কেউ কেউ তার সুবিধে নিয়ে থাকেন।

অথচ ইয়োরোপে আমাদের বদনামের অন্ত নেই– আমরা বহুবিবাহে বিশ্বাস করি, আমরা হারেম পুষি।

দুশমন সকলেরই থাকে। খ্রিস্টের ছিল, সাতেসের ছিল। আমাদেরও আছে। ইয়োরোপেও আছে।

তাদেরই কেউ কেউ আপনাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে পাঁচজনের সামনে শুধাবে, আপনাদের দেশে বহুবিবাহ প্রচলিত আছে– না?

আমি কোথায় না লজ্জা পাব, উল্টো একগাল হাসি। যেন বঙ্গ দু কান কাটা। বলি, বিলক্ষণ! একটা, দুটো, চারটে মুসলমান হলে– যত খুশি। আর হিন্দু হলে তো কথাই নেই। এক মুখুয্যের ছিল আটশো বাড়য্যের ছ শো, চাটুয্যের চারশো, বেচারি গাঙ্গুলির মাত্র আশি– ঘোষালের ফর্দটা জানা নেই। কায়েতরা অতখানি না, তবে তাঁরাও ছেড়ে কথা কননি। বার্নার্ড শ এ-ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

তার পর হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলি, এ ব্যবস্থা অতি অল্পকাল স্থায়ী ছিল। আসলে ভারতের শতকরা নিরানব্বইজন লোক একটিমাত্র স্ত্রীলোকের সংস্পর্শে আসে। যদিও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অধিকার আইনত তার ষোল আনা আছে।

তার পর ধীরে ধীরে রসকষহীন অতি শুকনো গলায় বলি, এবারে আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনাদের দেশে কজন লোক একদারনিষ্ঠ হয়ে, অর্থাৎ বিবাহের পূর্বে বা পরে অন্য কোনও কুমারী বা বিবাহিতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না এসে জীবন কাটায়? যদিও একাধিক স্ত্রীগমনের অধিকার আইনত আপনাদের নেই।

.

যেন ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজের নিচে দিয়ে যাচ্ছি। এই বিশাল উন্নতশির দেউড়ি যেন স্থপতি ইচ্ছে করেই এমনভাবে বানিয়েছেন যে, নিচে দিয়ে যাবার সময় মানুষ বুঝতে পারে সে কত নগণ্য।

কেনসিংটন গার্ডেনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। গাছগুলো এমনি বিরাট, এমনি উঁচু যে, যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বুলন্দ দরওয়াজার কথা। সেখানেও শীতের প্রভাতে কাঁপতে কাঁপতে ঢুকেছিলাম; এখানেও হেমন্তের শীতে জবুথবু হয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি।

আকাশে একরত্তি মেঘ নেই, বাতাসে এক ফোঁটা হিম নেই–সূর্যদেব তাঁর ভাণ্ডার উজাড় করে স্বর্ণরৌদ্র ঢেলে দিয়েছেন কিন্তু শীতের দাপট কমাতে পারেননি। পার্ক থেকেই দেখতে পাচ্ছি, বয়স্করা ওভারকোট পরেছে। কাল বৃষ্টি নেমেছিল– তখন জওয়ানরা পর্যন্ত কাঁধ কুঁচিয়ে, মাথা নিচু করে, হ্যাট সামনের দিকে নামিয়ে দিয়ে হনহন করে চলেছিল গায়ের গরম বাড়াবার জন্য। মেয়েরা কী করে হাঁটু পর্যন্ত ওইটুকু সিল্কের মোজা পরে শীত ভাঙায় সে এক সমস্যা। প্যারিসে দেখেছি, পেভমেন্টে যারা পুরনো বই বিক্রি করে তাদের কোনওপ্রকারের আশ্রয় নেই বলে দোকানের সামনে ঘন ঘন পায়চারি করে, আর দুই বাহু প্রসারিত, ডান হাত শরীরের বাঁ দিকে আর বাঁ হাত ডান দিকে থাবড়ায়। মাঝে মাঝে হাতের তেলো গরম করার জন্য দু হাত আঁজলা করে মুখ দিয়ে জোর ফুঁ দেয়।

কাল রাতের বৃষ্টি না আজ ভোরের হিমে গাছের পাতা সব ভেজা। সেগুনকাঠের পাতার মতো তারা ওজনে ভারী– সারা গ্রীষ্মকাল রোদ আর জল খেয়ে খেয়ে তারা যেন পেটের অসুখ করে কেউ হলদে, কেউ ফিকে, কেউ-বা কালো হয়ে গিয়েছে। আর কেউ টকটকে লাল শুনেছি, ঠিক মরার সময় কোনও কোনও মানুষের সব রক্ত এসে মুখে জড়ো হয়। টুপ করে কখনও এক ফোঁটা জল এসে নাকের উপর পড়ে, কখনও-বা হাতের উপর। কী ঠাণ্ডা। সঙ্গে সঙ্গে অতি নিঃশব্দে দুটি লাল পাতা।

দু দিকে সবুজ ঘাসের লন। ঠিক সবুজ বলা চলে না। নীলের ভাগটা কম, হলদেটাই বেশি। এখন না হয় হেমন্তের প্রথম শীতে তারা ফিকে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ভরগ্রীষ্মকালেও আমি ইউরোপে কখনও দেশের কালো-সবুজ দেখিনি। আর ঘাসগুলোই-বা কী অভদ্র রকমের লম্বা আর মোটা! একে তো তাদের যত্ন নেওয়া হয় প্রচুর তার ওপর বোধহয় এদের মাড়িয়ে পায়চারি করা বারণ বলে কী রকম উদ্ধতভাবে মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। এরাও ভেজা। গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে না। দেশে শীতের সকালে নৌকো দিয়ে যাবার সময় যে রকম ভিজে শাপলাপাতায় হাত দিতে গা কিরকির করে।

দু দিকে সবুজ লনের মাঝখানে কালো পিচের রাস্তা। ছোট্ট, এক ফালি। এঁকেবেঁকে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে চলে গিয়েছে বিরাট হাইড-পার্কে, বাঁ দিকে গিয়েছে এ বাগানেরই গোলদিঘির দিকে। সেই ফালি রাস্তাটুকু আবার নিয়েছে নানা রঙের মোজায়িক, কেটেছে ঝরা পাতার আলপনা। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য আলপনা এরকমের থাকে না। মুখে পাইপ, হলদে গোঁফওলা বুড়ো মালী এসে ঝাঁট দিয়ে সাফ করে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাসে আরেক প্রস্থ রঙিন পাতা ঝরে পড়ে আবার নতুন আলপনা আঁকা হয়।

বেলা এগারোটা। সমস্ত পার্কে মেরে কেটে দশ-বারো জন লোক হয় কি না হয়। শুনেছি আরও সকালে, ছুটির দিনে এবং গ্রীষ্মকালে বেশি ভিড় হয়। লন্ডন শহরের লোক যে কাজ করে, ছুটির দিন ছাড়া আলসেমি করে না, এ তত্ত্বটা এদের ফাঁকা পার্ক দেখলেই বোঝা যায়। ইতালিতে অন্য ব্যবস্থা। তাদের পার্ক সবসময়েই ভর্তি– অবশ্য সে দেশে টুরিস্টও যায় বেশি এবং তাদের পাবও সবসময়েই গুলজার। সকাল দশটাই হোক আর বিকেল চারটাই হোক– জোয়ান মদ্দেরা কাজকর্ম ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সস্তা লাল মদ খায় আর ব্যাক্-গ্যাম খেলে। এ খেলাটা আমি দেশে কখনও দেখিনি, অথচ ভূমধ্যসাগরের পাড়ে পাড়ে, ইতালি গ্রিস তুর্কি লেবানন প্যালেস্টাইন মিশর সর্বত্র প্রচলিত। তাই বোধহয় এরা কেউ দাবা খেলাতে নাম কিনতে পারেনি।

ব্যাক-গ্যামনের সুবাদে একটা কথা বলে নিই। মিশরে ওই খেলাতে পয়েন্ট গোনা হয় ফারসিতে– আরবিতে নয়। আমরা যে রকম টেনিস খেলার সময় থার্টি ফর্টি, লাভ ফিফটিন, থার্টি অল বলি– ত্রিশ-চল্লিশ,, ভালোবাসার পনেরো বা ত্রিশ সমস্ত বলিনে। ফারসিতে নম্বর গোনা থেকে বোঝা যায় খেলাটা আসলে ইরান থেকে মিশরে গিয়েছে। ঠিক তেমনি বাঙলা দেশের একাধিক গ্রাম্য খেলাতে দেখেছি, নম্বর গোনা হয় কিছু জানা-কিছু অজানা ভাষায় পুরোপুরি বাংলায় নয়। এগুলো তবে কোন ভাষা থেকে এসেছে। আমার বিশ্বাস, সত্যকার রিসার্চ করলে তার থেকে বেরুবে আর্যরা বাঙলা দেশে এসে কোন জাতি-উপজাতির সংস্পর্শে এসেছিল। অনেক পণ্ডিত বলেন, সিঁথির সিঁদুর আমরা সাঁওতালদের কাছ থেকে নিয়েছি। আমার বিশ্বাস, খেলার নম্বরের অনুসন্ধান করলে আরও বেশি তথ্য এবং তত্ত্ব বেরুবে। মমগ্রজ গ্রামের অবাংলা নাম নিয়ে বহু বত্সর খেটে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন আর্যভাষীরা কোন কোন উপজাতির সংস্রবে এসেছিল। তার ওসব লেখা কেউ পড়ে না। গবেষণা বলতে বাঙলা দেশে বোঝায়, তিনখানা বই পড়ে চতুর্থ বই লেখা। অর্থাৎ একখানা বই থেকে গা-মারা চুরি; তিনখানা বই থেকে চুরি-করা গবেষণা।

বেশি হাঁটাহাঁটি করলে পাছে ভগবান আসছে জন্মে ডাকহরকরা বানিয়ে দেয় তাই গোলদিঘির কাছে এসে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লুম। পুকুরের জল স্বচ্ছ কালো। চতুর্দিকে অনেকখানি ভোলা বলে জোর বাতাস শুকনো পাতা পুকুরের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে নিজেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে এক পাড়ে জড়ো করছে। মালী সেখানে দাঁড়িয়ে লম্বা আঁকশি দিয়ে টেনে এনে পুকুর সাফ রাখছে। একপাল পাতিহাঁস ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে। বাতাস হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে, স্বচ্ছ কালো জলের দিকে তাকিয়ে সে শীত যেন তার চরমে পৌঁছচ্ছে আর আহাম্মুকের মতো ভাবছি, হাঁসগুলো ওই হিমে থাকে কী করে? উত্তর সরল; হিমালয়ের সরোবরে যখন থাকতে পারে তখন এখানেই-বা থাকতে পারবে না কেন? কিন্তু চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।

হঠাৎ একটা ধেড়ে রাজহাঁস বিরাট দুটো পাখা এলোপাতাড়ি থাবড়াথাবড়ি করে পড়ি পড়ি হয়ে হয়ে ধপ করে নামল পাতিগুলোর মাঝখানে। তারা ভয় পেয়ে প্যাক প্যাক। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কী দরকার ছিল এদের এই শান্তিভঙ্গ করার? রাজহাঁসটা ভেবেছে, পাতিগুলি এতক্ষণ ধরে ওই কোণে যখন জটলা পাকাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই ভালো খাবারের সন্ধান পেয়েছে।

তাই হবে। নিশ্চয়ই তাই। ইয়োরোপের পাতিজাতগুলো যখন এশিয়া-আফ্রিকায় খাবার পেয়ে জটলা পাকাল তখন ধেড়ে ইংরেজ তাদের তাড়িয়ে দিয়ে রাজ্য বিস্তার করল। সাধে কি আর বিষ্ণুশর্মা এসপ বলেছেন, পশুপক্ষীর কাছ থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়। কিন্তু তাই করে কতকগুলো জাত যে পশুর মতো আচরণ করলে, এবং এখনও করছে, তার কী?

আচ্ছা, যদি খুব শীত পড়ে আর পুকুরের জল জমে যায়। আমি স্বচক্ষে রাইনের মতো নদী পর্যন্ত জমে যেতে দেখেছি তা হলে এ হাঁসগুলো যায় কোথায়? কোথায় যেন পড়েছি, কবি দুঃখ করে বলছেন, আমি মানস সরোবরে যেন ডানা ভাঙা রাজহাঁস। চতুর্দিকের জল জমে গিয়ে বরফ হয়ে হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, শেষটায় আমাকে পিষে মারবে। আমার সঙ্গী-সাথিরা অনেকদিন হল দক্ষিণে চলে গিয়েছে। আমার যাবার উপায় নেই। হায়, আমাদের সক্কলেরই তাই। কারও পা খোঁড়া, কারও ডানা ভাঙা, কারও প্রিয়া পালিয়ে গিয়েছে, কাউকে-বা সরকার জেলে পুরে দিয়েছে– সবাই যেন বলছে, পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে!

এদের জন্য নিশ্চয়ই কোনও ব্যবস্থা আছে। লন্ডন তো আর দেদ্দেড়ে গ্রাম নয় যে, হাঁসগুলো গোলাবাড়ির খামারঘরে গিয়ে আশ্রয় নেবে। পশুপ্রীতি ইংরেজের যথেষ্ট আছে। মিশর পরাধীন থাকাকালীন এক ইংরেজ হাকিম যখন এক মিশরি খচ্চরওলাকে জরিমানা করে জন্তুটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়ার জন্য–তখন সে মনের দুঃখে বলেছিল, আমি তো জানতুম না রে খচ্চর, আদালতে তোর এক দরদী ভাই রয়েছে।

সামনে দিয়ে একটি মেমসায়েব চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে দেশের মা-মাসিরা দেখতে পেলে বলতেন, হুনোমুখো। না, পরনে সে স্কার্ট নয়, যা পরে বাসে উঠতে গেলে ছিঁড়ে যায়। এর প্রনে হুবহু চীনা পাতলুন। ক্লাইভ স্ট্রিটে বিস্তর দেখেছি। তবে চামড়ার সঙ্গে সেঁটে টাইট, মে-র-কেটে পায়ের ডিম ছাড়ায় কি না-ছাড়ায়, আর লাল সবুজের মারাত্মক চেক। শিলওয়ার বুঝি, বড়ি মোরি–অর্থাৎ ঢিলে পাজামা বুঝি, চীনে পাজামা বোঝাও অসম্ভব নয়, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া পাজামা পরলে রমণীদেহের কোন সৌন্দর্যের কী যে খোলতাই হয় সেটা আদপেই বুঝতে পারলুম না। আর শরীরটাই-না কী বাহারে! বার তিনেক না ঘোরালে বোঝা যায় না কোনটা সামনের দিক, কোনটা পিছন। যেন মডার্ন পেন্টিং। গ্যালারিতে দেখে আমাদের মতো বেকুবদের মনে সন্দেহ জাগে উল্টো টাঙায়নি তো?

যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। যুবতী কখনও কুৎসিত হয় না। তবে যার যেটা মানায় তাকে সেটা পরতে হয়। আজকাল তো আরও কত সব কল বেরিয়েছে, শুনতে পাই। তা না হয় নাই-বা হল। একটু ফোলা ফাপার জামা-কাপড়ও তো আছে। সাড়ে বাইশ-গজি শিলওয়ার নাই-বা হল।

পিছনে আবার একটা কুকুর। মনিবের সেই মেলগাড়ির তেজে চলার সঙ্গে পাল্লা রাখতে গিয়ে এই শীতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অতিশয় অপ্রিয়দর্শন। ডাহুন্ট না কী যেন নাম। পিপের মতো দেহ। মনে হয় যেন দুটো কুকুর জুড়ে একটা বানানো হয়েছে। অথচ আস্তে আস্তে চললে একেও হয়তো মন্দ দেখাত না।

সবশুদ্ধ জড়িয়ে মুড়িয়ে যাকে বলে কাল্ট অব দি আগলি অর্থাৎ কুৎসিত ধর্ম। মডার্ন কবিতা। যার বিষয়বস্তু, ডাস্টবিন, পচা ইঁদুর, মরা ব্যাঙ।

বিরক্তি হয়নি, দুঃখ হয়েছিল। আসলে এরা তো কুৎসিত নয়। এসব গায়ে পড়ে করা। দেশকালপাত্র।

বাঁচালে। হাওয়াটা বন্ধ হয়েছে। ওই হাওয়াটাই যত অনর্থের মূল। উনি বন্ধ হলে বেশ ওম ওম ভাবটা জমে আসে। বেঞ্চির হেলানে মাথাটা চিত করে আকাশমুখো করলুম। ধুপ করে হ্যাটটা পড়ে গেল। তা পড়ক। বন্ধ চোখে লাগল রোদের কুসুম কুসুম পরশ। দেশে গরমের দিনে চোখে ঠাণ্ডা জল দিলে যে রকম আরাম বোধ হয়। হাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে পোড়া ট্রেলের গন্ধও নাকে আসছে না। এদেশের লোকের বোধহয় অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আমি তো সর্বক্ষণ হাতে-গোঁফে চামেলি ঘষি। ভাগ্যিস খানিকটে আতর সুটকেসের পকেটে করে অজানতে চলে এসেছে। এদেশের ও দ্য কলোন লেভেন্ডার ছিটোলে শীতটা যেন আরও ছমছম করে ওঠে।

এবার হেমন্তটা এই পোড়া লন্ডনেও হেমন্ত বলেই ঠেকছে। কাল গিয়েছিলুম মোটরে করে লন্ডনের উত্তরে, গ্রামাঞ্চলে মাইল বিশেক দূরে। তখন চোখে পড়েছিল সত্যকার হেমন্ত।

হেমন্ত নিয়ে এ সংসারের সব কবিই বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বোধহয় শ দেড়েক গান রচেছেন বর্ষা নিয়ে। হেমন্ত নিয়ে পাঁচটি হয় কি না হয়। কবিগুরু কালিদাস পর্যন্ত ঋতুসংহারে হেমন্তের বন্দনা করতে গিয়ে যা রচেছেন তার তুলনায় তার বর্ষা বর্ণন শতগুণে শ্রেয়। তবু তার কলম জোরদার। হেমন্ত ঋতুতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন তিনি মানসযাত্রী হংস ক্রৌঞ্চমিথুন আর মাটির দিকে দেখেছেন পরিকু শস্যে গ্রামের প্রত্যন্ত প্রদেশ পরিপূর্ণ। হেমন্তের সেই সফল শান্তির পূর্ণতা দেখে প্রার্থনা করেছেন;

বহুগুণরমণীয়ো যোষিতাং চিত্তহারী
পরিণতবহুশালিব্যাকুলগ্রামসীমা।
সততমতিমনোজ্ঞঃ ক্রৌঞ্চমালাপরীতঃ।
প্রদিশতু হিমযুক্তঃ কাল এষ সুখং বঃ ॥

হঠাৎ শুনি ধমকের শব্দ। রমণীকণ্ঠে।

শিক্ষিত ভদ্রলোকের ইংরেজিই ভালো করে বুঝিনে, ককনি বোঝা আমার কর্ম নয়। তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে ডান দিকে একটি পেরেম্বুলেটর। তার পিছনে একটি ছোট্ট বাচ্চা। চলি চলি পা-পা করে গোলদিঘিতে ক্ষুদে একটি রবারের নৌকা ভাসাবার চেষ্টা করছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটা বার বার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে তার আয়া অসহিষ্ণু হয়ে লাগিয়েছে তাকে এক বিকট ধমক। সে ধমকের ধাক্কায় রাজ-পাতি সব হাঁস প্যাক প্যাক করে পালাচ্ছে, নৌকোটা পর্যন্ত ডুবুডুবু!

শুনেছিলুম, এ দেশে বাচ্চাদের ধমক দেওয়া হয় না। দেশের এক অতি আধুনিক পরিবার। সেখানে অতিথি এলে এক ছেলে পিঠে পিন ফুটাত, অন্য ছেলে কাঁচ কাঁচ করে কাঁচি দিয়ে তার টাইটি কাটতে আরম্ভ করত। ধমক দিতে গেলে বাপ-মা অতিথিকে বিলেতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।

ফের ঘাড় ঝুলিয়ে দিলুম বেঞ্চির হেলানে, মুখ তুলে দিলুম আকাশের দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বললুম, হায় পেস্তালৎসি, হায় রে ফ্র্যোবেল, কোথায় তুমি ফ্রয়েট! এই ককনি রমণীকে পর্যন্ত তালিম দিয়ে শাবুদ করতে পারনি!

এবারে শুনি বাঁ দিক থেকে, বেগি পান্। মানে? ওহ্বেগ ইয়োর পার্ডন! হকচকিয়ে চোখ খুলে দেখি, আমার অজানতে এক ভদ্রলোক বেঞ্চির অন্য প্রান্তে আসন নিয়েছেন।

সুন্দর চেহারা। ঢেউ খেলানো সোনালি ব্লন্ড চুল হাওয়াতে অল্প উস্কোখুস্কো। নাকটি খাঁটি রোমান, ব্রিজের চিহ্নমাত্র নেই। মুখের রঙ পুরনো হাতির দাঁতের মতো। শুধু গাল দুটিতে অতি অল্প গোলাপির ছোঁয়া লেগেছে। একটুখানি গোঁফ মাথার চুলের চেয়ে এক পোঁচ বেশি সোনালি।

আমি তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে না। আমি কিছু বলিনি। তার পর আমতা আমতা করে বললুম, আমি শুধু পেস্তালৎসির কথা স্মরণ করছিলুম।

হাত দু খানি জানুর উপর ভারি শান্তভাবে রাখা, যেন রেমব্রান্টের ছবিতে আঁকা। সরু লম্বা লম্বা। নখে লালের আভাস। চমৎকার মেনিকোর করা। বয়স ৩০/৩৫। ঠিক বলতে পারব না। সায়েব-সুবোদের বয়েস আমি অনুমান করতে পারিনে।

এবারে আমার পালা। সায়েব কী যেন বললে। বুঝতে না পেরে বললুম, বেগি পান। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বুঝে গেলুম বলেছে, থ্যাঙ্ক গড় ধরনের কিছু একটা। কিন্তু তখন তো আর বেগ ইয়োর পার্ডনটা ফের বেগ করে ফেরত নেওয়া যায় না।

পাশে বেঞ্চির উপর অত্যুকৃষ্ট শোলার হ্যাট, তার ভিতরে দু খানা দস্তানা। পরনে হেরিং মাছের কাঁটার নকশা কাটা নতুন স্যুট। শক্ত কলার, ডোরাকাটা টাই– কোনও পাবলিক স্কুলের নিশানমারা হতেও পারে কফের বোম ঝিনুকের, মাঝখানে কী একটা ঝকঝকরছে। পায়ে ছুঁচলো কালো জুতো। এবং বিশ্বাস করবেন না, তার উপর স্প্যাট!

ত্রিশ বৎসর পূর্বে এ রকম বেশভূষা মাঝে-মধ্যে দেখেছি। বইয়ে বর্ণনা পড়েছি। এ কি বিংশ শতাব্দীর রিপ ভান উইনল?

তখন মনে পড়ল কেনসিংটন গার্ডেনের আশেপাশে থাকেন এদেশের খান্দানিরা। কাশ্মীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দি কবি গেয়েছেন,

য়হি স্বর্গ সুরলোক
মহি সুরকানন সুন্দর।
মহা অমরোকা ওক,
মহা কহি বসত পুরন্দর ॥

এইটেই স্বর্গসুরলোক, এইখানেই কোথাও পুরন্দর বাস করেন।

শুনেছি, এরই আশপাশে চার্চিল থাকেন, এপস্টাইন বাস করেন।

তবে ইনি খান্দানি লোক। কাজকর্ম নেই। অবেলায় পার্কে রোদ মারতে বেরিয়েছেন।

ছিঃ। তখন দেখি তার বাঁ দিকে একটা ক্রাচ– খোঁড়ারা যার উপর ভর দিয়ে হাঁটে। নিজের মনকে কষে কান মলে দিলুম- উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ না করে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য।

বললেন, পেস্তালৎসি কিন্তু শেষ বয়সে আপন মত অনেকখানি পরিবর্তন করেছিলেন। বলতেন, বাচ্চাদের বড় বেশি যা-তা করতে দিতে নেই।

আমি অবাক। আমি তো শুনেছি ইংরেজ অচেনার সঙ্গে কথা কয় না। ইনি আবার খান্দানি।

ভদ্রলোক কিন্তু পাঁচ সিকে সপ্রতিভ। কঞ্জুস যে রকম চুনের কৌটো থেকে খুঁটে খুঁটে শেষ রত্তি বের করে, ইনি ঠিক তেমনি দুটি নীল চোখ দিয়ে আমার চোখ দুটি খুঁটে খুঁটে শেষ চিন্তা বের করে নিচ্ছেন।

বললেন, সে আমি বেশ জানি, প্রাচ্যদেশীয়দের সঙ্গে বিনা পরিচয়েই কথা আরম্ভ করা যায়। মুখে অল্প অল্প হাসি-খুশির ভাব।

আমি শুধালুম, আপনি কি অনেক প্রাচ্যদেশীয়দের চেনেন?

বললেন, আদপেই না। আপনিই প্রথম।

আমি বললুম, সে কী? এখন তো লন্ডনে বিদেশিই বেশি বলে মনে হয়। আমি তো ভেবেছিলুম পাছে এদের ঠেলায় খাস লন্ডনবাসীরা শহরছাড়া হয় তাই ম্যাকমিলানকে প্রস্তাব করে পাঠাব কাঁটার তার দিয়ে দিয়ে লন্ডনের আদিবাসীদের জন্য (আমি এবরোজিনালস শব্দটি প্রয়োগ করেছিলুম) আলাদা মহল্লা করে দেবার জন্য। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, প্রাণীদের খাবার দেওয়া বারণ। হুকুম অমান্য করলে এক পৌন্ড জরিমানা। কী বলেন?

বললেন, খাঁটি কথা। আমাদের পাড়া তো যায়-যায়।

ইচ্ছে হচ্ছিল শুধাই কোন পাড়া। কিন্তু ইনি যখন প্রাচ্য কায়দায় বিনা পরিচয়ে আলাপ আরম্ভ করেছেন, তখন আমার উচিত প্রতীচ্য কায়দা অনুসরণ করা।

বললুম, কলকাতায় তো তাই হয়েছে। আমরা কলকাতার আদিবাসীদের কোণঠাসা করে এনেছি।

তিনি শুধালেন, আমরা মানে কারা?

এ তো তোফা ব্যবস্থা। উনি প্রাচ্য পদ্ধতিতে দিব্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যাচ্ছেন, আর আমি নেটিভ ছুরি-কাটা নিয়ে আনাড়ির মতো কিছুই মুখে তুলতে পারছিনে। ঠিকই তো। সেই কথামালার গল্প। বক তার লম্বা ঠোঁট চালিয়ে কুঁজো থেকে টপাটপ খাবার তুলে নিচ্ছে। আর আমি খেঁকশেয়ালটার মতো শুধু কুঁজোটার গা চাটছি। আর ব্যবস্থাটা করেছে বই।

কিন্তু হলে কী হয়? ইংরেজের বাচ্চা। বেশিক্ষণ প্রশ্ন শুধোবে কী করে? অনভ্যাসের ফোঁটা নয়, অনভ্যাসের লাল লঙ্কা। খাবে কতক্ষণ!

আমি বললাম, আমি শিক্ষাবিদ নই, তবু জানতে ইচ্ছা করে এ দেশের শিক্ষিত পরিবারে বাচ্চারা কতটুকু যাচ্ছেতাই করার সুযোগ পেয়েছে!

এবারে ইংরেজের ইংরেজিপনা আরম্ভ হল। অনেকগুলি সবৃজনকটিভ মুড ব্যবহার করতে পেরে ভদ্রলোক যেন বেঁচে গেলেন। ওই মুডটাই ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, কারণ এতে প্রকাশ পায় অনিশ্চয়তা। শুড উডের ছড়াছড়ি– আই শুড সে, ইট উড় অ্যাপিয়ার, ওয়ান মাইট থিন থাকলেই বুঝতে হবে ইংরেজ পাকাপাকি কিছু বলতে চায় না, কিংবা ভদ্রতা প্রকাশ করতে চায়– ফাউলার যা বলুন, বলুন। আমরা এ জিনিসটেই প্রকাশ করি অতীতকাল দিয়ে। শ্বশুরমশাই যখন জিগ্যেস করেন, তা হলে বাবাজি আসছ কবে? আমরা ঘাড় নিচু করে বলি, আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলুম ভাদ্র মাসে এলেই ভালো হয়। আসলে কিন্তু বলতে চাই, আমি ভাবছি…। তা বলিনে; অতীতে ফেললে বিনয় প্রকাশ হয় অনিশ্চয়তাও বোঝানো হয়, অর্থাৎ শ্বশুরমশাই ইচ্ছে করলেই আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাকচ করে দিতে পারেন।

ইংরেজ বললেন, অন্য লোকে যে আমাদের দ্বীপবাসী বলে সেটা কিছু মিথ্যে নয়! ওই পেস্তালৎসি, ফ্ল্যোবেলের কথা বলছিলেন না? এদের তত্ত্বকথা সর্বজনমান্য হয়ে গেলেও আমরা সেগুলো গ্রহণ করি সকলের পরে। চ্যানেলের ওপার থেকে যা কিছু আসে তাই যেন আমরা একটু সন্দেহের চোখে দেখি। আর গ্রহণ করলেও সমাজের সব শ্রেণি একই সময়ে নেয় না। আমাদের বাড়িতে কিছু মনে করবেন না, একটু ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে–

আমি বললুম, প্রাচ্য পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত হওয়াটাই রেওয়াজ।

ধন্যবাদ। আমাদের বাড়িতে এখনও প্রাচীন পন্থা চালু। দুনিয়ার আর সর্বত্র সেন্ট্রাল হিটিঙ কিংবা ইলেকট্রিক দিয়ে ঘর গরম করা হয়, আমাদের বাড়িতে এখনও লগ ফাইয়ার –কাঠের আগুন। ওহ্! একটা ঘটনা মনে পড়ল। আপনি জাওয়ার ডাক্তারের কথা শুনেছেন?

যদিও লোকটি অতিশয় ভদ্র, মাত্রাধিক দ্ৰ বললেও ভুল বলা হবে না, তবু একটু বিরক্ত হলুম। এই ইংরেজরা কি আমাদের এতই অগা মনে করে বললুম, সেই যিনি সর্বপ্রথম ফুসফুসের অপারেশন আরম্ভ করেন?

ইংরেজের তারিফ করতে হয় মানুষের গলা থেকে মনের ভাব চট করে বুঝে নেয়। ভদ্রলোক বার বার মাফ চাইতে আরম্ভ করলেন। আমিও একটু লজ্জা পেলুম।

বললেন, হাজারটা ইংরেজের একটা ইংরেজও ওঁর নাম জানে না। তাই আপনাকে জিগ্যেস করেছিলুম।

আমিও ভদ্রতা করে বললুম, আমিও জানতুম না যদি না এক জর্মন ডাক্তারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হত। তার পর কী বলছিলেন, বলুন।

১৯২৮-এ যখন পঞ্চম জর্জের শক্ত ব্যামো হয়, তখন তাঁর কাছে ইংরেজ ডাক্তাররা পাঠালে রাজার এক্স-রে ছবি। ওঁর মতামত জানতে চাইলে–বুকে অপারেশন করা হবে, না শুধু ফুটো করলেই হবে, না ড্রেন করতে হবে, না কী? এবং এ কথাও জাওয়ার বুঝে গেলেন যে, আর যা হয় হোক, কোনও বিদেশি সার্জনকে দিয়ে রাজার অপারেশন করা চলবে না। ইংরেজ ডাক্তারগোষ্ঠী তা হলে আপন দেশে মুখ দেখাতে পারবে না।

আমি বললুম, আশ্চর্য! আমাদের গান্ধীকে তো ইংরেজ ডাক্তারই অপারেশন করেছিল।

একটু চুপ করে থেকে বললেন, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। কয়েক দিন পর ডাচেস অব কনোট না কেন্ট, কার জানি শক্ত ব্যামো হয়েছে। জাওয়ারব্রুখকে প্লেনে করে এখন তো প্লেন ডাল-ভাত– লন্ডন আনানো হল। অর্থাৎ ডাচেসের বেলা জর্মন ডাক্তার চললে চলতেও পারে, রাজার বেলা নয়!

আমি বললুম, বা রে!

বললেন, এখানেও শেষ নয়। জাওয়াব্রুখ তো রুগীর ঘরে ঢুকে রেগে কাই। এ রুগী তো ভয়ে কাঁপছে না, কাঁপছে শীতে। রুগীর লেপ তো লেপ নয়, ভিজে কাঁথা। বললেন, এ ঘরে রুগীর চিকিৎসা চলবে না। বেশ চড়া গলাতেই নাকি বলেছিলেন, মানুষ থাকার উপযোগী এবং ভদ্র (রিজনেবল) ঘরে ওঁকে নাকি নিয়ে যেতে হবে। একে জর্মন, তায় ডাক্তার– চড়া গলাতে বলবেই তো। তখন আরম্ভ হল তুলকালাম কাণ্ড। বহু হট্টগোলের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য ঘরে সেখানে একটি ইলেকট্রিক হিটার কোনও গতিকে লাগানো হল।

ডাক্তার কী বললেন, জানেন? বললেন, কিছু হয়নি; কালই সেরে যাবেন। এবং সেরে গেলেন।

আমি বললুম আশ্চর্য।

তিনি বললেন, এ-ও শেষ নয়। পরদিন ডুক দিলেন ডাক্তারকে বিরাট ভোজ। তার পরিচিত লাট-বেলাট সবাইকে নেমন্তন্ন করা হল। স্বয়ং ডাচেস সেরে উঠে ব্যানকুয়েটে বসলেন। চার্চিলও ছিলেন। তার পর কী কাণ্ড হল জানেন?

ভোজ খেয়ে হোটেলে ফিরে এসে জাওয়ার দেখেন সেখানে আরেক কাণ্ড। চেনা আধা-চেনা যে তাঁকে দেখে সেই মাথা নিচু করে বাও করে। ওয়েটার, ম্যানেজার সবাই তাঁর পিছনে পিছনে ছুটছে। হুজুরের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো, হুজুরের কী চাই? ডাক্তার তো অবাক। ডাচেসের জন্য গরম ঘরের ব্যবস্থা করেই এতখানি?

আসলে তা নয়। শোবার ঘরে গিয়ে ডাক্তার দেখেন, তার টেবিলের উপর সন্ধ্যাবেলাকার কাগজ। তাতে মোটা মোটা হরফে লেখা জর্মনির ডাক্তার জাওয়ারব্রুখ রাজাকে আজ সন্ধ্যায় অপারেশন করলেন! খবরের কাগজ সবকিছু জানে কি না! জাওয়ারব্রু লন্ডনে, ওই সময়ে, টায়টায়।

আমি আবার বললুম, আশ্চর্য! জাওয়ার প্রতিবাদ করলেন না?

তিনি বললেন, পরের দিন ভোরেই তাকে প্লেনে তুলে দেওয়া হল– এ্যারপোর্টে ডুক ডাচেস সবাই উপস্থিত। হৈহৈ-রৈরৈ। দেশে গিয়ে দেখেন, ইতোমধ্যে মার্কিন কাগজগুলো বলতে আরম্ভ করেছে, জাওয়ার অস্তর করার জন্য এক মিলিয়ন পৌন্ড পেয়েছেন! জর্মন কাগজরা আত্মম্ভরিতায় ফেটে যাবার উপক্রম। জাওয়ারব্রুখ একে ওঁকে জিগ্যেস করলেন, কী করা উচিত। সবাই বলে এই ডামাডোলের বাজারে কেউ তোমার প্রতিবাদ (দেমাতি) শুনবে না। চেপে যাও।

তার পর! ঠিক সেই সময়ে এক তাগড়া লম্বাচৌড়া নার্স এসে উপস্থিত। তাকে তুলে ধরল। তিনি ক্রাচ তুলে নিয়ে একদিকে ধরলেন, অন্যদিকে ভর করলেন নার্স। সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বারোটার ঘন্টা। বললেন, ও রেভোয়া–অর্থাৎ আবার দেখা হবে। গুড বাই নয়। তার অর্থ অন্য।

কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগল, জাওয়ার কি জানতেন তাঁকে ডাচেসের বাড়িতে আনা হয়েছিল তার অসুখের ভান করে। ওই সময়ে তিনি যেন লন্ডনে হাতের কাছে থাকেন। অপারেশনে যদি গণ্ডগোল হয়, তাকে তখখুনি ডেকে পাঠাবার জন্য।

যাকগে। কালই তো জর্মনি যাচ্ছি। আমার বন্ধু পাউলকে শুধাব! সে গুণী, সব জানে।

.

বহু চেষ্টা করেও লন্ডনের সঙ্গে দোস্তি জমাতে পারলুম না। পূর্বেও পারিনি। কারণ অনুসন্ধান করে আশ্চর্য বোধ হয়েছে, যে শহরকে দশ-এগারো বছর বয়স থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মারফতে চিনতে শিখেছি তার সঙ্গে হৃদ্যতা হয় না কেন? বোধহয় ইংরেজ এদেশে রাজত্ব করেছে বলে। বোধহয় বহুকাল ইংরেজের গোলামি করেছি তার প্রতি রাগটা যেন যেতে চায় না। তার সদগুণ দেখলে রাগটা আরও যেন বেড়ে যায়। তখন মনে হয়, এর সঙ্গে দোস্তিটা জমাতে পারলে জীবনটা আরও মধুময় হতে পারত।

কিন্তু আমি তো এ ফরিয়াদে একা নই। ফরাসিরা তো ইংরেজকে সোজাসুজি অনেক কথা বলে। মাদাম টাবউই বই লিখেছিলেন– পারফিডিয়াস এলবিয়ন অর আঁতাৎকর্দিয়াল। জর্মন, হাঙ্গেরিয়ান এবং অন্যান্য জাত অত কড়াভাবে কথাটা বলেনি বটে, কিন্তু ইংরেজের প্রকৃতি যে আর পাঁচটা জাতের মতো নয় সে কথা সবাই স্বীকার করে নেয়। কেউ ব্যঙ্গ করেছে, কেউ সহিষ্ণুতার সদয় হাসি হেসেছে। এ শুধু টুরিস্টদের সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়, হাইনে, ভলতেয়ার, জোলার মতো বিচক্ষণ মহাজনরা যা বলে গেছেন সে তো কিছু ঝেড়ে ফেলে দেবার মতো নয়।

কিন্তু একটি কথা সবাই স্বীকার করেছেন। শেকসপিয়ারের মতো কৰি হয় না, ইসকিলাস, দান্তে, গ্যোটে এঁদের কারও চেয়ে ইনি কম নন। আর এর মহত্ত্ব এমনই বিরাট যে, তাঁকে নকল পর্যন্ত করার সাহস কারও হয় না।

কিন্তু এ তত্ত্ব নিয়ে অত্যধিক বাক্যব্যয় আমি করতে যাব কেন?

আমাকে যে জিনিস সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে সেইটে বলে প্লেনে উঠি।

.

ব্রিটিশ মিউজিয়মের পাঠাগার। অনেক দেশে বিস্তর পুস্তকাগারে ঢুকেছি। থানাতেও দু-একবার গিয়েছি। দুটোতে কোনও পার্থক্য লক্ষ করতে পারিনি। আমি যেন চোর। বই সরাবার মতলব ভিন্ন আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে এটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে চায় না। কার্ড দেখানো থেকে আরম্ভ করে বই ফেরত দিয়ে বেরোবার পরও মনে হয় পিঠের উপর ওদের চোখগুলো যেন সার্জেনের তুরপুনের মতো কুরে কুরে ঢুকছে।

এর জন্য কে দায়ী বলা কঠিন। কিন্তু যেই হোক, কিংবা যারাই হোন, এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, চোর-পুলিশের বাতাবরণে আর যা হয় হোক, জ্ঞানসঞ্চয় বিদ্যার্জন হয় না। তবে এর ব্যত্যয়ও আছে। এবং আমার বিশ্বাস, আমরা উন্নতির দিকেই চলেছি।

ব্রিটিশ মিউজিয়মে কাউকে যে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না তার প্রধান কারণ প্রায় সবাই বয়স্ক, অনেকেই পণ্ডিতরূপে বিশ্ববরেণ্য। এখানে কাজ করতে হলে সহজে অনুমতি পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ মিউজিয়মের কর্তারা যে ডগ অ্যান্ড দি ম্যানেজার, অর্থাৎ আমি খাব না, তোকেও খেতে দেব না নীতি অবলম্বন করেন তা নয়। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ রিসার্চ, যেমন মনে করুন ডক্টরেটের কাজ করার জন্য লন্ডনে আরও বিস্তর লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে ভিড় কম, ও রিসার্চ একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে আপনি আপনার বই পেয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি। যেমন মনে করুন, আপনি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই আপনি আপনার প্রয়োজনীয় বই পেয়ে যাবেন। কিন্তু যেখানে গবেষণা একাধিক বিষয়বস্তু ছাড়িয়ে যায় সেখানে স্পেশেলাইজড লাইব্রেরি কুলিয়ে উঠতে পারে না– তখন ব্রিটিশ মিউজিয়ম আপনাকে স্বাগতম জানায়।

এবং সবচেয়ে বড় কথা– পৃথিবীর সর্ব জায়গা থেকে এত সব নামকরা পণ্ডিত এখানে আসেন যে, মিউজিয়ম তাঁদের নিরাশ করে অপেক্ষাকৃত, কিংবা সম্পূর্ণ অজানা গবেষককে স্থান দিতে চায় না– কারণ পাঠাগারের সাইজ দশ ডবল করে দিলেও সে তার মোহাকৃষ্ট গবেষকদের স্থান কুলান করতে পারবে না।

মিউজিয়মের চায়ের স্টলে একজন পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ হয়।

তিনি বললেন, রিডিং রুমে ঢুকেই একজন নিগ্রো ভদ্রলোককে লক্ষ করেছেন কি? আবলুসের মতো রঙ আর বরফের মতো সাদা চুল? নাগাড়ে বিশ বছর ধরে ওই আসনে বসে কাজ করে যাচ্ছেন।

আমি বললুম, আপনি ক বছর ধরে?

তিনি যেন একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, সামান্য। পনেরো হবে। আমার চেয়ে যারা ঢের প্রবীণ তাঁদের কাছে শোনা।

আমি শুধালুম, ইনি কী কাজ করছেন?

হাবশি মুল্লুকে খ্রিস্টধর্মের অভ্যুদয় কিংবা ওরই কাছাকাছি কিছু একটা। হিব্রু, আরাহময়িক, আহমরিক, সিরিয়াক এসব তাবৎ ভাষায় লেখা বই ঘাঁটতে হলে এখানে না এসে তো উপায় নেই।

আমি সামান্য যে ক দিন কাজ করেছিলুম সে কদিন নিগ্রো ভদ্রলোকের নিষ্ঠা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। নটার সময় কাটায় কাটায় তাকে আসন নিতে দেখেছি এবং উঠতেন ছটার সময়। এর ভিতরে আসন ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকলে আমার অজানতে। আর দেড়টা থেকে দুটো অবধি চেয়ারের হেলানে মাথা দিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নিতেন।

লিখতেন অল্পই। পড়তেন বেশি। চিন্তা করতেন তারও বেশি। দু একবার চোখাচোখি হয়েছে। তিনি যেন আমাকে দেখতেই পাননি। চোখ দুটি কোন অসীম ভাবনার গভীর অতলে ডুবে আছে আমি জানব কী করে? কিংবা তিনি হয়তো ছবি দেখছেন, সেই আদিম আবিসিনিয়ান সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন খ্রিস্টের দূত, শান্তির বাণী বহন করে। তখন তাঁদের সভ্যতা সংস্কৃতি কোন স্তরে ছিল, খ্রিস্টের বাণী তারা কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন– তারই ছবি দেখছেন। যেখানে ছবি অসম্পূর্ণ কিংবা ঝাপসা সেটাকে সম্পূর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য এই সাধনা।

তাঁর বই লেখা শেষ হয়েছিল কি না, প্রকাশিত হলে কজন লোক সেটি পড়েছিল, বুঝবার মতো শক্তি কজন পাঠকের ছিল তা-ও জানিনে। কারণ এরকম নিষ্ঠাবান সাধক পাঠাগারের অনেকেই।

এ স্থলে পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমি সেখানে ঠাই পেলুম কী করে? কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, আমি পণ্ডিত নই।

জর্মনিতে পড়াশোনা করার সময় আমার কয়েকখানা বইয়ের প্রয়োজন হয়। সেদেশে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না বলে অধ্যাপক বললেন, ব্রিটিশ মিউজিয়মে যাও; সেই সুযোগে লন্ডনও দেখা হয়ে যায়।

তিনি নিজে প্রায়ই লন্ডনে এসে কাজ করে যেতেন। মিউজিয়মের কর্তারা ভালো করেই জানতেন, পণ্ডিতসমাজে তার স্থান কতখানি উঁচুতে। তিনি যখন পরিচয়পত্র দিয়ে পাঠালেন তখন এঁরা আর কোনও প্রশ্ন শুধালেন না।

কিন্তু বার বার লজ্জা অনুভব করেছি।

প্রথম মুশকিল আসন নিয়ে। কোনও আসনে কেউ বসছেন বিশ বছর ধরে, কেউ ত্রিশ বছর ধরে। ঠিক সেদিনটাই হয়তো তিনি তখনও আসেননি। আপনি না জেনে বসে গেলেন তারই আসনে– কারণ কোনও চেয়ার কারও জন্য রিজার্ভ করা হয় না। তিনি খানিকক্ষণ পরে এসে আপনাকে ওই চেয়ারে দেখে চলে গেলেন কিছু না বলে। অন্য জায়গায় বসে তিনি ঠিক আরাম পেলেন না। আপনি কিন্তু জানতেই পেলেন না।

পরের দিন গিয়ে দেখলেন, অন্য কে একজন– তিনিই হবেন– ওই আসনে বসে আছেন। আপনি নতুন আসনের সন্ধানে বেরোলেন।

এসব বুঝতে বুঝতে কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। যখন বুঝলুম, তখন শরণাপন্ন হলুম এক কর্মচারীর। তিনি অনেক ঘাড় চুলকে আমাকে একটি আসন দেখিয়ে বললেন, এ চেয়ারটায় এক ভদ্রলোক বসছেন দশ বৎসর ধরে।

আমি বললুম, থাক্ থাক্।

তিনি বললেন, তবে মাসখানেক ধরে তিনি আসছেন না।

আমি বললুম, তা হলে উপস্থিত এখানেই বসি। কিন্তু তিনি এলে আমায় বলে দেবেন কি?

বিরাট গোল ঘর! মাঝখানে চক্রাকারে সাজানো ক্যাটালগ। আর একেবারে কেন্দ্রে বসে কয়েকজন কর্মচারী। এঁদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বড় একটা হয় না। বই আসে-যায় কলের মতো।

কেন্দ্র থেকে সারি সারি হয়ে দেয়াল অবধি বেরিয়েছে পাঠকদের আসনপঙক্তি। উপরের কাঁচ দিয়ে যে আলো আসছে সেটুকু যথেষ্ট নয় বলে টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প। পাঠকদের অনেকেই পরেছেন কপালের উপরে রবারে বাধা শেড়–টেনিস খেলোয়াড়দের মতো। সামান্য পাতা উল্টোনোর শব্দ, পাশের ভদ্রলোকের কলমের অতি অল্প খসখস। আর কোনও শব্দ কোনও দিক দিয়ে আসছে না। অখণ্ড মনোযোগের পরিপূর্ণ অবকাশ।

এ জায়গা মানুষকে কাজ করতে শেখায়। আপনি হয়তো এলেন নটা পনেরো মিনিটে। এসে দেখেন আপনার পাশের ভদ্রলোক যেভাবে কাজ করছেন তার থেকে মনে হয়, তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। তার পর দশটা এগারোটা বারোটা একটা অবধি তিনি আর ঘাড় তোলেন না। আপনার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছে। তার পায়নি। আপনারও রোখ চেপে গেল। উনি না উঠলে আপনিও উঠবেন না। ইতোমধ্যে বাইরে গিয়ে বার বার সিগারেট খাবার ইচ্ছে হয়েছে সেটাও চেপে গিয়েছেন। দুটোর সময় উনি উঠলেন। আপনি যখন সাত তাড়াতাড়িতে চা-রুটি খেয়ে ফিরলেন, তিনি তখন ঘাড় গুঁজে ফের কাজে ডুব মেরেছেন। বোঝা গেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি সঙ্গে আনা দু খানা স্যান্ডউইচ খেয়েই কাজ সেরেছেন। তার পর তিনি উঠলেন পাঠাগার বন্ধ হওয়ার সময়।

এরকম যদি একটা লোক পাশে বসে কাজ করে তবে কার না মাথায় খুন চাপে। কিছুদিনের ভিতর দেখতে পাবেন, আপনিও দিব্য নটা ছটা করে যাচ্ছেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, কোনও ক্লান্তি আসছে না।

একেবারে কেন্দ্রে বসতেন একটি অতিশয় ছোটখাটো বৃদ্ধ। পরনে মর্নিং স্যুট। লম্বা দাড়ি। আবার মাথায় টপ হ্যাট! ঘরের ভিতরে ইংরাজ হ্যাট পরে না। এঁকে কিন্তু কখনও হ্যাটটি নামাতে দেখি না। বোধহয় হ্যাঁটের সামনের দিকটা দিয়ে তিনি শেডের কাজ চালিয়ে নিতেন।

সিন্ধি-গুজরাতিতে মেশানো কয়েকখানি ধর্মগ্রন্থের সন্ধান না পেয়ে তার কাছে গেলুম। তিন মিনিটের ভিতর তিনি ক্যাটালগের ঠিক জায়গা বের করে দিলেন, এবং এটাও বললেন, বোধহয় ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এ সম্বন্ধে আরও বই আছে।

পরে এক ভারতীয়ের মুখে শুনলুম, হেন বই লাইব্রেরিতে নেই যার হদিশ তার অজানা। মিউজিয়মের চায়ের ঘরে কথা হচ্ছিল। লাইব্রেরির দেশবিদেশের পাকা গাহক কয়েকজন ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলেন।

.

এই অশ্রান্ত অজস্র পরিশ্রম আর নিষ্ঠার শেষ কোথায়, ফল কী? এদের সকলের বই কি জনসমাজে সম্মান পায়? বহু পরিশ্রমের পর যখন বই সম্মান পায় না তখন লেখকের মনে কী চিন্তার উদয় হয়? তিনি কি আবার নতুন করে কাজ আরম্ভ করেন, না ভগ্নহৃদয়ে শয্যাগ্রহণ করেন।

এর উত্তর দেবে কে?

শুধু এইটুকু জানি, মিউজিয়ম এ নিয়ে মাথা ঘামাক আর না-ই ঘামাক, সে সাদরে বংশপরম্পরাকে জ্ঞানের সন্ধানে সাহায্য করছে, আর পাঠাগারের কেন্দ্রটি বিশ্বের সর্বজ্ঞানের কেন্দ্র না থোক, অন্যতম কেন্দ্র।

ইংরেজকে এখানে নমস্কার।

বিশ্বজনের কাছে ভারতবর্ষ অপরিচিত দেশ নয়। প্রাচীন যুগে সে অপরিচিত ছিল না, এ যুগেও নয়। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য অল্পসংখ্যক স্বার্থান্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ভারতবর্ষের সম্বন্ধে প্রচার করেন যে, যদিও এদেশ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল আজ তার সর্বলোপ পেয়েছে এবং বৈদেশিক শাসন ভিন্ন এর পুনর্জীবন লাভের অন্য কোনও পন্থা নেই। এ কুৎসা প্রচারের ফলে প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয় মহাদেশেই বিস্তর কুফল ফলেছিল, এখনও কিছু কিছু ফলছে। এর জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই স্বল্পসংখ্যক সাম্রাজ্যবাদীদের দেশই। কিন্তু এ স্থলে স্মরণ রাখা কর্তব্য, সে দেশের মনীষীগণও তাই নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

মাত্র একটি দেশ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কখনও তার ভক্তিশ্রদ্ধা হারায়নি। সে দেশ জর্মনি। এদেশের গুণীজ্ঞানীরা সে তত্ত্ব অবগত আছেন। আমাদের কবি মধুসূদন একশো বছর পূর্বে লন্ডনে থাকাকালীন জর্মন পণ্ডিত গল্টকারের সঙ্গে দেখা করতে যান; এমনকি যে স্বল্পসংখ্যক জর্মন পণ্ডিতের মতবাদ আমাদের সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ভ্রমাত্মক বলে মনে করেছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি আপন যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছেন। পরবর্তী যুগে আমাদের শিক্ষাচার্য রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় শাস্ত্র গবেষণার জন্য জর্মন পণ্ডিত ইউনটার-নিসকে নিমন্ত্রণ করে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসেন; তখনই অপরিচিতা শ্রীমতী ক্ৰামরিশ তাঁরই সৌজন্যে বিশ্বভারতীতে ভারতীয় কলাচর্চার সুযোগ পান।

কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এদেশের জনসাধারণ জর্মনির খবর পেল দুই অশুভ যোগাযোগের ফলে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবাসী জর্মনি সম্বন্ধে নানা অতিরঞ্জিত কাহিনী শুনে ঈষৎ পথভ্রান্ত হয়েছে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। এদেশের পণ্ডিতসমাজেও জর্মন ভাষা সুপ্রচলিত নয় বলে ভারতবর্ষীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা জর্মনিতে কীভাবে হয়, তার কতখানি উন্নতি হয়েছে, সে বিষয় বাংলায় অনূদিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যেসব বাঙালি বিপ্লবী জর্মনিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্ট কারণবশত এদেশে প্রসার লাভ করতে পারেনি।

ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান কলা-দর্শন সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার জন্য ইয়োরোপে যে শব্দটি প্রচলিত তার নাম ইভলজি– জর্মন উচ্চারণ ইন্ডলগি। শব্দটি অর্বাচীন ও গ্রিক গোত্রীয় (অবশ্য এর প্রথমাংশ ইন্দস শব্দটি মূলে ভারতীয়) এবং জর্মনির শিক্ষিতজন মাত্রই এটির বহুল প্রয়োগ করে থাকেন; ইংলন্ডের পণ্ডিতসমাজে এটি কখনও কখনও ব্যবহৃত হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় শব্দটি নেই, জর্মন সাইক্লোপিডিয়ায় নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ আছে।

জর্মনিতে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদির চর্চা অর্থাৎ ইন্ডলজি কতখানি প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা বাংলাতে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকাহিনী তার জন্য প্রশস্ত স্থান নয়, কিন্তু এ সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান না থাকলে জর্মন দেশবৃত্তান্তের একটা বিরাট মহৎ দিক অবহেলিত হয়, এবং দ্বিতীয়ত আমার ছাত্রজীবনের প্রায় চার বৎসর সেখানে কাটিয়েছি বলে একাধিক জর্মন সংস্কৃতজ্ঞের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয় এবং ভ্রমণকাহিনীতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় প্রকাশিত হবে বলে এসব পণ্ডিত এবং তাঁদের সাধনা সম্বন্ধে এই সুযোগে যা না বললে নিতান্তই চলে না সেইটুকু বলে রাখি। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি, ভবিষ্যতে আমি এ প্রলোভন সম্বরণ করব।

ইভলজি আরম্ভ করেন ইংরেজরাই অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। জোনস, কোব্রুক, উইলসন এর প্রতিষ্ঠাতা। এর পরই ফ্রান্সে সিলভেসূত্র দ্য সাসি এ চর্চা আরম্ভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে জর্মনিতে সেটা ব্যাপকতরভাবে আরম্ভ হয়। জর্মন পণ্ডিত শ্লেগেলই সর্বপ্রথম এ চর্চার ব্যাপকতা এবং কীভাবে একে অগ্রসর হতে হবে তার কর্মসূচি তার পুস্তক ঝুবার ডি স্পাখে উনট ভাইজহাইটডের ইভার (ভারতীয় ভাষা ও মনীষা:) ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। এর কয়েক বৎসর পরেই জর্মন পণ্ডিত বপু সংস্কৃত ধাতুরূপের সঙ্গে গ্রিক, লাতিন এবং প্রাচীন জর্মন ধাতুর তুলনা করে সপ্রমাণ করেন যে, ভবিষ্যতে আর্যগোষ্ঠীর যে কোনও ভাষার মূলে পৌঁছতে হলে সংস্কৃত ভাষা অপরিহার্য। বস্তুত তিনিই প্রথম তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের কেন্দ্রভূমিতে যে সংস্কৃতকে স্থাপনা করলেন এখনও সে সেখানেই আছে। তারই দু বৎসর পরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জর্মনির বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংস্কৃত অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয় এবং ওই কর্মে নিয়োজিত হন পূর্বোল্লিখিত ফ্রিডরিষ শ্লেগেলের ভ্রাতা ভিলহেলম শ্লেগেল। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে বপু বার্লিনে নিযুক্ত হলেন।

ভারতবর্ষে তখন সংস্কৃত চর্চার কী দুর্দিন!

শ্লেগেল ভ্রাতৃদ্বয়, বপ যে শুধু ভারতীয় ব্যাকরণ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন তাই নয়, তারা তখন সংস্কৃত সাহিত্যের রসের দিক অনুবাদের মাধ্যমে জর্মনিতে পরিবেশন করতে আরম্ভ করেছেন। ফলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ল জর্মন সাহিত্যে। কবিগুরু গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ। তিনি তখন যা বলেছিলেন তাই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন প্রায় একশো বছর পরে। তিনি লিখলেন :

য়ুরোপের কবিগুরু গ্যোটে একটিমাত্র শ্লোকে শকুন্তলার সমালোচনা লিখিয়াছেন, তিনি কাব্যকে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন করেন নাই। তাহার শ্লোকটি একটি দীপবর্তিকার শিখার ন্যায় ক্ষুদ্র, কিন্তু তাহা দীপশিখার মতোই সমগ্র শকুন্তলাকে এক মুহূর্তে উদ্ভাসিত করিয়া দেখাইবার উপায়। তিনি এক কথায় বলিয়াছিলেন, কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল, কেহ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখিতে চায়, তবে শকুন্তলায় তাহা পাইবে।

এবং প্রবন্ধ শেষ করতে গিয়ে লিখলেন :

গ্যোটের সমালোচনার অনুসরণ করিয়া পুনর্বার বলি, শকুন্তলায় আরম্ভের তরুণ সৌন্দর্য মঙ্গলময় পরম পরিণতিতে সফলতা লাভ করিয়া মর্তকে স্বর্গের সহিত সম্মিলিত করিয়া দিয়াছে।

গ্যোটের মতো কবি যখন সংস্কৃত নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত তখন অন্য কবিরা যে উৎসাহিত হবেন সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। গীতিকাব্যের রাজা হাইনে তখন দুঃখ-বেদনায় কাতর হলেই স্বপ্ন দেখতে লাগতেন সেই আনন্দনিকেতন, সেই স্বপ্নের ভুবন ভারতবর্ষ শেলি কিটস বায়রন যে অবস্থায় স্বপ্ন দেখতেন গ্রিসের।

গঙ্গার পার- মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে।
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতিধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙেস ডুফটেট লয়েস্টটস
উনটু রিজেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উনট শ্যোনে স্টিলে মেনশেন্।
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।

গঙ্গানদীতে আমি পদ্মফুল ফুটতে দেখিনি। কিন্তু এ তো স্বপ্নরাজ্য। এর কিছুটা সত্য কিছুটা কল্পনা। তাই পূর্ব-বাংলার কবিও মধ্য আরবের মরুভূমির ভিতর দিয়ে তার নায়িকা লায়লাকে যখন মজনুর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন তখন তিনি যাচ্ছেন নৌকোয় চড়ে! এবং শুধু কি তাই? তিনি বিলের জল থেকে সেই আরবদেশে–কুমুদকহার তুলে তুলে খোঁপায় খুঁজছেন!

হাইনে জাত-ধর্মে ইহুদি। তার ধমনিতে আর্যরক্ত নেই। কিন্তু আর্যজর্মানিতে তখন ভারতীয় আর্যের প্রতি যে সমবেদনা, গৌরবানুভূতির প্লাবন আরম্ভ হয়েছে তাতে তিনিও নিজকে ভাসিয়ে দিলেন। তাঁর বহু কবিতায় কখনও প্রচ্ছন্ন, কভু-বা প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি আকুল ব্যাকুল হৃদয়াবেগ (জর্মন ভাষায় এই হৃদয়াবেগের নাম শুয়ের্মেরাই)।

ওই সময়ে ভারতের প্রতি জর্মনির কতখানি শুয়ের্মেরাই (ইংরেজিতেও এর প্রতিশব্দ নেই- ফেনাটিক এনথুসিয়েজম-এর অনেকটা কাছাকাছি) তার কয়েকটি উদাহরণ দিই।

ভারতবর্ষে যখন কেউ জর্মন ভাষা শিখতে আরম্ভ করে তখন সাধারণত তাকে যে প্রথম ক্ষুদ্র উপন্যাস পড়তে দেওয়া হয় তার নাম ইমেজে। আমিও এই বই পূৰ্বোল্লিখিতা শ্রীযুক্তা ক্ৰামরিষের কাছে পড়ি। তাতে জর্মন বাচ্চাদের খেলাধুলোর একটি বর্ণনা আছে। তারা সবাই মিলে একটা ঠেলাগাড়ি তৈরি করে তার উপর কেউ-বা চাপছে, কেউ-বা দিচ্ছে ঠেলা। আর সবাই মিলে একসঙ্গে প্রাণপণ চেঁচাচ্ছে :

নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েন্!
ভারত চলো, ভারত চলো!

ঠেলাগাড়ি চড়ে চড়েই তারা ভারতবর্ষে পৌঁছবে!

কবিরা শিশুপ্রকৃতি ধরেন, এবং শিশুরাও কবিপ্রকৃতি ধরে। দু জনারই বাস কল্পনারাজ্যে।

কিন্তু প্রশ্ন, তারা নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েনই করছে কেন, না আমেরিকা কিংবা নাখ চীনা চেঁচাচ্ছে না কেন? জর্মনির কাচ্চাবাচ্চাদের ভিতরও তখন এই শুয়ের্মেরাই ছড়িয়ে পড়েছে। এ বইয়ের প্রকাশ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে।

ওই সময়ে ইয়োরোপে যেসব পণ্ডিত বেদ চর্চায় মত্ত তাদের তিনজনই জর্মন : বেনাই, ম্যাকমুলার এবং ভেবার। ম্যাকমুলারকে সবাই চেনেন, ভেবারের লেখার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র সুপরিচিত ছিলেন, কিন্তু কেনফাই সামবেদের অনুবাদ করেছিলেন বলেই বোধহয় অতখানি খ্যাতি পাননি। তবে জর্মনির শিশুসাহিত্যে তিনি সম্রাট। তার পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ প্রাতঃস্মরণীয়।

কাজ তখন এত এগিয়ে গিয়েছে যে একখানা সর্বাঙ্গসুন্দর সংস্কৃত-জর্মন অভিধান না হলে আর চলে না। দুই জন পণ্ডিত ব্যোটলি ও রোট তখন যে অভিধান প্রস্তুত করলেন সেটি প্রকাশিত হল রুশ সম্রাটের অর্থসাহায্যে সাত ভলুমে, ১৮৫২-৭৫ খ্রিস্টাব্দে।

এ অভিধান অতুলনীয়। কিয়দ্দিন পূর্বে পরলোকগত পণ্ডিতবর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ই আমার জানামতে একমাত্র বাংলা আভিধানিক যিনি তার বঙ্গীয় শব্দকোষ রচনাকালে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।

ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি
কাঁদিছে ক্রন্দসী।

এ স্থলে ক্রন্দসী শব্দের অর্থ কী? ভাসা ভাসাভাবে অনেকেই ভাবেন, ওই চতুর্দিকে কান্নাকাটি হচ্ছে, আর কি। অন্যায়টাই-বা কী? স্বয়ং নজরুল ইসলাম লিখেছেন, কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের কোষ অনবদ্য। তাতেও দেখবেন, সংস্কৃত অভিধানে পাই নাই, কিন্তু রোদসী পাইয়াছি। তার অনুকরণে অনুপ্রাসানুরোধে (!) ক্রন্দসী। কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক উদ্ভাবিত (!) এবং বাংলায় প্রথম ব্যবহৃত। কিন্তু এতখানি বলার পর জ্ঞানেন্দ্রমোহন প্রকৃত কোষকারের ন্যায় অর্থটি দিয়েছেন ঠিক। আকাশ ও পৃথিবী; স্বর্গমর্ত।

ব্যোটলিঙ্ক-রোটের সংস্কৃত-জর্মন অভিধানখানার প্রসঙ্গ উঠেছে বলেই এ উদাহরণটির প্রয়োজন হল। এ অভিধান জর্মন দেশ ও বাংলার যোগসেতু।

একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেলে পাঠক অপরাধ নেবেন না।

ছেলেবেলায় আমার মনে ধোকা লাগে ক্রন্দসী শব্দ নিয়ে। সবে শান্তিনিকেতনে এসেছি। দূর থেকে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। শুনে ভয় পেয়েছি, তিনি নাকি বিশ বছর ধরে একখানা বাংলা অভিধান লিখছেন। বিশ বছর ধরে বাংলা-সংস্কৃত নয়, গ্রিক নয়, বাংলা অভিধান- বি…শ বছর ধরে! তখনও জানতুম না তার পরও তিনি আরও প্রায় বিশ বছর খাটবেন।

তাঁকে গিয়ে শুধাতে তিনি বড় আনন্দিত হলেন– আমি ভয় পেয়েছিলুম, তিনি বিরক্ত হতে পারেন। একাধিক বাংলা অভিধান দেখালেন যাতে শব্দটা নেই। তার পর ব্যোটলিঙ্ক রোট পড়তে পড়তে বললেন, এইবারে দেখ, জর্মনরা কী বলে। তাতে দেখি, ডি টোবেন্ডেন শ্লাখটরাইয়েন, অর্থাৎ যে দুই সৈন্যবাহিনী হুঙ্কার করছে। হরিবাবু বললেন, ঠিক, অর্থাৎ দুই পক্ষ- তার মানে উর্বশীর জন্য দু পক্ষই কাঁদছে। কিন্তু তার পরেও এগোতে হয়। ঋগ্বেদের এই ২, ১২, ৮–এর টীকা দিতে গিয়ে সায়ণাচার্য ক্রন্দসী শব্দের অর্থ করেছেন স্বর্গমর্ত।

উর্বশী কবিতায় রবীন্দ্রনাথও ক্রন্দসী শব্দ স্বর্গ ও মর্ত্য এই মর্মে ব্যবহার করেছেন। কারণ স্বর্গে দেবতা এবং মর্তের মানব দুই-ই যে তার প্রেমাকাভী, তার বর্ণনা তিনি এ কবিতায় দিয়েছেন।

এ স্থলে আর এগোবার দরকার নেই। জর্মনিতে ফিরে যাবার পূর্বে উল্লেখ করি হরিচরণ তার সফল শব্দকোষ ব্যোটলিঙ্ক-রোটকৃত অভিধানের প্যাটার্নে নির্মাণ করেছেন।

এ অভিধান জর্মনিতে প্রসার লাভ করার ফলে সে দেশে ভারতীয় জ্ঞান-চর্চা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল এবং তারই ফলে তার পরিমাণ এমনই বিরাট রূপ এগিয়ে ধরল যে, ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিতদের হাতে সমর্পণ করতে হল। জর্মন পণ্ডিত ব্যুলার তখন এক বিরাট পুস্তকের পরিকল্পনা করলেন। আর্য-প্রাচ্যতত্ত্বের পরিকল্পনা–এন্টরিশ ডের ইন্ডো-আরিশেন ফিললগি উন্ট আলটের টুমসকুন্ডে নামে এ বই পরিচিত। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এর প্রথম ভলুম বেরোয়; এ যাবৎ কুড়ি ভলুম বেরিয়েছে। প্রধানত কিলহন, ডার্স, ভাকেরনাগেল এবং আরও অসংখ্য পণ্ডিত এতে সাহায্য করেন।

এর পর আর হিসাব রাখা যায় না।

কারণ এতদিন ছিল ব্যাকরণ, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন নিয়ে চর্চা; তার পর আরম্ভ হল ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য, নৃত্য, হস্তশিল্প, সঙ্গীত- আরও কত কী নিয়ে আলোচনা। শিট সায়েব তো একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন কামসূত্র নিয়ে। ব্যোটলিঙ্কের অভিধানে কামসূত্রের টেকনিকাল শব্দ বাদ পড়ে গিয়েছিল– শিট সে অভিধানের প্রয়োজন খণ্ড প্রণয়নকালে এত বেশি কামসূত্রীয় শব্দ প্রবেশ করিয়ে দিলেন যে, তাই নিয়ে পণ্ডিতমহলে নানা রকমের শ্রুতিমধুর মন্তব্য শোনা গেল। কৌটিল্য নিয়ে কী মাতামাতি! আর, আমি দেখেছি আমারই চোখের সামনে এক জর্মন মহিলা সপ্তাহে তিন দিন করে তিনটি বচ্ছর এলেন অধ্যাপক কিফেলের কাছে অষ্টাঙ্গের জর্মন অনুবাদে সাহায্যের জন্যে। তার পূর্বে তিনি মেডিকেল কলেজ পাস করে ওই বিষয়ে বোধহয় ডক্টরেটও নিয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ক বছর খেটেছিলেন বলতে পারব না। যে ডক্টর জাওয়ারব্রুখের কাহিনী পঞ্চম জর্জের অপারেশন প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি, তিনি পর্যন্ত ক্যানসারের গবেষণা আরম্ভ করার পূর্বে জর্মন ইন্ডলজিস্টের কাছ থেকে শুনে নিয়েছিলেন, ভারতীয় বৈদ্যরাজগণ এই মারাত্মক ব্যাধি সম্বন্ধে কোন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, কোন চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।

ভারতীয় সঙ্গীত ও জর্মনি সঙ্গীত ভিন্ন ভিন্ন মার্গে চলে। তৎসত্ত্বেও ভারতীয় বিষয়বস্তু একাধিক সঙ্গীতকারকে ভারতীয় লাইট-মোতিফ জুটিয়েছে, তুলনাত্মক আলোচনা প্রচুর হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জনৈক মজুমদার এ সম্বন্ধে একখানি উচ্চাঙ্গের পুস্তক লিখে ডক্টরেট পান। পরম পরিতাপের বিষয় ওই যুদ্ধে তিনি তরুণ বয়সে প্রাণ হারান। বইখানির পাণ্ডুলিপি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এ যাবৎ সে বই কেন যে কোনও ভারতীয় বা ইংরেজি ভাষাতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি সে এক বিস্ময়।

মৃচ্ছকটিকা জর্মনদের প্রিয় নাট্য। তার একাধিক প্রাঞ্জল এবং মধুর জর্মন অনুবাদ আমি দেখেছি। এ নাট্যের ঘটনাপরম্পরার বিচিত্র ঘাতপ্রতিঘাত যে রকম জর্মন মনকে চলিত করে, ঠিক তেমনি তার গীতিরস–বিশেষ করে অকাল বর্ষায় বসন্তসেনার অভিসার ও দয়িত দরিদ্রচারুদত্তের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর উভয়ের সে বর্ষণবর্ণন জর্মন হৃদয়কে নাট্যগৃহে বহুবার উল্লসিত উদ্বেলিত করেছে। জর্মন ভাষা ইংরিজির তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর ও প্রাচীনত্ব (আরকাইক) ধরে বলে সে ভাষায় মূল সংস্কৃতের অনেকখানি স্বাদগন্ধ রক্ষা পায় এবং কাব্যরসাশ্রিত নাট্যরস সহজেই সে ভাষায় সঞ্চারিত হয়।

জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা জাতীয় জীবন– এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে তার সিংহাবলোকন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ জর্মনিতে যান। জর্মনি তখন মিত্রশক্তির পদদলিত, শব্দার্থে মর্মাহত। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, পরাজিতের সঙ্গীত। তখন জর্মনিতে যেরূপ হার্দিক অভিনন্দন পেয়েছিলেন সে রকম অন্যত্র কোথাও পাননি। সে কথার উল্লেখ তিনি নিজেই করে গিয়েছেন। আমি অন্যত্র একাধিকবার তার প্রতি জর্মন প্রীতির নিদর্শন বর্ণন করার চেষ্টা করেছি। এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।

এতদিন জর্মনদের বিশ্বাস ছিল, ভারতবর্ষ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির উচ্চ শিখরে উঠেছিল বটে, কিন্তু বর্তমান যুগে সে দেশে শুধু ম্যালেরিয়া, গোখরো এবং ইংরেজ। (যদিও অবান্তর তবু বলে ফেলি; শেষের দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি বেইমান সেটা পশুবিদরা এযাবৎ স্থির করে উঠতে পারেননি) রবীন্দ্রনাথের আগমনে এবং দু তিন মাসের ভিতর তার লক্ষাধিক পুস্তক জনসমাজে প্রচারিত হওয়ার ফলে তথা ডাকঘর নাট্যরূপে দেখে তাদের ভুল ভাঙল। নবীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাদের মনে কৌতূহল জাগল। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রথম অধ্যাপক ভাগনার অবশ্য বাংলা শিখেছিলেন নিজের চেষ্টাতেই। জর্মনিতে অনূদিত তার বাংলা-গল্প চয়নিকা বেঙ্গালিষে এরসেলুনে সম্বন্ধে আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং প্রগাঢ় প্রীতি সম্বন্ধে বার্লিনে প্রবাসী বাঙালি মাত্রই সচেতন ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর দরদটি কেমন যেন ভীতি-ভরা বলে আমার মনে হত। আমার মনে হত, বিশ্বসাহিত্যের অপরিচিত এই সাহিত্যের প্রতি তাঁর মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি (প্রায় শুয়ের্মেরাই বলা চলে) পাছে লোকে ভুল বোঝে, সেই ছলে পাছে লোকে সেটিকেও অনাদর করে ফেলে– এই ছিল তার ভয়। দুঃখিনী মা লাজুক ছেলেকে যে রকম পরবের বাড়িতে নিয়ে যেতে ভয় পায়। শোকের বিষয় এই বিষয় নিরীহ ভাবুকটিও মজুমদারের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরও জর্মনি অনেক ভারতীয় রাজদ্রোহীকে আশ্রয় দিয়েছে। এ সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানিনে। তার কারণ এর সবকিছুটাই ঘটত লোকচক্ষুর অগোচরে। তবে শুনেছি ইংরেজ যখন জর্মনির ওপর চাপ আনত, কোনও ভারতীয় বিদ্রোহীকে সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য, তখন জর্মন পুলিশ তাকে কাতর কণ্ঠে বলত, কেন বাপু একই ঠিকানায় বেশি দিন ধরে থাক? ইংরেজ খবর জেনে আমাদের ওপর চোটপাট করে তোমাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য। আজই বাড়ি বদলাও। আমরা বলব, তোমার ঠিকানা জানিনে এ কথাটি আমি শুনেছি, নেতা লালা হরকিষণ লালের ছেলে মনোমোহনলাল গাওবার কাছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিংবা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে আমার চেনার মধ্যে জর্মনিতে ছিলেন শ্রীযুক্ত সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও বীরেন সেন (এঁর পুরো নাম ও পদবি আমার ঠিক মনে নেই); এ সম্বন্ধে এঁরা সবিস্তর বলতে পারবেন এবং কিছু কিছু বলেছেনও। আর ছিলেন পরলোকগত মানবেন্দ্র রায়।

ভারতের প্রতি হিটলারের শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। তদুপরি জাপানকে হাতে আনবার জন্য তিনি চীন ভারত তাকে (প্রভাবভূমি বা স্ফিয়ার অব্ ইনফ্লুয়েন্স রূপে) দান করে বসেছিলেন বলে সুভাষচন্দ্রকে বাইরে আদর দেখিয়েও ঠিকমতো সাহায্য করেননি। সুভাষচন্দ্র যে অতিশয় তেজস্বী মহাবীর এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বিচক্ষণ কূটনীতিক ছিলেন সে কথা আমার মতো সামান্য প্রাণীর প্রশস্তি গেয়ে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি হিটলারের মনোভাব বুঝতে পেরে জাপান চলে যান। জাপানই যখন শেষমেশ ভারত আক্রমণ করবে, তখন জর্মনিতে বসে না থেকে জাপানে চলে যাওয়াই তো বিচক্ষণের কর্ম। এ সম্বন্ধে বাকি কথা প্রসঙ্গ এলে হবে।

জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা তার জাতীয় জীবন–এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে, এ সম্বন্ধে আলোচনা করার অধিকার আমার নেই। আশা করি শাস্ত্ৰাধিকারী ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রামাণিক পুস্তক লিখবেন। উপস্থিত আমি মাত্র একটি উদাহরণ দিয়ে এ স্থলে ক্ষান্ত হই।

ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়ায় টেগোর শব্দ খুললে পাবেন, মাত্র রবীন্দ্রনাথের একটি অতি ক্ষুদ্র জীবনী। এবং তার জীবনীকার হিসেবে একমাত্র টমসনের নাম।

জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া সাইজে তার ইংরেজি অগ্রজের অর্ধেক মাত্র। তবু তার প্রথমেই পাবেন, টেগোর শব্দের অর্থ। অনুবাদ দিচ্ছি–

টিগোরে, আসলে ঠাকুর (Thakur) (সংস্কৃত ঠাকুর, প্রভু, সম্মতির প্রভু), পদবি (অষ্টাদশ শতাব্দীর আরম্ভ থেকে), বর্তমানে পারিবারিক নাম। এ পরিবার দ্বাদশ শতাব্দীতে অযোধ্যা হতে বঙ্গে আগত ব্রাহ্মণদের বাঁড়ুয্যে পদবিধারী। পূর্বপুরুষ সংস্কৃত নাট্যকার ভট্টনারায়ণ (অষ্টম শতাব্দী)।

এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার জন্য তার পর একখানি পুস্তকের উল্লেখ আছে। নাম আর্ষিত ফুর রাসেন উনটু গেজেলশাফটস্-বিয়োলগি অর্থাৎ আর্কাইভ ফর রেস অ্যান্ড বায়োলজি অব সোসাইটি- জাতি এবং সামাজিক জীববিদ্যার দলিল-দস্তাবেজ।

এর পর আছে, অবনীন্দ্রনাথের জীবনী, তার পর দেবেন্দ্রনাথের এবং বিস্তৃত বিবরণের জন্য তাঁর আত্মজীবনীর উল্লেখ আছে।

বর্ণানুক্রমে সাজানো বলে সর্বশেষে রবীন্দ্রনাথের জীবনী। অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করে লেখক বলছেন, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাকে যে স্যার উপাধি দেওয়া হয়, সেটা তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অমৃতসরে রক্তগঙ্গা (জর্মনে বুট-বাট= ব্ল-বাথ) প্রবাহিত হওয়ার পর বর্জন করেন।১ এবং সর্বশেষে যে জীবনীগুলোর উল্লেখ আছে সেটি লক্ষণীয়।

(i) H. Meyer-Benfey : Rabindranath Tagore (1921); (2) P. Notorp : Studen mit Rabindranath Tagore (1921); (3) W. Graefe : Die Weltanschauung Rabindranath Tagores (1930); (4) R. Otto : Rabindranath Tagores Bekenntnis (1931); (5) M. Winternitz : Rabindranath Tagore Religion und Weltanschauung des Dichters (Prag 1936) অতি উৎকৃষ্ট; এর বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত (লেখক) (6) Marjorle Sykes : Rabindranath Tagore (1943); (7) E. J. Thompson : Rabindranath Tagore, Poet and dramatist (1948); (8) J. C. Ghosh : Bengali Literature (1948).

পাঠশালে গুরুমশায়ের কাছে প্রথম যে চড় খেয়েছিলুম সেটা আজও ভুলিনি। স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসছে সে দৃশ্যটা কিন্তু তার কথা এখন ভাবতে গেলে কেমন যেন সদয় হাসি পায়। অথচ বার্লিনে নেমে যে চড় খেয়েছিলুম সেটা তো ভুলিনি বটেই, তদুপরি এখনও সেটা স্বপ্নে দেখি এবং এক গা ঘেমে জেগে উঠি। প্রত্যেকটি ঘটনা ঠাস ঠাস করে টাইপ রাইটারের মতো গালে চড় মেরে যায় এবং তার প্রত্যেকটি যেন মনের সাদা কাগজের উপর লাল রিবনের কালিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে।

প্রথমবারের অভিজ্ঞতা। কাবুল থেকে দেশ হয়ে বার্লিন পৌঁছেছি। কাবুলে অনেক মার খেয়ে অনেক কিছু শিখেছি, কিন্তু সেগুলো তো এখানে কোনও কাজে লাগবে না। বার্লিন মারাত্মক মডার্ন শহর। এখানে চলাফেরার কায়দা-কেতা একদম অজানা।

প্লাটফর্মে অসহায় আমি দাঁড়িয়ে। রবিনসন ক্রুশো নিশ্চয়ই এতখানি অসহায় অনুভব করেননি। তিনি যে ভুলই করুন না কেন, তার জন্য তাঁকে কারও কাছ থেকে চড় খেতে হবে না, জেলে যেতে হবে না। তিনি উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ কিছু বলবে না। মার্সেলেস বন্দরে রাস্তার বাঁ দিকে চলতে গিয়ে প্রথম ধমক খেয়েছি। ফরাসি মাস্টার বলে দিয়েছিলেন বটে, কন্টিনেন্টে কিপ টু দি রাইট–আমাদের দেশে খাল-বিলেও মাঝিরা চিৎকার করে একে অন্যকে তম্বি করে আপন ডা-ই-ন! কিন্তু বন্দরের ধুন্ধুমারের ভিতর কি অতশত মনে থাকে?

স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যাঁকে মার্সেলেস থেকে তার করেছিলুম, তিনি সে তার পাননি কিংবা সেগুলো আর বলে দরকার নেই। ভুক্তভোগীই জানেন, তখন সম্ভব অসম্ভব কত কারণই মনে আসে। আমি আসছি জেনে সে আত্মহত্যা করেনি তো ইস্তেক।

পোর্টারটি কিন্তু দেখলুম আমাদের কুলির মতো ঘড়ি ঘড়ি তাড়া লাগালে না। আমার সেই বিরাট মাল-বহর– পরে দেখলুম বার্লিনে তার পনেরো আনাই কাজে লাগে না ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নির্বিকার চিত্তে পাইপ টানছে।

জর্মন ভাষা যে একেবারে জানিনে তা নয়। ঝাড়া পাঁচটি বচ্ছর উত্তম উত্তম গুরুর কাছে শান্তিনিকেতনে সে ভাষার ব্যাকরণ কণ্ঠস্থ করেছি। কিন্তু বার্লিনের এই জীর্ণ শীতের সঝে কোন জর্মন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বিদেশির মুখে তারই মাতৃভাষার শব্দরূপ– তা-ও ভুল উচ্চারণে– শুনতে যাবে? হাওড়া স্টেশনে যদি কাবুলিওলা কোন বঙ্গসন্তানকে দাঁড় করিয়ে তার খাস কাবুলি উরুশ্চারণ সহযোগে লিটু, লঙ, আশিলিঙ শোনাতে চায় তবে অবস্থাটা হয় কী রকম?

বুদ্ধি করে ট্রেনে একটি ফরাসি-জাননেওলি মহিলাকে শুধিয়ে নিয়েছিলুম, স্টেশনে মালপত্র রাখার জায়গাটাকে জৰ্মনে কী বলে? তিনি বলেছিলেন,

Gepaeckaufbewahrungsstelle

!!!

প্রথম ভেবেছিলুম তিনি মস্করা করছেন। তাই আমি সেটা টুকে নিয়েছিলুম। মাসখানেক পরে বার্লিনে গোছগাছ করে বসার পরে শব্দটিকে হামানদিস্তে দিয়ে টুকরো টুকরো করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তার অর্থ বের করেছিলুম। উপস্থিত সেই চিরকুট টুকুন পোর্টারের হাতে দিলুম। সে একটা হুম শব্দ করে গুম গুম করে ঠেলাগাড়ি চালিয়ে এগোল। আমি মেরির লিটল ল্যামের মতো পিছনে পিছনে চললুম।

মাল সঁপে দিয়ে রাস্তায় নামলুম।

দেখিনি, কিছুই দেখিনি। রাস্তা, বাড়ি, দোকান, গাড়ি, কিছুই দেখিনি। আমি ভাবছি, যাই কোথায়?

হুদো হুদো কড়ি থাকলে কিছুটি ভাবনা নেই। ট্যাক্সি এবং হোটেল এ দুটি শব্দের প্রসাদাৎ শুটনিক সহযোগে চন্দ্রলোকে নেমে আশ্রয় মেলে। কিন্তু আমার বটুয়াতে তখন ছুঁচোর কেত্তন। স্কলারশিপের প্রথম কিস্তি না পাওয়া পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। তখনও অবশ্য জানতুম না, মাটি পেতে হলে পাথর ঢাকা বার্লিন থেকে অন্তত বারো মাইল দূরে যেতে হয়।

হঠাৎ শুনি, শুট আবেন্ট! তার পর গুড় ইভনিং, তার পর ব সোয়ার। তাকিয়ে দেখি, আমার চেয়ে দু মাথা উঁচু এক পুলিশম্যান কিংবা সেপাইও হতে পারে।

পরিষ্কার ইংরিজিতে শুধালে, আপনার কি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন।

ম্যাট্রিক ফেল বঙ্গসন্তান দু শো টাকার চাকরি পেলেও বোধহয় অতখানি খুশি হয় না।

আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, হোটেল।

লোকটা আমুদে। চলতে চলতে বললে, এ শব্দটা তো ইন্টারন্যাশনাল। আপনি অত অসহায় বোধ করছিলেন কেন?

সত্যি কথা বলে দেব? প্রথম পরিচয়ের প্রথম জর্মনকে? বলেই ফেলি।

লোকটি দরদীও বটে। দাঁড়িয়ে বললে, সে তো অত্যন্ত স্বাভাবিক। স্টুডেন্ট মানুষ। পয়সা থাকার তো কথা নয়। তা হলে হসপিৎসে চলুন।

আমি শুধালুম, সে আবার কী?

ও! হসপিস! ওটা তো ইংরেজিতেও চলে।

হায় রে কপাল। শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ, অ্যান্ড্রজ, কলিনসের কাছ থেকে পাঁচ বছর ইংরেজি শিখেও যা জানিনে, জর্মন পুলিশ সেটাও জানে। কলকাতার ভোজপুরি পুলিশ তা হলে একদিন আমাকে আরবি শেখাবে।

হোটেলেরই মতো। তবে বার, ব্যুফে, ডান্স হল, কাবারে নেই। খাবারদাবার সাদাসিধে, ঘন্টি বাজালেই ওয়েটার আসে না। তাই সস্তা পড়ে।

অর্থাৎ হোটেল জিনিসটি দ্য লুক্স–হসপিস তারই গার্হস্থ্য সংস্করণ। ডাকবাংলো আর চট্টিতে যে তফাৎ তাই।

এতদিন পরও আমার স্পষ্ট মনে আছে লোকটি সঙ্গে যেতে যেতে তার মনের দুঃখ আমাকে বলেছিল। তার ছেলেটি ম্যাট্রিক পাস করেছে, কিন্তু পয়সার অভাব বলে কলেজে ঢুকতে পারেনি।

আমি তো অবাক। তিন-তিনটে ভাষা জানে। শিক্ষিত লোক বলেই মনে হচ্ছে। ফিটফাট ইউনিফর্ম না হয় সরকারই দিয়েছে, কিন্তু তেমন কিছু গরিব বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে কি এদেশেও গরিব লোক আছে।

বাকি কথা পরে হয়েছিল। হসপি কাছেই। পৌঁছে গিয়েছি।

পুলিশ মোকামে পৌঁছে দিল এই তো বিস্তর। কিন্তু এ লোকটি শক্ৰমিত্রে তফাৎ করে না। শত্রুর শেষ করতে হয়– শাস্ত্রে বলে– এ লোকটি মিত্রেরও শেষ ব্যবস্থা দেখে যেতে চায়। হোটেলওলার সঙ্গে আলাপচারী করে সুব্যবস্থা করে দিল। আমি ভাবলুম, এবারে বোধহয় আমার খাটের পাশে বসে ঘুমপাড়ানিয়া গান গাইবে।

যাবার সময় আমি বললুম, আপনার নাম কী?

একখানা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিলে।

পুলিশম্যানেরও ভিজিটিং কার্ড!

আমি শুধালুম, এদেশের সব পুলিশই কি ইংরেজি-ফরাসি বলতে পারে?

বললে, আদপেই না। তার পর একটা ব্যাজ দেখিয়ে বললে, যাদের গায়ে এই ব্যাজ থাকে তারা একাধিক ভাষা বলতে পারে। যার ব্যাজে যতটা ফুটকি, সে ততটা ভাষা জানে। আমার ব্যাজে তিনটে।

ধন্যবাদ দেবার মতো ভাষা খুঁজে পাইনি।

পরে জানলুম, একাধিক ভাষা জাননেওলা পুলিশ বিরল– আমার কপাল ভালো যে প্রথম ধাক্কাতেই তারই একজন জুটে গিয়েছিল।

.

চাটুয্যে অতিশয় সুদর্শন পুরুষ। সুন্দর ঢেউখেলানো চুল। বর্ণটি উজ্জ্বল শ্যাম। চোখ দুটি স্বপ্নালু ঘন আঁখিপল্লব যেন অরণ্যানীর স্নিগ্ধচ্ছায়া নির্মাণ করেছে। সাধারণ বাঙালির চেয়ে কাঁধ অনেক বেশি চওড়া বুকের পাটা রীতিমতো জোরদার। কোমরটি সরু– প্রায় মেয়েদের মতো। সেই চওড়া বুক নিয়ে পাখির চলনের মধ্যে যে একটা দ্বন্দ্ব থাকত তাকে দ্বন্দ্বমধুর বলা যেতে পারে।

কিন্তু বার্লিনের ভারতীয় মহল এবং তার রায়ত-প্রজাদের ভিতর সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল তার আহনুলম্বিত দুটি মোলায়েম আকুঞ্চিত জুলপি খ্যাতিতে হিন্ডেনবুর্গের গোপের সঙ্গে এরা তাবৎ বার্লিনে পাল্লা দিত। জর্মন ভাষায় জুলপিকে বলে কাটলেট। হিন্দুস্তান হৌস রেস্তোরাঁয় চাটুয্যে খাবার কাটলেটের অর্ডার দিলে আমাদের ঠিকে বামনী রঙ করে বলত, দুটো কাটলেটের জন্য একটা কাটলেট, প্লিজ! সেই বামনী থেকে আরম্ভ করে বার্লিন সমাজের মশাইমোড়ল সবাই তাঁর নামে অজ্ঞান। চেহারা ছাড়া তার আরও দুটো কারণ ছিল। অতিশয় নম এবং স্বল্পভাষী। হাঙ্গামহুজ্জত অপচ্ছন্দ করতেন বলে দিন-যামিনীর অধিকাংশ তার কাটত হিন্দুস্তান হৌসের সুদূরতম কোণের বৃহত্তম সোফার নিবিড়তম আশ্রয়ে। ব্যসনের মধ্যে ছিল অবরে-সবরে বিপ্লবী নলিনী গুপ্তের সঙ্গে এক গেলাস অতি পানসে বিয়ার পান। এ স্থলে বলে রাখা ভালো যে, বিয়ার পান বার্লিনে ব্যসন নয়। খাঁটি খানদানি বার্লিনবাসী ভিরমি গেলেও তার গলা দিয়ে জল গলানো যায় না, এবং মৃতজনের মুখে বিয়ার পাত্র ধরলে সে চুকুস চুকুস করে দিব্য চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আর চাটুয্যে ছিলেন মি, বার্লিন নম্বর ওয়ান।

খুব যে শক্তিশালী ছিলেন তা নয়, কিন্তু পরনে সবসময়ই সুরুচিসম্মত সুট-টাই। ফরাসি মহিলাদের সঙ্গে সেদিক দিয়ে তাঁর মিল ছিল। শুনেছি, ইংরেজ রমণীর নাকি ক্ষোভ, ফরাসিনী কী করে এত অল্প খরচে এত সুন্দর জামাকাপড় পরে। কাঁচা বউ যে রকম পাকা শাশুড়ির কম তেল-ঘিয়ে রান্না করা দেখে অবাক হয়।

তিনি ছিলেন ভারতীয় সমাজের বেসরকারি অনারারি পাবলিক রিলেশন অফিসার। তার অতিশয় অনিচ্ছাতে এ কর্ম স্কন্ধে এসে পড়েছিল বলে হিন্দুস্তান হৌসের টেলিফোন বাজলে তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাত নেড়ে যে ফোনের কাছে বসে আছে তাকে বোঝাতেন যে তিনি অনুপস্থিত। অবশ্য বামাকণ্ঠ হলে শিভালরির খাতিরে মাঝে-মধ্যে ব্যত্যয় করা হত।

সোফার হাতায় ডান হাত ঠেস দিয়ে তারই উপর গাল রেখে দিনরাত চিন্তা করতেন। কী চিন্তা করতেন জানিনে– খোঁচাখুঁচি করেও বের করতে পারিনি।

হোটেলে বায়স-নিদ্রায় যামিনীযাপন করে পরদিন বেরোলুম বন্ধুর সন্ধানে। সে ঠিকানায় তিনি নেই। তার পর কলকাতার হিসেবে বলতে গেলে কখনও শেয়ালদা, কখনও আলিপুর, কখনও হাতিবাগান, কখনও টালিগঞ্জ করে করে বুঝলুম, বন্ধুর যে ঠিকানা আমার কাছে ছিল, সেটা অন্তত এক বছরের পুরনো এবং ইতোমধ্যে তিনি প্রায় প্রতি মাসে বাড়ি বদল করেছেন। পাওনাদারের ভীতি তাঁর নেই, তবে যে কেন তিনি এই বার্লিন প্রদেশটার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি চষেছেন পরে তাকে জিগ্যেস করেও জানতে পাইনি। ইতোমধ্যে আমি ভুল বাসে উঠে, ভুল জায়গায় নেমে, ট্রামের নম্বরের সঙ্গে বাসের নম্বর ঘুলিয়ে ফেলে, বিরাট বিরাট বাড়ির আগাপাশতলা ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে শীতে জবুথবু হয়ে কঁকাতে কঁকাতে যখন নিতান্তই একটা বাড়ির সিঁড়িতে ভেঙে পড়লুম, তখন সন্ধান পেলুম সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মশায়ের। তিনি নিয়ে গেলেন চাটুয্যের কাছে।

সেই শীতে আমি যেন মাঘের পানাপুকুরে চুবুনি খেয়ে দেখি সমুখের আঙিনায় খড়ের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এক লহমায় সর্বাঙ্গ ওমে এলিয়ে পড়ল। দু লহমায় কুল্লে সমস্যার সমাধান হল। সাধে কি রাঢ়ভূমি বলে, মুখুয্যে কুটিল অতি, বন্দ্যো বটে সাদা, তার মাঝে বসে আছে চট্টেী মহারাজা!

পাঠান্তর প্রক্ষিপ্ত।*[* তুলনার জন্য সুশীল দের বাংলা প্রবাদ নং ২৮৬০ ও ৬৮২৩ দ্রষ্টব্য।]

আমাদের বটতলাতে বই বিক্রি হয়, কলকাতা-মাদ্রাসা অঞ্চলের নাম তালতলা। সেখানে আরবি, ফারসি, উর্দু বই বিক্রি হয়। এখানে লিভেনতলাতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়। লিভেন মানে ইংরিজিতে লাইম, কিন্তু সে লাইম আমাদের নেবু নয়, তাহলে ওটাকে স্বচ্ছন্দে নেবুতলা বলা যেত। বাঙালিরা তৎসত্ত্বেও বলত।

আমাদের দেশ গরম। সেখানে না হয় পণ্ডিতমশাই অক্লেশে ক্লাস বসান। তারও বহু পূর্বে আরণ্যক হয়ে গিয়েছে। অরণ্যে পাঠ্য ব্রাহ্মণের অংশবিশেষ। কিন্তু শীতের দেশে গাছতলাতে ক্লাস বসবে কী করে? নেবুতলা নাম তা হলে নিতান্তই কাকতালীয়। যেমন বেনেরা বটগাছতলায় বসত বলে ফিরিঙ্গিরা বটগাছের নাম দিল বানয়ান ট্রি।

হিটলার যখন তার হাজার বছরের জন্য রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে তার রাজধানী বার্লিন শহরের সংস্কার আরম্ভ করলেন, তখন প্রথমেই হুকুম দিলেন লিন্ডেন বা লাইমগাছগুলো কেটে ফেলতে। শত্রুপক্ষ রটালে, ইনি আবার আর্টিস্ট! আসলে কিন্তু তার দোষ নেই; গাছগুলো তখন অত্যন্ত বৃদ্ধ জরাজীর্ণ। সেগুলো কাটার ফলে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো বড্ড ক্যাটক্যাট করে চোখে পড়ল শত্রু-মিত্র-নিরপেক্ষ সবাই মিলে রাস্তাটার নতুন নামকরণ করলে উনটার ডেন লাটের্নে অর্থাৎ লণ্ঠনতলা! পরে অবশ্য হিটলার তামাম জর্মনি খুঁজে সবচেয়ে সেরা লিন্ডেন চারা সেখানে পুঁতেছিলেন।

.

দুশো বছরের পুরনো খানদানি রাজপথ। রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় এক মাইল অবধি গিয়ে ব্রান্ডেনবুর্গ গেট। বিরাট সুউচ্চ সেই তোরণের উপর রথাসহ বিজয়িনী বা ভিক্টোরিয়ার (ইংলন্ডের রানি না) ব্রোঞ্জ প্রতিমূর্তি। হিটলার এ রাস্তা বাড়িয়ে দিয়ে শার্লটেনবুর্গ পেরিয়ে বহুদূর অবধি টেনে নিয়ে তার নাম দিয়েছিলেন ইস্ট-ওয়েস্ট একসিস! তাঁর আত্মহত্যা করার কয়েক দিন পূর্বে এ রাস্তায় যান চলাচল যখন প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ তখন তাকে সাহায্য করার জন্য এখানে উড়োজাহাজ পর্যন্ত একাধিকবার ওঠা-নামা করেছিল। এ্যারপোর্টগুলো তখন মিত্রশক্তির কজাতে চলে গিয়েছে বলে যারা বিশ্বাস করেন। হিটলারের পালাবার কোনও উপায় ছিল না, তাঁদের বিরুদ্ধে অন্যপক্ষ এই ইস্ট-ওয়েস্ট একসিস দেখিয়ে দেন। আজ অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে এ রাস্তার পূর্বার্ধ রাশার হাতে, পশ্চিমার্ধ মিত্রশক্তির। কিন্তু সে সব অনেক পরের কথা।

এ রাস্তায় দ্রুত জীবনের চরম গতিবেগের সঙ্গে শান্ত গ্রাম্য জীবনের সুষুপ্তির অদ্ভুত সমন্বয়। দু দিকে যান চলাচলের রাস্তা; মাঝখানে লাইমগাছের বিস্তীর্ণ এভিন চলেছে তো চলেছে, তার যেন শেষ নেই। এদিকে পেভমেন্টের উপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে একাধিক লোক, বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, স্টপেজে ওটাতে চাপবে বলে, আর এদিকে এভিন্যুর উপর দিয়ে মা চলেছেন পেরাম্বুলেটর ঠেলে ঠেলে সপ্তপদী চলার গতিতে। দশ কদম যেতে না যেতে বসে পড়ছেন হেলানদার বেঞ্চিতে। সেখানে পেনশনার চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেন, যুদ্ধে বিকলাঙ্গ বেঞ্চির গায়ে ক্রাচ খাড়া করে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে, এ-বাড়ির আয়া ও-পাড়ার রুটিওলার সঙ্গে রসালাপ করছে, আর বেঞ্চির হেলানে মাথা দিয়ে হেথাহোথা সর্বত্র ঘুমুচ্ছে অনেক লোক। এক বেঞ্চিতে দুটি কলেজের ছোকরা মৃদুকণ্ঠে আলোচনা করছে। আরেক বেঞ্চে একজন আরেকজনের পড়া নিচ্ছে।

দুই সারি বেঞ্চির মাঝখান দিয়ে স্কিপ করতে করতে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে। পিছনে ঠাকুরদা চলেছেন ভ্যামটার চেয়েও মন্দ গতিতে। মেয়েটি উই– ওখানে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্কিপ করছে; ঠাকুরদা গতিবেগ বাড়াবার প্রয়োজন বোধ করছেন না।

এরই এক পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়।

বেশি পুরনো দিনের নয়। একশো বছরের একটু বেশি। এর চেয়ে ঢের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় জর্মনিতে আছে। আসলে বার্লিন খুব সম্ভ্রান্ত শহর নয়। সে বাবদে রোম, প্যারিস, ভিয়েনা এমনকি প্রাগ;– যারা দেখেছেন তারা ইস্তাম্বুলেরও নাম করেন। বার্লিন অনেকটা লন্ডনের মতো; বেশিরভাগ জিনিসই নকল। তবে কি না বিজ্ঞান এ যুগের কামনার ধন। সেখানে বার্লিনের নাম আছে, আর আছে জর্মনির রাজধানীরূপে। তারই প্রায় কেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত বলে ব্যবসা-বাণিজ্য এখানে প্রচুর। টোকিও না ওঠা পর্যন্ত বার্লিন পৃথিবীর তৃতীয় নগরী ছিল।

য়ুনিভার্সিটির সামনেই প্রতিষ্ঠাতা ভিলহেলম ফন হুমবল্টের প্রতিমূর্তি। গ্যোটের বিশিষ্ট বন্ধু।

হায়, সে সত্যযুগ গিয়েছে।

ভারতবর্ষ, গ্রিস, আরব ভূখণ্ডে একদা জ্ঞানী বললে বোঝাত সর্বজ্ঞানে জ্ঞানী। সর্ববিষয়ে সমান জ্ঞান থাকবে এমন কোনও কথা ছিল না, কিন্তু সর্ব জ্ঞানভাণ্ডার থেকে অল্পবিস্তর সঞ্চয় করে যিনি অখণ্ড সর্বাঙ্গসুন্দর বিশ্বদর্শনে উপনীত হতে পারতেন তাকেই বলা হত পণ্ডিত। এ তিন ভূখণ্ডে পাঠ্যনির্ঘণ্ট দেখলেই বোঝা যায়, আদর্শ ছিল মানবজীবনে পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর জন্য পরিপূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান। একদিকে আয়ুর্বেদ অন্যদিকে যোগশাস্ত্র, একদিকে ব্যাকরণ অন্যদিকে অলঙ্কার, একদিকে রসায়ন অন্য দিকে দর্শন, সঙ্গে সঙ্গে কাব্যের প্রতি স্পর্শকাতরতা, নাট্যে প্রীতি, কৌটিল্যের কুটিলতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয়, বসন্তসেনার নৃত্যগীতসঙ্গীতের সম্মুখে সহৃদয় বিস্ময়।

বস্তুত, এ সবই বাহ্য। কিন্তু এদের সন্নিবেশের মাধ্যমে কোনও গুণী হঠাৎ পেয়ে যান অনির্বচনীয়ের সন্ধান। সে সন্ধান ভূয়োদর্শনের, ভূমানন্দের।

সবাই পেত তা নয়, কিন্তু না পেলেও তারা সাধকসমাজে সম্মানিত হতেন। সর্ববিষয়ে তাঁদের সহানুভূতি থাকত বলে তারা প্রাজ্ঞসমাজের পৃষ্ঠপোষক বলে খ্যাত হতেন। জর্মনিতে এ স্বর্ণযুগ আসে অষ্টাদশ শতকের শেষে ও ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভে। তার অন্যতম প্রতীক ভিলহেলম ফন হুমবন্ট।

আসলে ইনি কবি এবং আলঙ্কারিক রসশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রামাণিক পুস্তক এবং গ্যোটের কাব্যালোচনা নিয়ে তিনি নামলেন আসরে। কিন্তু অল্পকাল যেতে-না-যেতেই তাঁর রাজনৈতিক প্রাখর্য ধরা পড়তেই তাঁকে ডাকা হল রাজসভায়। ওদিকে তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করতেন–সর্বোচ্চ আদর্শ বলে ধরে তুলেছিলেন মানবচরিত্রের স্বাধীন এবং সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সেই আদর্শ যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় তাই তিনি আজ ভিয়েনা কাল লন্ডনের রাজদরবারে যেতেন, কিংবা পরশু বার্লিনের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে কাজ করে গেলেন। ওই সময়েই তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে স্পেনের বাসদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করে দেখিয়ে দিলেন যে ভাষার মূলে ব্যাকরণ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু ভাষার কাঠামো ভালো করে পরীক্ষা করলে পাওয়া যায় সে ভাষা-ভাষীর পরিপূর্ণ ইতিহাস। যে কোনও সমাজের সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস লুকনো থাকে তার ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের মাঝখানে। তাই এক সমাজ যেমন অন্য সমাজ থেকে ভিন্ন ঠিক তেমনি এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে। মূলে এক সমাজ হলেও তারা যদি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, তবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন বিবর্তন তাদের আপন আপন ভাষাতে প্রতিবিম্বিত হয়।

সেই সূত্রে তিনি উপনীত হলেন চরম মীমাংসায় মানুষের মননবৃত্তির শ্রেষ্ঠতম বিকাশ হয়েছে আর্য ভাষায়। মানব দেবতাত্মার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় তার বাঙময় ভুবনে।

ভিলহেলম্ ফন হুমবল্ট ভাষাতত্ত্বের সর্বপ্রথম দার্শনিক।

তাঁর অনুজ আলেক্সান্ডার ফন হুমবল্টের পরিচয় দেওয়া আরও কঠিন। সে যুগের গুণীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নেপোলিয়ানের পরেই খ্যাতিতে এর স্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন শাখা-প্রশাখা ছিল না যাতে তিনি বিচরণ করেননি। এদিকে ভূতত্ত্ব-উদ্ভিদতত্ত্ব, ওদিকে উত্তর মেরু থেকে আরম্ভ করে বিষুবরেখা অবধি চুম্বকের আকর্ষণশক্তি-বিবর্তন, মহাকাশে উল্কাপিণ্ডে বিশেষ দিনে প্রবলতর বর্ষণ–বিজ্ঞানের একাধিক নবীন ক্ষেত্র তিনি আবিষ্কার করলেন। মহাপুরুষ মুহম্মদ বলেছিলেন, জ্ঞানের সন্ধানে যদি বেরুতে হয় তবে চীনেও যেয়ো। আরবদের কাছে চীনই সবচেয়ে দূরের দেশ। এ মনীষী জর্মনি থেকে চীন, ওদিকে দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত কিছুই বাদ দেননি। ষাট বছর বয়সে মানুষ যখন খ্যাতির মুকুট পরে সহাস্যবদনে জনগণের করতালিধ্বনি.শোনে, তখন হঠাৎ অর্থানুকূল্য পেয়ে বেরুলেন রাশিয়া ভ্রমণে আবিষ্কার করলেন উরালে হীরকচিহ্ন। অথচ প্রথম যৌবনে প্রকাশিত তাঁর দার্শনিক রহস্যতত্ত্ব ও মাংসপেশির স্নায়ু সম্বন্ধে রচনা তখনই পণ্ডিতমণ্ডলীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল।

তার কসমস বা সৃষ্টি এখনও আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে পড়া যায়। এ ধরনের বই আজকাল আর লেখা হয় না। প্রাচীন দার্শনিক জ্ঞান ও সনাতন রসতত্ত্ব তিনি মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সে যুগের নববিকশিত বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এমন এক সংমিশ্রণে যাতে করে বিজ্ঞানের ক্ষুদ্রতম বিচ্ছিন্ন জ্ঞানবিন্দু ভূয়োদর্শনের অসীম সিন্ধুতে স্থান পায়। পক্ষান্তরে দার্শনিকের কল্পনাবিলাসের ব্রহ্মাণ্ড পরিক্রমা যেন বাস্তবের ধূলিকণাকে অবহেলা না করে।

তাই বোধহয় নগণ্যজনের দৈন্য-দুর্দশা সম্বন্ধে তিনি যৌবনপ্রারম্ভেই সচেতন হন। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার পদ্ধতি দেখে উদ্ধত তার প্রতিবাদ জানিয়ে যে সংস্কারকর্ম আরম্ভ করলেন সে কথা আজও জর্মনি ভোলেনি। পরবর্তীকালে দাসপ্রথার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-পরিচয় হয়। তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন এই যুগধর্মসম্মত প্রথার বিরুদ্ধে। এবং আজীবন তাঁর সাধনার মার্গ বর্জন না করে।

তাই যখন কৃতজ্ঞ জর্মনগণ বিত্তহীন জ্ঞানার্থীর জন্য ব্রহ্মোত্তর বা ওয়াফ অর্থাৎ ট্রাস নির্মাণ করল তখন সেটিকে উৎসর্গ করা হল তাঁরই নামে আলেকজান্ডার ফন হবল্ট স্টিফটুঙ। দেশে-বিদেশে এটি সুপরিচিত।

এদেশে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে এই ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ইনি এঁদের জীবনী ও কার্যকলাপের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন।

সে সত্যযুগ গেছে। মহাকবি গ্যোটেকে গুরুত্বে বরণ করে তাঁর চতুর্দিকে যে কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর কোথাও হয়নি। শ্লেগেল, ফিষটে, শিলার, হুমবল্ট ভ্রাতৃদ্বয়, একেরমান ইত্যাদি ইত্যাদি বহু পণ্ডিত, গবেষক, কবি তাঁদের জীবন-বাতায়ন উন্মুক্ত করে পূর্ব-পশ্চিমের জ্ঞান-দর্শন, ঊর্ধ্ব-অধেঃর বিজ্ঞান-বিশ্লেষণকে যে আবাহন করেছিলেন, তারই ফলে জর্মনির যে সর্বমুখী বিকাশ হল আজও সে বিশ্বজনের বিস্ময়।

লোকে শুধায়, যে জর্মনি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পদদলিত, নিঃস্ব, আজ সে বিশ্বের উত্তমর্ণ হল কী প্রকারে?

এর বুনিয়াদ বড় দড়।

.

জীবনে সেই তিনটি সপ্তাহ কী করে কেটেছে তার বর্ণনা দেবার শক্তি আমার নেই। যেন পাহাড়ের চূড়ায় হঠাৎ কুয়াশা নামল। হাতড়ে হাতড়ে আমি এদিক যাচ্ছি ওদিক যাচ্ছি আর দুঃস্বপ্নের বিভীষিকা দেখছি; হঠাৎ পায়ের তলায় শক্ত জমি খসে পড়েছে আর আমি সর্বনাশের অতল গভীরে বিলীন হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছি। এবারে ভাষা-পরীক্ষার শক্ত জমিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব কটা হাড়হাড়ি গুঁড়িয়ে যাবে।

ভাষা-পরীক্ষাটা কী?

চাটুয্যে নিয়ে গেছেন ড. গ্যোপেলের কাছে। বলে রাখা ভালো, ইনি হিটলারের প্রোপাগান্ডা-মাস্টার ড. গ্যোবেলস্ নন। হুমবল্ট ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি। অতিশয় নিরীহ লোক। ততোধিক সাদাসিধে জামাকাপড় যতদূর সস্তা হতে পারে। মোটাসোটা মানুষ এবং হাসি হাসি মুখ। মিষ্টি সুরে এত নিচু গলায় কথা কন যে, টেবিলের এপারে এসে পৌঁছয় না। দেশে থাকতে এর সঙ্গেই পত্রালাপ ছিল। ইনিই প্রাঞ্জল জর্মনে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিট তৈরি; আমি এলেই হল। এখন বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সেই মিষ্টি গলাতেই বললেন, অবশ্য একটা অত্যন্ত সরল মামুলি পরীক্ষা দিতে হবে যে, কলেজের লেকচার বোঝার মতো জর্মন ভাষায় ক খ গ ঘ আপনি জানেন।

বলে কী! পরীক্ষা দেব কী করে? ফেল মারব নিশ্চিত। পড়তে পারি– খানিকটা। কিন্তু কেউ কথা বললে সেটা বুঝতে তো পারিনে। না হলে চাটুয্যেকে দোভাষী বানিয়ে আনব কেন।

আর এত বড় বিদকুটে ব্যবস্থা! পড়াশুনোর পর পরীক্ষা দিতে রাজি আছি, কিন্তু এখানে বুঝি আগে পরীক্ষা, তার পর লেখাপড়ি আগে ফাঁসি তার পর বিচার। হটেনটটের রাজত্বেও তো এ রকম ধারা হয় না। হ্যাঁ, দার্শনিক শোপেনহাওয়ার নামকরা জর্মন লেখকদের ভাষাতে ব্যাকরণের ভুল দেখে একবার বলেছিলেন, শুধু জর্মন আর হটেনটটরাই আপন মাতৃভাষা নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলে।

আমাদের রঙ কালো বলে মুখের ভাব পরিবর্তন ইয়োরোপীয়রা চট করে ধরতে পারে না। তাই তারা বলে, আমরা দুয়ে, অবোধ্য। আমার চেহারা কিন্তু তখন এমনি ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে, শুকনো গলাতালু থেকে এমনি চেরা বাঁশের শব্দে আওয়াজ বেরুচ্ছে যে, ভালো মানুষ ড. গ্যোপেল পর্যন্ত সেটা লক্ষ করে আমাকে দিলাশা-সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করেছেন। পরীক্ষাটা নাকি একেবারে কিসসুটি নয়, ছেলেখেলা, এলিমেন্টারি, ছ মাসের কোর্স, এখনও তিন সপ্তাহ রয়েছে, এন্তের সময় পড়ে আছে।

মানে?

অর্থাৎ বিদেশিদের জন্য জর্মন ভাষার ক্লাস হয়। ছ মাসের কোর্স। আর তিন সপ্তাহ বাদে পরীক্ষা। আপনি কাল থেকে ঢুকে যান– সব ঠিক হয়ে যাবে।

অর্থাৎ ছ মাসের কোর্স আমাকে তিন হপ্তায় শেষ করতে হবে। ওহ! কী সুখবর।

কিন্তু আমি আপত্তি জানাই কী করে? বৃত্তির জন্য দরখাস্ত পেশ করার সময় কবুল জানিয়েছি যে, আমি জর্মন জানি, প্রোফেসারের সার্টিফিকেটও সঙ্গে ছিল। এখন সেগুলো রদবদল করি কী প্রকারে?

গ্যোপেল মিষ্টি গলায় হাসিমুখে আমাকে আরও অনেক সান্ত্বনা দিলেন তার অল্প অল্প বুঝলুম। বাকিটা চাটুয্যে অনুবাদ করে দিলেন।

তার প্রত্যেকটি সান্ত্বনা-বচন আমার সর্বাঙ্গ কণ্টকিত করল। এ যেন ফাঁসির আসামিকে বলা হচ্ছে, দড়িটাকে মাখন মাখিয়ে মোলায়েম করা হয়েছে, যে টুলে দাঁড়াবে সেটা মখমলে মোড়া!

সায়েবের কথার ফাঁকে এটাও বেরিয়ে গেল যে, পরীক্ষায় ফেল মারলে ভর্তি হতে পারব না। আবার ভর্তি হওয়ার পালা ছ মাস পরে অর্থাৎ আমার জর্মন-বাসের শেষের ছ মাস কাটবে বিনা বৃত্তিতে অনাহারী। সায়েব সেটা অবশ্য বলেননি তিনি পইপই করে বোঝাচ্ছিলেন, ও পরীক্ষাতে ফেল মারে শতকরা একজন। কিন্তু সে একজন যে আমি হব না, তিনি জানেন কী করে? লটারিতে হই না, সে আমি জানি।

আরবি ভাষায় বলে, আকাশে দু খানা চাপাতি। একটি ঠাণ্ডা, আরেকটি গরম। চন্দ্র আর সূর্য।

রাস্তায় যখন বেরোলুম তখন দুপুর। সূর্যটিও তখন আমার কাছে ঠাণ্ডা চাপাতি বলে মনে হল।

তাই বলছিলুম, ভাষা-পরীক্ষার শক্ত জমিতে পড়ে হাড়-হাড্ডি চুরমার না হওয়া পর্যন্ত এখন শুধু হুশহুশ করে নিচের দিকে পতন।

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে ক্রসিঙে ক্রসিঙে ট্রাফিক পুলিশম্যান রাখা উচিত। আমি ঢুকেছিলুম দু পিরিয়ডের মাঝখানে ক্লাস বদলাবদলির সময়। করিডরে করিডরে আপন ডাইন রেখে তরুণ-তরুণীর জনস্রোত উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম পানে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রসিঙে এসে লেগে যাচ্ছে ধুন্ধুমার। ঠিক ওই সময়ই হয়তো খুলে গেল তারই পাশের বিরাট হলের দরজা। তার থেকে বেরুবার চেষ্টা করছে আরও শ-দুই ছাত্রছাত্রী। তখন লেগে যায় সত্যিকার হরিনট। সবই আবার চলতে চলতে ধাক্কা খেয়ে এদিক-ওদিক ঠিকরে পড়ে তর্ক চালাচ্ছে নিজেদের মধ্যে এখখুনি ক্লাসে অধ্যাপক যা পড়িয়েছেন তারই বিষয়বস্তু।

কিন্তু এত তাড়া কিসের। পরে শুনলুম এবং দেখলুমও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা এবং তার অনুপাতেরও বেশি ছাত্রীসংখ্যা এত মারাত্মক রকমের বেড়ে গিয়েছে যে, এখন আর ক্লাসে জায়গা হয় না। আগে না গেলে রক্ষে নেই।

রোল কল এদেশে নেই। শুনে বঙ্গসন্তান আমি বড়ই উল্লাস বোধ করেছিলুম। গাইড বুক নিশ্চয়ই আছে। তাই মুখস্থ করে ঠিক পরীক্ষা পাস করে যাব– অবশ্য ভাষা-পরীক্ষা নয়, ফাইনালটার কথা হচ্ছে। তখন শুনলুম, গাইড বুক নেই, অধ্যাপকরা বই লেখেন, সেগুলো পড়তে হয়। তা হলে ক্লাসে যাবার কী প্রয়োজন? বিস্তর বই প্রকাশিত হওয়ার পরও অধ্যাপকরা যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলো বলেন ক্লাস লেকচারে। পরীক্ষার সময় প্রশ্ন করেন তার থেকে। তার উত্তর না দিতে পারলে ভালো নম্বর পাওয়া যায় না শুধুমাত্র বইয়ের জোরে মেরে-কেটে পাসনম্বর পাওয়া যায় মাত্র।

এসব পরের কথা।

এ জলতরঙ্গ ভেদ করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্পূর্ণ অসম্ভব বুঝতে পেরে আমি মোকা পেয়ে একটা ফাঁকা ক্লাসে ঢুকে পড়লুম। খানিকক্ষণ পরে ঘণ্টা পড়ল, নেক্সট পিরিয়ডের। করিডরগুলো মরুভূমির মতো খা খা করতে লাগল।

দেশে থাকতে কত রকম কথাই না শুনেছিলুম– জর্মনি পণ্ডিতের দেশ, সেখানকার সবাই ইংরেজি জানে। রাস্তা সোনা-মোড়া। গাঁয়ের লোক যে রকম ভাবে, শ্যালদায় পৌঁছলেই তার জন্যে হুদো হুদো চাকরি অপিক্ষে করে বসে আছে।

অনেক কষ্টে বিদেশিদের প্রতিষ্ঠানটি আবিষ্কার করলুম। আশা করেছিলুম, বিদেশিদের নিয়ে এদের যখন কারবার তখন অন্তত এরা ইংরেজি বলতে পারবে। পারে, তবে আমি যতখানি জর্মন পারি তার চেয়েও কম।

বুঝলুম, বিদেশি রাজত্ব না হওয়া পর্যন্ত কোনও দেশের লোক ব্যাপকভাবে বিদেশি ভাষা শেখে না। আমরা এককালে ফারসি শিখেছিলুম; তার পর ইংরেজি শিখলুম।

মনকে সান্ত্বনা দিলুম, এরা সবাই ইংরেজি বলতে পারলে আমার আর জর্মন শেখা হত না।

ইতোমধ্যে এক সুপুরুষ কাউন্টারে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। ওঁকে দেখেই যে মহিলাটি আমার তদারক করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি খুশিভরা মুখে অনর্গল জর্মন বলে যেতে লাগলেন। বার বার প্রফেসর কথাটা আসছিল বলে অনুমান করলুম, ইনি আমাকে  জর্মন শেখাবেন। আমিও খুশিমনে ভাবলুম, এবারে আমার ভাঙা নৌকা কূল পেল। একে। আমার হৃদয়বেদনা সমুচিত ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারব।

ইয়াল্লা। ইনিও তদ্বৎ। পরে জানলুম, পাছে তার ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আপন আপন মাতৃভাষায় তার সঙ্গে কথা বলে বলে জর্মন অবহেলা করে তাই তিনি একাধিক ভাষা জানা সত্ত্বেও জর্মন ভিন্ন অন্য ভাষা বলেন না।

নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ভাঙা নৌকাটা দ-য়ের দিকে ঠেলে দিয়ে অতল জলে ডুব দিলুম। মা গঙ্গাই জানেন, বস্ত্র নেই– গামছাখানা পর্যন্ত গেছে। মনকে ধমক দিয়ে বললুম, ইংরেজির প্রতি তোমার এত দরদ কেন? ওটা কি তোমার বোনপোর ভাষা? জর্মন কি সতীনের ভাষা? ব্যস, হয়েছে, আর মুক্তোবনে বেনা বোনবার প্রয়োজন নেই।

প্রফেসর আদর করে প্রায় হাতে ধরে ক্লাসের দিকে নিয়ে চললেন। আবার চতুর্দিকে জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। এবারে কিন্তু ভয় নেই। প্রফেসর কাণ্ডারী। ইনি যদি এ দরিয়ায় আমাকে না বাঁচাতে পারেন তবে ব্যাকরণ পারাবারের কুমির-হাঙ্গর কৃৎ-তুদ্ধিতের পুচ্ছ-দন্ত থেকে পরিত্রাণ করে ভাষা-পরীক্ষার ওপারে নিয়ে যাবেন কী করে? সেই পাদ্রি সায়েবের গল্প মনে পড়ল। বদলি হয়ে এসে অচেনা গ্রামে নেমেছেন। রাস্তায় দুটি ছেলেকে জিগ্যেস করলেন গাঁয়ের গির্জের পথ।

তারা বাতলে দিলে তিনি খুশি হয়ে বললেন, আজ তোমরা আমাকে গাঁয়ের পথ বাতলে দিলে; আসছে রবিবারে যদি গির্জেয় আস তবে স্বর্গে যাওয়ার পথ আমি তোমাকে বাতলে দেব!

তখন একটা ছেলে অন্য ছেলেটার পাজরে খোঁচা মেরে বললে, শুনলি? গাঁয়ের পথ জানে না- সে বাতলে দেবে স্বর্গে যাবার পথ।

উপস্থিত দেখলুম, জর্মনি দেশের আমার প্রথম গুরু অন্তত গাঁয়ের পথটা জানেন।

সে কী ক্লাস! চীনেম্যান থেকে আরম্ভ করে নিগ্রো পর্যন্ত। ঢের ঢের চিড়িয়াখানা দেখছি, কিন্তু এ রকম তাজ্জব চিড়িয়াখানা পূর্বে দেখিনি, পরেও দেখিনি। এরা যদি কোট-পাতলুন না পরে আপন আপন দেশের পোশাক পরত তা হলে অনায়াসে পৃথিবীর যে কোনও ফ্যানসি ড্রেস, কম বলকে হারাতে পারত। দুনিয়ার চিড়িয়া জড়ো হয়েছে জর্মন বুলি শিখে, এদেশের এলেম রপ্ত করে দেশে ফিরে নয়ি তালিমের ছয়লাপ বইয়ে দেবার জন্য। আর বয়েসেরই-বা কত রকমফের! আঠার থেকে চল্লিশ অবধি ছেলেবুড়ো, মেয়ে-মন্দ।

আমরা যখন ক্লাসে ঢুকলুম তখন একটি আঠার-উনিশের খাপসুরৎ চিংড়ি প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশের রগে-পাক-ধরা চুলের চীনা ভদ্রলোককে ব্লাকবোর্ডের উপর কী একটা ধাঁধা বোঝাতে গিয়ে খিলখিল করে হাসছে, আর চীনা প্রৌঢ়টি গাম্ভীর্যের স্মিতহাস্যের সঙ্গে বোকা বনে যাওয়ার ভাবটা মিশিয়ে ঘন ঘন সামনে পিছনে দুলে দুলে দু ভাঁজ হচ্ছেন– ভদ্রতা আর ধন্যবাদ জানাতে হলে চীনারা যে রকম কাওটাও করে।

প্রফেসর হেসে বললেন, চলুক। আমি বাধা দিতে চাইনে। ধাঁধাটা কী?

চিংড়ি আড়াই লফে ডেসকে পৌঁছে তারই উপর মোলায়েমসে বা হাত রেখে অর্ধ লক্ষের আধা চক্কর খেয়ে ডেসক টপকে গুপুস করে বসে পড়ল আপন সিটে। আমি শুধু দেখতে পেলুম, একগাদা বাদামি-সোনালি মেশা ঢেউখেলানো চুল আর বেগুনি হলদেতে ডোরাকাটা ঘাগরার ঘূর্ণি।

ক্লাসের লটবর– পরে জানলুম গ্রিক বললে শাবাশ!

ত্রেতা

সেই যে সুন্দরী মেয়েটি এক লফে ডেসক ডিঙিয়ে আসন নিয়েছিল তার পর ঝাড়া বিয়াল্লিশটি বছর কী করে যে হুশ করে মাথার উপর দিয়ে চলে গেল তার জমা-খরচ আমি কখনও নিইনি। এই চল্লিশ বৎসরের ইতিহাস লেখা আমার শক্তির বাইরে। তবে মনে মনে আশা পোষণ করেছিলুম ল্যানগুইজ পরীক্ষায় পাস করে আমি যে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলুম তার বয়স, বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপদ্ধতি, সেখানকার ছাত্রজীবন, তার পর বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন, এদিকে বন শহর ওদিকে সপ্তকুলাচল, মাঝখানে বিশাল প্রশস্ত রাইন নদ, গোডেসবের্গে জীবন যাপন, হিটলারের অ্যুদয়, তার একচ্ছত্রাধিপত্য, ইতোমধ্যে হাজার হাজার বৎসরের প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মিশরে বৎসরাধিক কাল বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, (ওই সময়টায় আমি অবশ্য জর্মনিতে ছিলাম না কিন্তু হিটলারের তাবৎ বক্তৃতা এবং গ্যোবেলস-এর অনেকগুলো বেতার মারফত শুনেছিলুম) হিটলারের পতন, যুদ্ধশেষের কয়েক বৎসর পর পুনরায় একাধিকবার– জর্মন ভ্রমণ, বন্ধুমিলন এবং যারা যুদ্ধ থেকে ফেরেনি তাদের বিধবা পুত্রকন্যার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আরও কত কী– এসবের বর্ণনা দফে দফে দেব। কিন্তু বিধাতা বোধহয় সেটা চাননি। আমি যাতে অকরুণ অকারণে নিরীহ বঙ্গপাঠকের মস্তকোপরি অষ্টাদশ ভলুম নিক্ষেপ না করি তাই তিনি এই চল্লিশ বৎসর আমাকে ননস্টপ তুর্কি নাচন নাচিয়েছেন এবং তার ড্যান্স-ফ্লোর কন্যাকুমারী থেকে সিমলে, মসৌরি, পিণ্ডিদাদনখান থেকে কামাখ্যা! আর সব বাদ দিন– অষ্টাদশপদী এ খট্টাঙ্গ পুরাণ রচনা করার জন্য নিদেন যেটুকু দেশকাল পাত্রের তথা অবকাশের প্রয়োজন তার একরত্তিও তিনি আমাকে দেননি। তাকে বার বার নমস্কার।

পাগলা রাজা মুহম্মদ তুগলুক সর্বদাই তাঁর প্রজাদের মঙ্গল কামনা করতেন। কিন্তু অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন বলে মাত্রাবোধ ছিল তাঁর কম এবং প্রায়ই লঘু অপরাধে মারাত্মক গুরুদণ্ড দিয়ে বসতেন– অনেক স্থলে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী পিতা যে রকম পুত্রকে তস্য উপকারার্থে মাত্রাধিক লাঠৌষধি সেবন করান। তাই পরলোক গমনের কিয়দ্দিন পূর্বে তিনি আফসোস করেছিলেন, আমি প্রজাদের কল্যাণার্থে যেসব আদেশ দিতুম তারা সেগুলো অমান্য তো করতই তদুপরি আমার পুণ্য উদ্দেশ্যও তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারল না। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ-ঐতিহাসিক জিয়া উদ-দীন লিখলেন প্রজাসাধারণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মহারাজ আনন্দিত হলেন ও প্রজাসাধারণও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

অষ্টাদশী খট্টাঙ্গ পুরাণ লোষ্ট্র চিরসহিষ্ণু বঙ্গীয় পাঠকের শীর্ষদেশে নিক্ষেপ না করতে পেরে আমি হর্মোদ্বেলিত কণ্ঠে শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ আমেন আমেন জপ করছি এবং আচণ্ডাল গৌড়জনও সেই বিকট মধুচক্র পান না করতে পেরে ঘন ঘন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।

কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আপ্তবাক্য রূপে বলেছেন, যে-লোক মুলো খেয়েছে তার ঢেকুরে মুলোর গন্ধ থাকবেই। তাই এই চল্লিশ বৎসরের অভিজ্ঞতা যে আমার লেখাতে কিছু না কিছু বেরিয়ে যাবেই যাবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যে ইঙ্গিত পূর্বেই দিয়েছি তারই পূর্ণার্থ প্রকাশ করে বলি, সে সব অভিজ্ঞতা সুসংলগ্নভাবে কালানুক্রমে লিখে উঠতে পারিনি। কিন্তু আমি ভরসা রাখি যে, সুচতুর পাঠক আমার প্রকাশিত পুস্তক থেকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত টুকিটাকি ছিটেফোঁটা জুড়ে নিয়ে একটি জিগশো পাজল সমাধান করতে পারবেন অর্থাৎ একটি মোজাইক নির্মাণ করতে পারবেন, তদর্থ : মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি পেয়ে যাবেন। যদিও তার আউটলাইনগুলো সূক্ষ্ম শার্প হবে না, বহু ডিটেল বাদ পড়ে যাবে কিন্তু তাতে করে কিছু আসে-যায় না। তদুপরি ভারতের প্রায় সর্বশেষ আলঙ্কারিক বলেছেন, সবকিছু সবিস্তর বর্ণন করো না; পাঠককে ইঙ্গিত দেবে ব্যঞ্জন দেবে মাত্র যাতে করে সে তার কল্পনাশক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পায়। তাই কবিগুরুও আপ্তবাক্য বলে গেছেন :

একাকী গায়কের নহে তো গান
গাইতে হবে দুজনে
একজন গাবে খুলিয়া গলা
অন্য জন গাবে মনে।

যে দেশে বার বার গিয়েছি তারই এক গুণী বলেছেন, যে সবকথা সবিস্তর বলতে চায়, তার কোনও কথাই বলা হয় না। অনেক কথা যাও যে বলি কোনও কথা না বলি। (তাই) তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি ॥

বলেছেন পুনরপি ভাষার জহুরি বিশ্বকবি।

মোদ্দা কথা : কোনও পুস্তকের সব ছত্রই যদি আন্ডারলাইন করো তবে কোনও ছত্রই আন্ডারলাইন করা হয় না।

শ্রদ্ধেয় সুনীতি চট্টোপাধ্যায় একখানা বিরাটাকার বাংলা ব্যাকরণ লেখার পর অনুভব করলেন, হয়তো বড় বেশি বলা হয়ে গেছে। তাই রচনা করলেন একটি ক্ষুদ্র ব্যাকরণ। পথে দেখা হতে বললেন, এবারে একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ লিখেছি; আগেরটা ছিল ক্ষিপ্ত ব্যাকরণ। আমার এ লেখাটাতে তাঁর ইরশাদ-নির্দেশ মস্তকাভরণ হয়ে রইল।

আরেক গুণী আরেকটি সরেস উপদেশ দিয়েছেন : স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে লেখাতে কিছু কিছু ভুল রেখে দিয়ে। পাঠক সেগুলো ধরতে পারলে বিমলানন্দ অপিচ আত্মপ্রসাদ অনুভব করে। মনে মনে বলে, আমিই-বা কম যাই কিসে! ব্যাটা লেখক যতই বড়-ফাট্টাই করুক না কেন আমি, হ্যাঁ, আমি তার সবকটা বমাল ধরতে পারি। হয়তো-বা কাগজে ভ্রম সংশোধন করে চিঠি লিখবে। সে শংকরের কান মলতে পারে, অবধূতের নাসিকা কর্তন কর্মে সিদ্ধহস্ত। আপনার বইয়ের আরও তিন কপি সে কিনবে। সে যে কেরামতি মেরামতি করেছে সেগুলোসহ বিয়ে-শাদিতে প্রেজেন্ট করবে। আপনার অন্যান্য তাবৎ বই গ্যাটের কড়ি খর্চা করে বাড়িতে তুলবে– ভুলের সন্ধানে, আত্মপ্রসাদ লাভের জন্য।

আমাকে অবশ্য সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় ভুলের কলঙ্ক লেখার উপর ছিটোতে হয় না। সদাপ্রভু আমার হাত দিয়ে নিত্য নিত্য তামাক খান আর আমি খাই পাঠক পণ্ডিতের কানমলা।

ঈশ্বর সদগুরু জগদগুরু মন্নাহ জগন্নাথ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেই পরলোক গমনের দিন দুই পূর্বে তাঁরই সম্মুখে তাঁর চিকিত্সক তার সহধর্মিণীকে বলেন, আর দুধটাতে একটু জল দিয়ে সেটা পেতলে নেবেন–উনি তা হলে সহজেই হজম করতে পারবেন। ক্ষিতিমোহন জানতেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু যে লোক আজীবন রসিকতা করেছে মৃত্যুভয় তাকে স্বধর্মচ্যুত করতে অক্ষম। মৃদু কণ্ঠে বললেন, সিডা আর হাসপাতালে করন লাগবে না। গয়লাই আপন বাড়িতে কইরা লয়!

বিধাতা বলুন, নলরাজের অন্তরে প্রবিষ্ট কলিই বলুন, তিনি ওই গয়লার মতো আমার রচনাতে অনবরত জল মেশাচ্ছেন। অধম এ লেখককে আমার গুবীর মতো আর জল মেশাতে হয় না।

আগাতা ক্রিস্টি বিয়ে করেন এক আর্কিয়োলজিস্ট বা প্রত্নতাত্ত্বিককে। ক্রিস্টি যখন বার্ধক্যে উপনীত হলেন তখন এক দরদী যুবতী তাঁকে শুধোন, আপনি বুড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্বামী আপনাকে অবহেলা করছেন না তো? আফটার অল– পুরুষের মন।

মাদাম স্যানা হাসির ঝিলিক খেলিয়ে বললেন, তোমরা তো বিয়ে করার সময় অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে দুম করে ঝুলে পড়ো! আম্বো প্রথম বারে তাই করেছিলুম। দ্বিতীয় বারে নির্বাচনটি হৃদয়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে দিলুম হেডাপিস অর্থাৎ ধুরন্ধর ব্রেন বকসটিকে। সে ফরমান দিলে বিয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করাটাই শ্রেয়তর প্রস্তাব। কিন্তু নিতান্তই যদি করতে হয়, তবে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিককে।… খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাদাম শেষ তত্ত্ব, গভীরতম তত্ত্ব প্রকাশ করে বললেন, জানো তো, যে জিনিস যত বেশি প্রাচীন হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে তার মূল্য তত বেশি। কব্জিটো এর্গো সুমের ছকে ফেলে অতএব আমি যত বুড়োচ্ছি ততই ওর কাছে আমার মূল্য বাড়ছে।

বিধাতা গয়লা আমার লেখাতে যেমন শনৈঃ শনৈঃ ব্যাকরণের ভুল বাড়াচ্ছেন, শৈলীর শিরদাঁড়া আর ভাষার পাঁজর কটা মটমট করে ভাঙছেন, আমার বইয়ের কাটতি তেমন তেমন হুশহুশ করে বেড়ে যাচ্ছে। পূর্বে যে স্থলে আড়াই শো বইয়ের এক সংস্করণ কাটতে ঝাড়া কুড়িটি বছর কেটে যেত এখন মাত্র উনিশটি বত্সর।

হরি হে তুমিই সত্য।

এই যে হনুমানি লম্ফ দিয়ে আমি মবলগ চল্লিশটি বছর অতিক্রম করলুম নানাবিধ প্রবন্ধ গল্প মারফত এ চল্লিশ বৎসরের একটা সাদামাটা বোচাভোতা মোজায়িক গড়ে তুলেছি, যার উল্লেখ পূর্বেই করেছি, এবং এটাকে দু যুগের সেতুবন্ধস্বরূপ বিবেচনা করা যেতে পারে সে সম্বন্ধে এবং বর্তমান লিখন সম্বন্ধে একটি সাবধানবাণী চতুর্থ বা পঞ্চম বারের মতো পাঠকের দরবারে পেশ না করলে আমি গুরুহীন তথা ধর্মভ্রষ্ট হব।

সেটি এই :

১৯৪৪ সালে যখন স্বরাজ কোন শুভাশুভ লগ্নে অবতীর্ণ হবেন, কী রূপ নিয়ে অবতীর্ণ হবেন, বামন অবতার না এক আজব নয়া ক্লীব শিখণ্ডি অবতার এবং সে-ও অতিশয় ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র ধূলি পরিমাণ অংশাবতার হয়ে (আজ তো অহরহ চতুর্দিকে সেই নপুংসকাবতারই দেখতে পাচ্ছি) এই দিলীপ ভগীরথের (একদা) প্রাতঃস্মরণীয় পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে অবতীর্ণ হবেন- সে যুগে আমাদের মনে স্বরাজ সম্বন্ধে স্পষ্টাস্পষ্ট কোনও ধারণাই ছিল না। ১৯২০/২১-এ গাঁধীজি এক বৎসরের ভিতর (ভাগ্যিস দশ মাস দশ দিন বলেননি) স্বরাজ আনবেন বলে দিলাশা দেন। কবিগুরু তখন তাকে মুখোমুখি বলেন, এক বৎসরের ভিতর যদি না আসে তবে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জনগণ-মনে যে নৈরাশ্যজনিত কর্মবিমুখ জড়ত্ব এনে দেবে সে কথা ভেবেছেন কি? মহাত্মাজি বলেন, আমি মরালি স্থিরনিশ্চয় যে প্রত্যেক ভারতীয় যদি আমার কর্মসূচি গ্রহণ করে তবে এক বৎসরের ভিতর আমরা স্বরাজ লাভ করবই করব। (এর মাত্র আঠারো বৎসর পর হিটলারও রণশখে ফুকার দেবার পূর্বে বলেন, প্রত্যেক জর্মন সৈন্য যদি সূচ্যগ্রন সুতীনে ভিদ্যতে যা চ মেদিনী পরিত্যাগ করে পশ্চাৎপদ না হয় অপিচ শত্রুকে নিধন করতে করতে বীরের ন্যায় যে ভূমিতে দণ্ডায়মান সেখানেই মৃত্যুবরণ করে তবে আমার জয়লাভ অনিবার্য। অতিশয় হক কথা- সাধু, সাধু। উত্তম, উত্তম। কিন্তু জিজ্ঞাস্য : আমাদের যখন অজানা নয় যে প্রত্যেক মানুষেই কর্মক্ষমতা, আত্মোৎসর্গপ্রবৃত্তি, শৌর্যবীর্য পরিচয় দানের একটা সীমা আছে তখন প্রত্যেকটি লোক শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করে করে ধূলিশয্যা গ্রহণ করবে এহেন আশা করাটা পূৰ্বাভিজ্ঞতাসম্মত নয়– এটাকে বরঞ্চ ধর্মরাজের দূতক্রীড়ার সময় এবারে আমি জিতব, এবারে আমি জিতবই জিতব দুরাশা দুরাশায় গড়া পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তদুত্তরে হিটলার অবশ্যই বলতে পারতেন, নিয়তি (হিটলার ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না, কট্টর নাস্তিকও না, কিন্তু নিয়তির অদৃশ্য লিখনে দৃঢ় বিশ্বাস করতেন) কখনওই কোনও মানুষের স্কন্ধে সে বোঝা চাপান না যেটা বইতে পারবে না।

তা সে যাই হোক যাই থাক, কর্মক্ষেত্রে দেখা গেল গাঁধীজির প্রতিশ্রুতি এক বৎসর অতি সরেস রবারের মতো– বড্ডই ইলাস্টিক, বিলম্বিত উভয়ার্থে হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ধারণ করে। যতই মারিবে টান ততই যাবে বেড়ে।

এ স্থলে আমাকে বাধ্য হয়ে কিছুটা জীবনস্মৃতি মন্থন করতে হবে। পাঠক, অসংখ্যবার আমার অপরাধ মার্জনা করেছ। আরেকবার করলে হয়তো একশোতে পৌঁছে তুমি রত্নাকরের মতো মোক্ষ লাভ করে যাবে। আর কথায় বলে যাহা বাহান্ন তাহা তিরানব্বই (হায়, হায় পাঠক, দ্যাখ তো না দ্যাখ, বিধাতা গয়লা আমার হাত দিয়ে কী কৌশলে তামাক খেয়ে নিলেন, অতি সাধারণ একটি প্রবাদ গুবলেট করে দিলেন)। কিন্তু আমার জীবনস্মৃতি লিপিবদ্ধ করার মতো দুর্মতি আমার কখনও হবে না সে আমি জানি। ওদিকে আবার আমার চেয়েও পাপিষ্ঠজন ইহসংসারে আছে। তারা সর্বক্ষণ আমাকে টুইয়ে টুইয়ে অনুযোগ বিনয় করে, আমি যেন আমার আত্মজীবনী লিখি, কারণ আপনার মতো বিচিত্র অভিজ্ঞতা কজনের আছে (অর্থাৎ খুনখারাবি করে পৃথিবীতে কোন দীনতম দেশের কারাগারের শ্রীবৃদ্ধি সাধনে মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন আমি করিনি?), পৃথিবীর কোন দেশ আমি চষিনি (অর্থাৎ কোন দেশের পুলিশ আমাকে গুণ্ডা আইনে ফেলে– যে আইনানুযায়ী নগরপাল যে কোনও গুণ্ডাকে চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর শহর ছেড়ে অন্যত্র যাবার মোক্ষম আদেশ দিতে পারেন– সেদেশ থেকে বের করে দেয়নি?)। মোদ্দা কথা আমি অকপটে সত্যবর্ণন করলে তেনারা বগল বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে বলবেন, বলেছিলুম, তখনই বলেছিলুম। হয়তো-বা একটি ছড়াও সঙ্গে জুড়বেন :

বাইরে তোমার লম্বা কোঁচা
ঘরেতে চড়ে না হাঁড়ি,
খেতে মাখতে তেল জোটে না,
কেরোসিনে বাগাও তেড়ি।
যাও হে, যাও হে, কালাচাঁদ
আর এসো না আমার বাড়ি
এবার এলে আমার বাড়ি
দেব তোমায় খ্যাঙরার বাড়ি।

পক্ষান্তরে এবারে আমার জীবন সম্বন্ধে নির্বিকার উদাসীন পাঠক বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই, কোন দুষ্ট, পরশ্রীকাতর, বিঘ্ন-সন্তোষী জুগুপ্সা দ্বারা তাড্যমান হয়ে এনারা আমাকে জীবনস্মৃতি লিখতে বলেন।

কিন্তু ভবদীয় সেবককে তার কিছুটা, সামান্যতম অংশটা এ স্থলে নিবেদন করতেই হবে। নইলে (১) সে-পটভূমি নির্মিত হবে না যার সাহায্য বিনা পাঠক আমার তাবৎ সম্যক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।

অপরঞ্চ (২) পূর্বলিখিত চল্লিশ বৎসর যে মুষ্টিযোগ প্রসাদাৎ আমি ডুবসাঁতার মেরে মোজায়িক নির্মাণ করেছিলুম এ স্থলেও তদ্বৎ। সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করব।

.

১৯৪৪-এর কাছাকাছি আমি বে-car (বে-কার) তো বটেই, এবং নির্জলা বেকার। শ্যামপেন বরগন্ডি মাথায় থাকুন জল এস্তেক জোটে না। মাথার উপরে ছাতখানাও যদি না থাকে তবে ট্যাপই-বা কোথায় কুঁজোই-বা কই? কাজেই রাস্তার কল থেকে আঁজলা আঁজলা জল খেতুম। তদাভাবে পার্কের পুকুর কিংবা মা-গঙ্গার স্তন্যরসই ছিল আমার সম্বল।

অবস্থা যখন চরমে তখন শ্রীমান কানাই (ভজু-কানাই) সরকারের সঙ্গে দেখা। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, (আমি যখন শান্তিনিকেতন কলেজে পড়তুম সে তখন ইস্কুলে) যে আমি তখন ইস্কুলের সাহিত্য সভায় বেনামিতে কয়েকটি রচনা পেশ করি। সেগুলো এমনই ওঁচা যে আমি স্বয়ং পড়লে সাধু-স্ সাধু-সাধু রব ওঠার পরিবর্তে দুয়ো দুয়ো দুয়ো ধ্বনি সভাস্থলের চতুর্দিকে মুখরিত হত। ওদিকে মহারাজ শ্রীমান ভজু-কানাই সাহিত্যসভার সেক্রেটারি (আমরা আড়ালে বলতুম স্যাঁকা রুটি) তারে মারে কেডা।*

[*শ্রীমান কানাই যখন শান্তিনিকেতনে এলেন তখন অন্য এক কানাই সেখানে বর্তমান। গুবলেট এড়াবার জন্য তখন তার দাদা ভজুর সঙ্গে তার নাম জুড়ে দিয়ে ভজু-কানাই নাম রাখা হল। আরেকটি উদাহরণ চমৎকার একটি এমনি ছোটখাটো একমুঠো ছেলে এল যে সবাই তার নাম দিল সিকি। ওমা, পরের বৎসর সে তার ছোট ভাইকে নিয়ে এল–সে আরও ক্ষুদে, একদম মাটির সঙ্গে কথা কয়। তার নাম রাখা হল দুআনি।]

সেই কানাইয়ের সঙ্গে দেখা কলকাতায়। ছেলেবেলার বিস্তর কচিকাঁচারা একটুখানি সিনিয়র ছাত্রদের হিরো ওয়ারশিপ করে। আমার রচনা পরে সে যে বিস্তর সাধু-স-সাধু কুড়িয়েছিল তার থেকে তার একটা অন্ধ ধারণা হয়ে গিয়েছিল আমি কালে রীতিমতো ডাকসাইটে কেউকেডা লেখক হব। তাই দেখা হওয়া মাত্রই আমাকে পড়কে নিয়ে গেল স্বর্গত সুরেশ মজুমদার মহাশয়ের সমীপে।

আহা! এ রকম আরেকটি সংবাদপত্র কর্ণধার আমি ত্রিভুবন চষেও পাইনি। কিন্তু আজ না, মোকা পেলে আরেকদিন তাঁর দেহ, মন ও সর্বোপরি তার হৃদয়ের সবিস্তর বর্ণন দেব। তিনি আড়নয়নে আমার দিকে একবার মাত্র তাকিয়েই কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা মুদ্রা দেখালেন। এ রকম বিনা মেহনতে আমি কোনও পরীক্ষা পাস করিনি।

সত্যপীর ছদ্মনামে সপ্তাহে দু বার দুই কলম, আফটার এডিট লিখতুম। সে কাহিনী দীর্ঘ। শুধু দুঃখের সঙ্গে বলি সে আমলে যারা সবে সাবালক হতে যাচ্ছেন সেই আমি আজ হয়ে গেলুম তাদের পেট রাইটার, অর্থাৎ আমি তাদের ফ্যান। হায় আজ তাদের দরবারে কল্কে পেতে হলে আমাকে রীতিমতো কসরৎ করতে হয়। সব সময় পাইনে। এখন যদি সেই প্রায় ত্রিশ বৎসরের পুরনো সত্যপীর নাম দিয়ে কিছু লিখি– অতিশয় সভয়ে বৃদ্ধ বরজলালের মতো ক্ষীণ কণ্ঠে অর্থাৎ শ্লথ অক্ষম হস্তে লিখিত যৎকিঞ্চিৎ পাঠাই তবে সেটা ছাপা হয় ইংরেজিতে যাকে বলে অন এ রেনি ডে। রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সে একটি কবিতা নিম্নের কটি ছত্র দিয়ে আরম্ভ করেন :

ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক
তাহার তরে বৃথায় করা শোক।
কিন্তু যখন বলে জীবন্মৃত্রর
তখন শোনায় তিতো
আমার হল তাই—

পরে কবি বুঝলেন, গৌড়ীয় পাঠক মাত্রই তার এ-বিনয় অট্টহাস্যসহ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। তাই পুস্তকাকারে প্রকাশের সময় এ ছত্র কটি তিনি নাকচ করে দিলেন।

আর আমার বেলা?

জীবন্ত না। খাবি-খেকো, গঙ্গাযাত্রার আস্ত জীবন্মৃত।

সে কথা থাক।

ওই সময় অন্যান্য যাবতীয় বিষয়বস্তুর মধ্যে আমার একটি বক্তব্যে আমি বার বার ফিরে আসতুম। বলতুম, স্বরাজ আমাদের দিগ্বলয় চক্রের মতোই নিয়ে বা ঊর্ধ্বে দৃষ্টির বাইরে থাকুন না কেন, এই বেলাই তার জন্য কিছু কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন। ২. স্বরাজলাভের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত পৃথিবীর সর্বদেশেই এম্বেসি, লিগেশন, কনসুলেট, ট্রেড কমিশন নিযুক্ত করবে; ৩. সে সব দফতরের জন্য বিদেশি ভাষা জাননেওলা লোকের প্রয়োজন হবে; ৪. বাঙালি ভাষা শেখার জন্য বিশেষ বুদ্ধি ধরে অতএব, এই বেলাই সাততাড়াতাড়ি কলকাতাতেই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা শিখবার ব্যবস্থা করা অতীব প্রয়োজনীয় জরুরি কাজ। কারণ প্রথম ধাক্কাতেই যারা ফরেন সার্ভিসে ঢুকতে পারবেন তারা দেশদেশান্তরে ঘুরে বেড়াবেন এবং ফলে তাদের ছেলে এমনকি মেয়েরাও একাধিক ভাষা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় শিখে নেবে। তখন আমাদের কলকাতার মেধাবী ছেলেরাও এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। ফলে ভালো ভালো চাকরি, যারা প্রথম ধাক্কায় ঢুকেছিল বংশানুক্রমে তাদের গোষ্ঠীপরিবারের একচেটে সম্পত্তি হয়ে যাবে। এ কিছু আজগুবি নয়া হাল নয়। বিসমার্ক এমনকি তার পূর্বেও যেসব খানদানি পরিবার ফরেন অফিসে প্রথম ধাক্কাতেই প্রবেশ করেছিল তাদের বংশধরগণকে গণতান্ত্রিক ভাইমার রিপাবলিক কমিয়ে দিয়ে মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোককে ঢোকাতে পারেননি। এমনকি হিটলারও এদের বিশেষ কাবু করতে পারেননি। এঁরা মস্করা করে বলতেন, নাৎসিদের দিয়ে এসব কাজকর্ম করানো যায় না; আমাদের মতো স্পেস (স্পসিয়ালিসট= স্পেশালিস্ট ওয়াকিফহাল) না থাকলে তাবৎ ফরেন আপিস এবং সঙ্গে সঙ্গে ওদের নিযুক্ত ন্নি ভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো তছনছ বানচাল হয়ে যাবে।

আমার এসব সাবধানবাণীতে খুব কম লোকই তখন কান দিয়েছিলেন। একাধিক জন। আমাকে বলেন, আরে মশাই, আগে তো স্বরাজ ফলটি পেকে মাটিতে পড়ুক।

আমার পেটেন্ট উত্তর ছিল, রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?

আজ আমাদের কানে জল গেছে। আজ ম্যাকস্যুলার ভবনে, রুশ পাঠচক্রে ভিড় এমনকি কোনও কোনও বাড়ির বউ-ঝিরা এঁদের মধ্যে আছেন। শ্ৰীযুত মনোজ বসুর ধর্মপত্নী ও পুত্রবধূ কয়েক বৎসর আগে একই রুশ ক্লাসে পড়াশুনো করতেন।

কিন্তু ইতোমধ্যে ঘোড়া পালিয়েছে। আস্তাবলে এখন চাবি মারাটা বন্ধ্যাগমনের ন্যায় নিষ্ফল। সংস্কৃত সুভাষিত কয়, প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে যাওয়ার পর তেল দিয়ে কী লাভ, যৌবনান্তে বিবাহ করে কী ফল পাবে!

সেই ১৯৪৪ থেকে কানমলা খেয়ে খেয়ে অর্থাৎ এ সব বাবদে লেখা সাধারণ জনের কৌতূহল উদ্রেক না করাতে আমি অন্য সব বিষয় নিয়ে লিখতে আরম্ভ করলুম। যারা দেশ পত্রিকায় (এ পত্রিকাতে ১৯৪৮/৪৯-এ আমার সর্বপ্রথম পুস্তক দেশে-বিদেশে ধারাবাহিক রূপে বেরোয় এবং সে-সম্বন্ধে দেশ পত্রিকার সুযোগ্য একনিষ্ঠ সম্পাদক শ্রীমান সাগরময় ঘোষ তাঁর অনবদ্য সম্পাদকের বৈঠক পুস্তকে কীর্তন করেছেন। সে যুগ থেকে বস্তুত ১৯৪৪ থেকে আমি কয়েক মাস, কখনও-বা দু এক বৎসর বাদ দিয়ে ঢাকের বাদ্যি থেমে গেলেই ভালো শোনায় দেশ পত্রিকায় প্রধানত পঞ্চতন্ত্রই লিখে আসছি) আমার এই পঞ্চতন্ত্র মাঝে মধ্যে পড়েছেন তারাই জানেন আমি এখন প্রধানত অজগর আসছে তেড়ে।/আমটি আমি খাব পেড়ো কিংবা ঔড্র পদ্ধতিতে ক রে কমললোচন শ্রীহরি/। করেন শঙ্খচক্রধারী ধরনের নির্বিষ অজাতশত্রু রচনাতে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখি।

কিন্তু ইতোমধ্যে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে। আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে। স্বরাজ লাভের সঙ্গে (১) ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা মদনভস্মের মতো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লেন। তারা যে সব দেশে অবস্থান করছেন তাদের সমস্যা, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় সম্বন্ধে বিবৃতি দিতে লাগলেন; কখনও স্বেচ্ছায় কখনও পার্লিমেন্টের তাড়া খেয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারফত। তাঁদের দারাপুত্ৰপরিবারও এ সব দেশকে কেন্দ্র করে সাহিত্য নিম-সাহিত্য প্রকাশ করলেন। (২) দলে দলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, জর্নালিস্ট, সাহিত্যিক, ছাত্রছাত্রী, টুরিস্ট, সরকারি কর্মচারী গয়রহ নিত্যি নিত্যি দুনিয়াটা চষে ফেলতে লাগলেন। তাদের অনেকেই গানা থেকে অল-আলেমিন সিদি অল-বররাণি, পানামা থেকে তাশকেন্দ প্লাদিভস্তক সম্বন্ধে এন্তের এন্তের প্রবন্ধ কেতাব লিখলেন। অনেক সময় অগ্রপশ্চাৎ সম্যক বিবেচনা না করে। পরে সে বইয়ের কিয়দংশ সানুষ্ঠানে ভস্মীভূত করা হল। চার্বাক বলেছেন, ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতৎ কিন্তু এস্থলে পুনরাগমন আদৌ অসম্ভব নয়। বিশাখাপট্টনমে যখন জাপানি বোমা পড়ে তখন সরকারের হুকুমে ট্রেজারি অফিসার জমায়েত কারেনসি নোট পুড়িয়ে দিল্লিতে খবর দিলেন তিনি সাকুল্যে তাবৎ নোট ভস্মীভূত করেছেন। উত্তম। দু বত্সর যেতে না যেতে তার কিয়দংশ গুঁড়ি গুঁড়ি কী করে যে হাটবাজারে মদ্যালয়ে ক্লাবে আত্মপ্রকাশ করল কেউ জানে না।… এবং সবচেয়ে মোক্ষম তত্ত্ব (৩) ইংরেজ আমলে আমাদের বৈদেশিক নীতি কী হবে সে নিয়ে আমাদের কোনও শিরঃপীড়া ছিল না। এখন ওই বিষয় কানু ভিন্ন গীত নেই। অধুনা ডিহি পোঁদালিয়া ২/১ক/ক নং থার্ড বাইলেন শালপাতা ঠোঙ্গা বিতরণীর সহ-শাখা-কমিটির রক থেকে আরম্ভ করে টাটা-বিড়লা-লিভার ব্রাদারজের গোপনতম আলোচনা কক্ষে ওই এক কানুর গীত। যেমন মনে করুন এই যে ইংরেজ কমন মার্কেটে ঢোকার জন্য বেহায়া বেশরম হ্যাংলামোর চূড়ান্তে পৌচেছে, টা-পেনি হে-পেনি লুকসুমবের্গ বেলজিয়ামের মতো দেশের পা চাটছে সর্ব ইজ্জৎ সর্ব ইমান সৰ্ব আব্রু বাকিংহাম প্রাসাদস্থ স্কেটিং করার পুকুরে গলায় পাথর বেঁধে বিস্ হাথ পানিমে ডুবিয়ে দিয়ে দ্য গলের প্রেতাত্মারূপী বর্তমান সরকার তাদের পশ্চাদ্দেশে দু-চারখানা সবুট সরেস কিক কষাবে না তো- গোষ্ঠ-সমদ যে রকম পেনালটি পেলে, কালী (মৌলা) আলী ফোকটে বেমক্কা না-হক্কো পেনালটি পেলে যে রকম কালী আলীর (কালীঘাট মৌলা আলী) কাছে পুজো শিরনি মানৎ করে।

এইসব এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে ট্রেনজিসটারের সুলভতা ভুলবেন না– দেশের লোক, রকের রকফেলার এস্তেক পাড়ার পদীপিসি পর্যন্ত নানা বিষয়ে এমনই ওয়াকিফহাল হয়ে গিয়েছেন যে ১৯৪৪ সালে যা ছিল কঠিন বিষয়বস্তু, স্পেশেলাইজড তত্ত্বতথ্য, আজ তার অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে ক ম ন ন লে জ। যেমন ধরুন ১৯৪৪–চুয়াল্লিশ কেন প্রায় ১৯৫২/১৯৫৩ অর্থাৎ যত দিন না নাপাক সরকার উভয় বঙ্গের যাতায়াতের জন্য ভিসা প্রথা প্রচলন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গসন্তান চোখের জলে নাকের জলে শিখল, ভিসা কারে কয় এবং প্রথম আপন সরকার ভারতীয় হলে ভারত সরকার পাকিস্তানি হলে পাক সরকারের কাছ থেকে যে সর্বপ্রথম দশ টাকা না পনেরো টাকা খর্চা করে একখানি পাসপোর্ট যোগাড় করতে হয়। তার জন্য কিউয়ে দাঁড়াও, ফর্ম বের করো এবং বিরাটতম চার পৃষ্ঠাব্যাপী তিন দফে (ইন ট্রিপলিকেট!) সেগুলো ফিলআপ করো। পাক্কা দেড়ঘণ্টা থেকে দু ঘণ্টা লাগে, যশয়। এই ফর্ম যদি আপনি স্বয়ং ফিলআপ করেন তবে আন্তর্জাতিক প্রাথমিক আইনকানুন সম্বন্ধে আপনার বেশ খানিকটে জ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু দোহাই ধর্মের, আপনার নিরাপত্তার জন্যে তথা পাসপোর্ট আপনি আখেরে যেন পান তার জন্য আপনি সে ফর্ম স্বয়ং ফিলআপনা করে করাবেন ওই আপিসের আশেপাশে যেসব প্রফেশনাল ফর্ম ফিল আপ করনেওলারা আছে। অপরাধ নেবেন না; বেহারি ভাইয়ারা যে রকম ইটালিয়ান ব্যুরোতে, অর্থাৎ ইটের উপর বসে প্রফেশনালকে দিয়ে মনিঅর্ডার ফর্ম ফিলআপ করায়। হুবহু সেই রকম। অ। আপনি বুঝি ইংরেজিতে এম.এ. ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, পিএইচডি.লিট। তাই আপনার দেমাক। কোনখানে ব্লক ক্যাপিটাল হরফে লিখবেন আর কোনখানে সাদামাটা হরফে, যে সব জায়গা দফতর ফিল আপ করবে, করে ফেললেন আপনি, যে জায়গাটা সুন্দুমাত্র খালাসিদের (যারা একদা পাকিস্তানি ছিল কিন্তু অধুনা ইন্ডিয়ান, আবার কখন রঙ বদলাবে তার স্থিরতা নেই এবং ইতোমধ্যে বেআইনি কায়দায়– যার জন্য তিন মাসের তরে শ্রীঘর-শ্বশুরালয়– সে জোগাড় করেছে তিন-তিনখানা পাসপোর্ট : প্রথমটাতে সে ভারতীয় নাগরিক, দ্বিতীয়টাতে সে পাক্কা ব্রিটিশ, তৃতীয়টাতে সে পাকিস্তানি। পুলিশ সন্দেহ করে শুধোলে সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলবে সে ভারতীয় এবং ভারতীয় পাসপোর্ট তার ছিল কিন্তু সেটা খোয়া গেছে : তার মতলব আরেকখানা পাবার। পেলে এটা বা আগেরটা বিক্রি করে দেবে। এই কলকাতাতেই যারা নোট জাল করে তারা স্পেয়ার টাইমে করে পাসপোর্ট জাল। এরা সে পাসপোর্ট কিনে নিয়ে অত্যুকৃষ্ট কেমিক্যাল দিয়ে খালাসির ফোটোগ্রাফ সেই পাসপোর্ট থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। যে ব্যক্তি গুণ্ডা বা ফেরার বলে পাসপোর্ট যোগাড় করতে পারেনি তার ফটো ছাপা হবে– সেখানে জায়গাটায় নতুন ফোটো কেমিকাল লাগিয়ে।… এতে বেশ কাঁচা দু পয়সা আমদানি হয়। খিদিরপুর অঞ্চলে নাকি একটা (প্রাইভেট) লিমিটেড কোম্পানি হয়েছে– ভাবছি কিছু শেয়ার কিনব) সেটা ফিল আপ করে বসলেন আপনি। সে ভুলটা ধরিয়ে দেবে আপনারই এক ভাগ্নে– উনিশবার ম্যাট্রিকে সে/ঘায়েল করে থামল শেষে। তখন ছিঁড়ে ফেলুন সেই তিন প্রস্ত ফর্ম, ফের দাঁড়ান কিউয়ে– ফের, ফিনসে। আর সবচেয়ে মারাত্মক অদৃশ্য ফাঁদ যেটি সদাশয় সরকার, অবশ্য অতিশয় অনিচ্ছায় কিন্তু সরকারি পয়সার যাতে অপচয় না হয় সেই শুভ ব্রত গ্রহণ করে আপনার জন্য পেতেছেন। অদৃশ্য কেন বললুম এখখুনি বুঝতে পারবেন। আমরা তথা পাকিস্তানিরা বিলেত ফ্রান্সের তুলনায় তো সবে স্বরাজ পেয়েছি। আমাদের সরকারকে কোন কোন প্রশ্ন জিগ্যেস করতে হয় সে সম্বন্ধে খুব একটা স্পষ্ট ধারণা নেই। ইংরেজ একদা যেসব প্রশ্ন শুধোত তার বেশকিছু বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মহারানির রাজত্ব যেন হিটলারের সহস্রবর্ষের রাইষ-এর মতো অজরামর হয়ে থাকে। মহারানির রাজত্বে যেন কস্মিনকালেও– মহাপ্রলয়ে তাবৎ মণ্ডলসমূহ তথা অগণিত নক্ষত্ররাজি লোপ পাওয়ার পরও সূর্য কখনও অস্তমিত না হয়। … তা সে যাক গে। এখানে পাসপোর্ট ফরম তৈরি করার সময় ভারতীয় হুজুরদেরই স্থির করতে হয় আমরা কোন কোন প্রশ্ন শুধব। পয়লা ঝটকাতেই সব প্রশ্ন হুজুরদের মনে আসে না। পরে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, ঐয্যা! অমুক প্রশ্নটা তো শুধানো হয়নি। কিন্তু হায় তখন তো আর তাবৎ ছাপা ফর্ম বাতিল করে দেওয়া যায় না। তাই বের করলে এক নয়া কৌশল। নতুন প্রশ্ন রবার স্ট্যাম্পে বানিয়ে নিয়ে চাপরাশিকে দিলেন হুকুম, প্রত্যেক ফর্মে মারো এই ইস্টাম্পো। চাপরাসি ভটভট সেই কর্ম করতে লাগল ফর্মের এক সংকীর্ণ কোণে। এখন হয়েছে কী, আপনি পেলেন ৩৭৩৮৫ নম্বরের ফর্ম। ততক্ষণের রবার স্ট্যাম্পের হরফগুলো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে সেটি হয়ে গিয়েছে নখের মতো পালিশ। তখন ফর্মে একটা ঝাপসা ঝাপসা ফিকে বেগনি রঙের কুয়াশা কুয়াশা মাত্র দেখা যায় অবশ্য আপনি যদি সেটি সাতিশয় মনোযোগসহ নিরীক্ষণ করেন। সেটা দেখে আপনার মনে কিছুতেই সন্দেহ হবে না যে এটা খয়ে যাওয়া রবারস্ট্যাম্পের অবদান– আপনি সন্দেহ-পিচেশ হোন না কেন? অ! ভুলে গিয়েছিলাম আপনি ইংরেজিতে ডি লিট কিংবা যাই হোন না কেন, যেখানে কোনও অক্ষরের চিহ্নমাত্র নেই তার পাঠোদ্ধার করবেন কী করে? তাই আপনি নিশ্চিন্ত মনে ফর্ম পাঠিয়ে দিলেন হেড অফিসে। এক মাস পরে সেটি এল ফেরত। এবং সঙ্গে লেখা আছে আপনি অমুক নম্বর প্রশ্নের উত্তর দেননি কেন? আপনি খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবেন সেই প্রফেসনালের ইটের পাজাতে। সে লেটেস্ট খবর রাখে। সে সেই বেগনি কুয়াশার মধ্যিখানে সঠিক জায়গায় উত্তরটি লিখে দেবে। শুধু কি তাই? আপনি যেসব উত্তর দিয়েছেন, আপনার জ্ঞান আপনার বিবেক অনুযায়ী সেগুলো চেক অপ করতে করতে সে বিষম খাবে, আঁতকে উঠবে আর গোঙরাতে গোঙরাতে বলবে, এসব কী উত্তর দিয়েছেন! বরঞ্চ আপনার কৃষ্ণপ্রাপ্তি হলেও হতে পারে কিন্তু এসব উত্তর শুনতে চান এবং শুধু তাই নয়, আজ কী উত্তর শুনতে চান, মত পালটে পরশু দিন ফের কোন উত্তর দিলে পাসপোর্ট প্রাপ্তি হবে না। সে জানে, হুজুররা কী উত্তর শুনতে চান। সে নতুন ফর্ম তার বাক্স থেকে বের করবে আপনাকে ফের কিউয়েতে ধন্না দেবার গব্বযন্তনা থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে এবং এমন সব আকাশকুসুম, সোনার পাথরবাটি উত্তর লিখবে যে এবারে আপনার বিষম খাবার, আঁতকে ওঠবার পালা।

কিন্তু আপনি পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। যদিস্যাৎ না পান তবে জানবেন অন্য কোনও ব্যাপারে আপনার জীবন নিষ্কলঙ্ক নয়। পুলিশ আপনার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে, কিংবা আপন ফাইল (দসিয়ে) থেকে আবিষ্কার করেছে, আপনি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে রুশ লেখক গর্কির মাদার পড়েছিলেন, কিংবা ওয়েল নেভার মাইন্ড—কিছু একটা আছে।

এমন সময় আপনার এক উকিল বন্ধু আপনাকে বললে, সংবিধানে প্রত্যেক ভারতীয়কে জন্মগত অধিকার দিয়েছে, যত্রতত্র গমনাগমনের স্বাধীনতা। ঠোকো মোকদ্দমা। পেত্যয় যাবেন না, আপনার চেয়েও শতগুণে তালেবর এক খলিফে ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়ে বিদেশ যাবার পাসপোর্ট পেয়েছিলেন। তিনি বগল বাজিয়ে প্লেনের টিকিট কাটতে ধাওয়া করেছিলেন কি না জানিনে, আমরা হুঁশিয়ার করছি,

ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু
ফাঁদ তো বাবা দেখোনি।

কিংবা’ না আঁচিয়ে’ ভরসা কই! কিংবা সুকুমার রায়ী ভাষায়

কেই বা শোনে কাহার কথা
কই যে দফে দফে।
গাছের পরে কাঁঠাল দেখে
তেল দিয়ো না গোঁফে ॥

পাসপোর্ট পাওয়ার পর একটি

বৈষ্ণব হইতে মনে গেল বড় সাধ।
তৃণাদপি শোলোকেতে ঘটালো পরমাদ।

সে তৃণটি এস্থলে পি ফরম। বিদেশের হোটেলে তো আপনাকে মুফতে থাকতে দেবে না, রেস্তোরাঁতে মাগনা খেতে দেবে না। অতএব আপনার বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন। সে মুদ্রা ক্রয় করার তরে আপনি দিশি মুদ্রা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু পি ফর্মের পীঠস্থান রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সবিনয়ে বলবে, এদানির বিদেশি অর্থের বড়ই অনটন। সরি! কথাটা খুবই সত্য, সে কথা আমি কোনও ব্রাহ্মণ বন্ধুর কাছ থেকে পৈতে ধার করে সেইটে ছুঁয়ে কসম খেতে রাজি আছি।

সবই জানি। শুধু জানিনে, পাসপোর্ট না পেলে যে রকম মোকদ্দমা করা যায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বিদেশি কড়ি না দিলে তার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করা যায় কি না।

এ পর্যায়ে কিন্তু একটি শেষ কথা না বললে অন্যায় হবে। কর্তারা যে যাকে-তাকে চট করে বিদেশ যেতে দেন, তার প্রচুর কারণ আছে। কিন্তু সেকথা আরেক দিন হবে।

.

মোদ্দা কথায় ফিরে যাই।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে এইসব বহুবিধ, যাবতীয়, হরেকরকম্বা সমস্যা সম্বন্ধে সবাই ছিল উদাসীন। মার খেয়ে খেয়ে, এবং তার চেয়েও নির্মমতর অভিজ্ঞতা পয়সাওলারা কী করে সর্ববাধা অতিক্রম করে সর্বত্র যাতায়াত করেন, বিজনেসমেন দেশের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বিদেশ যাবার তরে সর্ব ছাড়পত্র সংগ্রহ করে ড্যাংড্যাং করে রওনা দিলেন, আপনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, সে তো বুঝি, কিন্তু সঙ্গে তাঁর বিরাটকলেবরা ভামিনী গোটাদুত্তিন বালক পুত্র এবং কন্যা,– এনারা যাচ্ছেন দেশের কোন সম্পদ বৃদ্ধি করতে, এবং এনাদেরই একজন

উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল করে চললো হেসে
বিলেতে কিংবা ওয়াশিংটন
মুদ্রা মেলা, হাজার টন।

এ তো বিদেশের কথা। কটা লোকই-বা বিদেশ যাবার মতো রেস্ত ধরে। দেশের ভিতরকার সমস্যাই-বা কিছু ছেড়ে কথা কয় নাকি? একদা ভূমিকম্প হলে, যথেষ্ট বৃষ্টিপাত না হলে, টাইগার হিল থেকে কুয়াশার দরুন কাঞ্চনজঙ্র দর্শন না পেলে, বাজী পঠি বাচ্চা না বিয়োলে অন্যথা বউ সাত নম্বরের বাচ্চা বিয়োলে, পর্যাপ্ত পরিমাণে স্কচ চুকুস চুকুস করে না চাখতে পারলে, গণ্ডায় গণ্ডায় রামমোহন রবিঠাকুর না জন্মালে আমরা বণিকের মানদণ্ড-র উত্তরাধিকারিণী মহারানির (পাড়ার ঘোষাল বলত, ব্যাটাদের ঘিনপিতও নেই– বেনের এঁটো গব গব করে খেল রাজার বেটাবেটি) বাজার সরকার বড়লাটের খুলিতে ডবল বম ফাটাবার চেষ্টা করতুম– অবশ্য সঙ্গোপনে মনে মনে।

সুস্থাবস্থায় কিন্তু সেই মনই অতিশয় বেয়াদব প্রশ্ন শুধোত এসব বর্গিদের, খাজনা দেব কিসে?

গুরু বড় দুঃখে বলেছিলেন, শোন থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করে উত্তর আসে আব্রু দিয়ে, ইজ্জৎ দিয়ে, ইমান দিয়ে–বুকের রক্ত দিয়ে।

একই নিশ্বাসে গুরুর সেই ভবিষ্যবাণীর সঙ্গে আমার পরবর্তী যুগের অক্ষম সাবধানবাণীর কথা তুলি কোন পাপমুখে? কিন্তু পাঠক ক্ষণতরে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, এটা আমার দম্ভ নয়। ঝাড়া তিনটি মাস মেসের ভাত না খেলে (কিংবা উপস্থিত আমি যে নার্সিং হোমের খুঁটে খাচ্ছি সে বস্তুর অভিজ্ঞতা না থাকলে) মায়ের রান্নার প্রকৃত মূল্য কে কখন বুঝতে পেরেছে? যুধিষ্ঠিরকে যে নরক দর্শন করানো হয়েছিল সেটা বিধাতার কোনও উটকো খামখেয়ালি নয়। নইলে স্বর্গপুরীর অপ্সরাদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ বিশ্রম্ভালাপ করার পূৰ্ণানন্দটা তিনি তারিয়ে তারিয়ে চাখতেন কী প্রকারে? গব গব করে গিলতেন, আমরা যে রকম মেসের রান্না হড় হড় করে গিলে রেকর্ড টাইমে পাপ বিদেয় করি।… এইবারে শ্যানা পাঠক নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, আমার প্রবন্ধ সাতিশয় মনোযোগ সহকারে পঠন কেন অবশ্য কর্তব্য, একান্ত অবর্জনীয়। তার চেয়েও ইমপর্টেনট প্রবন্ধ : তার চেয়ে আরও ইমপর্টেনট কর্তব্য, আমার বই কিনুন– চাই পড়ুন, চাই না বা পড়ন।

ত্রিশ বৎসর পূর্বে আমি পুনঃপুন বলেছিলুম, আরও কঠোরতর, আরও নির্মমতর খাজনা দিতে হবে স্বরাজ লাভের পর। এইবেলাই যদি সে খাজনার সন্ধান না নাও তবে তোমার কপালে বিস্তর গদিশ আছে। এই দেখুন না আজ পুব বাংলার হাল! কাল যে পশ্চিম বাংলায় হবে না তার আশ্বাস দেবেন কোন পলিটিকাল গোঁসাই?– আমি অবশ্য এসব দুর্যোগের ভবিষ্যত্বাণী আপ্তবাক্য রূপে প্রকাশ করিনি। কিন্তু যা কিছু নিবেদন করেছিলুম সেটা কেউ কান পেতে শোনেনি। (বলতে ইচ্ছে করছে এখন তবে খাও কানমলা, কান টানলে মাথা আসে সেটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি কান না পাতলে কানমলা খেতে হয়)।

ওঁরা বলতেন বা ভাবতেন, আমার বক্তব্য স্পেশালাইজড নলেজ; এসব এখন তকলিফ বরদাস্ত করে আমরা পড়বই-বা কেন, বুঝতে যাবই-বা কেন। আগে স্বরাজ আসুক তার পর অন্য কথা। আমি সবিনয় বলেছিলুম, রাধে মেয়ে কি চুল বাধে না?

মার খেয়ে অপমান সয়ে সয়ে আমরা এখন অনেক কিছু শিখে ফেলেছি- এই যেমন খানিকক্ষণ আগে পাসপোর্ট কী প্রকারে পেতে হয়, সেটা পাওয়ার পরও আপনার কপালে আর কোন কোন গর্দিশ আছে সে সম্বন্ধে অতিশয় যৎকিঞ্চিৎ সাতিশয় সংক্ষেপে নিবেদন করেছি।

তারই ফলে একদা যেসব তথ্য নিয়ে শুধু স্পেশ লশটরা আলোচনা করতেন, যেগুলো নিছক স্পেশালাইজড নলেজ ছিল এখন সেগুলো হয়ে গিয়েছে ডালভাত, কমন নলেজ। একদা যেমন বিশেষজ্ঞরাই শুধু মাথা ঘামাতেন, পৃথিবী ঘোরে না সূর্য ঘোরে, পরবর্তী যুগে সেই সমস্যার সমাধান কমন নলেজ হয়ে দাঁড়াল!

চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বঙ্গসন্তান আমার য়ুরোপ ভ্রমণ, লন্ডনে বঙ্গ মহিলার ঘরকন্না, নরওয়েতে প্রথম বঙ্গরমণী উৎসাহ ও কঙ্গোতে কৌতূহল সহকারে পড়ত। এখন এতশত লোক নিত্য বঙ্গো ইন উইক এন্ড কাটাতে যায়, জবল অল অলবিয়াতে হানিমুনের প্রথমার্ধ চুষে আসে যে ফ্রান্স ভ্রমণ কিংবা মন্তে কার্লো দর্শন শিরোনামা এখন সে অবজ্ঞার চোখে দেখে, লেখক পরিচিতজন হলে গেরেমভারি মুরুব্বির মতো তাকে পেট্রোনাইজ করে পিঠ চাপড়ে বলে, লেগে থাকো ছোকরা; এখনও হাদ্ৰামুৎ অঞ্চলে অমুসলমানকে ঢুকতে দেয় না বটে কিন্তু তুমিই হয়তো একদিন সেখানকার সেই বিরাট প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ যেখানে একদা শেবার রানি বাস করতেন সেইটে সক্কলের পয়লা দেখে এসে তাবৎ গৌড়জনকে তাক লাগিয়ে দেবে।

একদা আমি দেশে-বিদেশে নাম দিয়ে কাবুল সম্বন্ধে একখানা পুস্তক রচনা করি। প্রকাশকালে বইখানা কিছু লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শুনেছি, এখনও নাকি কেউ কেউ বইখানা পড়ে। আমি জানি, কেন? তার একমাত্র কারণ যদিও কাবুল পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে অবস্থিত নয়, এবং উত্তর মেরুতে অভিযান করার মতো বিপজ্জনকও নয়, তবু একাধিক কারণে প্রধানতম কারণ অবশ্য এই যে আফগান সরকার চট করে সব্বাইকে ও দেশে যাবার অনুমতিলাঞ্ছন ভিসা পারমিট মঞ্জুর করে না, এবং এই একটি কারণই পূর্বে উদ্ধৃত তৃণাদপি শোলকের মতো কাবুলগামীর সম্মুখে অলঙ্ প্রতিবন্ধন; কাবুলি প্রবাদও বলে সিংহের এক বাচ্চাই ব্যস (যথেষ্ট)। বইখানি তাই এখনও লিকলিক করে টিকে আছে।

.

গৌড়জনের কমন নলেজ এ-কালে এতই সুদূরবিস্তৃত– ভয়ে ভয়ে বলি, কুলোকে বলে শুধু বিস্তারই আছে– গভীরতা আদৌ নেই এবং সে বিস্তারও নাকি বড় পল্লগ্রাহী যে তাদের মন পাওয়া প্রতিদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুনতে পাই, বিকৃত যৌনজীবন, এবনরমাল সেকস, সমকাম, সাদিজম, মাসোখিজম, পিকচার পোস্টকার্ড, ব্লু ফিলম ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়বস্তু বেহদ্দ রগরগে ভাষায়, সর্ববিধ অসম্ভব ফোটোগ্রাফসহ পরিবেশন করলেও তারা যে শুধু নাসিকা কুঞ্চিত করেন তাই নয়, বা দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে ডান রু ইঞ্চিটাক উত্তোলন করে বলেন, ছোঃ! চাঃ!! পুঃ!!! এগুলো আবার কী? ক-অ-অ-বে কোন আদ্যিকালে এ-সব তো কমন নলেজেরও নিচের স্তরে নেমে গিয়েছে। পুলিশের নাকের সামনে পেভমেন্টে বিক্রি হয়, জলের দরে। শোনননি বুঝি থাকো কোন ভবে কোন দুনিয়ায়?- যবে থেকে ডেনমার্কে এসব মালের ওপর থেকে ব্যান তুলে দেওয়া হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তার বিক্রি দশ আনা পরিমাণ কমে গিয়েছে। তাবৎ বস্তু, সাকুল্যে বিষয় ব্যান তুলে দেওয়ার ফলে যখন তিন দিনের ভিতর কমন নলেজ হয়ে গেল, তখন আর ওসব মাল কানা কড়ি দিয়েও কিনবে কে? শুনছে, এখন নাকি দিনেমার প্রকাশক ওসব মাল তালাক দিয়ে ধর্মগ্রন্থ ছাপবে। সেটা যখন স্পিরিচুয়াল লেভেলে উঠে গিয়েছে তখন স্পিরিচুয়াল বই অর্থাৎ গ্রন্থ ছাপানোই প্রশস্ততর।

হ্যাঁ, তদুপরি আরেকটি খবর আমি কাগজে পড়েছি। তত্ত্বটি আমি বাল্যকালেই শুনেছিলুম। পরিপূর্ণ স্বাদ পেতে হলে চুম্বনটি চুরি করে নিতে হয়। এ কিস টু বি দি সুইটেসট হ্যাঁজ টু বি স্টোলেন। সম্মানিত মার্কিন কাগজে পড়লুম, নাম ছিল লেডি চ্যাটারলিজ লয়ারজ। লাভারজ নয়–অর্থাৎ কি না মার্কিন মুলুকে যখন লেডি চ্যাটারলি কেতাবখানা অশ্লীল কিংবা কাব্যরসের অত্যুকৃষ্ট উদাহরণ কি না ওই নিয়ে মোকদ্দমা উঠল তখন এক বাঘা উকিল বিচারগৃহ প্রকম্পিত করে ওজস্বিনী ভাষায় তাঁর সুদীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করে আবেগোল কণ্ঠে বললেন, ধর্মাবতার তথা সম্মানিত জুরি মহোদয়গণ! লেডি চ্যাটারলি পুস্তকে গ্রন্থকার যে অপূর্ব কলানৈপুণ্য ও সত্য শাশ্বত সাহিত্যরস সৃষ্টি করেছেন তাই নয়, যৌনজীবনকে তিনি স্পিরিচুয়াল লেভেলে (আধ্যাত্মিক স্তরে) তুলে নিয়েছেন, তুলে ধরেছেন।

এই শেষ অভিমতটি শুনে এক পরিপক্কা সমাজে সম্মানিতা ফরাসি নাগরী মৃদু, দুই মেয়ের স্মিত হাস্য হেসে বললেন, সর্বনাশ। আমি তো এ্যাদ্দিন জানতুম যৌনসম্পর্কটা নিষিদ্ধ পাপাচার। এখন থেকে ওই আনন্দের অর্ধেকটাই মাঠে মারা গেল।

.

নিষিদ্ধ হোক, কিংবা পুলিশসিদ্ধ তথা শাস্ত্রসম্মত হোক আর নাই হোক বিদগ্ধ গৌড়ীয় পাঠক এখন চান কড়া পাকের মাল, তত্ত্ব ও তথ্য সম্বলিত– একদা যে রকম নৃত্যসম্বলিত গ্রামোফোন রেকর্ড সাদামাটা রেকর্ডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে আমি যে সওগাত পরিবেশন করছিলুম তারা অধুনা সেই বস্তু চান।

কিন্তু আমি পোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই।

ইতোমধ্যে আবার অন্য দিক থেকে আরেক বিপরীত বায় বইতে আরম্ভ করেছে। জীবনসংগ্রাম কঠোরতর হয়েছে, পাপাচারের উত্তাল তরঙ্গ গিরিচূড়া লঙ্ন করে উধ্বমুখে উৎক্ষিপ্ত, দিনান্তে বলীবদের ন্যায় কর্মক্লান্ত জন স্বগৃহে পৌঁছবে না টিয়ার গ্যাসে অন্ধ হবে এবং/কিংবা গুলি খেয়ে পঞ্চভূতে লীন হবে সেই দুশ্চিন্তায় সে ম্রিয়মাণ মোহ্যমান।

ঠিক এই একই অবস্থাতে ফরাসি সাহিত্যের তদানীন্তন গ্রামেত্র (গ্রান্ড মাস্টার) কী উপদেশ দিয়েছিলেন সেটি অবহিত চিত্তে শ্রবণ করে কর্ণ সার্থক তথা পুণ্যার্জন করুন।

প্যারিসের এক অসহিষ্ণু গবি অর্থাৎ যিনি অবোধ্য মডার্নস্য মডার্ন গবিতা লেখেন আনাতোল ফ্রাসকে প্রায় শাসিয়ে হুঁশিয়ার করে তালিম দেন, কবিতা পড়াটা কিছু ছেলেখেলা নয়, যে ছ্যাবলামো এ্যাদ্দিন ধরে চলে আসছে। মডার্ন কবিতা আগাপাশতলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু।৬

এ কবিতা-দেউলের প্রতি পাঠককে তীর্থযাত্রীর ন্যায় অবনত মস্তকে অগ্রসর হতে হয়। ভক্তিশ্রদ্ধা তথা (সূচ্যগ্রন সুতীক্ষেণ) একাগ্রতাসহ মডার্ন পোয়ট্রির দ্বারস্থ হতে হয়! (মডার্ন পোয়েট্রি শুড বি এপ্রোচ উইদ ডিভোশন অ্যান্ড কনসানট্রেশন)

এ উদ্ধৃতি দেওয়ার পর ফ্ৰাস যেন দিবাদ্বিপ্রহরে সাক্ষাৎ যমদূতের দর্শন পেয়ে সাতঙ্কে ভগবানকে স্মরণ করছেন যে স আযৌবন প্রকাশ্যে একাধিকবার তার নাস্তিকতা প্রচার করেছিলেন; এর থেকেই সর্ব আস্তিক সর্ব নাস্তিক অনায়াসে বুঝে যাবেন। সেই গবির আপ্তবাক্য শুনে তাঁর হৃদয়ে কী মারাত্মক গগনচুম্বী পাতালস্পর্শী ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। উচ্চকণ্ঠে সৃষ্টিকর্তাকে আহবান জানিয়ে প্রার্থনা করছেন :

হেভন ফরবিড! দেবভাষায় বলা হয় ঈশ্বর রক্ষতু, মুসলমান বলে লা হাওলা কুয়েতি ইল্লা বিল্লা। বাংলায় এ স্থলে ঠিক কী বলা হয় জানিনে। ভূত দেখলে লোকে রাম নাম স্মরণ করে অবশ্য। কিন্তু এ স্থলে প্রার্থনা রয়েছে, নাস্তিক ফ্ৰাস বলছেন, ঈশ্বরাদেশে এ হেন অপকর্মে যেন বিরত হয়।

এর পরই ফ্ৰাঁস বলছেন, আমি জানি বেচারী (সাধারণ) ফরাসিকে সমস্ত দিন সামান্য রুটি-মাখনের জন্য কী রকম মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়।

এ স্থলে এগোবার পূর্বে পাঠককে ফের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, ত্রেতা যুগটি আমি লিখছি (দ্বাপরের পরে। কেন, সেটা যারা তাপসী অহল্যার কাহিনী পড়েছেন তারাই জানেন) হাসপাতালে। (যদিও খানদানি ভাষায় এটি নার্সিং হোম বা মেডিকাল সেন্টার নামে সগৌরবে প্রচারিত, তথাপি আমার সামান্য অভিজ্ঞতা প্রতিবাদ জানিয়ে অজ্ঞজনকে হুঁশিয়ার করে বলে, এটা হোম তো নয়ই, এবং আচার-আচরণ, প্রাচীন যুগীয় সাজ-সরঞ্জাম দেখে মনে হয়, মেডিকাল সেন্টার-এর নাম পালটে এটাকে মেডিঙ্গভালো– মধ্যযুগীয় কান্তার নাম দিলেই এর প্রতি সত্য বিচার করা হয়, কিংবা মেডিঙ্গভালো হান্টারও বলতে পারেন, এবং এখানে কী শিকার হয় তার আলোচনা করে অসুস্থ শরীর নিয়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চাইনে)। সবসুদ্ধ মিলিয়ে এখানকার কর্তৃপক্ষই স্মৃতিভ্রষ্ট হন, আমি যে আনাতোল ফ্রাসকে উদ্ধৃত করার সময় পর্বতপ্রমাণ ভুলভ্রান্তি করব সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং কার্সিং (প্রুফরিডার মশাই, আমি কার্সিং অভিসম্পাত অভিশপ্ত-ই লিখেছি– সজ্ঞানে; নার্সিং লিখিনি) বম বাবদে যাদের সামান্যতম অভিজ্ঞতা আছে, অর্থাৎ এ পুরী থেকে সুস্থ অস্থি নিয়ে নিতান্তই ভগবদকৃপায় বেরুতে পেরেছেন তারা যে আমাকে ক্ষমাসুন্দর চক্ষে দেখবেন সেটা ততোধিক স্বাভাবিক।

ফ্ৰাঁস বলছেন, বেচারী ফরাসি যখন ক্লান্ত দেহে শ্লথ পদে বাড়ি পৌঁছে একখানা পুস্তক হাতে তুলে নেয় (অর্থাৎ, অত্যধিক মদ্যপান করে বউকে না ঠেঙিয়ে, কিংবা ঝটপট জুয়ো খেলাতে বসে বউ-বাচ্চার জন্য দু মুঠো অন্ন কেনার রেস্ত উড়িয়ে না দিয়ে– লেখক) তখন, ঈশ্বর রক্ষতু, আমি তার কাছ থেকে সশ্রদ্ধ একাগ্রতা (ডিভোশন অ্যান্ড কনসানট্রেশন) মোটেই কামনা করিনে–  বলছেন ফ্রাঁস। তার পর তিনি যেন নিবেদন করছেন : আমি যা দিতে চাই, এবং সে-ই আমার উজাড় করে দেওয়া, (অল আই উয়োন্ট টু গিভ) তার যেন একটুখানি শ্রান্তি বিনোদন হয়, তার যেন একটুখানি ফুর্তি জাগে (রিলেকসেশন, এনটারটেনমেন্ট, এম্বুজমেন্ট হয়। এবং যেদিন ওই সবের ফাঁকে ফাঁকে ওই বেচারী ফরাসিকে কোনও প্রকারের কোনও ইনফরমেশন দিতে পারি, সেদিন আমার আর আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না (মাই জএ নোজ নো বাউন্ডজ)।

দম্ভী মসিয়ো মরিসকে, আমার পাঠকদের মধ্যে দম্ভী কেউ নেই, কিন্তু যদিস্যাৎ কোনও উটকো দম্ভী মাল ছিটকে এসে গোলে হরিবোল দিয়ে থাকেন তবে তাকে বলছি, অবহিতচিত্তে প্রণিধান করো, যে ফ্রাসকে ফরাসিদের লোক ক্রাঁ মেৎর, গ্র্যান্ড মাস্টার, গুরুদেব বলে একবাক্যে স্বীকার করে সাহিত্যের ময়ূর সিংহাসনে বসিয়েছিল তিনি কতখানি বিনয় সহকারে বলছেন, তার নগণ্য অর্ঘ্য কী? এবং সেটা এমনি যৎসামান্য অকিঞ্চিত্বর যে তার জন্য কোনও পাঠকের কাছ থেকে কোনও প্রকারের ডিভোশন বা কনসানট্রেশন তিনি চান না।

এবং সর্বশেষে মসিয়ো মরিসকে একটুখানি ধূলি পরিমাণ উপদেশ দিচ্ছেন : তদুপরি সর্বোপরি, হে মসিয়ো মরিস, তুমি যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ভ্রমণ করতে করতে পেরিয়ে যেতে চাও তবে হাল্কা হয়ে ভ্রমণ করো। (ইফ ইউ উয়োন্ট টু ট্র্যাভেল গ্রু সেঞ্চুরিজ, ট্র্যাভেল লাইট!)

কী মহান আপ্তবাক্য! মরিস, তুমি যদি চাও যে তোমার রচনা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লোকে পড়ক তবে সে রচনার ঘাড়ে বিস্তরে বিস্তর ভারী মাল চাপিয়ো না। অর্থাৎ যে মাল কনসানট্রেশন চায়, ডিভোশন চায়।

ব্যাসদেব এ তত্ত্বটির প্রথম আবিষ্কারক। গণপতিকে যখন তিনি মহাভারতের ডিকটেশন নেবার জন্য মনোনীত করেন তখন তার মাত্র একটি শর্ত ছিল, তুমি নিজে না বুঝে কোনও বাক্য লিখতে পারবে না। গণপতি গণের অর্থাৎ সাধারণজনের, mass-এর প্রতি। অতএব তিনি লিখবেন সবকিছু নিজে প্রথমটায় বুঝে নিয়ে যাতে করে জন গণও সবকিছু বুঝতে পারে। তাই বোধহয় কাব্যতত্ত্ববিশারদ তলস্তয় মন্তব্য করেছিলেন, মহাভাররে মতো কাব্য ইহসংসারে আর নেই।

আনাতোল ফ্রাঁস হুবহু এই আদর্শটিই শ্রীমান মরিসের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

অবনত মস্তকে, করজোড়ে, দাঁতে দাঁতে কুটো কেটে স্বীকার করছি, প্রাগুক্ত তত্ত্বটি আবিষ্কার করতে এবং সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে আমার অনেকখানি সময় লেগেছিল। অবশ্য মসিয়ো মরিসের মতো সশ্রদ্ধ একাগ্রতার প্রত্যাশা করার মতো হিমালয় বিনিন্দিত উত্তুঙ্গ দম্ভ আমার কস্মিন কালেও ছিল না। আমি ভুল করেছিলুম অন্য ক্ষেত্রে। আমি মনে করেছিলুম দেশবিদেশ ঘুরে আমি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, একাধিক ভিন দেশে বাধ্য হয়ে যে দু একটি ভাষা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, বহুবিধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ এবং তার নির্যাস গলাধঃকরণ করেছি, নানান ধরনের নানান চিড়িয়ার সঙ্গে মোলাখাৎ-সহবাসের ফলে যে আদর-অনাদর, দাগা-মহব্বত পেয়েছি, প্রবাসের নিরানন্দ দিনে, নির্জন ত্রিযামা শর্বরীতে আকাশকুসুম চয়ন করেছি, দীর্ঘ, দীর্ঘকাল ধরে মাতৃবিরহের অসহ কাতরতা এবং তার চেয়েও নিষ্ঠুর উপলব্ধি যে পুত্রবিরহিণী আমার মা-জননী আমার চেয়েও কত লক্ষ গুণে কাতর নিরানন্দ নিরালোক দিনযামিনী যাপন করছেন আমার প্রত্যাগমন প্রত্যাশা করে এর মধ্যে অসাধারণ অলৌকিক এমন কোনও সৃষ্টিছাড়া উপাদান-উপকরণ নেই যেটা আমার মতো নিতান্ত সাধারণজনসুলভ সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করলে গৌড়ীয় পাঠকের বোধগম্য হবে না, তার দিকচক্রবাল অতিক্রম করে মহাশূন্যে বিলীন হবে না।

আমি জানতুম, এবং এখনও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি যে হাড় আলসে, রকবাজিতে দিগ্বিজয়ী ফোকটে টু পাইস কামাবার তরে বাপের কামানো ফোর পাইস ঝটসে ঝেড়ে দিতে প্রস্তুত, এবং পাড়ায় একটি সর্বজনসেবী পাঠাগার নির্মাণের জন্য হোক কিংবা নির্মাণান্তে দলাদলিবশত সেটিকে বীরদর্পে ভস্মীভূত করাই হোক, উভয় মহৎ কর্মের জন্য, তদাভাবে সর্বকর্মের জন্য, তদাভাবে কর্মহীন কর্মের জন্যই হোক, চাঁদা তোলাতে যে বাঙালি অদ্বিতীয়, অপরাজেয়, যে বাঙালি গত বিশ্বযুদ্ধের সময় ওই মহৎ ব্রত উদযাপনের জন্য হিটলার-স্তালিনের চাঁদা তোলার প্রয়াস-পদ্ধতির বর্ণনা শুনে শিশু! শিশু!! বলে অট্টহাস্য দ্বারা গোরশয্যাশায়ী ওই দুই মহাপ্রভুকে লজ্জা, আত্মগুলায় ঘন ঘন ঘূর্ণায়মান করতে ভানুমতী বিশারদ, সেই বাঙালি, আবার বলছি, সেই বাঙালি– অন্য জাত যারা ভ্রমণ ব্যপদেশে কলকাতাতে এসে সভয়ে, আমাদের রঙ্গভূমি থেকে সম্মানিত ব্যবধান রক্ষা করে, আমাদের কীর্তিকলাপের খুশবাইটুকু মাত্র পেয়েছে তারা কিছুতেই প্রত্যয় যাবে না যে বাঙালি বই পড়ে।

হ্যাঁ, বই পড়ে। অধিকাংশ স্থলেই অবৈধ কিন্তু মার্জনীয় পদ্ধতিতে। কিন্তু পড়ে।

তাই আমি হরেদরে ধরে নিয়েছিলুম, আমার বক্তব্যবস্তু যতই হ য ব র ল মার্কা হোক না কেন, সেটা তার কাছে কিছুতেই সম্পূর্ণ অপরিচিত হতে পারে না– নিতান্ত দু-একটি উৎকট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া। কারণ প্রকৃত পাঠকের কাছে কোনও বিষয়ই সম্পূর্ণ অজানা নয়, আবার কোনও বিষয়ই সম্পূর্ণ জানা নয়। তাই এক আরব গুণী বলেছেন, পুস্তক, সে যেন একটি ছোট্ট বাগান যেটি তুমি অনায়াসে পকেটে পুরে সর্বত্র নিয়ে যেতে পার। যখন খুশি তাতে ডুব মেরে ভ্রমরগুঞ্জন, কোকিলের কণ্ঠ, বসরাই গোলাপের খুশবাই, সারা দিনমান ঝরনার গান সবকিছুই পেতে পার। তেমন বই যদি বেছে নাও তবে সে বাগিচায় মিশরের পিরামিড, হিমালয়ের গিরিশ্রণি, পাভলোভা পাভলোভাই বা কেন উর্বশী-মেনকার নৃত্যও দেখতে পাবে। এমনকি এমন বই অর্থাৎ এমন বাগিচাতেও তুমি প্রবেশ করতে পার যে বাগিচা তোমাকে আরও লক্ষ লক্ষ বাগিচার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। যেমন ধরো, প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগার সম্বন্ধে একখানি প্রামাণিক পুস্তক। কত লক্ষ বাগবাগিচার সঙ্গে সে যে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবে সেটা নির্ভর করে শুধু তোমার কৌতূহলের ওপর।

আরেক জ্ঞানী বলেছেন, একখানা পুস্তক যেন একখানা ম্যাজিক কার্পেট; তারই উপর আরামসে তাকিয়া হেলান দিয়ে বসে তুমি যত্রতত্র যেতে পার, যা ইচ্ছা তাই এমনকি তোমার সে রকম রুচি হলে যাচ্ছেতাই দেখতে পারো।

তবে হ্যাঁ, আমার মনে ধারণা ছিল, ম্যাজিক কার্পেট রাজারাজড়ার মিনার, অধুনা মার্কিন মুলুকের চন্দ্ৰস্পৰ্শী প্রাসাদাদির থেকে গা বাঁচিয়ে বহু উধ্বলোক দিয়ে উড্ডীয়মান হয় বলে পাঠক সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় না। আমার রচনা হবে যুগ মানানসই হেলিকপ্টার, অনেক নিচু দিয়ে যায় বলে, অনেক মন্থরে চলে বলে পাঠক হয়তো অনেক আধ-চেনা জিনিসের চৌদ্দ আনা চিনে নেবে।

কিংবা বলি, ম্যাজিক কার্পেটের সন্ধানে অতদূরে যাই কেন? এই কাছেই তো বাঙলা দেশ, নিত্য নিত্য যার ক্রন্দনধ্বনি আমাদের কানে আসছে, কিন্তু সে কথা থাক। সেই বাঙলা দেশের ঢাকার এক কুট্টি ফেরিওলা আম বেচতে এসে বাড়ির সামনে লন-এর উপর ঝুড়িটা রেখেছে। বাবু উপরের বারান্দা থেকে আমগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে ঈষৎ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কী আম আনছে, মিয়া, বড় যে ছোড় হোড় (ছোট ছোট)। কুট্টি একগাল হেসে উপরভাগে তাকিয়ে বললে, ছোড তো লাগবই, কর্তা–উচা থনে ছোড তো লাগবই। ল্যামা আহেন মহারাজ, তখন দেখবাইন অনে, বরো বরো।

কিন্তু হায়, আমার পাঠক মহারাজা নেমে এলেন না। আমগুলোর সত্য রূপ তাঁরা নিকটে এসে দেখতে রাজি হলেন না। সেটা হয়ে যেত স্পেশালাইজড নলেজ। তখন তারা চাইতেন কমন নলেজ। এখন তারা চান স্পেশালাইজড নলেজ। কিন্তু অধম এ-খাট, ইন্দ্রলুপ্তজন আর দ্বিতীয়বার বিল্ববৃক্ষ নিয়ে গমনাগমন করিবেক না।

এখন থেকে আমি সুদুমাত্র অতিশয় সাদামাটা, সাতিশয় নির্জন কমন নলেজ পরিবেশন করব।

কিন্তু না, পুনরপি না। যদ্যপি উন্নাসিক সম্প্রদায় উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বারবার বলছেন সে কমন নলেজ হয়ে গিয়েছে, এবং আমিও এইমাত্র যে প্রতিজ্ঞাপাঠ লিপিবদ্ধ করলুম তার কালি এখনও শুকোয়নি, এবং যার অর্থ, আমি এখন থেকে শুধু কমন নলেজ নিয়ে লিখব তার অর্থ এই নয় যে আমি ইহসংসারের তাবৎ কমন নলেজ-এর বিশ্বকোষ রচনা করতে বসে যাব। সংসারের বিস্তর পোড় খাওয়া এক ধনী বাপ মৃত্যুকালে অন্যান্য উপদেশ দিতে দিতে বলেছিল, আর হ্যাঁ, প্রতি গ্রাসে পাঁচটা করে মাছের মুড়ো খাবি। পয়সাওলা সে বাড়িতে পাকা রুই বাঘা কাৎলা গোত্রের বড় মাছের মুড়ো ভিন্ন অন্য কোনও মাছের মুড়ো কস্মিন্ কালেই প্রবেশ লাভ করেনি। ছেলে বেচারী একই গ্রাসে পাঁচটা রুই মাছের মুড়ো খেতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে মৃত পিতার অনুজ হওয়ার উপক্রম। বাবা বলতে চেয়েছিল চুনোর্পটি কেঁচকি পোনার মুণ্ডু খেয়ে সস্তায় আহারাদি সমাপন করো। আমি কমন নলেজের চুনোপুঁটির মুণ্ডু গিলতে রাজি আছি কিন্তু রাঘব বোয়ালের বাঘা মুণ্ডু এক গরাসে গেলবার চেষ্টা করতে রাজি নই, যদিও মুণ্ড তো দুটোই। সে কমন নলেজ আবার পুরাতন ভৃত্যও কমন নলেজ।

দ্বিতীয়ত, এ যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবে কেরে? হরে মুরারে হরে মুরারে আর্তনাদ করেছিলেন কবি আকুল কঠে। এখন এ যৌন বটতলা প্লাবন রুধিবে কে রে? আই জি রে, পি সি রে? আমি বাস করি একতলায়। খুব বেশি দিনের কথা নয়, তেড়ে নেমেছে কলকাতার বর্ষা। গৃহিণী দুরুদুরু বুকে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখছেন রাস্তা থেকে পেভমেন্টে জল। উঠেছে। এইবারে পেভমেন্ট ছাড়িয়ে ঘরের ভিতরে জল ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার আবর্জনা ময়লাও অপর্যাপ্ত পরিমাণে। (পৌর পিতারা নিশ্চয়ই উদ্ধাহু হয়ে নৃত্য করেছিলেন এবং মার্কিন টুরিস্টদের দাওয়াত করেছিলেন দেখে যেতে, আমাদের কলকাতা কী সুন্দর, কী সাফ, কী সুৎরো) এবং তার পর কেলেঙ্কারি। ডাবু সি-তে জল ঢুকে, না জানি কোন বৈজ্ঞানিক কারণে উজান বইতে আরম্ভ করল কোথা থেকে নানাবিধ স্রোত, ভেসে আসতে লাগল নানাবিধ অবদান। বীভৎস রস এ স্থলেই সমাপ্ত হোক।

হুবহু একদম সে-ই প্রক্রিয়ারই পুনরাবৃত্তি হল যৌন-সাহিত্য মারফত। প্রথম ছেয়ে গেল পেভমেন্ট, তার পর হুড়হুড় করে ঢুকল ঘরের ভিতরে। কিন্তু সত্যিকারের রগড় তো শুরু হল তার পর। যৌনজীবনের যেসব আবর্জনা আমরা ডাবু সি দিয়ে, স্যুয়ারেজ দিয়ে বাড়ি থেকে নগর থেকে বের করে দিয়েছি সেগুলোকে কোন এক পিচেশ মার্কা উচাটন মন্ত্রে আবাহন জানাল বাইরের সেই আবর্জনা, সেই বিদেশ থেকে আমদানি যৌন-বটতলীয় মাল যা ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলেছিল কুল্লে পেভমেন্ট, তাবৎ ফুটপাথ পুলিশের নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে (আমি পুলিশের ঘাড়ে কুল্লে বেলেল্লাপনার বালাই চাপাতে চাইনে; দেশের লোক যদি এ মাল চায় তবে পুলিশ আর কতখানি ঠেকাবে?) দেশ-বিদেশের একাধিক ডাঙর ডাঙর কর্ণধার কখনও সোল্লাসে, কখনও-বা মুচকি হেসে, কখনও-বা বক্রোক্তি করে আপ্তবাক্য ঝেড়েছেন, এ নেশন (কানট) বি রং।

এই হৈ-হুল্লোড়, জগঝম্প বাদ্যির মধ্যিখানে কে কান দেবে, মশাই, আপনার গুনগুনানি প্যানপ্যানিতে। আপনার বক্তব্য, যত অসুস্থই হোক না কেন, তাকে দেখতে হবে। কিন্তু সুস্থ মাথায়, অধ্যয়ন করতে হবে শান্তচিত্তে, অযথা উত্তেজিত না হয়ে। কিন্তু তাতে কোনও ফায়দা হবে না, এখন থেকেই বলে দিচ্ছি। এই যে সেদিন শ্যামাপুজোর সাঁঝ থেকে ভোর অবধি বেধড়ক, আচমকা, নানাবিধ কর্ণপটহ বিদারক বাজি ফাটালে কলকাত্তাইরা, সে অক্তে আপনি পাকা সুরেলা হাতে বীণাযন্ত্রে দরবারি কানাড়া বাজালে কান দিত না যেদো-মেধো কেউই। তাই কবি শাবাশ শাবাশ রব ছেড়ে বলেছেন :

ভদ্রং কৃতং কৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে

বর্ষাকাল এসেছে। এখন মত্ত দাদুরী পাগলা কোলাব্যাঙের পালা। কোকিল যে মৌনতা অবলম্বন করল সেটা অতিশয় ভদ্র কর্ম (বিচক্ষণেরও বটে)। জন্ম-অভিজাত জাতদ্রই এ আচরণ ভিন্ন অন্য আচরণ কল্পনা করতে পারে না।

.

তা আমি যতই কমন নলেজ নিয়ে পড়ে থাকতে চাইনে কেন, আমরা একদল হাফউন্নাসিক (হাফ-গেরস্ত তুলনীয় নয়, থুড়ি, থুড়ি, এই দেখুন, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যতই সন্তর্পণে আপনি যৌনের প্রতি সামান্যতম ইঙ্গিত দিয়েছেন কি না, অমনি দ্যাখ-তো-না-দ্যাখ ওই খাটালের বোঁটকা গন্ধের অর্ধান্যায্য বখরাটি আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন)– হ্যাঁ, কী বলছিলুম, এক দল অর্ধ-উন্নাসিক পাঠক আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন বহু বৎসর ধরে। কেন, বলতে পারব না। কখনও ভেবেছি, অনুকম্পাবশত লক্ষ করেননি এই তত্ত্বটি, পথে যেতে যেতে দেখলেন দুই অজানা টিমে ফুটবল খেলা হচ্ছে, তার একটি স্পষ্টত দুর্বল; আপন অজানতে দেখবেন, আপনার দরদখানি আস্তে আস্তে ওই দুলা টিমের পাল্লার ওপর ভর দিচ্ছে। কখনও ভেবেছি, হয়তো আমার মুসলমানি চিন্তাধারা, ভাষার যাবনিক কায়দা কেতা তার নতুন তত্ত্বের জন্যে কোনও কোনও একঘেয়েমি-ক্লান্ত পাঠককে আকৃষ্ট করেছে। আমি অবশ্য সে সম্বন্ধে অল্পই সচেতন ছিলুম; আমি জানত এমন কোনও বিষয়, এমন কোনও ভাষা ব্যবহার করিনি যা সুদ্ধমাত্র যাবনিকতা দ্বারা নিত্যনবীনের সন্ধানী জনের পাজরে কাতুকুতু দিয়েছে, জড় রসনায় চুলবুল জাগাবার চেষ্টা করেছে। যাবনিক জিনিস আমি আলিঙ্গন করেছি, পাঠকের সম্মুখে পেশ করেছি তখনই, যখন অনুভব করেছি সে যাবনিকতার মধ্যে বিশ্বজনীন ভাব সঞ্চারিত আছে, যে যাবনিকতা দেশ-কালপাত্র উত্তীর্ণ হয়ে শাশ্বত হবার অধিকার লাভ করেছে। কোণের প্রদীপ মিলায় যথা জ্যোতিঃ সমুদ্রেই। বলা বাহুল্য খ্রিস্টীয়, অখ্রিস্টীয়, জনপদসুলভ ভাবধারা, আমার আবাল্য পরিচয়ে খাসিয়া-সাঁওতাল সভ্যতার প্যাটার্ন আমি ঠিক সেইভাবেই গ্রহণ করেছি যেভাবে আমি যাবনিক চিন্তামণিকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি।.. এই পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা অতিক্রম করার সময় কিছু পাঠক সর্বদাই আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন, বিশেষ করে দুর্দিনে;

দুর্দিনে বলো, কোথা সে সুজন যে তোমার সাথী হয়?
আঁধার ঘনালে আপন ছায়াটি সেও, হায়, হয় লয় ॥

তদস্তিমে কৌন কিসকা সাথ দেতা হৈ?
কি ছায়া ভি জুদা হোতা হৈ ইনসাসে তারিকিমে ॥

এঁদের বয়স হয়েছে। এদের অনেকেই এখন গভীরে প্রবেশ করতে চান।

আমি তাই একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করব। দয়া করে আমার সহৃদয় পাঠকসমুদায় তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ এই অধম লেখককে তার মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রদোষে, তার ধূসর জীবনের গোধূলিতে তাকে আশীর্বাদ করবেন।

আমার অনুরোধ, আমার মূল লেখাটি পড়ার সময় যদি কৃপালু পাঠক অম্লাধিক নিরবচ্ছিন্ন আনন্দলহরীতে দোলা খেতে খেতে এগিয়ে যান, সে-রসস্রোতে (যদি আদৌ রসসৃষ্টিতে আমি কথঞ্চিৎ সক্ষম হই) ভেসে ভেসে সমুখ পানে চলতে থাকেন তবে হঠাৎ সে স্রোত থেকে সরে গিয়ে ফুটনোটের গভীরে ডুব দেবেন না।

আর যারা ফুটনোটের গভীরে গিয়ে কিছুক্ষণ সে গভীরে অবগাহন করার পর সাঁতার দিয়ে পুনরায় ভেসে উঠে স্রোতোপরি অন্যান্য পাঠকদের সঙ্গে সম্মিলিত হন তারা তখন নিশ্চয়ই আমাকে সস্নেহ আশীর্বাদ জানাবেন।

দ্বাপর

০১.

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে রাতদুপুরে হোক আর দিনদুপুরেই হোক চট করে বলতে পারবেন না, আপনি যে হোটেলে শুয়ে আছেন সেটা কোন শহরে। টোকিও, ব্যাংকক, কলকাতা, কাবুল, রোম, কোপেনহাগেন যে কোনও শহর হতে পারে। আসবাবপত্র, জানালার পর্দা, টেবিলল্যাম্প যাবতীয় বস্তু এমনই এক ছাঁচে ঢালা যে স্বয়ং শার্লক হোমসকে পর্যন্ত তারা সবকটা পুরু পুরু আতসি কাঁচ মায় তার জোরদার মাইক্রোস্কোপটি বের করে ওয়াটসনকে কার্পেটের উপর ঘোড়া বানিয়ে, নিজে তার পিঠে দাঁড়িয়ে, ছাতের উপর তার স্বহস্তে নির্মিত আ লা হোমস স্প্রে ছড়িয়ে বাকিটা থাক্‌, ব্যোমকেশ ফেলুদার কল্যাণে আজ ইস্কুল বায় ও সেগুলো জানে– তবে বলবেন, হয় মন্তে কালোর রেজিনা হোটেল নয় মোহোনেসবের্গের অল হোয়াইট হোটেল। দূরপাল্লার অ্যারোপ্লেনের বেলাও আজকের দিনে তাই। একবার তার গর্ভে ঢুকলে ঠাহর করতে পারবেন না, এটা সুইস এ্যার, লু হানজা, অ্যার ইন্ডিয়া না কেএলএম। তিমির পেটে ঢুকে নোয়া কি আর আমেজ-আন্দেশা করতে পেরেছিলেন এটা কোন জাতের কোন মুল্লুকের তিমি?

ইন্ডিয়ান মানেই নেটিভ, আস্তে আস্তে এ ধারণা কমছে। নইলে জর্মনি এ দেশের সেলাইয়ের কল, রুশ কলকাতার জুতো কিনবে কেন?

অতএব অ্যার ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যারোপ্লেনকে একটা চান দিতেই বা আপত্তিটা কী? অন্য কোম্পানিগুলো তো প্রায় সব চেনা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য আরেকটা কথা আছে। ওই কোম্পানির এক ভদ্রলোক বুদ্ধি খাঁটিয়ে তদ্বির-তদারক করে আমার সুখ সুবিধার যাবতীয় ব্যবস্থা না করে দিলে হয়তো আমার যাওয়াই হত না। তার নাম বলব না। উপরওলা খবর পেলে হয়তো কৈফিয়ৎ তলব করে বসবেন, কোনও একজন ভিআইপিকে সাহায্য না করে একটা থাচ্ছো কেলাস নেটিভ রাইটারের পিছনে তিনি আপিসের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করলেন কেন? তবে কি না তাঁর এক ভিআইপি মিত্রও আমাকে প্রচুরতম সাহায্য করেছিলেন। তাকে না হয় শিখণ্ডিরূপে খাড়া করবেন।

ভাবছিলুম চুঙ্গী (কাসটম্‌সের) উৎপাত থেকে এই দুই দোস্তো কতখানি বাঁচাতে পারবেন। ইতোমধ্যে এক কাস্টমিয়া আমার কাগজপত্র পড়ে আমার দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়ে শুধোলে, আপনিই তো আপনার বইয়ে চুঙ্গীঘরের কর্মচারীদের এক হাত নিয়েছেন, না?

খাইছে। এ যাত্রায় আমি হাজতবাস না করে মানে মানে কলকাতা ফিরতে পারলেই নিতান্তই পঞ্চপিতার আশীর্বাদেই সম্ভবে। কে জানে, এই কাস্টমিয়াই হয়তো হালে কয়েকজন ডাঙর ভিআইপি কাম সরকারি কর্মচারীকে বেআইনিতে মাল আনার জন্য নাজেহাল করেছিলেন।… এত দিন কলকাতা করপরশনের অত্যুৎসাহ ও মাত্রাধিক কর্মতৎপরতাবশত জলের কল খুললে যে রকম জল না বেরিয়ে শব্দ বেরুত সেই রকম আমার ব্লটিং পেপারের লাইনিংওলা গলা দিয়ে কথা না বেরিয়ে বেরোল ঘসঘস খসখস চো-ও-ও-ও ধরনের কী যেন বদখৎ আওয়াজ।

নাহ্। এ লোকটির রসবোধ আছে কিংবা এঁর বাড়িতে মাসে একদিন করপরশনের কলের জল আসে। ওই ভাষা বাবদে তিনি সুনীতি চাটুয্যে মশাইকে তাক লাগিয়ে উত্তম ধ্বনিতত্ত্ববাদের কেতাব লিখতে পারবেন। বললেন, নিশ্চিন্তমনে ওই আরাম চেয়ারটায় বসুন। আমি সব ঠিক করে দিচ্ছি। তার পর ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে এক অশ্রুত টরে-টক্কার সঙ্কেত করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে জনাচারেক বাঙালি কাস্টমিয়া আমাকে ঘিরে যা আদর-আপ্যায়ন আরম্ভ করলেন যে হৃদয়ঙ্গম করলুম, দেবীর প্রসাদে মূক যে রকম বাঁচাল হয়, আমি কেন, হরবোলাও মূক হতে পারে।

প্রতিজ্ঞা করলুম, চুঙ্গীঘর লেখাটি আমি ব্যান করে দেব। কার যেন দুশো টাকা ফাইন হয়েছে। অবশ্য অন্য অকারণে, কিন্তু জরিমানা ইজ জরিমানা! আপনার কারণ ভিন্ন বলে আপনি তো আর মেকি টাকা দিয়ে শোধবোধ করতে পারবেন না।

কিন্তু এত সব বাখানিয়া বলছি কেন?

শুনুন। জীবনে ওই একদিন উপলব্ধি করলুম, সাহিত্যিক- তা সে আমার মতো আটপৌরে সাহিত্যিক হওয়ার মধ্যেও একটা মর্যাদা আছে।

***

এসব যে বাখানিয়া বলছি তার আরও একটা কারণ আছে।

আমার নিজের বিশ্বাস, প্লেনের পেটের ভিতরকার তুলনায় অ্যারপোর্টে আজব আজব তাজ্জব চিড়িয়া দেখতে পাওয়া যায় ঢের বেশি। পাসপোর্ট, কাস্টমস, হেলথ অফিসে, রেস্তোরাঁয় তাদের আচরণে কেউ-বা সঙ্কোচের বিহ্বলতায় অতীব মিয়মাণ, কারও-বা গড় ড্যাম ডোন্টো কেয়ার ভাব– ওদিকে একটি বিগতযৌবনা মার্কিন মহিলা অ্যারোপ্লেনে অর্ধন্দ্রি যামিনী কাটিয়ে আলুথালু-কেশ, হৃতপাউডাররুজ, এঞ্জিনের পিস্টন বেগে পলস্তরা পলস্তরা ক্রিম-পাউডার-রুজ মাখছেন, এদিকে তার কর্তা প্লেনে সস্তায় কেনা স্কচ স্যাট স্যাট করছেন; আর ওই সুদূরতম প্রান্তে দেখুন, দেখুন বললুম বটে, কিন্তু দেখার উপায় নেই- কালো বোরকাপরা জড়োসড়ো গণ্ডা দুই মক্কাতীর্থে হজযাত্রিনীর গোঠ। এরা নিশ্চয়ই চলতি ফ্যাশানের ধার ধারেন না। বেশিরভাগ আঁকড়ে ধরে আছেন পুঁটুলি- হ্যাঁ, বেনের পুঁটুলি। গরুর গাড়িতে, গয়নার নৌকোয় ওঠার সময় যে পটুলি নেন। ওঁরা ভাড়া বাবদ কয়েক হাজার টাকা দিয়েছেন নিশ্চয়ই। অনায়াসে হাল্কা স্যুটকেস কিনতে পারতেন। দু-একজনের ছিলও বটে। কিন্তু ওদের কাছে গরুর গাড়ি যা, হাওয়াই জাহাজও তা– এদের মক্কা পৌঁছলেই হল। হায়, এঁরা জানেন না প্লেনে ভ্রমণ– তা সে যে কোনও কোম্পানিই হোক না কেন– গরুর গাড়িতে মুসাফিরি করার তুলনায় ঢের বেশি তকলিফদায়ক। এমনকি প্লেনে এঁদের পক্ষে হায়া-শরম বাঁচিয়ে চলাও কঠিন। কলকাতার বস্তিতে কী হয় জানিনে, কিন্তু এদের গ্রামাঞ্চলে কেউ কখনও প্রাতঃকৃত্যের জন্য কিউ দেয় না। অথচ প্লেনে প্রাতঃকৃত্যের জন্য এদের কিউয়ে দাঁড়াতে হবে– মেয়েমদ্দে লাইন বেঁধে। সে কথা পরে হবে। তবে হজযাত্রীদের জন্য স্পেশাল প্লেনে যদি স্পেশাল ব্যবস্থা থাকে তার তথ্য জানিনে। কোনও কোম্পানি অপরাধ নেবেন না।

***

শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি প্লেন দিল ছাড়ি
দাঁড়ায়ে রহিল পোর্টে সব বেরাদরুই শুষ্ক চোখে।

পূর্বেই নিবেদন করেছি প্লেনের ভিতরে দেখবার মতো কিছুটি নেই। খেয়াপারে রেলগাড়িতে যা দেখতে পাওয়া যায় তার চেয়েও কম। আর সর্বক্ষণ আপনার চোখের তিন ফুট সামনে, সম্মুখের দুটো সিটে দুটো লোকের ঘাড়। তারও সামনে সারি সারি ঘাড়। দোস্ত আমার এ প্লেনের মালিক, অতএব আমার জন্য উইন্ডো সিটের ব্যবস্থা করেছেন অর্থাৎ বাঁ দিকে তাকালে বাইরের আকাশ দেখা যায় মাত্র, বলতে গেলে পৃথিবীর কিছুই না। এক রাত্রে, তদুপরি আল্লায় মালুম, বিশ হাজার না পঁচিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে প্লেন যাচ্ছে। কিছু-বা দেখতে পায়। তবে ভারতীয় প্লেনে একটা বড় আরাম আছে। যদিও অধিকাংশ যাত্রী ভারতীয় নয়–বিদেশি, এবং প্রধানত ইয়োরোপীয়। তারা জানে, ইন্ডিয়ানরা বেলেল্লাপনা পছন্দ করে না। কাজেই অতিরিক্ত কলরোল, এবং ছাগলের দরে হাতি কেনার মতো স্কচ-ভোদকা সেবনজনিত মাঝে-মধ্যে তদতিরিক্ত কলহরোল থেকে নিশ্চিন্ত মনে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।

.

এ-বাবদে এখানেই থাক। কারণ শ্রদ্ধেয় শ্ৰীযুত তারাশঙ্কর, সম্মানীয় শ্ৰীযুত বুদ্ধদেব, ভদ্র প্রবোধ ও অন্যান্য অনেকেই প্লেনের ভিতরকার হাল সবিস্তর লিখেছেন।

জাগরণ, তন্দ্রা, ঘুম সবই ভালো। কিন্তু তিনটিতে যখন গুবলেট পাকিয়ে যায় তখনই চিত্তির। এ যেন জ্বরের ঘোরে দু দিন না তিনদিন কেটে গেল বুঝবার কোনও উপায় নেই।

চিৎকার চেঁচামেচি। রোম! রোম!! রোম!!!

.

০২.

ক্যাথলিকদের তো কথাই নেই। প্রটেসটান্টদের ঈষৎ সংযত কৌতূহল। বিশেষ করে মার্কিনদের। দেশে ফিরে বড়ফাট্টাই করতে হবে,  তেমন কিছু না, তবে কি না, হ্যাঁ, দেয়ালের আর গম্বুজের ছবিগুলো ভালো। কী যেন নাম (ভামিনীর দিকে তাকিয়ে) মাইকেল রাফাএল, না হল না। লেওনার্দো দা বত্তিচেল্লি। ও! সেটা বুঝি মোনালিসার লিনিং টাওয়ার?

বললে পেত্যয় যাবেন না, আমি স্বকর্ণে শুনেছি, তাজমহলের সামনে বসে একই বেঞ্চে বসা এক মার্কিনকে তার মিসিসের উদ্দেশে শুধোতে শুনেছি, কিন্তু আশ্চর্য, এই ইন্ডিয়ানরা এ সব তৈরি করল কী করে– ফরেন সাহায্য বিনা, অর্থাৎ আমাদের সাহায্য না নিয়ে।

রোমে নামতেই হল। সেখানে আমার এক বন্ধু বাস করেন। কিন্তু তার ফোন নম্বর জানা ছিল না বলে যোগসূত্র স্থাপন করা গেল না। একখানা পত্রাঘাত, তদ্দরুন স্ট্যাম্প যোগাড় করতে না করতেই অ্যার কোম্পানির লোক রাখাল ছেলে যেরকম গরু খেদিয়ে খেদিয়ে জড়ো করে গোয়ালে তোলে সেই কায়দায় প্যাসেঞ্জারদের প্লেনের গর্ভে ঢোকালে। প্যাসেঞ্জারদের গরুর সঙ্গে তুলনা করাটা কিছুমাত্র বেয়াদবি নয়। মোটা, পাতলা ঠিক বয়স্ক গরুরই মতো লাউঞ্জের মধ্যিখানে একজোট হয়ে বসেছে বটে কিন্তু বাছুরের পাল, অর্থাৎ চ্যাংড়া-চিংড়িরা যে কে কোনদিকে ছিটকে পড়েছে তার জন্য হুলিয়া সমন বের করেও রত্তিভর ফায়দা নেই। কেউ গেছেন কিওরিওর দোকানে। কাইরোর মতো এখানেও খাঁটি-ভেজাল দুই বস্তুই সুলভ এন্তের পড়ে আছে কিন্তু দুর্লভ, কলকাতার মাছের বাজারকেও হার মানায় গাহকের কান কাটতে। কেউ-বা গেছেন বিনমালের (ট্যাক্স ফ্রি) দোকানে। হয়তো ইতালির নামকরা একখানা আস্ত ফিয়াৎ (মোটামুটি, ফা (F) ব্রিসিয়োনে; ই (i) ইতালিয়ানা; আ (a) ওতোমিবিলে; তু (T) রিনো– এই চার আদ্যাক্ষর নিয়ে FIAT. একুনে, ফ্যাব্রিকশন (মেড ইন) ইতালিয়ানা (of Italy) অটোমবিল (of) তুরিনো। তুরিনো সেই শহরের নাম যেখানে এই স্বতশ্চলশকট নির্মিত হয়; ফিয়াৎ শব্দ আবার আরেক প্রাচীন অর্থ ধরে, ফরমান, তাই হোক।) গাড়ি কিনে নিয়ে আসেন! একটি হাফাহফি আধাআধি, অর্থাৎ পাতে দেওয়া চলে মার্কিন চিংড়ি ওই হোথা বহু দূরে বার-এ বসে চুটিয়ে প্রেম করছেন একটি খাবসুরৎ ইতালিয়ান চ্যাংড়ার সঙ্গে। খাবসুরৎ বলতেই হবে– এই রোম শহরে ছবি এঁকে মূর্তি গড়ে যিনি নাম করেছেন সেই মাইকেল এঞ্জেলো যেন এই সদ্য একে গড়ে চরে খাওগে, বাছা, বলে ছেড়ে দিয়েছেন। আর ইতালিয়ান যুবক-যুবতীর প্রতি মার্কিনিংরেজের যে পীরিত সেটা প্রায় বেহায়ামির শামিল। চিংড়িটা চরে খাবে না কেন? সর্বশেষ বলতে হয়, ইতালির কিয়ান্তি মদ্য দুনিয়ার কুল্লে সুধার সঙ্গে পাল্লা দেয়। সেটা ও মেয়েটা পাওয়া যাচ্ছে ফ্রি, গ্রেটিস অ্যান্ড ফর নাথিং। মুফৎ মে।

প্লেনে ঢুকে দেখি, সত্যি সেটা গোয়ালঘর। মশা খেদাবার তরে গায়ের চাচার বাড়িতে যে রকম স্যাঁৎসেঁতে খড়ে আগুন ধরানো হত এখানেও সেই প্রতিষ্ঠান। তবে হ্যাঁ, এটা বিজ্ঞানের যুগ। নানা প্রকারের ডিসিনফেকটেট, ডি অডরেনট স্প্রে করা হয়েছে প্রেমসে। সায়েবদের যা বি ও বডি ওডার গায়ের বোঁটকা দুর্গন্ধ!!

সকালবেলার আলো দিব্যি ফুটে উঠেছে। ইতোমধ্যে প্লেনে পাক্কা সাড়ে পনেরো ঘন্টা কেটেছে! দমদম ছেড়েছি রাত নটায়; এখন সকাল আটটা। হওয়ার কথা তো এগারো ঘণ্টা! কী করে হল? বাড়ির কাচ্চাবাচ্চাদের শুধোন।

.

প্লেন যখন রোম ছাড়ল তখন অপ্রশস্ত দিবালোক।

দিবালোকের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক আছে। যে দেশে যাচ্ছি, সেই জনির বাঘা দার্শনিক কান্ট নাকি বলেছেন কাল এবং স্থান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে না। (টাইম অ্যান্ড স্পেস আর আ প্রিয়রি কনসেপশন)।

বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি, যেন দেশের সকালবেলার সাতটা-আটটা। কিন্তু হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে নজর পড়াতে দেখি, সেটি দেখাচ্ছে সাড়ে বারোটা! কী করে হয়? আমার ঘড়িটি তো পয়লা নম্বরি এবং অটোমেটিক। অবশ্য এ কথা আমার অজানা নয়, অটোমেটিক বেশি সময় কোনও প্রকারের ঝাঁকুনি না খেলে মাঝে-মধ্যে থেমে গিয়ে সময় চুরি করে। কিন্তু কাল রাতভর যা এপাশ ওপাশ করেছি তার ফলে ওর তো দম খাওয়া হয়ে গেছে নিদেন দু দিনের তরে। আমার পাশের সিটে এক বর্ষীয়সী বাচ্চাটার ঠাকুরমা দিদিমার বয়সী। তার দিকে ঝুঁকে শুধালুম, মাদাম, বেজেছে কটা, প্লিজ? মাদামের উস্কোখুস্কো চুল, সকালবেলার ওয়াশ, মুখের চুনকাম, ঠোঁটের উপর উষার লালবাতি জ্বালানো হয়নি। শুকনো মুখে যতখানি পারেন ম্লান হাসি হেসে বললেন, পারুদো মসিয়ো, জ ন পার্ল পা লেদুস্তানি। অর্থাৎ তিনি হিন্দুস্তানি বলতে পারেন না। ইয়াল্লা। সরলা ফরাসিনী ভেবেছেন, প্লেনটা যখন হিন্দুস্তানি, আমি হিন্দুস্থানের কলকাতাতে প্লেনে উঠেছি, চেহারাও তদ্বৎ, অতএব আমি নিশ্চয়ই হিন্দুস্তানিতে কথা বলেছি। আমি অবশ্য প্রশ্নটি শুধিয়েছিলাম আমার সর্বসত্ব সংরক্ষিত অতিশয় নিজস্ব বাঙাল ইংরেজিতে। ওদিকে এ তত্ত্ব আমার সবিশেষ বিদিত যে ফরাসিরা নটোরিয়াস এক ভাষী– ফরাসি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষা শিখতে চায় না। তাদের উহ্য বক্তব্য, তাবশ্লোক যখন হদ্দমুদ্দ হয়ে ফ্রান্সে আসছে, বিশেষ করে কড়ির দেমাক, বন্দুক-কামানের দেমাক, চন্দ্রজয়ের দেমাকে ফাটো ফাটো মার্কিন জাত এস্তেক প্যারিসে এসে ফরাসির মতো নাজুক জবান্ শেখবার ব্যর্থ চেষ্টায় হরহামেশা হাবুডুবু খাচ্ছে তখন ওদের আপন দেশে আপোসে তারা যে কিচিরমিচির করে সেগুলো শেখার জন্য খামোখা উত্তম ফরাসি ওয়াইনে সুনির্মিত নেশাটি চটাবে কেন? তবু মহিলাটির উক্তি শুনে আমারও ঈষৎ ন্যাজ মোটা হল। দূর-দুনিয়ার ভারতীয় প্লেন সার্ভিস না থাকলে মহিলাটি কি কল্পনাও করতে পারতেন যে হিন্দুস্তানিও আন্তর্জাতিক ভাষা হতে চলেছে খলিফে মুসাফির যে রকম এ্যার ফ্রান্সে ফরাসি, কেএলএমে ডাচ্‌, বিওএসি-তে ইংরেজির জন্য তৈরি থাকে।

তখন পুনরপি আপন ঔন অরিজিনাল ফরাসিতে প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করলুম। আ আ–! বুঝেছি, বুঝেছি! কিন্তু এই সময় সমস্যাটি ভারি কঁপ্লিকে অর্থাৎ কমপ্লিকেটিভ, জটিল। আমি ওটা নিয়ে মাথা ঘামাইনে।

তবু?

সব দেশ তো আর এক টাইম মেনে চলে না। ভোয়ালা!–নয় কি? প্যারিসে যখন বেলা বারোটা তখন রেঙ্গুনে– আমি সেখানে বাস করি বিকেল পাঁচটা-ছটা। কিন্তু আপনাকে ফের বলছি, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি টাইম কত জেনে যাই আমার অতিশয় বিশ্বাসী মিনিসত্র দ্য লেক্টেরিয়রকে (হোম সেক্রেটারি, অর্থাৎ ভিতরকার ইন্টেরিয়ের এঁতেরিয়র-কে) শুধিয়ে। সোজা কথায় পেটটিকে। ওখানে যখন লামার্সেইয়েজ সঙ্গীত (বাংলায় পেটে যখন হুলুধ্বনি) বেজে ওঠে তখন সেটা লাঞ্চের বা ডিনারের সময় উপস্থিত আমার এতেরিয়রেতে সে সঙ্গীত ক্রেসেন্ডতে (তার সপ্তকের পঞ্চমে)। তাই এখন রেঙ্গুনে নিশ্চয়ই দেড়টা-দুটো।

আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, তা এখখুনি বোধহয় লাঞ্চ দেবে।

মাদাম যদিও বলেছেন তিনি টাইম নিয়ে মাথা ঘামান না, কিন্তু দেখলুম, তার প্র্যাকটিকাল দিকটা খাসা বোঝেন। আপত্তি জানিয়ে বললেন, রেঙ্গুনে যখন লাঞ্চ তখন এই মিত্রোপাতে (মিৎ = মিল;- রোপা, ইয়োয়োপা-র শেষাংশ অর্থাৎ মধ্য-ইয়োরোপে) ব্রেকফাস্ট। জাপানে যারা এ-প্লেনে উঠেছে তাদের তো এখন ডিনারের সময় হয় হয়। সুতরাং কোন যাত্রী কোথায় উঠেছে, কার পেট কখন ব্রেকফাস্টলাঞ্চ/ডিনারের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে সে হিসাব রেখে তো আর কোম্পানি ঘড়ি ঘড়ি কাউকে লাঞ্চ, কাউকে সাপার, কাউকে স্যানউইচসহ বিকেলের চা দিতে পারে না। তবে কি না, এরা ব্রেকফাস্টে যে পরিমাণ খেতে দেয় সেটা কলেবরে প্রায় লাঞ্চের সমান।… তাই বলছি, এসব টাইম নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ট্রেনেও যদি ঘড়ি ঘড়ি ঘড়িটার দিকে তাকান তবে সে জনি দীর্ঘতর মনে হয় না? আমি তো প্যারিসে পৌঁছতে পারলে বাঁচি। ব দিয়ো (দয়ালু ঈশ্বর) ঘন্টা দেড়েকের ভিতর পৌঁছিয়ে দেবেন। নাতনিটা নেতিয়ে গিয়েছে।

মহিলাটি যেভাবে সবিস্তর গুছিয়ে বললেন সেটা ধোপে টেকে কি না বলতে পারব না, কারণ আমি যত বার এসেছি-গিয়েছি, আহারাদি পেয়েছি, তখন ঘড়ি মিলিয়ে দেখিনি কোনটা লাঞ্চ কোটা কী? এবং আজকের দিনে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন টাইমের সালঙ্কার সটীক ফিরিস্তি দেবার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনে। রেডিও ট্রানজিস্টারের কল্যাণে এখন বাড়ির খুকুমণি পর্যন্ত জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দেয়, বুঝিয়ে বলে গ্রিনচ মিন টাইম, ব্রিটিশ সামার টাইম, সেন্ট্রাল ইয়োরোপিয়ান টাইম, কোনটি কী? তবু যে এতখানি লিখলুম, তার কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন টাইম যে কীভাবে কসরৎ বিন্ মেহৎ আয়ত্ত করতে হয় সেটা ফরাসি মহিলাটি আমাকে শিখিয়ে দিলেন অতি প্র্যাকটিকাল পদ্ধতিতে। সেটা কী? রাজা সলমন যেটা গুরুগম্ভীর ভাবে, ধর্মনীতি হিসেবে আপ্তবাক্য রূপে হাজার তিনেক বছর পূর্বে প্রকাশ করে গিয়েছেন, নো দাইসেল নিজেকে চেনো (চিনতে শেখো)। শ-বছর আগে লালন ফকিরও বলেছেন, আপন চিনলে খুদা চেনা যায়। ফরাসি মহিলাটিও সেই তত্ত্বটিই, অতিশয় সরল ভাষায় প্রকাশ করলেন, আপন পেটটিকে বিশ্বাস করো। তার থেকেই লোকাল টাইম, স্ট্যান্ডার্ড টাইম, সর্ব টাইম জানা হয়ে যাবে। ওইটেই মোক্ষমতম ক্রনোমিটার। বরঞ্চ ক্রনোমিটার মাঝে-মধ্যে বিগড়োয়। আলবৎ, পেটও বিগড়োয়। কিন্তু বিগড়োনো অবস্থাতেও সে লাঞ্চ ডিনারের সময়টায় নিগেটিভ খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়, তার খিদে নেই।

ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট না কী যেন এসে গেছে। মাদাম বলেছিলেন, সেটা কলেবর। আমি মনে মনে বললুম, বপু। এ্যাব্বড়া বড়া ভাজা, সসিজ, পর্বতপ্রমাণ ম্যাশ পটাটো, টোস্টমাখন, মার্মলেড়, টমাটো ইত্যাদি কাঁচা জিনিস, আরও যেন কী কী। তখন দেখি, বেশ খাচ্ছি। অতএব পেটের ক্রনোমিটার বলছে এটা কলকাতার লাঞ্চ, অর্থাৎ বেলা একটা-দুটো। ঘড়ি মিথ্যেবাদী, বলছে নটা!

.

০৩.

অজগাঁইয়া যে রকম ওয়াকিফ হবার চেষ্টা না দিয়েই ধরে নেয় দিল্লি মেলও তার ধেধূধেড়ে গোবিন্দপুর ফ্ল্যাগ ইটিশানে দাঁড়াবে এবং চেপে বসে নিশ্চিন্দি মনে তামুক টানে, আমার বেলাও হয়েছিল তাই। আমার অপরাধ আরও বেশি। আমি জেনেশুনেই অপকর্মটি করেছিলুম। আমি ভালো করেই জানতুম, যে প্লেনে যাচ্ছি সেটা যদিও জর্মনির উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তবু সে দেশের কোনও জায়গায় দানাপানির জন্যও নামবে না। অবশ্য অ্যার-ইন্ডিয়ার মুরুব্বি আমার, একগাল হেসে আমায় বলেছিলেন, এ প্লেনটা কিন্তু প্যারিসে নামে। আপনি সেখানে চলে যান। দু চারদিন ফুর্তিফার্তি করে চলে যাবেন জর্মনি। খর্চা একই। আর প্যারিস হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ- সঙ্গে যে মিত্রটি ছিলেন তিনিও মৃদু হেসে সায় দিলেন। দু জনারই বয়স এই তিরিশ-পঁয়ত্রিশ। মনে মনে বললুম, এখন কলকাতা-দিল্লির রাস্তাঘাটেই যা দেখতে পাওয়া যায় প্যারিসের নাইট ক্লাব-কাবারে তার চেয়ে বেশি আর কী ভেল্কিবাজি দেখাবে? তদুপরি বানপ্রস্থে যাবার বয়সও আমার তৈলদানং? তাই আখেরে স্থির হল আমি অ্যার-ইন্ডিয়া প্লেন থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিচে (স্থানীয় ভাষায় স্যুরি) নামব। হেথায় চেঞ্জ করে ভিন্ন প্লেনে মৌকামে পৌঁছব– অর্থাৎ জর্মনির কলোন শহরে। তাই সই।

ফরাসিনীকে বিস্তর বঁ ভোয়াইয়াজ (গুড জর্নি, গুড ফ্লাইট) বলে জুরিচের অ্যারপোর্টে নেমে পাসপোর্ট দেখালুম। তার পর গেলুম খবর নিতে কলোনে যাবার প্লেন কখন পাব। উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ, জড়। দেশে বলে,

অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর।

তখন বেজেছে সকাল নটা। রামপন্টক বলে কি না, কলোন যাবার প্লেন দ্বিপ্রহরে। বিগলিতার্থ আমাকে নিরেট তিনটি ঘণ্টা এখানে বসে বসে আঙুল চুষতে হবে।

শুনেছি, যে রুগী দশ বৎসর ধরে পক্ষাঘাতে অসাড় অবশ সে নাকি মৃত্যুর সময় অকস্মাৎ বিকট মুখভঙ্গি করে, তার সর্বাঙ্গ খিচোতে থাকে, হঠাৎ দশ বৎসরের টান-টান হাঁটু যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে থুতনির দিকে গোত্তা মারতে চায় এবং মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বেরোতে থাকে।

আমার হল তাই। আমি হয়ে গিয়েছিলুম অচল অসাড়। স্তম্ভিত বললুম না, কারণ আজকের দিনের পয়লা নম্বরি অ্যারপোর্টে স্তম্ভ আদৌ থাকে না। যাই হোক যাই থাকু, আমার মুখ দিয়ে বেরুতে লাগল আতশবাজির ঝটকা, তুবড়ির পর তুবড়ির হিংস্র হিসহিস আর পটকা, বোমার দুদ্দাড় বোম্বা। আর হবেই-না কেন? যে জুরিচের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কর্ণপটহবিদারক তথা নয়নান্ধকারক আতশবাজি ছাড়ছি সেই আতশবাজিকেই আপন জর্মন ভাষায় বলে বেঙ্গালিশে বেলোয়েষটুঙ অর্থাৎ বেঙ্গল রোশনি; এবং এ দেশের ফরাসি অংশে বলে ফ্য দ্য বাঙাল অর্থাৎ ফায়ার অব বেঙ্গল। তদুপরি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফরাসি ভাষায় বঙ্গদেশকে বাঙালরূপে উচ্চারণ করে। আমি বাঙাল বঙ্গসন্তান। আমি আমার জন্মনি, জন্মনি অধিকার অর্থাৎ বার্থরাইট ছাড়ব কেন? ফায়ার ওয়ার্কস চালাবার যদি কারও হক্ক থাকে তবে সে আমার। হুহুঙ্কার ছাড়লুম :

কী বললে? ঝাড়া তিনটি ঘণ্টা আমাকে এই অ্যারপোর্টে বসে কলোনের প্লেনের জন্য তাজ্জিম মাজ্জিম করতে হবে? আমার দেশ যে-ভারতবর্ষকে তোমরা অন্ডর ডিভালাপড় কন্ট্রি সাদামাটা ভাষায় অসভ্য দেশ– বলল সেখানেও তো তিন-তিনটি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না, কনেকশনের জন্য। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি রেলগাড়ির কথাই বলছি। আমি যদি আজ ভারতের যে কোনও ডাকগাড়িতে করে যে কোনও জংশনে পৌঁছুই তবে আধঘণ্টার ভিতর কনেকশন পেয়ে যাই। না পেলে– সেটাও সাতিশয় কালে কম্মিনে– খবরের কাগজে জোর চেল্লাচেল্লি করি (মনে মনে বললুম অম্মদেশীয় রেলের কর্তারা তার ঘোড়াই কেয়ার করেন) অ্যারোপ্লেনের তো কথাই নেই। সে তো আরও তড়িঘড়ি কনেকশন দেয়। আমাকে যত তাড়াহুড়ো করে মোকামে পৌঁছে দিতে পারে, ততই তার লাভ। অন্যত্র অন্য প্যাসেঞ্জারের সেবার্থে যেতে পারলে তার আরও দু পয়সা হয়।… অ! তোমাদের বিস্তর ধনদৌলৎ হয়ে গিয়েছে বলে তোমরা আর পয়সা কামাতে চাও না? আর শোনো, ব্রাদার, এ তো হল ট্রেন-প্লেনের কাহিনী। গরুর গাড়ির নাম শুনেছ? বুলক কার্ট? সেই গরুর গাড়িতে করে যদি আমি দশ-বিশ মাইল যাই তবে সেখানে পৌঁছেও সঙ্গে সঙ্গে কনেকশন পাই। বোলপুর থেকে ইলামবাজার গিয়ে নদীর ওপারে তদ্দণ্ডেই অন্য গরুর গাড়ির কনেকশন হামেহাল তৈরি। বস্তুত তখন ওপারের গাড়োয়ানরা গাহককে পাকড়াও করার জন্য যা হৈ-হুল্লোড় লাগায় তার সামনে আন্তর্জাতিক পাণ্ডা প্রতিষ্ঠানের পর্ব মহাভারত- থুড়ি, পাঁচখানা ইলিয়াড দশখানা ফাউসট লিখতে পারি। কিন্তু উপস্থিত সেটা স্থগিত থাক। আমার শেষ কথা এইবারে শুনে নাও। এই যে আমি কন্টিনেন্টে এসেছি তার রিটার্ন টিকিটের জন্য কত ঝেড়েছি জানো? এক-একটা টাকা যেন নাক ফুটো করে কুরে কুরে বেরিয়েছে তোমরা যাকে বলল, পেইং প্রু দি নোজ। পরাক্কা ছ হাজার পাঁচশোটি টাকা। তার পর ফরেন এক্সচেন্জ, গয়রহ হিসেবে নিলে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে সাত হাজারের মতো। এ ভূখণ্ডে থাকব মাত্র তিনটি মাস। এইবারে হিসাব করো তো বসে, তবে বুঝি তোমার পেটে কত এলেম, এই যে কনেকশনের জন্য আমার তিনটি ঘণ্টা বরবাদ করলে তার মূল্যটা কী? সে না হয় গেল। কিন্তু সে সময়টা যে বন্ধুবান্ধবীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলে তার জন্য তোমার হৃদয়বনে কোনও সন্তাপানল প্রজ্বলিত হচ্ছে না? তারা–

ইতোমধ্যে আমার চতুর্দিকে একটা মিনি মাসির মধ্যিখানের মিডি সাইজের ভিড় জমে গিয়েছে। ফ্রি এনটারটেনমেন্ট। আমার সোক্রোতেসপারা, কিংবা দ্রৌপদী যে রকম রাজসভায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন সেই ধরনের যুক্তিজাল বিস্তার এদের হৃদয়-মনে যেন মলয়বাতাসের হিল্লোল, দে দোল দোল খেলিয়ে গেল। এদের বেশিরভাগই আমার বেদনাটা সহানুভূতিসহ প্রকাশ করেছে। য়া য়া, উই উই, সি সি যাবতীয় ভাষায় আমাকে মিডিসমর্থন জানাচ্ছে। আমি ফের তেড়ে এগুতে যাচ্ছি এমন সময়

এমন সময় সর্বনাশ! একটি কুড়ি-একুশ বয়সের কিশোরী, আমি যাকে কেছে মুছে ইস্ত্রি মেরে ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছি, কাউন্টারের পিছনের কুঠরি থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বললে, আপনার টেলিফোন। তনুহূর্তেই সেই মহাপ্রভু তিলব্যাজ না করে, যেন সসেমিরে দে ছুট দে ছুট। লোকটা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথের আমারে ডাক দিল কে ভিতর পানে গানটি জানে। কিশোরী একগাল হেসে আমাকে শুধোলে, আপনার জন্য কী করতে পারি স্যার? দুত্তোর ছাই। আধ-ফোঁটা এই চিংড়ির সঙ্গে কী লড়াই দেব আমি! নাথিং বাট ইয়োর লড। বলে দুমদুম করে লাউঞ্জের সুদূরতম প্রান্তে আসন নিলুম।

.

সোফাটা মোলায়েম। সামনে ছোট্ট একটি টেবিল।

বেজার মুখে বসে আছি। এমন সময় দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু হাতে দুটি ভর্তি ওয়াইনগ্লাস নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক যতখানি নিচু হয়ে অপরিচিত জনকে বাও করাটা কেতাদুরস্ত তাই করে শুধোলেন, ভুপেরমেতে, মসিয়ো–অর্থাৎ আপনার অনুমতি আছে স্যার? নিশ্চয়, নিশ্চয়। যদিও সোফাটির যা সাইজ তাতে পাঁচজন কিংকিং অনায়াসে বসতে পারে তবু ভদ্রতা দেখাবার জন্য ইঞ্চিটাক সরে বসলুম। ভদ্রলোক ফের কায়দামাফিক বললেন, ন ভূ পেঁরাজে পা, জ ভু প্রি। এর বাংলা অনুবাদ ঠিক কী যে হবে, অতখানি ফরাসি জানিনে, বাংলাও না। মোটামুটি না, না, ব্যস্ত হবেন না। ঠিক আছে, ঠিক আছে। উর্দুতে বরঞ্চ খানিকটে বলা যায় তকলুফ কিজিয়ে ওই ধরনের কিছু একটা। তকলু কথাটা তকলিফ (বাংলায় কিছুটা চালু) অর্থাৎ কষ্ট! মোদ্দা: আপনাকে কোনও কষ্ট দিতে চাইনে।

সেই দুটো গ্লাস টেবিলে রেখে একটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আরেকটা নিজে তুলে নিয়ে বললেন, আপনার স্বাস্থ্যের মঙ্গলের জন্য।

চেনাশোনা কিছুই নেই। খোদার খামোখা এ লোকটা একটা ড্রিংক দিচ্ছে কেন? তবে কি লোকটা কনফিডেন্স ট্রিকস্টার? আমাদের হাওড়া-শ্যালদাতে যার অভাব নেই। ভাবসাব (কনফিডেন্স) জমিয়ে বলবে দাদা, তা হলে আপনি টিকিট দুটো কিনে আনুন। এই নিন আমার লিলুয়ার পয়সা, আমি মালগুলো সামলাই।… টিকিট কেটে ফিরে এসে দেখলেন, ভো ভো। আপনার মালপত্র হাওয়া।

কিন্তু এ লোকটা আমার নেবে কী? সুকুমার রায় (?) একদা একটি ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। বিরাট ভূড়িওলা জমিদার টিঙটিঙে দারওয়ানকে শাসিয়ে শুধোচ্ছেন, চোর ভাগা কিও? দারওয়ান বললে, মেরা এক হাতমে তলওয়ার দুসরেমে ঢাল। পকড়ে কৈসে? আমার এক হাতে তলওয়ার, অন্য হাতে ঢাল। ধরি কী করে?

আমার এক পাশে আমার মিত্রের দেওয়া এটাচি, অন্যদিকে অ্যার ইন্ডিয়ার দেওয়া ছোট্ট একটি বাকসো। দুটোই তো বগলদাবা করে বসে আছি। লোকটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না, ও স্বৰ্গত পিসি সরকার (এ স্থলে বলে রাখা ভালো সরকার কখনও এহেন অপকর্ম করতেন না) যে আমার দুটি বাক্স সরিয়ে ফেলবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এ রকম রুচিসম্মত পোশাক-আশাক আমি একমাত্র ডিউক অব উইন্ডসরকে (উচ্চারণ নাকি উইনজার) পরতে দেখেছি– জীবনে একবার। ডিউকের জীবনে একবার নয়, আমার জীবনে একবার। সে বেশের বর্ণনা অন্যত্র দেব।

একখানা কার্ড এগিয়ে দিলেন। তাঁর নাম আঁদ্রে দ্যুপোঁ। তার পর একগাল হেসে শুধোলেন, যদি অপরাধ না নেন তবে একটি প্রশ্ন শুধোই, আপনি কি কটিঙে বিশেষজ্ঞ?

আমি থতমত খেয়ে শুধোলুম, কটিঙে? সে আবার কী?

ভুদ্রলোক আরও থতমত খেয়ে কিন্তু চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে কী মশাই! এই মাত্র আপনার অনবদ্য লেকচারটি শুনলুম, আপনি ক হাজার টাকা ঝেড়ে কলকাতা থেকে এ দেশে আসার রিটরন টিকিট কেটেছেন, এবং কনেকশন না পেয়ে তিন ঘণ্টাতে আপনার কী পরিমাণ অর্থক্ষয় হল তার পুরোধাক্কা, করেট টু দি লাস্ট সাতিম, ব্যালানস শিট। একেই তো বলে কটিঙ। আমি ব্যবসা-বাণিজ্য করি। ওই নিয়ে নিত্যি নিত্যি আমার ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই। কিন্তু সে কথা থাক। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি প্রস্তাব নিয়ে। আপনার যখন তিন ঘণ্টা বরবাদ যাচ্ছে তখন এক কাজ করুন না! মিনিট পনেরো পরে এখান থেকে একটা প্লেন যাচ্ছে জিনিভা : আমার সামান্য একটি বাড়ি আছে সেখানে। আপনার খুব একটা অসুবিধে হবে না। বেডরুম, বাথরুম, ডাইনিংরুম, স্টাডি সব নিজস্ব পাবেন। (আমি মনে মনে মনকে শুধালাম, একেই কি বলে সামান্য একটি বাড়ি?) আমাদের সঙ্গে আহারাদি, দুদণ্ড রসালাপ করে জিরিয়ে নেবেন। তার পর আপনাকে আপনার মোকাম, কলোনগামী প্লেনে তুলে দেব। তার পর একটু ইতিউতি করে বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমি এ প্রস্তাবটা নিজের স্বার্থেই পাড়ছি। আমার একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে। ষোল, চোদ্দ, দশ। আপনার সঙ্গে আলাপচারী করে তারা সত্যই উপকৃত হবে। এদেশে চট করে একজন ইন্ডিয়ান পাওয়া যায় না। পেলেও তিনি ফরাসি জানেন না। আর আমার বিবি বাসা রাঁধতে পারেন—

আমি বাধা দিয়ে বললুম, কিন্তু এই দশ মিনিটের ভিতর আপনি আমার জন্য জিনিভার টিকিট পাবেন কী করে?

মসিয়ো দ্যুপোঁ মুচকি হেসে বললেন, সেই ফরমুলো, ন ভূ দেরাজে পা- আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এটা-ওটা ম্যানেজ করার কিঞ্চিৎ এলেম আমার পেটে আছে; নইলে ব্যবসা করি কী করে! কাচ্চা-বাচ্চারা বড় আনন্দ পাবে। প্লেনের ভাড়াটার কথা আপনি মোটেই চিন্তা করবেন না–

আমি ফের বাধা দিয়ে বললুম, আপনি ও-বাবদে চিন্তা করবেন না। অ্যার-ইন্ডিয়ার আমার টিকিটটি অমনিবাস, অর্থাৎ যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারি; তার জন্য আমাকে ফালতো কড়ি ঢালতে হবে না। (পাঠক, এ ধরনের মোটর অমনিবাসকে কবিগুরু নাম দিয়েছেন বিশ্বষহ। এবং তদীয় অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ মোটরগাড়ি, অটোমবিলকে, যেটা আপন শক্তিতে চলে, তার নাম দিয়েছিলেন স্বতশ্চলশকট। অতএব এস্থলে আমরা যানবাহন প্লেনের টিকিটকে স্বতশ্চল বিশ্বষহ মূল্য পত্রিকা অনায়াসে বলা যেতে পারে)।

একটু থেমে বললাম, আমি এখনি আসছি। অর্থাৎ যে স্থলে যাচ্ছি, যেখানে রাজাধিরাজও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন না, অর্থাৎ শৌচাগার।

সেদিকে যাইনি। যাচ্ছিলুম অন্য পথে। অ্যাটাচি বাসা সোকাতেই রেখে এসেছি। এরকম সহৃদয় সজ্জনকে বিশ্বাস করে আমি বরঞ্চ ও দুটো হারাব, অবিশ্বাস করতে ঘেন্না ধরে। গেলুম বার-এ। সেখানে মসিয়ো যে ওয়াইন এনেছিলেন তারই দু গ্লাস কিনে ফিরে এলুম সোফায়। একটা গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার স্বাস্থ্য কামনা করে বললুম, আপনার আন্তরিক আমন্ত্রণের জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার একটা বড়ই অসুবিধে আছে। কলোন অ্যারপোর্টে আমার বন্ধুবান্ধবরা অপেক্ষা করছে। তারা খবর নিয়ে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছে, আমি তিন ঘণ্টা পরে কনেকশন পাব। আমি আপনার সঙ্গে জিনিভা গেলে বড় দেরি হয়ে যাবে। তারা বড় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে।

আর মনে মনে ভাবছি, ইহসংসারে, এমনকি ইয়োরোপেও, সেই বাগদাদের আবু হোসেনও আছে যারা রাস্তায় অতিথির সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একা একা খেতে পারে না।

মসিয়ো বড্ডই দুঃখিত হয়ে প্রথমে বললেন, কিন্তু আপনি আবার আমার জন্য ড্রিংক আনলেন কেন? এ কি দেনা-পাওনা!

আমি মাথা নিচু করলুম। দ্যুপোঁ বললেন, তা হলে দেশে ফিরে যাবার সময় আমার ওখানে আসবেন।

তার পর একটি পকেটবই বের করে বললেন, কিছু একটা লিখে দিন। ছেলেমেয়েরা খুশি হবে। আমি তৎক্ষণাৎ লিখলুম :

কত অজানারে জানাইলে তুমি
কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।

হায়! ফেরার পথেও দ্যুপোঁর বাড়িতে যেতে পারিনি।

.

০৪.

জুরিচের মতো বিরাট অ্যারপোর্টে কী করে মানুষ একে অন্যকে খুঁজে পায় সেটা বুঝবার চেষ্টা করে ফেল মেরেছি। তা হলে নিশ্চয়ই স্বীকার করতে হবে এখানকার কর্মচারীদের পেটেপিঠে এলেম আছে। তাদেরই একজন আমার সামনে এসে বললে, আপনার জন্য একটা মেসেজ আছে স্যার। আমি সত্যিই বিস্মিত হলুম। আমাকে এই সাহারা ভূমিতে চেনে কে বললুম, ভুল করেননি তো? এজ্ঞে না। আমি জানি– সঙ্গে সঙ্গে ছোকরা আমার পুরো নামটি বলে দিল। যদিও সে এদেশেরই লোক তবু আমার মনে হল সে দেশ পত্রিকার পঞ্চতন্ত্র নিত্য সপ্তাহে পড়ে এবং তারই মারফত আমার ভোলা নামটি পুরো পাকা রপতত করে নিয়েছে। হয়তো ডাকনামটাও জানে। হয়তো ভোম্বল কাবলা জাতীয় আমার সেই বিদকুটে ডাকনামটা সে পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনিতে প্রকাশ করতে চায় না; কিন্তু এসব ভাববার চেয়ে ঢের বেশি জানতে চাই, কে আমাকে স্মরণ করলেন।

অ। ফ্রলাইন ফ্রিডি বাওমান! কিন্তু ইনি জানলেন কী প্রকারে যে আমি আজ সকালে এখানে পৌচচ্ছি। তার মেসেজ খুলে জিনিসটে পরিষ্কার হল। কলকাতা ছাড়ার পূর্বে অ্যার ইন্ডিয়ার ইয়াররা শুধিয়েছিলেন জুরিচে আমার কোনও পরিচিতজন আছেন কি না, কেননা ওখানে আমাকে কনেকশনের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। খবর পাঠালে ওঁরা হয়তো আরপোর্টে এসে আমাকে সঙ্গসুখ দেবেন। আমি উত্তরে বলেছিলুম, জুরিচে নেই, তবে সেখান থেকে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে লুৎসের্ন শহরে একটি পরিচিত মহিলা আছেন। এবং তার নাম-ঠিকানা দিয়েছিলুম। এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম বেবাক। দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি শুড়ের পাটালি; কিছু ঝুনো নারিকেল; / দুই ভাণ্ড সরিষার তেল; / আমসত্ত্ব আমচুর এর মাঝখানে কবিগুরু যদি তার প্রিয় কন্যাকে ভুলে যান তবে সাতান্নটা হাবিজাবির মাঝখানে আমি যে এটা মনে রাখিনি তার জন্য সদয় পাঠক রাগত হবেন না।

কিন্তু এই সুবাদে সেই খাঁটি জাত সুইস মহিলাটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করে দিতে চাই। ফ্রিডি বাওমান। ১৯৪২/৪৩-এ ইনি সেই মহারাজা সয়াজি রাওয়ের বরোদা প্রাসাদে প্রবেশ করেন। আজকের দিনে ক্রিকেট কিংবা পলিটিকসের সঙ্গে যাদেরই সামান্যতম পরিচয় আছে তারাই জানেন বরোদার শ্ৰীযুত ফতেহ সিং রাও গায়কোয়াড়কে। এই ফ্রিডির হাতেই তিনি পৃথিবীতে পদার্পণ করেন। অথবা মস্তকাবতীর্ণ করেন। কিন্তু তার ওপর আমি জোর দিচ্ছিনে। রাজা মহারাজা ভিখিরি আতুর পৃথিবীতে সবাই নামেন একই পদ্ধতিতে।

আসল কথা, ফতেহ সিং রাও মানুষ হন ফ্রিডির হাতে। তিনি অসাধারণ শিক্ষিতা রমণী সেই ছাব্বিশ বছর বয়সেই। জর্মন, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইংরেজি সব-কটাই বড় সুন্দর জানতেন। এ দেশে এসেছিলেন বেকারির জন্য নয়। রোমান্টিক হৃদয় : ইন্ডিয়াটা দেখতে চেয়েছিলেন। গ্যোটে তার প্রিয় কবি। গ্যোটের ভারতপূজা তাঁর মনে গভীর দাগ কেটেছিল। এদিকে তার উত্তম উত্তম পুস্তক পড়ার অভ্যেস চিরকালের। রাজপ্রাসাদের কাজকর্মও গুরুভার নয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে কী করে তাঁর প্রিয়সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের বাণীর মর্মস্থলে পৌঁছে গেলেন সেটা বুঝলাম যেদিন তিনি আমাকে বললেন যে, ছেলেবেলা থেকেই তিনি সেন্ট ফ্রানসিস আসিসির ভক্ত। এবং সকলেই জানেন, এই সন্তটির সঙ্গেই ভারতীয় শ্রমণ, সন্ন্যাসী, সাধুসন্তের সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য। একদিকে যেমন দরিদ্রনারায়ণের সেবা, অন্যদিকে ঠিক তেমনি পরমাত্মার ধ্যানে মগ্ন হয়ে প্রভু খ্রিস্টের সঙ্গে একাত্ম বোধ করাতে তিনি এদেশের মরমিয়া সাধক, ইরান-আরব-ভারতের সুফিদের সঙ্গে এমনই হরিহরাত্মা যে অনেক সময় বোঝা কঠিন কার জীবনবৃত্তান্ত পড়ছি। খ্রিস্টানের, ভক্তের না সুফির?

কিন্তু আমার কী প্রগলভতা যে আমি তাঁর জীবনীর সংক্ষিপ্ততম ইতিহাসও লিখতে পারি। দেশ পত্রিকার প্রিয়তম লেখক শ্ৰীযুত ফাদার দ্যুতিয়েন যদি বাংলায় তার জীবনী লেখেন তবে গৌড়জন তাহা আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।

কুমারী ফ্রিডির কথা পুনরায় লিখব। কনটিনেন্ট সেরে, দেশে ফেরার পথে, লুৎসের্নে শ্রীমতীর বাড়িতে সপ্তাহাধিককাল ছিলুম সেই সুবাদে। উপস্থিত ফ্রিডি লিখেছেন, তিনি আমার (অ্যারইন্ডিয়া মারফত) টেলে পেলেন কাল রাত্রে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জুরিচের অ্যারপোর্টে ট্রাংককল করে জানালেন, আমি জুরিচে নেবেই যেন তাঁকে ট্রাংককল করি। বরাবর তিনি বাড়িতেই থাকবেন।

মনে হয় কত সোজা। কিন্তু যারা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে চান তাদের উপকারার্থে এ স্থলে কিঞ্চিৎ নিবেদন করে রাখি।

প্রথমত আপনাকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করতে হবে। সে বুথ আবার সন্ ব্রাহ্মণ। আপন দেশজ খাদ্য ভিন্ন অন্য খাদ্য খান না। অর্থাৎ তার বাসে আপনাকে ছাড়তে হবে এদেশের আপন সুইস মুদ্রা। অতএব গো-খোঁজা করুন, সে সাহারাতে, কোথায় সে পুণ্যভূমি যেখানে আপনার ডলার বা পৌন্ডের বদলে সুইস মুদ্রা দেবে। সবাই তো ইংরেজি বোঝে না। ভুল বুঝে অনেকেই। তারা কেউ বলে ওই তো হোথায়, কেউ বলবে তার জন্য তো শহরে যেতে হবে। শেষটায় পেলেন সেই কাউন্টার পুণ্যভূমি আমি অতি, অতি সংক্ষেপে সারছি। পেলেন সুইস বস্তু। তখন আবার ভুল করে যেন শুধু কাগজের নোট না নেন। কারণ ফোন বুথ কাগজাৰ্থশী নন; তিনি চান মুদ্রা। সেই মুদ্রা আবার ওই সাইজের হওয়া চাই। ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে চলুন ফের ওই পুণ্যভূমিতে আরও বহুবিধ ফাড়াগৰ্দিশ আছে। বাদ দিচ্ছি।

আহ্! কী আনন্দ!! কী আনন্দ!!!

কে বলছেন? আমি ফ্রিডি।

আমি সৈয়দ।

ওই য যা! ট্রাঙ্ক লাইন কেটে গেল। পাবলিক বুথ থেকে ট্রাঙ্ক-কল করা এক গব্বন্তনা। আমি যে দুটি মুদ্রা মেশিনে ফেলে লুৎসের্ন পেয়েছিলুম, তার ম্যাদ ফুরিয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আর দুটো না ফেলার দরুন লাইন কাট অফফ। ফের ঢালো কড়ি।

অতি অবশ্য সত্য ফোন যন্ত্রের বাকসে সুইটজারল্যান্ডে প্রচলিত তিন-তিনটি ভাষা– ফরাসি, জর্মন এবং ইতালীয় লেখা আছে কোন গুহ্য সরল পদ্ধতিতে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে হয়। লেখা তো অনেক কিছুই থাকে। ধর্মগ্রন্থে তো অনেক কিছুই লেখা থাকে। সেগুলো পড়লেই বুঝি মোক্ষ লাভ হয়! জিমনাস্টিকের কেতাব পড়লেই বুঝি কিড় সিঙ-এর মতো মাসল গজায়। প্র্যাকটিস করতে হয়। এবং তার জন্য খেসারতিও দিতে হয়। উপযুক্ত শুরু বিনা যোগাভ্যাস করতে গিয়ে বিস্তর লোক পাগল হয়ে যায়। আমি ইতোমধ্যে প্রায় দেড় টাকার মতো খেসারতি দিয়ে হ্যালো হ্যালো করছি। আর, এ খেসারতির কোনও আন্তর্জাতিক মূল্য নেই। কারণ জনি, ফ্রান্স, ইংলন্ড প্রায় প্রত্যেক দেশই আপন আপন কায়দায় আপন আপন মেশিন চালায়। আর সেখানেই কি শেষ? তিন মাস পরে যখন ফের সুইটজারল্যান্ড আসব, তখন দেখব, বাবুরা এ ব্যবস্থা পালটে দিয়েছেন। নতুন কোনও এক আবিষ্কারের ফলে যন্ত্রটার ব্যবহার নাকি সরলতর করেছেন। সরলতর না কচু! তাই যারা এসব ব্যাপারে ওয়াফিহাল নন, যারা এই হয়তো পয়লা বারের মতো কন্টিনেন্ট যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমার সরলতম উপদেশ, বিশুরু এসব যন্ত্রপাতি ঘাটাতে যাবেন না। অবশ্য গুরু পাওয়া সর্বত্রই কঠিন; এখানে আরও কঠিন। যে যার ধান্দা নিয়ে উধ্বশ্বাসে হন্তদন্ত। কে আপনাকে নিয়ে যাবে সেই বুথ-গুহায়, শিখিয়ে দেবে সে গুহায় নিহিতং ধর্মস্য তত্ত্বং।

যাক। ফের পাওয়া গিয়েছে লাইন।

তুমি লুৎসের্নে কখন আসছ?

অপরাধ নিয়ো না। আমি উপস্থিত যাচ্ছি কলোন। তার পর হামবুর্গ ইত্যাদি। তার পর লন্ডন, নাটিংহাম। সেখান থেকে ফেরার পথে লুৎসের্ন। তুমি খেদিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তোমার বাড়িতে।

দ্যৎ। কিন্তু তদ্দিন এখানে যে বড্ড শীত জমে যাবে। গরম জামাকাপড় এনেছ তো? মা নিস্ (নেভার মাইন্ড- আসে-যায় না), আমার কাছে আছে।

তুমি এখনও ফ্রানসিস আসিসিরই শিষ্যা রয়ে গিয়েছ– কী করে কাতর জনকে মদৎ করতে হয়, সে-ই তোমার প্রধান চিন্তা। আমি কি তোমার স্কার্ট-ব্লাউজ পরে রাস্তায় বেরুব? সে কথা থাক। আমাকে অ্যারপোর্টে আরও তিন ঘণ্টাটাক বসে থাকতে হবে। চলে এসো না এখানে। আজ তো রোববার। তোমাকে অফিস-দফতর করতে হবে না।

রোববার। সেই তো বিপদ। বাড়ি থেকে যেতে হবে লুৎসের্ন স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে করে জুরিচ। পঁয়ত্রিশ মাইল। সেখান থেকে বাস-এ করে তোমার অ্যারপোর্টে। রোববার বলে আজ ঢের কম সার্ভিস। সব কটা উঠতি-নাবতিতে টায় টায়, কোথায় পাব কনেকশন-

আমি মনে মনে বললুম হুঁ : ফের সেই কনেকশন। ইলামবাজার রামপুরহাট।

ফ্রিডি বললে, আচ্ছা দেখি।

আমি বললাম, কতকাল তোমাকে দেখিনি।

ফ্রিডি যদি এখানে আসেই তবে তার বাস দাঁড়ায় কোথায়? আমি বসে আছি ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারের খোয়াড়ে। এখানে তো ফ্রিডির প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য সে দেশের রীতিমতো সম্মানিতা নাগরিকা (সংস্কৃত অর্থে নয়) সিটুজেন। কাজেই সে স্পেশাল পারমিট যোগাড় করতে পারবে। তবে সেটা যোগাড় করতে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে? আম আনতে দুধ না ফুরিয়ে যায়। ততক্ষণে হয়তো আমার কলোনগামী প্লেনের সময় হয়ে যাবে।

বাসস্ট্যান্ডে যেতে হলে আমাকে খোয়াড় থেকে বেরোতে হয়। কিন্তু আমাকে বেরুতে দেবে কি? খোয়াড়ের বাইরেই স্বাধীন মুক্ত সুইটজারল্যান্ড। তার জন্য ভিসার প্রয়োজন। আমার সেটা নেই। তবু চেষ্টা করে দেখাই যাক না, কী হয় না হয়। সুকুমার রায় বলেছেন, উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়। সেইটে পড়ে আমার এক সখা ডাকপিয়নকে বলেছিল, আমার কোনও চিঠি নেই? কী যে বলছ? ফের খুঁজে দেখো। উৎসাহে কি না হয়, কি না হয় চেষ্টায়।

খোঁয়াড়ের গেটে গিয়ে সেখানকার উর্দিপরা তদারকদারকে অতিশয় সবিনয় নিবেদন করলুম, স্যার! আমি কি একটু বাইরে ওই বাসস্ট্যান্ডে যেতে পারি?

আপনি তো ট্রানজিট না?

আমি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললুম, বাস-এ করে লুৎসের্ন থেকে আমার একটি বান্ধবী–

হায় পাঠক, তুমি সেই তদারকদারের প্রতিক্রিয়া যদি তখন দেখতে। বান্ধবী! বান্ধবী!! সেরতেমা (সার্টলি) চেরআনুতে (ইতালিয়ানে, সার্টলি) এবং তার জর্মনে জিষার জিয়ার (শিওর, শিওর) এবং সর্বশেষে, যদি না কুল পায়, মার্কিন ভাষায় শিয়োঁর, শিয়োঁ।

আমি জানতুম, আমি যদি বললুম, আমার বন্ধু আসছেন, সে বলত, নো। যদি বললুম আমার বিবি, উত্তর তদ্বৎ। যদি বলতুম, বৃদ্ধা মাতা তখনও হত না হয়তো কিঞ্চিৎ থতমত করে। কিন্তু বান্ধবী! আমার সাত খুন মাফ!

কলোনের নাম কে না শুনেছে। বিশেষ করে হেন ফ্যাশনেবল মহিলা আছেন যিনি কস্মিনকালেও প্রসাধনাৰ্থে ও-দ্য-কলোন– জর্মনের ক্যলনিশ ভাষার–কলনের জল ব্যবহার করেননি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি এই তরল সুগন্ধিটির। ৪৭১১ এবং মারিয়া ফারিনা এই দুটিকেই সবচেয়ে সেরা বলে ধরা হয়। এ দেশেও কলোন জল তৈরি হয় কিন্তু ওটা বানাতে হলে যে সাত-আট রকমের সুগন্ধি ফুলের প্রয়োজন, তার কয়েকটি এদেশে পাওয়া যায় না– সর্বোপরি প্রাক প্রণালী তো আছেই। বিলেতেও কলোন জলের এতই আদর যে, হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য চেম্বারলেন যখন সপারিষদ কলোন থেকে মাইল বিশেক দূরে গোডেসবের্গ-এর মুখোমুখি, রাইন নদীর ওপারে যে বাড়িতে ওঠেন, তার প্রতি ঘরে কলোন জল, কলোন জলের সুগন্ধ দিয়ে নির্মিত গায়ে মাখার সাবান, দাড়ি কামাবার সাবান, ক্রিম, পাউডার- বস্তৃত প্রসাধনের তাবৎ জিনিস রাখা হয়েছিল হিটলারের আদেশে। চেম্বারলেন এই সূক্ষ্ম বিদগ্ধ আতিথেয়তা লক্ষ করেছিলেন কি না জানিনে। কারণ তখন তার শিরঃপীড়া তার এ অভিসার তাঁর দেশবাসী কী চোখে দেখবে। তার আপন ফরেন অফিস যে সেটা নেকনজরে দেখছে না, সেটা তিনি জানতেন, কারণ ইতোমধ্যেই তারা একটা প্যারডি নির্মাণ করে ফেলেছে :

ইফ অ্যাট ফাস্ট ইউ কানট সাকসিড
ফ্লাই ফ্লাই ফ্লাই এগেন।

বলা বাহুল্য চেম্বারলেন ফ্লাই করে গিয়েছিলেন। আর আমি তো সেই গোডেসবের্গ-এর উপর দিয়ে কলোন পানে ফ্লাই করে যাচ্ছিই। সেই সুবাদে প্যারডিটি মনে পড়ল।

জুরিচে ফ্রিডির সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলুম। মনটা খারাপ হয়ে আছে।

কলোন শহরের সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের পরিচয়।

এখান থেকে প্রায় চৌদ্দ মাইল দূরে বন। সেখানে প্রথম যৌবনে পড়াশুনা করেছিলাম। ট্রামে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে করে এখানে আসা অতি সহজ। আমার একাধিক সতীর্থ কলোন থেকে বন ডেনিপ্যাসেঞ্জারি করত। তাদের সঙ্গে বিস্তর উইক এন্ড করেছি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শহরটাকে দেখেছি।

সে-সব সবিস্তর লিখতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচুতি হবে। আর লিখতে যাবই-বা কেন? জর্মন টুরিস্ট ব্যুরো যদি আমাকে কিঞ্চিৎ ব্রাহ্মণ-বিদায় করত তবে না হয়–

যদি নিতান্তই কিছু বলতে হয়, তবে প্রথম নম্বর সম্বন্ধে বলি যে, সেটি আপনি চান কি না চান, কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। কলোনের বিরাট গগনস্পর্শী গির্জা। প্যারিসে যে রকম যেখানেই যান না কেন, অ্যাফ্যাল টাওয়ারটা এড়াতে পারবেন না, কলোনের এই কেথিড্রেলটির বেলাও তাই। তবে অ্যাফ্যাল স্তম্ভ বদখদ, কিন্তু কলোনের গির্জাচুড়ো তন্বী সুন্দরী। যেন মা-ধরণী উৗঁপানে দু বাহু বাড়ায়ে পরমেশ্বরকে তার অনন্ত অবিচ্ছিন্ন নমস্কার জানাচ্ছেন।

এ গির্জা আবার আমাদের কাছে নবীন এক গৌরব নিয়ে ধরা দিয়েছে।

বছর দুত্তিন পূর্বে কলোনবাসী প্রায় শ-দুই তুর্কি ও অন্যান্য মুসলমান ওই গির্জার প্রধান বিশপকে গিয়ে আবেদন জানায়, এ বছরে ঈদের নামাজ শীতকালে পড়েছে। বাইরে বরফ; সেখানে নামাজ পড়ার উপায় নেই। যদি আপনাদের এই গির্জের ভিতর আমাদের নামাজ পড়তে দেন, তবে আল্লা আপনাদের আশীর্বাদ করবেন। বিশপের হৃদয়কন্দরে কণামাত্র আপত্তি ছিল না কিন্তু এ শহরের লোক খ্রিশ্চান। তাদেরই বিত্ত দিয়ে, গরিবের কড়ি দিয়ে এ গির্জা সাত শো বছর আগে গড়া হয়েছে। এখনও ওদেরই পয়সাতে এ মন্দিরের তদারকি দেখভাল চলে। সে-ও কিছু কম নয়। এরা যদি আপত্তি করে? কিন্তু এই বিশপটি ছিলেন বড়ই সন্তপ্রকৃতির সজ্জন। এবং তার চেয়েও বড় কথা : সাহসী। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। মা-মেরি মালিক। তিনি সর্ব সন্তানের মাতা।

কিমাশ্চার্যমতঃপরম। তাঁর কাছে কোনও প্রতিবাদপত্রও এল না। খবরের কাগজেও এই অভাবনীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ বেরুল না। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!! অবিশ্বাস্য!!!

কিন্তু মার্কিন টাইম কাগজে বেরিয়েছে ও বিলেতেও বেরিয়েছে। তার পর সন্দ করে কোন পিচেশ!

.

কলোন অ্যারপোর্টে নেমে দেখি, দুটো স্যুটকেসের একটা আমার নেই। ছুট ছুট দে ছুট, সেই ঘরের দিকে যেখানে হারানো-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে তড়িঘড়ি ফরিয়াদ জানাতে হয়। নইলে চিত্তির। অবশ্য এরা নিজের থেকেই হয়তো দু-পাঁচ দিনের ভিতরই আমার বেওয়ারিশ জাদুকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি কোন মোকামে আস্তানা গাড়ব, তার ঠিকানাটা এদের না দিলে মাল হস্তগত হবে কী বলে? সেটা তখন তার মালিককে হারাবে। কোনও এক গ্রিক দার্শনিক নাকি বলেছেন একই নদীতে তুমি দু বার আঙুল ডোবাতে পারবে না, একই শিখায় দুবার আঙুল পোড়াতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটি বস্তু প্রতি মুহূর্ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানলুম। কিন্তু একই স্যুটকেস নিশ্চয়ই দু বার, দুবার কেন, দু শো বার হারাতে কোনও বাধা নেই। অতি অবশ্য কবিগুরু বলেছেন, তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারাই ক্ষণেক্ষণ/ও মোর ভালোবাসার ধন!! কিন্তু প্রশ্ন, এটা কি হারানো বাক্সের বেলাও খাটে?

আপিসঘরটি প্রমাণ সাইজের চেয়েও বৃহদায়তন। ভিতরে ফুটফুটে মেমসায়েব বসে আছেন। আমার লাগেজ টিকেট দেখাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা খোওয়া যাবে না। কিন্তু বলুন তো ওটার ভিতরে কী কী আছে?

সর্বনাশ। সে কি আমি জানি? প্যাকিং করেছে আমার এক তালেবর ভাতিজা মুখুজ্যে। তার বাপ প্রতি বৎসর নিদেন তিনবার ইয়োরোপ-আমেরিকা যেতেন। সে নিখুঁত প্যাকিং করে দিত। আমার বেলা এ বারে করেছে নিখুঁততর। কোন বাক্সে কী মাল রেখেছে কী করে জানব!

কিন্তু মিসি-বাবা সদয়া। পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার ঠিকানাটি টুকে নিলেন। আর ইতোমধ্যে বার বার বলছেন, অ্যার ইন্ডিয়া বলুন, লুট-হানজা বলুন, সুইস অ্যার বলুন কোনও লাইনেই কোনও লাগেজ খোওয়া যায় না। আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন।

আমি মনে মনে বললুম, বট্ট্যে! বেরোবার সময় তাকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বললুম, গ্রেডিগেস ফ্রলাইন (সদয়া কুমারী)! একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি কি?

সুমধুর হাস্যসহ, নিশ্চয়, নিশ্চয়।

আমি বললাম, তাবৎ হারানো মালই যদি ফিরে পাওয়া যায়, তবে এ হেন বিরাট আপিস আপনারা করেছেন কেন? আমি তো শুনেছি, কলোন অ্যারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা ছাড়তে হয়।

প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা না করেই এক লক্ষে দফতর থেকে বেরিয়ে মাল-সামান নিয়ে উঠলুম বিরাট এক বাস-এ।

***

বাঁচলুম, বাবা, বাঁচলুম। প্লেনের গর্ভ থেকে বেরিয়ে খোলামেলায় এসে বাঁচলুম। বাসটি যদিও পর্বতপ্রমাণ, সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান, তবু চলছে যেন রোলস রইস রইস খানদানি গতিতে, মৃদু মধুরে। কবিগুরু গেয়েছিলেন, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে– আমি গাইলুম, বাঁচালে তুমি মোরে ভালো বাস-এর ছায়ে।

আহা কী মধুর অপরাহ্নের সূর্যরশি। কখনও মেঘমায়ায়, কখনও আলোছায়ায়। দু-দিকের গাছ-পাতার উপর সে রশ্মি কভু-বা মেঘের ভিতর দিয়ে আলতো আলতো হাত বুলিয়ে যায়, কভু-বা রুদ্রদীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড আলিঙ্গন করে। ওই হোথায় দেখছি, বুড়ো চাষা ঘাসের উপর শুয়ে আছে, চোখের উপর টুপি ঢেকে। তার সবুজ পাতলুন যেন ঘাসের ঝিলিমিলির সঙ্গে একতালে যায় মিলি। এদেশের নবান্ন হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। চতুর্দিকে অল্পবিস্তর ফসল কাটা হচ্ছে। আজ রোববার। রাইনল্যান্ডের লোক বেশিরভাগই ক্যাথলিক। তাদের অধিকাংশই সেদিন সর্বকর্ম ক্ষান্ত দেয়। তাই খেতখামারে তেমন ভিড় নেই। আমিও মোকামে পৌঁছুতে পারলে বাঁচি। ইংরেজিতে প্রবাদ এ সিনার হ্যাঁজ নো সনডে। পাপীর রোববার নেই। আমি তো তেমন পাপিষ্ঠ নই!!

বাস মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যায়। সেখানেও রাস্তা নির্জন। বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়? তারা তো ক্লাইপে বা সুধালয়ে যায় না সেখানে অবশ্যই আজ জোর কারবার, বেজায় ভিড়। আমার পাশের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললুম, স্যর, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি এসব গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছেলে-মেয়েরা রাস্তার উপর রোল-স্কেটিঙ করত, দড়ি নিয়ে নাচত, এমনকি ফুটবলও খেলত। ওরা সব গেল কোথায়?

বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একাধিক উত্তর হয়তো আছে। চট করে যেটা মনে আসছে সেটা বলতে গেলে বলি, বন্ধ ঘরে টেলিভিশন দেখছে।

আমি একটু ঘাড় চুলকে বললুম, যদি কিছু অপরাধ না নেন স্যর, তবে শুধাব, এটা কি সর্বাংশ ভালো? ফারসিতে একটি দোহা আছে :

হর চে কুনি ব খুদ কুনি
খাঁ খুব কুনি, খা বদ কুনি।
যা করবে স্বয়ং করবে।
ভালো করো কিংবা মন্দই কর।

এই যে প্যাসিভভাবে বসে বসে টেলি দেখা তার চেয়ে রাস্তায় অ্যাকটিভভাবে খেলাধুলো করা কি অনেক বেশি কাম্য নয়?

গুণী এবারে চিন্তা না করেই বললেন, নিশ্চয়ই। অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। যেমন মনে করুন, আমরা যখন মোৎসার্ট বা শপা শুনি তখন তো আমরা প্যাসিভ। আর তাই-বা বলি কী করে? বেটোফেনকে গ্রহণ করা তো প্যাসিভ নয়। ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ কর্ম! কী পরিমাণ কনসানট্রেশন তখন করতে হয়, চিন্তা করুন তো। কিন্তু বাচ্চাদের কথা বাদ দিন কটা বয়স্ক লোকই-বা সে জিনিস করে?

তা হলে শুনুন, আপনাকে পুরো ফিরিস্তি দিচ্ছি। যদিও আমি ওই যন্ত্রটির পূজারি নই। পুরনো ফিল্ম, নয়া থিয়েটার, গর্ভপাতের সেমিনার আলোচনা, পাদ্রিদের বক্তৃতা (এ দুটো তিনি ঠিক পর পর বলেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে), রাজনৈতিকদের সঙ্গে ইন্টারভ, খেলা, কাবারে, ইতালি ভ্রমণ, চন্দ্রাভিযান, ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন, পার্লামেন্টে হার ভিলি ব্রান্ট ও হার শেলের বক্তৃতা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই একই কেচ্ছা, একই অন্তহীন খাড়াবড়িহোড়বড়িখাড়া (তিনি জর্মনে বলেছিলেন একই ইতিহাস–ডি জেলবে গেশিষটে)। সর্ববস্তু কুচি কুচি করে পরিবেশন। পরের দিনই ভুলে যাবেন, আগের দিন কী দেখেছিলেন– মনের ওপর কোনও দাগ কাটে না। পক্ষান্তরে দেখুন, বই পড়ার ব্যাপারে আপনি আপনার রুচিমতো বই বেছে নিচ্ছেন।

ইতোমধ্যে আমাদের বাস কতবার যে কত ট্রাফিক জ্যামে কত মিনিট দাঁড়িয়েছে তার হিসাব আমি রাখিনি। অথচ এদেশের রিকশা, ঠ্যালা, গরুর গাড়ি এমন কোনও কিছুই নেই যে-সব হযবরল আমাদের কলকাতাতে নিত্য নিত্য ট্রাফিক জ্যাম জমাতে কখনও স্বেচ্ছায় কখনও অনিচ্ছায় বিশ্ববিজয়ী প্রতিষ্ঠান।

ভদ্রলোক বাইরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন, আরেক উকট নেশা। মোটর, মোটর, মোটর। প্রত্যেক জর্মনের একখানা মোটরগাড়ি চাই। জর্মন মাত্রই মোটরের পূজারি।

আমার কেমন যেন মনে হল, আমরা বোধহয় বন্ শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুটা চেনাচেনা ঠেকছে, আবার অচেনাও বটে। অথচ একদা এ শহর আমি আমার হাতের তেলোর চেয়ে বেশি চিনতুম।

আমি ভদ্রলোককে আমার সমস্যা সমাধান করতে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, এটা বনই বটে। তবে এ অঞ্চলটা গত যুদ্ধে এমনই বোমারু মার খেয়েছিল যে এটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যিখানটা প্রায় পূর্বেরই মতো মেরামত করে বানানো। আসল কথা কী জানেন, বমিঙের ফলে ঘিঞ্জি পাড়াগুলো যে নষ্ট হয়ে গেল সেগুলোকে ভালো করে, নতুন করে প্ল্যান মাফিক বানাবার চান্সটা আমরা মিস করছি। তবে এই যে বললুম, শহরের মাঝখানটা মোটামুটি আগেরই মতো–হার্ট অব দি সিটি– আর জানেন তো পুরনো হার্টের জায়গায় নতুন হার্ট বসানো মুশকিল। এই ধরুন লুটভি ফান বেটোফেন–

আমি বললুম, ওই নামটার ঠিক উচ্চারণটা আমি আজও জানিনে।

হেসে বললেন, ওই তো ফেললেন বিপদে। মাঝখানে Vanটা যে খাঁটি জর্মন নয় তা তো বুঝতেই পারছেন। ওঁরা প্রাচীন দিনের ফ্ল্যামিশ। তখন তারা ভান না ফান উচ্চারণ করত কে জানে– অন্তত আমি জানিনে–

আমি বললুম, থাক, থাক। এবারে যা বলছিলেন তাই বলুন।

সেই বেটোফেনের বাড়ি যদি বোমাতে চুরমার হয়ে যেত তবে সেখানে তো একটা পিরামিড গড়া যেত না।

এমনকি তাজমহলও না।

***

দুম করে গাড়ি থেমে গেল। এ কি? ও। মোকামে পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ বন শহরে। এবং সবচেয়ে প্রাণাভিরাম নয়নানন্দদান দৃশ্য যে পরিবারে উঠব তারই একটি জোয়ান ছেলে ডিটরিষ উলানোফস্কি প্রবলবেগে হাত নাড়াচ্ছে। মুখে তিন গাল হাসি। পাশে দাঁড়িয়ে তার ফুটফুটে বউ। সে রুমাল দুলোচ্ছে।

.

০৬.

লক্ষ্মী ছেলে ডিটরিষ। তার মাঝারি সাইজের মোটরখানা এনেছে। আমার কোনও আপত্তি না শুনে বললে, আমি মালপত্রগুলো তুলে নিচ্ছি। আপনি ততক্ষণ বউয়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিন। ও তো আপনাকে চেনে না। মেয়েটিকে বাড়ির কুশলাদি শুধোলুম। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে কয়েকদিন আগে দেশ পত্রিকায় যে সিগারেট-মুখী মডার্ন মেয়ের ছবি বেরিয়েছে তার ঠিক উল্টোটি। কোনও প্রশ্ন শুধোয় না। শুধু উত্তর দেয়। শেষটায় বোধহয় সেটা আবছা আবছা অনুভব করে একটি মাত্র প্রশ্ন শুধোলে, বন কি খুব বদলে গেছে? আমি অবশ্য প্রাচীন দিনের বন চিনিনে। আমার বাড়ি ছিল ক্যোনিষবের্গে।

সর্বনাশ! এবং পাঠক সাবধান।

ক্যোনিষবের্গ শহরটি এখন বোধহয় পোলান্ডের অধীন! ওইসব অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী বাস্তুহারা সর্বহারা হয়ে পশ্চিমে জর্মনিতে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই সে সব দুঃখের কাহিনী ভুলে যেতে চায়। কাজেই সাবধান! ওসব বাবদে ওদের কিছু জিগ্যেস করো না।

তবে এ তত্ত্বও অতিশয় সত্য যে মৌকামাফিক দরদ-দিলে যদি আপনি কিছু শুনতে চান তখন অনেক লোকেই, বিশেষ করে রমণীরা অনর্গল অবাধগতিতে সবকিছু বলে ফেলে যেন মনের বোঝা নামাতে চায়। বিশেষ করে বিদেশির সামনে। সে দু দিন বাদেই আপন দেশে চলে যাবে। ও যা বলেছিল সেটা নিয়ে খামোখা কোনও ঘোটলার সৃষ্টি হবে না। আমি তাই বেমালুম চেপে গিয়ে বললুম, ও! ক্যোনিষবের্গ। যেখানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কাট জন্মে ছিলেন। এবং শুনেছি তিনি নাকি ওই শহরের বারো না চোদ্দ মাইলের বাইরে কখনও বেরোননি। শহরটাকে এতই ভালোবাসতেন। ইতোমধ্যে ডিটরিষ স্টিয়ারিঙে বসে গেছে। এবং আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেছে। বললে, ভালোবাসতেন না কচু। আসলে সব দার্শনিকই হাড়-আলসে। আমি বললুম, সে কথা থাক। তোর বউ শুধপাচ্ছিল, বন্ শহরটা কি খুব বদলে গেছে? তারই উত্তরটা দিই। বদলেছে, বদলায়ওনি।

তুমি, মামা, চিরকালই হেঁয়ালিতে কথা কও–

আমি বললুম, থাক, বাবা থাক। বাস্-এ এক বৃদ্ধ বিষয়টির অবতারণা করতে না করতেই মোকামে পৌঁছে গেলাম। আর এ তাবৎ দেখেছিই-বা কী?

***

বন শহরের নাম করলেই দেশি-বিদেশি সবাই বেটোফেনের নাম সঙ্গে সঙ্গে করে বটে, কিন্তু এ বৎসরে বিশেষভাবে করে। কারণ তাঁর দ্বিশত জন্মশতবার্ষিকী সম্মুখেই। ডিসেম্বর ১৯৭০-এ। এ শহর তাঁকে এতই সম্মান করে যে তার সুন্দর প্রতিমূর্তিটি তুলেছে তাদের বিরাটতম চত্বরে, তাদের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম না হলেও তারই কাছাকাছি প্রাচীন মনস্টার গির্জার পাশে। হয়তো তার অন্যতম কারণ, বেটোফেন ছিলেন সর্বান্তকরণে ঈশ্বরবিশ্বাসী। শুধু তাঁর সংগীত নয়, তাঁর বাক্যালাপে চিঠিপত্রে সর্বত্রই তাঁর ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রভুর পদপ্রান্তে তার ঐকান্তিক আত্মনিবেদন বার বার স্বপ্রকাশ।

সেখান থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা– ছোট গলির ছোট্ট একটি বাড়ির ছোট্ট একটি কামরায়, যেখানে তার জন্ম হয়। বাড়ির নিচের তলায় বেটোফেন মিউজিয়ম। সেখানে তার ব্যবহৃত অনেক কিছুই আছে, যেমন ইয়াসনা পলিয়ানাতে তলস্তয়ের বৃহত্তর, সম্পূর্ণতর, কারণ সেটা দেড়শো বছর পরের কথা এবং অসম্পূর্ণতম রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে, যদ্যপি সেটা তলস্তয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে।…

কিন্তু সেখানে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বেটোফেনের কানের চোঙাগুলো। বত্রিশ বত্সর বয়স থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমে কালা হতে আরম্ভ করলেন। বিধাতার এ কী লীলা! বীণাপাণির এই অংশাবতার আর তার বীণা শুনতে পান না। তখন তিনি আরম্ভ করলেন ওইসব কানের চোঙা ব্যবহার করতে। পাঠক, দেখতে পাবে, তার বধিরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোঙার সাইজও বাড়তে লাগল। তাতে করে তার কোনও লাভ হয়েছিল কি না বলা কঠিন। তবে এটা জানি, তার কিছুকাল পরে, যখন তাঁর সঙ্গীতপ্রেমী কোনও সহচর বলতেন, বাহ্! কী মধুর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলেটি, আর তিনি কিছুই শুনতে পেতেন না তখন বেটোফেন বলতেন, তিনি তনুহর্তেই আত্মহত্যা করতেন যদি-না তাঁর বিশ্বাস থাকত যে সঙ্গীতে এখনও তার বহু কিছু দেবার আছে। আমাদের শ্রীরাধা যেরকম উদ্ধবকে বলেছিলেন, যদি-না আমার বিশ্বাস থাকত, প্রভু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, তা হলে বহু পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়ে যেত। এবং সকলেই জানেন, বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়ার পরও বেটোফেন মনে মনে সঙ্গীতের রূপটি ধারণ করে বহুবিধ স্বর্গীয় রচনা করে গেছেন। যেগুলো তিনি স্বকর্ণে শুনে যেতে পাননি। আমি যেন কোথায় পড়েছি, তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে করুণ আবেদন জানাচ্ছেন, প্রভু যেন তাঁকে একবারের মতো তার শ্রুতিশক্তি ফিরিয়ে দেন যাতে করে তিনি মাত্র একবারের তরে আপন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনে যেতে পান। তার পর তিনি সধন্যান্তঃকরণে পরলোকে যেতে প্রস্তুত।

চিন্তাসস্রাতে বাধা পড়ল। ডিটরিষ শুধাল, মামা, কথা কইছ না যে!

বললুম, আমি ভাবছিলুম বেটোফেনের কানের চোঙাগুলোর কথা। ওগুলো সত্যি কি তার কোনও কাজে লেগেছিল?

ডিটরিষ বললে, বলা শক্ত। কোনও কোনও আধাকালা একখানা কাগজের টুকরো দু পাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কাগজের বেশিরভাগটা মুখের বাইরে রাখে। ভাবে, ধ্বনিতরঙ্গ ওই কাগজকে ভাইব্রেট করে দাঁত হয়ে মগজে পৌঁছোয়, কিংবা কান হয়ে। কেউ-বা সামনের দু-পাটির চারটি দাঁত দিয়ে লম্বা একটা পেনসিল কামড়ে ধরে থাকে। কী ফল হয় না হয় কে বলবে?… আচ্ছা, মামু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কী রকম অদ্ভুত, প্রিমিটিভ মিনি সাইজের যন্ত্র দিয়ে তিনি তার বিচিত্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন? আমার কাছে আশ্চর্য লাগে।

আমি বললুম, কেন বত্স, ওই যে তোমার ছোট পিসি, যার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব, লিজেল– দেখেছ, ঝড়তি-পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা, আড়াই ফোঁটা নেবুর রস আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে কীরকম সরেস স্যাল্যাড তৈরি করতে পারে? মুখে দিলে যেন মাখন!!… আর তোর-আমার মতো আনাড়িকে যাবতীয় মশলাসহ একটা মোলায়েম মুরগি দিলেও আমরা যা রাঁধব সেটা তুইও খেতে পারবিনে, আমিও না। পিসি লিজেল কী বলবে, জানিনে। অথচ জানিস ওই অভুক্ত মুরগিটি তাকে তখন দিয়ে দে। তিনি সেটাকে ছোট ছোট টুকরো করে যাকে ফরাসিরা বলে রাও ফাঁরা ফ্রিকা অর্থাৎ লম্বা লম্বা/ ফালি-ফালি করে কেটে, মুরগিটাতে আমরা যেসব বদ রান্নার ব্যামো চাপিয়েছিলুম সেগুলো রাইনের ওপারে পাঠিয়ে এ্যামন একটি রান্না করে দেবেন যে, প্যারিসের শ্যাফত আমরি আমরি বলতে বলতে তরিয়ে তরিয়ে খাবে… প্রকৃত গুণীজন যা কিছুর মাধ্যমে যা কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমাদের দেশে একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে। একতারা তার নাম। তাতে একটিমাত্র তার। তার দু দিকে দুটি ফ্লেক্সিবল বাঁশের কৌশল আছে। সে দুটোতে কখনও হাল্কা চাপ দিয়ে তার মাঝখানের তারটাকে প্লাক করে নাকি বিয়াল্লিশ না বাহান্নাটা নোট বের করা যায়। তবেই দ্যাখ। বেটোফেনের মতো কটা লোক পৃথিবীতে আসে আমাদের দেশেও গণ্ডায় গায় তানসেন জন্মায় না। যদিও আমাদের দেশ তোদর দেশের চেয়ে বিস্তর বিরাটতর, এবং সেখানে কলাচর‍্যা আরম্ভ হয়েছিল অন্তত চার হাজার বছর পূর্বে। এবং আমাদের কলাজগতে আমরা এখন সাহারাতে এবং–

ডিটরিষ বললে, তুমি আমাদের পার্লামেন্ট হাউসটা দেখবে না? রাইনের পারে। আমি একটু ঘুরপথে যাচ্ছি। সোজা পথে গেলে দু-পাঁচ মিনিট আগে বাড়ি পৌঁছতুম।

দ্যাখ ডিটরিষ, তোর পিসি নিশ্চয়ই বিস্তর কেক পেট্র আমাদের জন্য বানিয়ে বসে আছে।

ডিটরিষের বউ বললে, মামা, শুধু কেক পেসট্রি বললেন। ওদিকে পিসি কী কী বানিয়ে বসে আছেন, জানেন? ক্যেনিসবের্গের ক্লপসে (ক্যানিসবের্গ শহরের একরকম কাতা), ফ্রাঙ্কফুর্টের সসিজ, হানোফারের ষাঁড়ের ন্যাজের শুরুয়া

আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে তো জানি। কিন্তু লিজেল পিসি আমার জন্যে কি ক্যাঙারুর ন্যাজের শুরুয়া তৈরি করেছে?…

দু জনাই তাজ্জব। আমি বললুম, সঁড়ের ন্যাজের ভিতর থাকে চর্বি এবং মাংস। তার একটা বিশেষ স্বাদ থাকে। কিন্তু ষাঁড়ের ন্যাজ আর কতটুকু লম্বা? তার চেয়ে ক্যাঙারুর ন্যাজ ঢের ঢের বেশি। ওটা যদি পাঁচজনকে খাওয়ানো যায় তবে বিস্তর কড়ি সাশ্রয় হয়।

ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামল।

এটা কী রে? মনে হয়, গোটা আষ্টেক বিরাট বিস্কুটের টিন একটার উপর আরেকটা বসিয়ে দিয়েছে। বললুম আমি।

ডিটরিষ বললে, এটাই আমাদের পার্লামেন্ট।

.

০৭.

যাকে বলে মডার্ন আর্ট, পিকাসো উপস্থিত যার পোপস্য পোপ, সেই পদ্ধতিটি জর্মনরা কখনও খুব পছন্দ করেনি। কাইজার দ্বিতীয় ভিলহেলম যাকে এখনও মার্কিনিংরেজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী করে, তিনি ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আর্ট এবং আর্টের আদর্শ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল : আর্ট হবে সমাজসেবক, রাষ্ট্রসেবক, আর্ট মানুষের দুঃখদৈন্যের ছবি না এঁকে আঁকবে এমন ছবি, কম্পোজ করবে এমন সঙ্গীত, রচনা করবে এমন সাহিত্য যাতে মানুষ আপন পীড়াদায়ক পরিস্থিতি ভুলে গিয়ে আনন্দসায়রে নিমজ্জিত হবে। আজকের দিনে আমরা এটাকে নাম দিয়েছি এসকেপিজম পলায়নমনোবৃত্তি। বলা বাহুল্য জর্মন আর্টিস্ট সাহিত্যিক সঙ্গীতস্রষ্টা– কাইজারের এই পথনির্দেশ খবরের কাগজে পড়ে স্তম্ভিত হন। তা হলে আর্টিস্টের কোনও স্বাধীন সত্তা নেই! সে তার আপন সুখ দুঃখ, আপন বিচিত্র অভিজ্ঞতা, আপন হৃদয়ের উপলব্ধি, ভবিষ্যতের আশাবাদী চিত্র অঙ্কন করতে পারবে না। সে তা হলে রাষ্ট্রের ভাঁড়, ক্লাউন! তার একমাত্র কর্তব্য হল জনসাধারণকে কাতুকুতু দিয়ে হাসানো!

কিন্তু জর্মন জনসাধারণ কাইজারের কথাই মেনে নিল। এটা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। এই পরিস্থিতিটা বোঝাতে গিয়ে প্রখ্যাত জর্মন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, দার্শনিক শ্ৰীযুক্ত যোখিম বেসার বলেছেন, জর্মন মাত্রই উপরের দিকে তাকায়; রাজা কী হুকুম দিলেন সেই অনুযায়ী কাব্যে চিত্রে সঙ্গীতে আপন রুচি নির্মাণ করে।

১৯১৮-এ কাইজার যুদ্ধে হেরে হল্যান্ডে পলায়ন করলেন।

তখন সত্য সত্য আরম্ভ হল মডার্ন আর্টের যুগ। যেন কাইজারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য আর্টিস্টরা আরম্ভ করলেন রঙ নিয়ে নিত্য নব উন্মাদ নৃত্য, ধ্বনি নিয়ে সঙ্গীতে তাণ্ডব একসপেরিমেন্ট, ভাস্কর্যে বিকট বিকট মূর্তি যার প্রত্যেকটাতেই থাকত একটা ফুটো (তার অর্থ বোঝাতে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে পুরবে)। আমি ওই সময়ে জর্মনিতে ছিলুম। মডার্নদের পাল্লায় পড়ে একদিন একটা চারুকলা প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে একলক্ষে পুনরপি বেরিয়ে এসেছিলুম। একদা যে রকম কোনও এক জু-তে বোকা পাঁঠার খাঁচার সামনে থেকে বিদ্যুৎগতিতে পলায়ন করেছিলুম। বোটকা গন্ধে।

তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, সেখানে উত্তম দ্রষ্টব্য কিছুই ছিল না। নিশ্চয়ই ছিল। রাস্তার ডাস্টবিন খুঁজলে কি আর খান দুই লুচি, একটা আলুর চপ পাওয়া যায় না? কিন্তু আমার এমন কী দায় পড়েছে।

এর পর ১৯৩৩-এ এলেন হিটলার। তাঁর কাহিনী সবাই জানেন। কিন্তু আর্ট সম্বন্ধে তাঁর অভিমত সবাই হয়তো জানেন না; তাই সংক্ষেপে নিবেদন করছি। হিটলার সর্বক্ষণ কাইজারকে অভিসম্পাত দিতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কাইজার যদি কাপুরুষের মতো হার না মেনে লড়ে যেতেন তবে জর্মনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করতই করত।… অথচ আর্ট সম্বন্ধে দেখা গেল হিটলার-কাইজার সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তিনি কঠিনতর কণ্ঠে উচ্চৈঃস্বরে বারবার বলে যেতে লাগলেন, আর্ট হবে সমাজের দাস, অর্থাৎ নাৎসিদের দাস। সূর্যনিম্নে এই পৃথ্বীতলে তারা যে ন্যায়সম্মত আসন খুঁজছে তারই সেবা করবে আর্টিস্টরা।

কাইজারের চরম শত্রুও বলবে না তিনি অসহিষ্ণু লোক ছিলেন। তাঁর আমলে তার নির্দেশ সত্ত্বেও যারা মডার্ন ছবি আঁকত তাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনও প্রকারেরই কোনও কিছু করেননি।

কিন্তু হিটলার চ্যানসেলার হওয়ার পর আরম্ভ হল এদের ওপর নির্যাতন। উত্তম উত্তম ছবি, নব নব সঙ্গীত ব্যান করা হল। সেরা সেরা পুস্তক পোড়ানো হল– কারণ এগুলো নাৎসি সঙ্গীতের সঙ্গে এক সুরে এক গান গায় না। আমি দূর থেকে এরকম একটা অগ্নিযজ্ঞ দেখেছিলুম। কাছে যাইনি। পাছে প্রভুরা আমার রঙ দেখে আমাকে ইহুদি ঠাউরে আমার নাকটা না কেটে দেন। যদিও আমার নাকটি খাঁটি মঙ্গোলিয়ন। খাটো, বেঁটে, হ্রস্ব। কিন্তু বলা তো যায় না।

হিটলার তার সাধনোচিত ধামে গেছেন। এখন জর্মনরা উঠে-পড়ে লেগেছেন মডার্ন হতে। চোদ্দতলা বাড়ি ভিন্ন অন্য কথা কয় না।

তাই এ বিস্কুটটিন-পারা পার্লিমেন্ট।

***

ডিটরিষকে বললুম, জানো ভাগিনা, আমাদের দেশেও এ ধরনের স্থাপত্য হুশ হুশ করে আকাশ পানে উঠেছে। তারই এক আর্কিটেকটু এসেছেন আমাদের সঙ্গে তাস খেলতে। ভদ্রলোক দেশলাই খোঁজেন।… খেলা শেষ হল। তখন কেন জানিনে তিনি তার দেশলাই আর খুঁজে পান না। আমাদের এক রসিক বন্ধু বসে বসে খেলা দেখছিল। সে দরদী কণ্ঠে বললে, দাদাদের কাছে আমার অনুরোধ, আর্কিটেকটু মশায়ের মডেলটি তোমরা কেউ গাপ মেরো না। দেশলাইটির মডেল থেকে তো তিনি হেথাহেথা সর্বত্র বিয়াল্লিশ তলার বিলডিং হাঁকাচ্ছেন! ওটা গায়েব হলে ওয়ার রুটি মারা যাবে যে।

ডিটরিষ বললে, জানো মামু, আমাদের বিশ্বাস প্রাচ্যদেশীয়রা বড়ই সিরিয়াস। সর্বক্ষণ শুমড়ো মুখ করে লর্ড বুদ্ধের মতো আসন নিয়ে শুধু আত্মচিন্তা মোক্ষানুসন্ধান করে। তারাও যে রসিকতা করে এ কথা ৯৯.৯% জর্মন কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। অথচ তোমার এই বন্ধুটির রসিকতাটি শুধু যে রসিকতা তাই নয়। ওতে গভীর দর্শনও রয়েছে। মডার্ন আর্কিটেকচার সম্বন্ধে মাত্র ওই একটি দেশলাই দিয়ে তিনি তার তাচ্ছিল্য সিনিসিজমসহ প্রকাশ করলেন কী সাতিশয় সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে। ভদ্রলোক কি তোমার মতো লেখেন-টেখেন– লিতেরাত্যের?।

আমি বললুম, তওবা, তওবা! ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের ফরেন অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার; পণ্ডিত নেহরুর সহকর্মী। খুব বেশিদিন কাজ করেননি। ওইসব দার্শনিক সিনি রসিকতা তিনি সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করতেন তার ভিন্ন ভিন্ন সহকর্মী মন্ত্রীদের সম্বন্ধে। ঠিক পপুলার হওয়ার পন্থা এটা নয়– কী বলো? কাজেই তিনি যখন ফরেন অফিস থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি বলেছিলুম, তিনি মন্ত্রীমণ্ডলী থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিদায় নেবার সময় উল্লাসে নৃত্য করলেন এবং মন্ত্রীমণ্ডলীও তার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উল্লাসে নৃত্য করলেন।

ডিটরিষ চুপ। আমি একটু অবাক হলুম। সে তো সব সময়ই জুম্মাফিক উত্তর দিতে পারে।

সে বললে, আমার অবস্থাও তাই। যে অফিসে আমি কাজ করি সেটা থেকে বেরুতে পারলে আমিও খুশি হই; ওরাও খুশি হয়।

.

০৮.

ওই তো সামনে গোডেসবের্গ। ডিটরিষ শুধোলে, মামু, পিসি বলছিল তুমি নাকি এই টাউনটাকে জর্মনির সর্ব জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাস? কেন বলো তো।

আমি মুচকি হেসে কইলুম, যদি বলি তোর পিসির সঙ্গে হেথায় আমার প্রথম প্রণয় হয়েছিল বলে?

ডি। ধ্যত! আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করেছি, লিজেল পিসির ধ্যানধর্ম শুধু কাজ আর কাজ। ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া। এবং সে বইগুলোও দারুণ সিরিয়াস। বড় পিসি বরঞ্চ মাঝে মাঝে হালকা জিনিস পড়ত। কিন্তু ছোট পিসি ওসবের ধার ধারত না। সে যেত প্রতি প্রভাতে ট্রামে চড়ে বন শহরে যেখানে সে চাকরি করত।

আমি। সেই সূত্রেই তো আমাদের পরিচয়। আমো ওই সকাল আটটা পনেরোর ট্রামে বন্ যেতুম। আমরা আর সবাই দু তিনটে সিঁড়ি বেয়ে ট্রামে উঠতুম। আর লিজেল পিসি ডান হাতে একখানা বই আর বাঁ হাতে ট্রামের গায়ে সামান্যতম ভর করে সিঁড়িগুলোকে তাচ্ছিলি করে এক লঞ্চে উঠত ট্রামের পাটাতনে। উঠেই একগাল হেসে ডাইনে-বাঁয়ে সমুখ পানে তাকিয়ে বলত শুটেন মরগেন সুপ্রভাত। ওর ওই লম্ফ মেরে ওঠার কৌশল দেখে আমি মনে মনে বলতুম, একদম টম বয়! ওর উচিত ছিল মার্কিন মুল্লুকে কাউ বয় হয়ে জন্ম নেবার। অথবা ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন গুরুদেবের ভাষায়।

গোডেসবের্গ তখন অতি ক্ষুদ্র শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু আসল কথা, ওই আটটা পনেরোর ট্রামে থাকত পনেরো আনা কাচ্চাবাচ্চা। ইস্কুলে যাচ্ছে বন শহরে। এরা সবাই জানত যে লিজেল পিসির, অবশ্য কখনও তিনি পিসি খেতাব পাননি, কাছে আছে লেবেনচুস, দু একটা আপেল, হয়তো নবাগত মার্কিন চুইংগাম, মাঝে-মধ্যে চকলেট। কাজেই বাচ্চারা সমস্বরে, কোরাস কণ্ঠে বলত, অন্তত বার তিনেক সুপ্রভাত–। তার পর সবাই তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়াত। সবাই বলত, প্লিজ, এজ্ঞে, এই এখানে বসুন।

আমি বললুম, বুঝলি ডিটরিষ, তোর পিসি লিজেল ছিল আমাদের হিরইন অব দ্য প্লে। তবে ঠিকই বলেছিস ও কখনও প্রেম-ফ্রেমের ধার ধারত না। আমি দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে প্রতিবন্ধুত্ব ছিল গভীর। আমাকে কত কী-না খাইয়েছে ওই অল্প বয়সেই বেশ দু পয়সা কামাত বলে। তখনকার দিনে ছিল– এখনও নিশ্চয়ই আছে– একরকমের বেশ মোটা চকলেট– ভিতরে কন্যাক। বড় আক্রা। কিন্তু খেতে– ওহ! কী বলব–মুখে ফেলে সামান্য একটু চাপ দাও। ব্যস হয়ে গেল। ভিজে ভিজে চকলেট আর তরল কন্যা মিশে গিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, চলে গেল একদম পেটের পাতালে। কিন্তু যাবার সময় ওই যে কন্যাক– তোরা যাকে বলিস ব্র্যানটভাইন, ইংরেজিতে ব্র্যান্ডি, নাড়িভূঁড়ির প্রতিটি মিলিমিটার মধুর মধুর চুলবুলিয়ে বুঝিয়ে দিত, যাচ্ছেন কোন মহারাজ!… আর মনের মিলের কথা যদি তুলিস তবে বলব, লিজেল ছিল বড়ই লিবরেল। তাই যদিও নাৎসিরা তখনও ক্ষমতা পায়নি কিন্তু রাস্তাঘাটে দাবড়াতে আরম্ভ করেছে- পিসি সেটা আদৌ পছন্দ করত না। আমিও না। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ইংরেজ যে ইতোমধ্যেই হিটলার বাবদে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আমার চিত্তে পুলক জাগাত। পিসিও সেটা জানত। ভারতবর্ষের পরাধীনতার কথা উঠলেই সে ব্যথা পেত। বলত, ও কথা থাক না। ওরকম দরদী মেয়ে চিনতে পারার সৌভাগ্য আমি ইহসংসারে অতি অল্পই পেয়েছি।

হঠাৎ লক্ষ করলুম ভাগিনা ডিটরিষ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। শুধোলুম, কী হল রে? তুই কি পরশুদিনের হাওয়া খেতে চলে গিয়েছিস?

কেমন যেন বিষপ্ত কণ্ঠে ভেজা ভেজা গলায় সে বললে, মামা, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বাবা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে ওপারে চলে গেল কী করে।

ডিটরিষের এখন যৌবনকাল। তার বাপ কেন, ঠাকুন্দাও বেঁচে থাকলে আশ্চর্য হবার মতো কিছু ছিল না। বললুম, আমি তো জানিনে ভাই। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার হচ্ছেও না। কারণ তোর গলাটা কী রকম যেন ভারী ভারী শোনাচ্ছে।

তুমি এইমাত্র বললে না, তুমি-পিসি দু জনাই নাৎসিদের পছন্দ করতে না। বস্তৃত পিসি পরিবারের কেউই নাৎসি ছিল না। যদিও আমি তোমার বান্ধবীকে পিসি বলে পরিচয় দিয়েছি, আসলে তিনি আমার মাসি। তারা তিন বোন। আমার মা সকলের ছোট। তিনি বিয়ে করলেন এক নাৎসিকে কট্টর নাৎসিকে। কেন করলেন জানিনে। প্রেমের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল। বাড়ি গিয়ে তোমাকে তার ডাইরিটি দেখাব। আর চেহারাটি ছিল সুন্দর

বাধা দিয়ে বললুম, সে তোর চেহারা থেকেই বোঝা যায়।

থ্যাঙ্কউ। আর বাবা ছিল বড্ডই সদয় হৃদয়

ভাগিনা, কিছু মনে করো না। আমি মোটেই অবিশ্বাস করি না যে তোর পিতা অতিশয় করুণ হৃদয়, শান্তস্বভাব ধরতেন– তোর দুই মাসিই সে কথা আমাকে বারবার বলেছে। আবার বলছি কিছু মনে করো না, তা হলে তিনি নাসিদের কনসানট্রেশন ক্যাম্প সয়ে নিলেন কী করে?

ডিটরিষ চুপ মেরে গেল। কোনও উত্তর দেয় না। আমি এবার, বহুবারের পর আবার, বুঝলুম যে আমি একটা আস্ত গাড়োল। এ রকম একটা প্রশ্ন করাটা আমার মোটেই উচিত হয়নি, বললুম, ভাগিনা, আমি মাফ চাইছি। আমি আমার প্রশ্নটার কোনও জবাব চাইনে। ওটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।

ডিটরিষ বললে, না মামু। তুমি যা ভেবেছ তা নয়। আমি ভাবছিলুম, সত্যই তো, বাবা এগুলো বরদাস্ত করত কী করে? এবং আরও লক্ষ লক্ষ জর্মন? এই নিয়ে আমি অনেকবার বহু চিন্তা করেছি। তুমি জানো মার্কিনিংরেজ রুশ-ফরাসি নরেনবের্গ মোকদ্দমায় বার বার নাৎসিদের প্রশ্ন করেছে, তোমরা কি জানতে না যে হিটলার কনসানট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করছে? উত্তরে সবাই গাইগুই করেছে। সোজা উত্তর কেউই দেয়নি। জানো তো যুদ্ধের সময় কত সেনসর কত কড়াকড়ি। কে জানবে কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমার মনে হয়, আবার বলছি জানিনে, বাবার কানে কিছু কিছু পৌঁছেছিল। কিন্তু বাবা তখন উন্মত্ত। তিনি চান জর্মনির সর্বাধিকার। তার ডাইরিতে বারবার বহুবার লেখা আছে, ইংরেজ কে? সে যে বিরাট বিশ্ব শুষে খেতে চায় তাতে তার হক্কো কী? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানি, তারা যদি আমাদের কিংবা ফরাসিদের মতো কলচরড় জাত হত তবে আমরা এ নিয়ে কলই করতুম না। কিন্তু ইংরেজ জাতটাই তো বেনের জাত, তারা কলচারের কী বোঝে! ওদের না আছে মাইকেল এঞ্জেলো, না আছে বেটোফেন। আছে মাত্র শেকসপিয়ার। ওদের না আছে স্থাপত্য, না আছে ভাস্কর্য, না আছে–হঠাৎ বললে এই তো বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।

.

০৯.

–ডু হালুঙ্কে সোল্লাসে হুহুঙ্কার ছাড়ল শ্রীমতী লিজেল। তুই গুণ্ডা–

আমরা যেরকম কোনও দুরন্ত ছোট বাচ্চাকে আদর করে গুণ্ডা বলে থাকি, হালুঙ্কে তাই। শব্দটা চেক ভাষাতে জর্মনে প্রবেশ লাভ করেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখা হলেই লিজেল এইভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।

তার পর আমাকে জাবড়ে ধরে দু গালে দুটো চুমো খেল।

ডিটরিষ মারফত পাঠককে পূর্বেই বলেছি লিজেল ছিল ন-সিকে টম-বয়। বরং দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। তবে এটা হল কী প্রকারে? শুচিবায়ুগ্রস্ত পদীপিসিরা ক্ষণতরে ধৈর্য ধরুন। বুঝিয়ে বলছি। এই ষাট বছরে তার কি আর টমবয়তু আছে? এখন আমাকে জাবড়ে ধরে আলিঙ্গন করাতে সে শুধু তার অন্তরতম অভ্যর্থনা জানাল।

আমি মনে মনে বললুম, চল্লিশ বছর ল্যাটে, চল্লিশ বছর ল্যাটে। এই আলিঙ্গন-চুম্বন চল্লিশ বছর পূর্বে দিলেই পারতে, সুন্দরী। পরে তাকে খুলেও বলছিলুম।

ইতোমধ্যে ডিটরিষ আমতা আমতা করে বললে, আমরা তা হলে আসি। রাত্রের পার্টিতে দেখা হবে।

ওরা পাশেই থাকে। তিন মিনিটের রাস্তা। ওদের ভাব থেকে বুঝলুম, ওরা মনে করছে বিদ্যা ও সুন্দর যখন বহু বছর পর সম্মিলিত হয়ে গেছেন তখন ওদের কেটে পড়াই ভালো। আমাদের প্রেমটি যে চিরকালই নির্জলা জল ছিল সেটি হয়তো তারা গলা দিয়ে নাবাতে পারেনি– হজম করা তো দূরের কথা।

লিজেল আমাকে হাতে ধরে ড্রইংরুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি বললুম, এ কী আদিখেতো! চল্লিশ বছর ধরে যখনই এ বাড়িতে এসেছি তখনই আমরা বসেছি বাবা, মা, বড়দি, তুমি, ছোড়দি রান্নাঘরে। অবিশ্যি মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আজ কেন এ ব্যত্যয়? তদুপরি বিরাট ড্রইংরুম। বাপস। তুই যদি এক কোণে বসিস আর আমি অন্য কোণে, তা হলে একে অন্যকে দেখবার তরে জোরদার প্রাশান মিলিটারি দুরবিনের দরকার হবে; কথা কইতে হলে আমাদের দেশের ডাকহরকরা, নিদেন একটা ট্রাংককল ফোন ব্যবস্থা, আর।

লিজেল সেই প্রাচীন দিনের মতো বললে, চোকোর চোককোর। তুই চিরকালই বড্ড বেশি বকর বকর করিস।

গতি পরিবর্তিত হল। আমরা শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই গেলুম।

.

কিচেনের এক প্রান্তে টেবিল, চতুর্দিকে খান ছয় চেয়ার। অন্য প্রান্তে দুটো গ্যাসউনুন, তৃতীয়টা কয়লার (সেটা খুব সম্ভব প্রাচীন দিনের ঐতিহ্য রক্ষার্থে)। দুই প্রান্তের মাঝখানে অন্তত দশ কদম ফাঁক। অর্থাৎ কিচেনটি তৈরি করা হয়েছে দরাজ হাতে। বস্তুত লিজেলের মা যখন রাঁধতেন তখন এ প্রান্ত থেকে আমাকে কিছু বলতে হলে বেশ গলা উঁচিয়ে কথা কইতে হত।

লিজেল একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, এটাতেই বস।

সত্যি বলছি, আমার চোখে জল এল। কী করে লিজেল মনে রেখেছে যে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে (তিনি গত হয়েছেন বছর আটত্রিশেক হবে) তার পিতা আমাকে ওই চেয়ারটায় বসতে বলতেন। আমি জানতুম, কেন। জানালা দিয়ে, ওই চেয়ারটার দিকে দূর-দূরান্তরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। পরে জানতে পেরেছিলুম, তিনি স্বয়ং ওই চেয়ারটিতে বসে আপন খেতখামারের দিকে এবং বিশেষ করে তার বিরাট আপেল বাগানের দিকে নজর রাখতেন– (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আমাদের যেরকম আমবাগান)। অবশ্যই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসতেন। নইলে ওখানে বসতে বলবেন কেন? আমি তো সেখান থেকে তার খেতখামার, আপেলবাগান তদারকি করতে পারব না যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা তাঁর আপন মুনিষ না ভিনজন আমি ঠাহর করব কী প্রকারে? আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ? সে দিকে আমার কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। একদিন ওই শেষ কথাটি তাকে আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে- যাতে অনন্যরা শুনতে না পায় তিনি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অতিশয় সুন্দর স্মিতহাস্যে বললেন, তোমরা ইন্ডিয়ান। তোমাদের দেশে এখনও কলকারখানা হয়নি। তোমরা এখনও আছ প্রকৃতির শিশু। শিশু কি মায়ের সৌন্দর্য বোঝে না। সে শুধু তার মায়ের স্তনরস চায়– সেই স্তনদ্বয়ের সৌন্দর্য কি সে বুঝে? যেমন তার বাপ বোঝে? ঠিক এরকম তোমরা তোমাদের মা-জননী জন্মভূমিতে খেতখামার করে খাদ্যরস আহারাদি গ্রহণ করো। তোমরা কী করে বুঝবে, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? সেটা শুধু হয় যখন মানুষ কলকারখানার গোলাম হয়। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, বড় হয়ে সে তার মাতৃদুগ্ধের মূল্য বুঝতে শেখে–।

আমি বললুম, মানছি, কিন্তু দেখুন গ্রিস, রোম এবং আমার দেশ ভারতবর্ষেও তো কলকারখানা নির্মিত হওয়ার বহু পূর্বে উত্তমোত্তম কাব্য রচিত হয়েছিল এবং সেগুলোতেও বিস্তর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনা আছে। তবে কেন-_

এসব কথাবার্তা যেন ওই চেয়ারে বসে কানে শুনতে পাচ্ছি। কত বৎসর হয়ে গেছে। এমন সময় লিজেল আমার মাথায় মারল একটা গাট্টা। আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বিশেষ করে তার ঠাকুরমার ছবিটি।

কী খাবে বলছিলে?

আমি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলুম, আমি তো কিছুই বলিনি।

তবে চলো, তুমি যে সুপ পছন্দ করতে সেই সুপই করেছি– অর্থাৎ পি সুপ (কলাইশুটির সুপ)- এবারে বলো তুমি কী খাবে? তুমি যা খেতে চাও তার জন্য মাছ, মাংস ক্রিম আছে।

আমি বললুম, দিদি, সুপ ছাড়া আমার অন্য কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এই জর্নিতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়।… তবে কি না আমি বঙ্গসন্তান। হেথায় ডান পাশে রাইন নদী। সে নদীর উত্তম উত্তম মাছ খেয়েছি কত বৎসর ধরে। তারই যদি একটা কিছু–

বেচারি লিজেল!

শুকনো মুখে বললে, রাইনে তো আজকাল আর সে মাছ নেই।

আমি শুধোলুম, কেন?

বললে, রাইন নদের জাহাজের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছে। তাদের পোড়ানো তেল তারা ওই নদীতে ছাড়ে। ফলে নদীর জল এমনই বিষে মেশা হয়ে গিয়েছে যে, মাছগুলো প্রায় আর নেই। আমার কাছে যেসব মাছ আছে সেগুলো টিনের মাছ।

আমি বললুম, তা হলে থাক।

.

১০.

বিনু যখন সোয়ামির সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিল তখন বললে, আহা ওরা কেমন সুখে আছে। আমরাও ভাবি ইংরেজ ফরাসি জর্মন জাত কী রকম সুখে আছে। কিন্তু ওদের দুঃখও আছে। তবে আমাদের মতো ওদের দুঃখ ঠিক একই প্রকারের নয়। ওরা খেতে পায়, আশ্রয় আছে। তৎসত্ত্বেও ওদের দুঃখ আছে।

লিজেলদের বাড়ি প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সে আমলে স্টিল-সিমেন্টের ব্যাপার ছিল না। বাড়িটা মোটামুটি কাঠের তৈরি। দুশো বছর পর ছাদটা নেমে আসছে। এটাকে বাড়া রাখা যায় কী প্রকারে।

আমি জিগ্যেস করলুম, লিজেল, এটাকে কি মেরামত করা যায় না?

লিজেল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, শুধু ছাদ নয়, দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। এ বাড়ি মেরামত করতে হলে কুড়ি হাজার মার্ক (আমাদের হিসাবে চল্লিশ হাজার টাকারও বেশি) লাগবে। বাবা গেছেন, আমার কোনও ভাইও নেই। খেতখামার দেখবে কে? আপেলবাগানটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছি। তাই স্থির করেছি বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেব। ওরা সব পুরনো বাড়ির কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কারণ এ বাড়িটির স্টাইল এক্কেবারে খাঁটি রাইনল্যান্ডের।

আমি বললুম, এটা মর্টগেজ করে টাকাটা তোলো না কেন?

লিজেল বললে, যে টাকাটা কখনও শোধ করতে পারব না সে টাকা ধার করব কী করে!

আমার মনে গভীর দুঃখ হল। বাড়িটি সত্যিই ভারি সুন্দর। শুধু বাড়িটি নয়, তার পেছনে রয়েছে ফল-ফুলের বাগান, তরিতরকারির ব্যবস্থা, কুয়ো, হ্যান্ডপাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে উত্তম ব্যবস্থা। খেতখামার গেছে যাক। ওদের আপেলবাগান এই অঞ্চলে বৃহত্তম এবং শ্রেষ্ঠতমও ছিল। সে-ও গেছে যাক। কিন্তু এই সুন্দর বাড়িটি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, এটা আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না।

ইতোমধ্যে লিজেলের ঘোট বোন মারিয়ানা এল। তিন বোনের ওই একমাত্র যার বিয়ে হয়েছিল। যে ডিটরিষ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বন-এ এসেছিল তার মা। ছেলের বাড়ি দু মিনিটের রাস্তা। সেখানে বউ নিয়ে থাকে।

মারিয়ানা বিধবা। প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। বরটি ছিল খাসা ছোকরা কিন্তু…

এ বাড়ির তিন বোনের কেউই নাৎসি ছিল না। এরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে হয়তো ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। হয়তো করেনি। যাই হোক, যাই থাক, তাই বলে দীর্ঘ, সুদীর্ঘ, সেই ঘটনার দু হাজার বছর পর ওদের দোকানপাট, ভজনালয়, ওদের লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দেবে (মহাকবি হাইনরিষ হাইনের কবিতাও বাদ যায়নি), ইহুদি ডাক্তার, উকিল প্রাকটিস করতে পারবে না– এটা ওরা গ্রহণ করতে পারেনি। এটা ১৯৩৪ সালের কথা। তখনও কনসানট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভ হয়নি। যখন আরম্ভ হল তখন আমি দেশে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি-চাপাটির গমনাগমন সম্পূর্ণ রুদ্ধ। কিন্তু আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ ছিল না যে লিজেদের পরিবার এ প্রকারের নিষ্ঠুর নরহত্যা শুধু যে ঘৃণার চোখে দেখবে তাই নয়, এরা যে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না সেটা তাদের মনকে বিকল করে দেবে। … এ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি জর্মনি যাই; তখন লিজেল আমাকে বলেছিল, ডু হালুঝে, তুই তো ভালো করেই চিনিস, আমাদের এই মুফেনডার্ফ গ্রাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হোক, জর্মনির ক্ষুদ্রতম গ্রাম। সেই হিসেবে আমরা প্রখ্যাততম গ্রাম। এখানে মাত্র একটা-দুটো ইহুদি পরিবার ছিল। দিদি সময়মতো ওদেরকে সুইটজারল্যান্ডে পাচার করে দিয়েছিল।

এবারে আরম্ভ হবে ট্রাজেডি।

মারিয়ানা বড় সরলা। এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। অবশ্য সে-ও ছিল আর দুই দিদির মতো পরদুঃখকাতর।

বিয়ে করে বসল এক প্রচণ্ড পাঁড় নাসিকে। কেন করল এ মুখকে শুধোবেন না। মেয়েরা কেন কার প্রেমে পড়ে, কেন কাকে বিয়ে করে– এ নিগূঢ় তত্ত্ব দেবতারাও আবিষ্কার করতে পারেননি।

তার পর যুদ্ধ লাগল। সেটা শেষ হল।

***

এইবারে মার্কিন-ইংরেজদের কৃপায় দেশের শাসনভার পেলে নাসিবৈরীরা। এঁরা খুঁজে খুঁজে বের করলেন নাৎসিদের। তখন আরম্ভ হল তাদের ওপর নির্যাতন। আজ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তিন রাত্রির গারদে নির্জন কারাবাসের পর আপনাকে ছেড়ে দিল। আপনি ভাবলেন, যাক বাঁচা গেল। দশদিন যেতে না যেতে আবার ভোর চারটেয় আপনাকে গ্রেফতার করে ঠাসল গারদে। (এই যে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু আপনার পিছনে গোয়েন্দা রেখে ধরবার জন্য কারা কারা আপনার সহকর্মী ছিল; কারণ স্বভাবতই আপনি তাদেরই সন্ধানে বেরোবেন। দ্বিতীয়ত এরা আপনার দরদী বন্ধু। আপনার দৈন্য-দুর্দিনে একমাত্র তারাই আপনাকে সাহায্য করবে– অবশ্য যদি তাদের দু পয়সা থাকে।…) এটা কিছু নবীন ইতিহাস নয়। আমাদের এই স্বদেশি আন্দোলনের সময়, পরবর্তী যুগে মহামান্য টেগার্ট সাহেবের আমলে

বারে বারে সহস্র বার হয়েছে এই খেলা।
দারুণ রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা ॥

সর্বশেষ মারিয়ানার স্বামীর তিন বছরের জেল হল। সেখানে যক্ষ্মা। বেরিয়ে এসে ছয় মাসের পরই ওপারে চলে গেল।

পাঠক ভাববেন না, আমি নাৎসিবৈরীদের দোষ দিচ্ছি।

বার বার শুধু আমার মনে আসছে : এদেশের প্রভু, প্রভু খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, ক্ষমা ক্ষমা, ক্ষমা।

জানি, মানুষ এত উঁচুতে উঠতে পারে না।

কিন্তু সেই চেষ্টাতে তো তার খ্রিষ্টত্ব, তার মনুষ্যত্ব।

.

১১.

হুররে, হুররে, হু্ররে।

কৈশোরে অবশ্য আমরা বলতাম, হিপস হিপস হুররে।

পুরোপাক্কা ক্রেডিট নিশ্চয়ই আর ইন্ডিয়া কোম্পানির। দীর্ঘ হাওয়াই মুসাফিরির পর অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম সকাল আটটা অবধি। নিচে নামতেই লিজেন চেঁচিয়ে বললে, ভূ হালুঙ্কে। তোর হারানো সুটকেস ফিরে পাওয়া গিয়েছে।

কী করে জানলি?

আমাদের তো টেলিফোন নেই। চল্লিশ বছর আগে এই গডেসবের্গের যে বাড়িতে তুই বাস করতি তার টেলিফোন নম্বরটি তুই কলোনের হারানো প্রাপ্তির দফতরে সুবুদ্ধিমানের মতো দিয়ে এসেছিলি। আশ্চর্য! সে নম্বর তুই, পুতুপুতু করে এত বৎসর ধরে পুষে রেখেছিলি কী করে আর সেটা যে কলোনে সেই হারানো প্রাপ্তির দফতরে আপন স্মরণে এনে ওদের দিয়েছিলি সেটা আরও বিস্ময়জনক। তোর পেটে যে এত এলেম তা তো জানতুম না। আমি তো জানতুম তোর পশ্চাদ্দেশে টাইম বম রাখতে হয়। (আমরা বাংলায় বলি, পেটে বোম না মারলে কথা বেরোয় না), পিউজের হিসহিস শুনে তবে তোর বুদ্ধি খোলে। সে কথা থাক। কলোনের দফতর সেই নম্বরে ফোন করে, আর তোর সেই প্রাচীন দিনের ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল তুই আমাদের বাড়িতে উঠেছিস। তা ছাড়া যাবি আর কোন চুলোয়।

আনার বিয়ে হয়েছে এক যুগ আগে। ভাতার আর বাচ্চা দুটো রয়েছে। তাই সেখানে না উঠে আমাকে আপ্যায়িত করতে এসেছিস। ফের বলছি সে কথা থাক। আনা কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে।

আমি বাধা দিয়ে বললুম, হবে না কেন? আমি ওদের বাড়িতে ঝাড়া একটি বছর ছিলুম। আমার সঙ্গ পেয়েছে বিস্তর।

লিজেল আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে কোনও মন্তব্য না করে বললে, সে জানে আমাদের টেলিফোন নেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার আছে। তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে তোর সুটকেসটি পাওয়া গিয়েছে এবং কলোন দফতরে জমা পড়েছে।

আমি বললুম, সর্বনাশ। আমাকে এখন ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে যেতে হবে সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর কলোন? আধাখানা দিন তাতেই কেটে যাবে। হেথায় এসেছি ক দিনের তরে? তারও নিরেট চারটি ঘণ্টা মেরে দিয়েছে জুরিচ। কনেকশনে ছিল না বলে। আমি।

লিজেল বাধা দিয়ে বললে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে প্রাথমিক পরিচয়ে তোক যে একটা আকাট মূর্খ ঠাউরেছিলুম সেটা কিছু ভুল নয়, কলোনের দফতরে তোর প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি ব্যত্যয়। অবশ্য আমি কখনও বলিনে একসেপশন ভজ দি রুল, আমি বলি ফুল ভজ দি একসেপশন। তোর সুটকেস তারাই এখানে পৌঁছে দেবে।

***

ওহ। কী আনন্দ, কাল রাত্রে ভয়ে ভয়ে আমি আমার হারিয়ে না যাওয়া বড় সুটকেসটি খুলিনি। যদি দেখি, এদের এবং আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের জন্য ছোটখাটো যেসব সওগাত এনেছি সেগুলো এই বড় সুটকেসটিতে নেই। এটাকেই নাকি বিদেশি ভাষায় বলে অসট্রিচ মনোবৃত্তি।

ইতোমধ্যে বাড়ির সদর দরজাতে ঘা পড়ল। লিজেল সেথায় গিয়ে কী যেন কথাবার্তা কইলে। মিনিট দুই পরে সেই হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া সুটকেসটি নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললে, তোদের অ্যার কোম্পানি তো বেশ স্মার্ট : কমপিটেনট। এত তড়িঘড়ি হুলিয়া ছেড়ে বাক্সটাকে ঠিক ঠিক পকড় কর তোর কাছে পৌঁছে দিলে। আমার ছাতি সুশীল পাঠক, ইঞ্চি ছয় মাফ করবেন, আজকাল নাকি তাবৎ মাপ সেন্টিমিটার মিলিমিটারে বলতে হয়– অর্থাৎ ১৫ মিলিমিটার (কিংবা সেন্টিমিটারও হতে পারে আমার প্রিনস অব ওয়েলস অর্থাৎ বড় বাবাজি যে ইসকেলখানা রেখে দিয়ে চলে গিয়েছেন সেটাতে তার হদিস মেলে না) ফুলে উঠল।

***

বাকসোটা খুলে দেখি, আমার মিত্র মিত্র যেসব বস্তু খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে দিয়েছিল তার সবই রয়েছে (১) বারোখানা মুর্শিদাবাদি রেশমের স্কার্ফ, (২) উড়িষ্যার মোষের শিঙে তৈরি ছটি হাতি, (৩) পূর্ববৎ ওই দেশেরই তৈরি পিঠ চুলকানোর জন্য ইয়া লম্বা হাতল, (৪) দশ বান্ডিল বিড়ি (এগুলো অবশ্য লিজেল পরিবারের জন্য নয়, এগুলো আমার অন্য বন্ধুর জন্য), (৫) ভিন্ন ভিন্ন গরম মশলা এবং আচার (৬) বর্ধমানের রাজপরিবারের আমার একটি প্রিয় বান্ধবীর দেওয়া একখানি মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম স্কার্ফ (তার শর্ত ছিল সেটি যেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠা বান্ধবীকে দিই), (৭) তিনটি স্কার্ফ ক্লাস বেনারসি রেশমের টাই, কাশ্মিরের ম্যাংগো ডিজাইনের শালের মতো ওগুলো বর্ধমানেরই দেওয়া, (৮) দুই পৌন্ড দক্ষিণ ভারতের কফি ও পূর্ববৎ ওজনে দার্জিলিঙের চা… এবং একখানা বই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তার এক বিশেষ পূজারিণীর জন্য, তিনি বাস করেন সুইটজারল্যান্ডে। আর কী কী ছিল ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না। বেশ কিছু কান্দোও ছিল। এই ইয়োরোপিয়ানদের বড়ই দেমাক, তাদের মাস্টার্ড নিয়ে। দম্ভজনিত আমার উদ্দেশ্য ছিল, এদেরকে দেখানো যে আমাদের বাঙলা দেশের কাসুন্দো এ লাইনে অনির্বচনীয়, অতুলনীয়। পাউডার দিয়ে তৈরি ওদের মাস্টার্ড দু দিন যেতে না যেতেই মনে ধরে সবুজ হয়ে অখাদ্যে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের কাসুন্দো? মাসের পর মাস নির্বিকার ব্রহ্মের মতো অপরিবর্তনশীল।

ডিজেলকে বললুম, দিদি, এসব জিনিস ওই বড় টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখ। আর খবর দে ডিটরিষ ও তার বউকে। মারিয়ানা আর তুই তো আছিসই। যার যা পছন্দ তুলে নেবে।

লিজেল বললে, এটা কি ঠিক হচ্ছে এখান থেকে তুই যাবি ডুসলডফেঁসেখানে তোর বন্ধু পাউল আর বউ রয়েছে। তার পর যাবি হামবার্গে; সেখানে তোর বান্ধবীর (তিনি গত হয়েছেন। তিনটি মেয়ে রয়েছেন। তার পর যাবি স্টুটগার্ট-এ। সেখানে রয়েছেন তোর ফার্স্ট লভ। এখানেই যদি ভালো ভালো সওগাত বিলিয়ে দিস তবে ওরা পাবে কী?…

একেই বঙ্গভাষায় বলে পাকা গৃহিণী। কোন গয়না কে পাবে জানে।

.

১২.

গডেসবের্গ সত্যই বড় সুন্দর। এ শহরের সৌন্দর্য আমাকে বার বার আহ্বান করেছে। রাস্তাগুলো খুবই নির্জন। এতই নির্জন যে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলে, সে সম্পূর্ণ অচেনা হলেও আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, গুটেন টাহ। আপনিও তাই বলবেন। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট গেরস্তবাড়ি। সবাই বাড়ির সামনে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে ফুল ফুটিয়েছে। যদি কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফুলগুলোর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকেন তবে প্রায়ই বাড়ির কর্তা, কিংবা গিন্নি, কিংবা তাদের ছেলে-মেয়ের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনার সঙ্গে কথা জুড়ে বসবে। শেষটায় বলবে, আপনিও আমাদেরই একজন; কিছু ফুলটুল চাই? বলুন না, কোনগুলো পছন্দ হয়েছে। তার পর একগাল হেসে হয়তো বলবে, প্রেমে পড়েছেন নাকি? তা হলে লাল ফুল। হাসপাতালে রুগী দেখতে যাচ্ছেন নাকি, তা হলে সাদা ফুল। আমি একবার শুধিয়েছিলাম, আর যদি আমার প্রিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে থাকে, তা হলে কী ফুল পাঠাব? যাকে শুধিয়েছিলাম তিনি তখন দু গাল হেসে বলেছিলেন, সবুজ ফুল। সবুজ ঈর্ষার রঙ। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সবুজ ফুল তো এদেশে দেখিনি কখনও। আমাদের দেশেও সবুজ ফুল একেবারেই বিরল। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও। কিন্তু আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সবুজ ফুল আছে। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ও মশাই, দাঁড়ান, আমার সবুজ ফুলের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই– ও মশাই–

কিন্তু কে-বা শোনে কার কথা!

মিনিট দুই যেতে না যেতেই সেই মহাত্মার পুনরাবির্ভাব। হাতে একটি সবুজ গোলাপ। চোখেমুখে যে আনন্দ তার থেকে মনে হল তিনি যেন বাকিংহাম প্রাসাদ কিংবা কুতুব মিনার কিংবা উভয়ই কুড়িয়ে এনেছেন। আমি বিস্তর ধন্যবাদ, ডাঙ্কে শ্যোন, ডাঙ্কে রেষট শ্যোন বলৈ অজস্র ধন্যবাদ জানালুম।

ইতোমধ্যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি মহিলা ডেকে বললেন, ওগো তোমার কফি।

হঠাৎ আমাকে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন।

ভদ্রলোক বললেন, চলুন না। এক পাত্র কফি হেঁ হেঁ—

আমি বললুম, কিন্তু আপনার গৃহিণী?

না, না, না– আপনি চিন্তা করবেন না। আমার গৃহিণী খাণ্ডারিণী নয়। অবশ্য সে আপনাকে কখনও দেখেনি। চলুন চলুন।

বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক আমাকে কফি টেবিলের পাশে সযত্নে বসিয়ে বললেন, আপনাকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে কত-না দেখেছি। আমার বয়েস তখন চৌদ্দ-পনের। কিন্তু ভয়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারিনি

আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী?

এজ্ঞে আমি জানতুম, আপনি ইন্ডিয়ান। আর ইন্ডিয়ানরা সব ফিলসফার। তারা যত্রতত্র যার তার সঙ্গে কথা কয় না। তাই আপনি ধীরে ধীরে পা ফেলে যেতেন রাইন নদের পারে। আমি কত-না দিন আপনার পিছন পিছন গিয়েছি। আপনি একটি বেঞ্চিতে বসে রাইনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন। তখন কি আর বিরক্ত করা যায়?

আমি বললুম, ব্রাদার, এটা বড় ভুল করেছ। তখন আমার সঙ্গে কথা কইলে বড়ই খুশি হতুম।

ইতোমধ্যে বাড়ির গৃহিণী কেক ইত্যাদি নিয়ে এসে আমাদের টেবিলে রাখলেন। তার গাল দুটো আরও লাল হয়ে গিয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে এবং তিনি হাঁপাচ্ছেন। অর্থাৎ এ পাড়ায় কোনও কেকের দোকান নেই বলে তিনি কুড়ি কুড়ি মিনিটের রাস্তা ঠেঙিয়ে কেক টার্ট নিয়ে এসেছেন।

এ স্থলে যে কোনও ভদ্রসন্তান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাফ চাইত। বলত, এ সবের কী প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমি চাইনি, আমাকে বেয়াদব মূর্খ যা খুশি বলতে পারেন।

আমি শুধু আমার পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তাঁর কপালটি মুছে দিলুম।

.

১৩.

ভ্রমণকাহিনী লিখতে লিখতে মানুষ আশকথা পাশকথার উত্থাপন করে। গুণীরা বলেন এটা কিছু দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে পথিক যদি পথের ভুলে আশপথ পাশপথ, না যায় তবে অচেনা ফুলের নয়া নয়া পাখির সঙ্গে তার পরিচয় হবে কী প্রকারে? কবিগুরুও বলেছেন,

যে পথিক পথের ভুলে,
এল আমার প্রাণের কূলে—

অর্থাৎ প্রণয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমি যদি মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি তবে সহৃদয় পাঠক অপরাধ নেবেন না।

***

আলেকজান্ডার ফন হুমবল্টের নাম কে না শুনেছে? নেপোলিয়ন, গ্যোটে, শিলারের সমসাময়িক। দুই কবির সঙ্গে তাঁর ভাবের আদান-প্রদান হত। এবং অনেকেই বলেন, ওই সময়ে পাশ্চাত্য মহাদেশগুলোতে নেপোলিয়নের পরেই ছিল হুমবল্টের সুখ্যাতি। আসলে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক এবং পর্যটক– ওদিকে কাব্য দর্শন অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গেও সুপরিচিত।

কিন্তু তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখাটি আরম্ভও করিনি।

হুমবল্ট গত হন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। যেহেতু তিনি ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য (দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ককেশাস সাইবেরিয়া পর্যন্ত) অতিশয় সযত্নবান ছিলেন তাই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনের জর্মন পররাষ্ট্র দফতরের উৎসাহে ওই দেশের জনসাধারণ একটি প্রতিষ্ঠান এনডাওমেন্ট দেবোত্তর ব্রহ্মোত্তর, ওয়াকফ, যা খুশি বলতে পারেন নির্মাণ করল, নাম : আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট স্টিফটুঙ। তাদের একমাত্র কর্ম তখন ছিল বিদেশি ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে জর্মনিতে পড়াশুনো করার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আমার বড়ই বিস্ময় বোধ হয়, জর্মনির ওই দুর্দিনে (ইনফ্লেশন সবে শেষ হয়েছে, তার খেয়ারি তখন কাটেনি) সে কী করে এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করল? আমরা বলি আপনি পায় না খেতে। অনেক চিন্তা করে বুঝেছিলুম, দয়াদাক্ষিণ্য আর্থিক সচ্ছলতার ওপর নির্ভর করে না। লক্ষপতি ভিখিরিকে একটা কানাকড়ি দেয় না, অথচ আমি আপন চোখে দেখেছি এক চক্ষুম্মান ভিখিরি এক অন্ধ ভিখিরিকে আপন ভিক্ষালব্ধ দু-চার আনা থেকে দু পয়সা দিতে। আমার এক চেলা এদানীং আমাকে জানালে গঙ্গাস্বরূপা ইন্দিরাজিও নাকি বলেছেন, গরিবই গরিবকে মদৎ দেয়।

সে আমলে ইন্ডিয়া পেত মাত্র একটি স্কলারশিপ আজ অনেক বেশি পায়। সেটি পেলেন আমার বন্ধু সতীর্থ বাসুদেব বিশ্বনাথ গোখলে।২ ইনি সর্বজনপূজ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাতঃস্মরণীয় ঈশ্বর গোখলের ভ্রাতুস্পুত্র। তার চার বৎসর পর পেলুম আমি। সে কথা থাক। মাঝে মাঝে গাধাও রাজমুকুট পেয়ে যায়।

গোডেসবের্গ শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি, একটি বাড়ির সমুখে মোটা মোটা হরফে লেখা–

আলেকজান্ডার ফন্ হুমবল্ট স্টিফটুঙ

আমার তখন আর পায় কে? লম্বা লম্বা পা ফেলে তদ্দণ্ডেই সে বাড়িতে উঠলুম। আমি অবশ্যই আশা করিনি যে সেই চল্লিশ বৎসর পূর্বেকার লোক এ আপিস চালাবেন।

কিন্ত এনারাও ভদ্রলোক। অতিশয় দ্রভাবে শুধোলেন,

আপনি কোন সালে হুমবল্ট বৃত্তি পেয়েছিলেন?

১৯২৯।

ভদ্রলোক যেন সাপের ছোবল খেয়ে লম্ফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

আমিও তাজ্জব বনে গিয়ে বললুম,

কী হল?

কী! চল্লিশ বছর পূর্বে!

এজ্ঞে হ্যাঁ!

মাইন গট (মাই গড)! এত প্রাচীন দিনের কোনও স্কলারশিপ হোল্ডারকে আমি তো কখনও দেখিনি। ।

আমি একটুখানি সাহস পেয়ে বললাম, ব্রাদার, ইহসংসারে তুমিও অনেক কিছু দেখনি, আম্মো দেখিনি। তুমি কি আপন পিঠ কখনও দেখেছ? তাই কি সেটা নেই?

যেহেতু আমি ও বাড়িতে ঢোকার সময় আমার ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলুম, তাই তারা ইতোমধ্যে চেক-আপ করে নিয়েছে, আমি সত্য সত্যই ১৯২৯-এ স্কলারশিপ পেয়ে এ দেশে এসেছিলুম।

হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

অ- অ অ জানেন, আপনি আমাদের প্রাচীনতম স্কলারশিপ হোল্ডার?

আমি সবিনয়ে বললুম,

তা হলে আমাকে আপনাদের প্রাচ্যদেশীয় যাদুঘরে পাঠিয়ে দিন।

টুটেনখামেনের মমির পাশে কিংবা রানি নফ্রেটাট্টির পাশে আমাকে শুইয়ে দিন।

.

১৪.

সুইটজারল্যান্ড, জর্মনি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনে টাকাকড়ির এমনই ছড়াছড়ি, সে কড়ি কী করে খরচ করবে যেন সেটা ভেবেই পায় না। বিশ্বময় (সঠিক বলতে পারব না, তবে বোধহয় চীন এবং লৌহ্যবনিকার অন্তরালের দেশগুলো এখনও অপাঙক্তেয়) গণ্ডায় গণ্ডায় স্কলারশিপ ছড়ানোর পরও হুমবল্ট ওয়াকফের হাতে বেশ কিছু টাকা বেঁচে যায়।

তাই তারা প্রতি বৎসর একটা জব্বর পরব করে। তিন দিন ধরে। জর্মনিতে যে শত শত হুমবল্ট স্কলার ছড়িয়ে আছে এবং যারা একদা স্কলার ছিল, উপস্থিত জর্মনিতেই কাজকর্ম করে পয়সা কামাচ্ছে তাদের সবাইকে তিন দিনের তরে বাড গডেসবের্গে নেমন্তন্ন জানায়। যারা বিবাহিত, তাদের বউ কাচ্চা বাচ্চা সহ- বলা বাহুল্য ওই উপরোক্ত সম্প্রদায়, যারা কাজকর্ম করে পয়সা কামায়। আসা-যাওয়ার ট্রেনভাড়া, হোটেলের খাইখর্চা, তিন দিন ধরে নানাবিধ মিটিং পরব নৃত্যগীত, অনুষ্ঠানে যাবার জন্য মোটরগাড়ি– এক কথায় সব– সব। প্রাচীন দিনে আমাদের দেশে যে রকম জমিদারবাড়িতে বিয়ের সময় দশখানা গায়ের বাড়িতে তিন দিন ধরে উনুন জ্বালানো হত না!!

হ্যার পাপেনফুস স্টিফটুঙের অন্যতম কর্তাব্যক্তি। আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে বললেন, আপনার তুলনায় জর্মনিতে উপস্থিত যেসব প্রাক্তন স্কলার আছেন তারা নিতান্তই শিশু।

আমি বললুম, আমার হেঁটোর বয়স।

পাপেনফুস ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। অর্থাৎ বুঝতে পারেননি। সব দেশের ইডিয়ম, প্রবাদ তো একই ছাঁচে তৈরি হয় না। আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর বললুম, আমাকে যে আপনাদের পরবে নিমন্ত্রণ করেছেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাদের পরব আসছে সপ্তাহ তিনেক পরে। ওদিকে আমাকে যেতে হবে কলোন, ডুসলডর্ফ, হামবুর্গ, স্টুটগার্ট এবং সর্বশেষ স্টুটগার্ট থেকে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে পাড়াগাঁয়ে আমার প্রাচীন দিনের এক বিধবা বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনো করেছি। তার অর্থ আমার স্কলারশিপের মতো তিনিও চল্লিশ বছরের পুরনো প্লস তাঁর বয়স।

লক্ষ করলুম, তৃতীয় ব্যক্তি সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তার চোখে-ঠোঁটে কেমন যেন একটুখানি মৃদু হাসি খেলে গেল। এর অর্থ হতে পারে:

(১) এ তো বড় আশ্চর্য! ষাট বছর বয়সের প্রাচীন প্রিয়ার অভিসারে যাচ্ছে এই নাগর।

কিংবা

(২) এর এক-প্রিয়া-নিষ্ঠতাকে তো ধন্যি মানতে হয়। (রামচন্দ্রকে বলা হয় একদারনিষ্ঠ।)

ইতোমধ্যে কর্তা বললেন, সে কী কথা! আপনি আসবেন না, সে তো হতেই পারে না। আপনার ভাষায়ই বলি আপনার মতো মিউজিয়ম পিস আমাদের কর্তাব্যক্তিদের গুণীজ্ঞানীদের দেখাতে পারব না, সে কি একটা কাজের কথা হল? ওনাদের অনেকেই ভাবেন, আমাদের আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট স্টিফটুঙ বুঝি পরশু দিনের বাচ্চা অথচ আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন কবে সেই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে– অবশ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ জর্মনি যখন তছনছ হয়ে গেল তখন কয়েক বৎসর প্রতিষ্ঠান দেউলে হয়ে রইল। এদের আমি দোষ দিইনে– সব জর্মনই তো ঐতিহাসিক মমজেন হয় না। অতএব চল্লিশ বছরের পূর্বেকার জলজ্যান্ত একজন বৃত্তিধারীকে যদি ওদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তখন হুজুরদের পেত্যয় যাবে–

আমি মনে মনে বললুম, ঈশ্বর রক্ষতু। যাদুঘরে যে রকম পেডেস্টাইলের উপর গ্রিক মূর্তি খাড়া করে রাখে, সে রকম নয় তো! তা করুক, কিন্তু জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণার্থে কুল্লে একখানা ডুমুরপাতা পরিয়ে দিলেই তো চিত্তির–

কর্তা বলে যেতে লাগলেন, আপনি পরবের সময় কন্টিনেন্টে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা সানন্দে আপনাকে একখানা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে দেব। এখানে হোটেলের ব্যবস্থা, যানবাহন সবই তো আমরা করে থাকি। তার পর আপনি ফিরে যাবেন আপন মোকামে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি কি মাত্র তিনটি দিনও শেয়ার করতে পারবেন না… আচ্ছা, তবে এখন চলুন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।

বড্ডই নেমকহারামি হয়। তদুপরি এরা আমাকে দুই যুগ পরে আবার নেমক দিতে চায়। একদা যে প্রতিষ্ঠান যে জর্মন জাত এই তরুণকে স্কলারশিপ-নেমক দিয়েছিল, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদেরকে নিরাশ করি কী প্রকারে?

আমি সকৃতজ্ঞ পরিপূর্ণ সম্মতি জানালুম।

***

রেস্তোরাঁটি সাদামাঠা, নিরিবিলি, ছোটখাটো, ঘরোয়া। ব্যান্ডবাদ্যি, জ্যাজম্যাজিক, খাপসুরুৎ তরুণীদের ঝামেলা, কোনও উৎপাতই নেই। বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে এ রেস্তোরাঁতে আসেন নিকটস্থ আপিস-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। তার অন্যতম প্রধান কারণ মেনু (খাদ্যনির্ঘন্ট) দেখেই আমার চক্ষুস্থির। তৃরিতেই হিসাব করে দেখলুম এখানে অতি সাধারণ লাঞ্চ খেতে হলেই নিদেন পনেরো মার্ক লাগার কথা। আমাদের হিসাবে তিনখানা করকরে দশ টাকার নোট। অবশ্য গচ্চাটা আমাকে দিতে হবে না। কারণ ওঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। এবং এ দেশের রেস্তোরাঁতে যে ব্যক্তি অর্ডার দিল সেই পেমেন্ট করবে– যে খেলো তার কোনও দায় নেই।

কিন্তু এ স্থলে সেটা তো কোনও কাজের কথা নয়।

যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন তারা আমাকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, কী খাবেন, বলুন। আমি কি তখন তাদের ঘাড় মটকাব!

আমি শুধোলুম, আপনারা কি এই রেস্তোরাঁতেই প্রতিদিন লাঞ্চ খেতে আসেন?

এজ্ঞে হ্যাঁ।

কী খান, মানে, কোন কোন পদ?

সুপ মাংস আর পুডিং। কখনও-বা আইসক্রিম– তবে সেটা বেশিরভাগ গ্রীষ্মকালে। মাঝে-মধ্যে শীতকালেও।

আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, শীতকালে আইসক্রিম।

তখন আমার মনে পড়ল আমরাও তো দারুণ গরমের দিনে গরমোতর চা খাই তবে এরাই-বা শীতকালে আইসক্রিম খাবে না কেন?

আমি অতিশয় সাদামাঠা লাঞ্চ অর্ডার দিলুম। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তার গলা মটকাতে নেই।

.

১৫.

আহারাদির কেচ্ছা শুরু হলেই আমি যে বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই আমার সম্বন্ধে সে বদনাম এতই দীর্ঘকালের যে তার সাফাই এখন বেবাক তামাদি– ইংরেজি আইনের ভাষায় টাইম-বার না কী যেন বলে হয়ে গিয়েছে। তাই পাঠক ধর্মাবতারের সমুখে করজোড়ে স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি দোষী, অপরাধ করেছি।

কিন্তু আমি জাতক্রিমিনাল। আমার মিত্র এবং পৃষ্ঠপোষক জেল সুপারিনটেনডেন্ট তার একাধিক প্রামাণিক পুস্তকে লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে জাতক্রিমিনাল হয় না। হুঃ! আমি জাতক্রিমিনাল সেটা জানার পূর্বেই তিনি এসব দায়িত্বহীন বাক্যবিন্যাস করেছেন। তাই আমি আবার সেই লাঞ্চের বর্ণনা পুনরায় দেব।

সুপ আমি বড্ড বেশি একটা ভালোবাসিনে।

এ বাবদে কিন্তু আমি সমুদ্রে বেলাভূমিতে সম্পূর্ণ একাকী নুড়ি নই। ডাচেস অব উইন্ডসর (উচ্চারণ নাকি উইনজার) অতি উত্তম রান্নাবান্না করতে পারেন। তা সে অনেকেই পারেন। কিন্তু তিনি আরেকটি ব্যাপারে অসাধাণ হুনুরি। ভোজনটি কী প্রকারে কমপোজ করতে হবে– এ তত্ত্বটি তিনি খুব ভালো করে জানেন।

অপরাধ নেবেন না। আমরা বাঙালি মাত্রই ভাবি ভোজনে যত বেশি পদ দেওয়া হয় ততই তার খানদানিত্ব বেড়ে যায়। তিন রকমের ডাল, পাঁচ রকমের চচ্চড়ি, তিন রকমের মাছ, দু-তিন রকমের মাংস, চিনিপাতা দই আর কত হরেক রকমের মিষ্টি তার হিসাব নাই-বা দিলুম।

আর প্রায় সবকটাই অখ্যাদ্য। কারণ, এতগুলো পদের জন্য তো এতগুলো উনুন করা যায় না, গোটা দশেক পাঁচক ডাকা যায় না। অতএব বেগুনভাজা মেগনেলিয়ার আইসক্রিমের মতো হিম, চিনিপাতা দই পাঞ্জাব মেলের এনজিনের মতো গরম, লুচি কুকুরের জিতের মতো চ্যাপটা, লম্বা, খেতে গেলে রবারের মতো। আজকাল আবার ফ্যাশন হয়েছে ঘি-ভাত বা পোলাওয়ের বদলে চীনা ফ্রাইড রাইস। চীনারা র উচ্চারণ করতে পারে না। অতএব বলে স্লাইড লাইস–অর্থাৎ ভাজা উকুন। তা সে যে উচ্চারণই করুক আমার তাতে কানাকড়ি মাত্র আপত্তি নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন, গোলাপে যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে। তাই ফ্রাইড রাইস বলুন বা ফ্লাইড লাইসই বলুন–সোওয়াদটি উত্তম হলেই হল। কিন্তু আজকালকার কেটারাররা (হে ভগবান, এই সম্প্রদায়কে বিনষ্ট করার জন্য আমি চেঙ্গিস খান হতে রাজি আছি) নেটিভ পাঁচক দিয়ে ফ্লাইড লাইস নির্মাণ করেন। সত্য সত্য তিন সত্য বলছি, সে মহামূল্য সম্পদ জিহ্বা স্পর্শ করার পূর্বেই আপনি বুঝে যাবেন এই অভূতপূর্ব বস্তু উকুন ভাজা। আলবৎ, আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি, উকুন ভাজা আমি এই কেটারার সম্প্রদায়ের অবদান– মেহেরবানির পূর্বে কখনও খাইনি। তাই গোড়াতেই বলেছি, আমরা মেনু কম্পোজ করতে জানিনে।

তা সে থাক, তা সে যাক্। পরনিন্দা মহাপাপ। এখানেই ক্ষান্ত দিই। বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই খিটখিটে হয়ে যায়।

পুরনো কথায় ফিরে যাই। ডাচেস অব উইনজার নাকি তার লাঞ্চ ডিনারে নিমন্ত্রিতজনকে কখনও সুপ পরিবেশন করেন না। অতিশয় অভিজ্ঞতালব্ধ তাঁর বক্তব্য : এই যে বাবুরা এখন ডিনার খেতে যাবেন তার আগে তেনারা গিলেছেন গ্যালন গ্যালন ককটেল হুইস্কি। জালা জালা সেরি, পোর্ট। সক্কলেরই পেট তরল বস্তুতে টইটম্বুর ছয়লাপও বলতে পারেন। ডাচেসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত সুচিন্তিত অভিমত : এর পরেও যদি হুজুররা তরল দ্রব্য সুপ পেটে ঢোকান তবে, তার পর আর রোস্ট ইত্যাদি নিরেট সলিড দ্রব্য খাবেন কী প্রকারে? তাই তার ডিনারে নো সুপ! অবশ্য ডাচেস সহৃদয়া মহিলা। কাজেই যারা নিতান্তই সুপাসক্ত তাদের জন্য সুপ আসে। ওদেরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনিও মাঝে মাঝে দু চার চামচ সুপ গলাতে ঢালেন।

অতএব আমাকেও নিতান্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য হুমবল্ট স্টিফটুঙ্গ প্রদত্ত লাঞ্চে কিঞ্চিৎ সুপ সেবন করতে হল।

বাহ! উত্তম সুপ! ব্যাপারটা তাহলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।

যেসব দেশের কলোনি নেই– বিশেষত ভারত, সিংহল কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় তারা গরম মশলা পাবে কোত্থেকে? কেনার জন্য অত রেস্ত কোথায়? শত শত বৎসর ধরে তাদের ছোঁকছোঁকানি শুধু গোলমরিচের জন্য! শুনেছি ভাস্কো দা গামা ওই গোলমরিচের জন্য অশেষ ক্লেশ করে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, কলমস নাকি ওই একই মতলব নিয়ে সাপ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো পেয়ে গেলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। এর পর ইয়োরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় ঝাল লাল লঙ্কা আবিষ্কার করল, কিন্তু ওটা ওদের ঠিক পছন্দ হল না! যদ্যপি আমরা ভারতীয়রা সেটি পরমানন্দে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করলুম।

ইতিহাস দীর্ঘতর করব না।

ইতোমধ্যে জর্মনির এতই ধনদৌলত বেড়ে গিয়েছে যে, এখন সে শুধু কালা মরিচ কিনেই পরিতৃপ্ত নয়– এখন সে কেনে দুনিয়ার যত মশলা। বিশেষ করে কারি পাউডার আর লবঙ্গ, এলাচি, ধনে ইত্যাদির তো কথাই নেই। তবে কি না আমি কন্টিনেন্টের কুত্রপি কাঁচা সবুজ ধনেপাতা দেখিনি। কিন্তু ভয় নেই, কিংবা ভয় হয়তো সেখানেই। যেদিন কন্টিনেন্টের কুবের সন্তানরা ধনেপাতা-লঙ্কা-তেঙুল তেলের চাটনির সোয়াদটি বুঝে যাবেন সেদিন হবে আমাদের সর্বনাশ। হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে কুল্লে ধনেপাতা হিল্লি-দিল্লি হয়ে চলে যাবেন কাঁহা কাঁহা মুলুকে। এটা তো এমন কিছু নয়া অভিজ্ঞতা নয়। ভারত-বাঙলা দেশের বহু জায়গাতেই আজ আপনি আর চিংড়ি মাছ পাবেন না। টিনে ভর্তি হয়ে তারা আপনার উদরে না এসে সাধনোচিত ধামে (অর্থাৎ কন্টিনেন্টে- যেখানে চিংড়ি মাছ কেন, সর্বভারতীয় যুবকই যেতে চায়) প্রস্থান করেন। একমাত্র কোলাব্যাঙ সম্বন্ধেই আমাদের কোনও দুঃখ নেই। যাক যত খুশি যাক। ওটা ফরাসিদের বড়ই প্রিয় খাদ্য। তবে কি না বাঙালোর থেকে তারস্বরে এক ভদ্রলোকে প্রতিবাদ করেছেন : পাইকিরি হিসেবে এভাবে কোলাব্যাঙ বিদেশে রফতানি করায় ওই অঞ্চলে মশার উৎপাত দুর্দান্তরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ওই কোলাব্যাঙরাই মশার ডিম খেয়ে তাদের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করত।

এটা অবশ্যই একটা সমস্যা দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমার ভাবনা কী? আমার তো একটা মশারি আছে।

.

গুরমে ভোজনরসিকরা বলেন সুইটজারল্যান্ডের জর্মনভাষী অঞ্চলের খাদ্যই সবচেয়ে ভোতা। অথচ নেপোলিয়ন না কে যেন বলেছেন, ইংরেজ এ নেশন অব শপকিপারজ (অবশ্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে সাকী নামক ছদ্মনামের এক অতিশয় সুরসিক ইংরেজ লেখক বলেন, আমরা এখন এ নেশন অব শপলিফটারজ অর্থাৎ লেখক বলেন, আমরা এখন দোকানের ভিড়ে চটসে এটা-ওটা চুরি করতে ওস্তাদ) এবং সুইসরা এ নেশন অব হোটেলকিপারস। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাবৎ ইয়োরোপে সুইসরাই পরিচ্ছন্নতম হোটেল রাখে। কিন্তু প্রশ্ন : তোমরা হোটেল-রেস্তোরাঁ যতই সাফসুতরো রাখো না কেন, তোমার রেস্তোরাঁর সুপে ব্লন্ড, ব্রুনেট, কালো চুল না পাওয়া গেলেও (দিনের পর দিন তিন রঙের চুল আবিষ্কার করতে করতে আমার এক মিত্র–সুইটজারল্যান্ডে নয়, অন্য এক নোংরা দেশের হোটেলে একদিন ম্যানেজারকে শুধোলেন, আপনার রান্নাঘরে তিনটি পাচিকা আছেন; না? একজনের চুল ব্লভ, অন্য জনের নেট এবং তেসরা জনের কালো। নয় কি? ম্যানেজার তো থ! এই ভদ্রলোকই কি তবে শার্লক হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমস? সবিনয়ে তথ্যটা স্বীকার করে শুধোলে, স্যর, আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমাদের রসুইখানায় কখনও পদার্পণ করেননি! বন্ধু বললেন, সুপে কোনও দিন ব্লন্ড, কখনও-বা নেট এবং কালো চুল পাই– কালোটাই পাতলা সুপে চোখে পড়ে বেশি। এ তত্ত্বে পৌঁছবার জন্য তো দেকার্ত কান্ট-এর দর্শন প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি ওই কালো চুলউলিকে যদি দয়া করে বলে দেন, সে যেন আর পাঁচটা হোটেলের পাঁচজন পাঁচকের মাথায় যে রকম টাইট সাদা টুপি পরা থাকে ওইরকম কোনও একটা ব্যবহার করে। আমার মনে হয় ওর মাথায় দুর্দান্ত খুসকি–পাঠক অপরাধ নেবেন না, এ কেচ্ছাটা বলার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলুম না।) সুন্ধুমাত্র সুইস হোটেলের সুপমধ্যে হরেকরকম্বা চুল নেই বলেই যে দুনিয়ার লোক হদ্দমু হয়ে সে দেশে আসবে এ-ও কি কখনও সম্ভব? আমার সোনার দেশ পুবপচ্ছিমওতর বাঙলায় সুপ তৈরি হয় না। অতএব প্লাটিনাম ব্লন্ড, সাদামাটা ব্লন্ড, চেশমাট ব্রাউন, মোলায়েম ব্রাউন, কালো-মিশকালো কোনও রঙের কোনও চুলের কথাই ওঠে না। মোটেই মা রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা। কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার গোড়ায় রশি বাধার মতো। তাই বলে কি মার্কিন-সুইস টুরিস্ট এ দেশে আসে না।

বিজনেস ইজ বিজনেস–তাই সুইসরা পর্যন্ত তাদের রান্নাতে প্রাচ্যদেশীয় মশলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।

আমার কাছে একখানা সুইস সাপ্তাহিক আসে। তার কলেবর প্রায় ষাট পৃষ্ঠা। একদা কেউ ল্যাটে এলে আমরা ঠাট্টা করে বলতুম কী বেরাদর, কেপ অব গুড হোপ হয়ে এলে নাকি?– সুয়েজ কানাল যখন রয়েছে। এখন কিন্তু এটা আর মস্করা নয়। অ্যার মেলের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ষাট পৃষ্ঠা বপুধারী পত্রিকা তো আর অ্যার মেলে পাঠানো যায় না। খর্চা যা পড়বে সেটা সাপ্তাহিকের দাম ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দিতে বলে লড়কে সে, লড়কার গু ভারী বাচ্চাটার ওজনের চাইতে তার মলের ওজন বেশি।

সেই পত্রিকার একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগ আছে। কেউ শুধোল, মাংস আলু তরকারিসহ নির্মিত ভোজনের মেন তিশ (পিয়েস দ্য রেজিসাস) খাওয়ার পর যেটুকু তলানি সম্ (শুকনো ঝোল, কলকাত্তাইয়ারা কাইও বলে থাকে) পড়ে থাকে তার উপর পাউরুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে কাঁটা দিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চেটেপুটে খাওয়াটা কি প্রতোকোলসম্মত– এটিকেট মাফিক, বেয়াদবি অভদ্রস্থতা নয় তো!

উত্তর : পৃথিবীতে এখন এমনই নিদারুণ খাদ্যাভাব যে ওই সসটুকু ফেলে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই (অবশ্য তার সঙ্গে রুটির টুকরোগুলোও যে গেল সে বাবদে বিচক্ষণ উত্তরদাতা কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ রুটিটি পরের ভোজনেও কাজে লাগত কিংবা গরিব-দুঃখীকে বিলিয়ে দেওয়া যেত— এঁটো প্লেটের তলানি সস তো পরবর্তী ভোজনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যায় না, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলানো যায় না– লেখক) তার পর তিনি বলছেন, কিন্তু আপনি যদি নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও যান তবে এই কার্পণ্যটি করবেন না। তার মানে আপনার বাড়ির বাইরের এটিকেট যেন বাড়ির ভিতরের চেয়ে ভালো হয়। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নমত ধরি। আমার মতে বাড়ির এটিকেট, আদবকায়দা যেন বাইরের চাইতে ঢের ঢের ভালো হয়।

প্রশ্ন: কোহিনূর প্রস্তর কোন ভাষার শব্দ?

উত্তর : ফারসি।

(সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোহ= পাহাড়–ফার্সিতে যেমন কাবুলের উত্তর দিকে কোহিস্তান রয়েছে [ আমার সখা আব্দার রহমান ওই কোহিস্তানের লোক] কিন্তু কোহ-ই-নূরের নূর শব্দটি ন সিকে আরবি। খাঁটি ফারসিতে যদি বলতেই হয় তবে নূর-এর বদলে রওশন বা রোশনি বাংলায় রোশনাই] ব্যবহার করে বলতে হয় কোহ-ই-রওশন। শুদ্ধ আরবিতে বলতে হলে জবলুন (পাহাড়) নূর।… কিন্তু এ রকম বর্ণসঙ্কর সমাস সর্বত্রই হয়ে থাকে। দিল্লীশ্বর ইত্যাদি।)।

প্রশ্ন : আমার বয়স বত্রিশ; আমি বিধবা। আমার মোললা বছরের ছেলের একটি সতেরো বছরের ভেরি ডিয়ার ক্লাসফ্রেন্ড প্রায়ই আমাদের এখানে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা জমাবার চেষ্টা করছে। আমি করি কী?

উত্তর : আপনি ওকে সঙ্গোপনে নিয়ে গিয়ে বলুন, তুমি তোমার অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম করো। আমি তোমার মায়ের বয়সী। তোমার বয়েসী মেয়ের তো কোনও অভাব নেই। কিন্তু, আমার মনে হয়, ছেলেটার বোধহয় মাদার কমপ্লেকস আছে– অতি অল্প বয়সেই তার মা গত হন। কাজেই সে একটি মায়ের সন্ধানে আছে– তার পর আরও নানাপ্রকারের হাবিজাবি ছিল।

এ উত্তর যে কোনও গো-গর্দভ দিতে পারত।

কিন্তু এ প্রশ্নোত্তরমালা নিতান্তই অবতরণিকা মাত্র।

***

কয়েক মাস পূর্বে মনে হল– একটি প্রাচীনপন্থী মহিলা–প্রশ্ন শুধোলেন : আজকালকার ছেলে-ছোকরা এমনকি মেয়েরাও বড় বেশি মশলাদার খানা খাচ্ছে। আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি। সেদিন বাধ্য হয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। যদি জানতুম, শহরের মাই লর্ড রেস্তোরাঁওয়ালারা কী জঘন্য ঝাল, মাস্টার্ড (আমাদের কাসুন্দো– লেখক) আর মা মেরিই জানেন কী সব বিদকুটে বিদকুটে বিজাতীয় মশলা দিয়ে যাবতীয় রান্না করেন, তবে কি আমি সে রেস্তোরাঁয় যেতুম! এক চামচ সুপ মুখে ঢালা মাত্রই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে লাগল। আমার কপালে সেই শীতকালে, ঘাম জমতে লাগল। মনে হল, আমার জিভে যেন কেউ আগুন ঠেলে দিয়েছে। আমার চোখ থেকে যা জল বেরুতে আরম্ভ করল সেটা দেখে আমার কাছেরই একটি সহৃদয় প্রাইভিট শুধাল মাদাম, আমি বহু দেশ-বিদেশ দেখেছি যেখানে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হয়; কিন্তু আমাদের এই সুইটজারল্যান্ডে তো কখনও দেখিনি। শোকাতুরা হয়ে কান্না করলে রমণীর চোখে অশ্রুজল বেরোয়, এটা তো তা নয়।

একদা সুইস কাগজে প্রশ্ন বেরোল: এই যে আমরা প্রতিদিন আমাদের রান্নাতে মশলার পর মশলা বাড়িয়েই চলেছি এটা কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো?

সেই সবজান্তা উত্তরিলা :

মাত্রা মেনে খেলে কোনও আপত্তি নেই। কোনও বস্তুরই বাড়াবাড়ি করতে নেই। (মরে যাই! এই ধরনের মহামূল্যবান উপদেশ পাড়ার পদীপিসি, ইস্কুলবয় সবাই দিতে পারে– লেখক)। তার পর সবজান্তা বলছেন, ডাক্তারদেরও আধুনিক অভিমত, মেকদার মাফিক মশলাদার খাদ্য ভোজনস্পৃহা আহাররুচি বৃদ্ধি করে। তদুপরি আরেকটা গুরুত্বব্যঞ্জক তত্ত্ব আছে। আপনি যদি আপনার ভোজন ব্যাপারে সর্বক্ষণ এটা খাব না ওটা ছোঁব না– এ রকম পুতুপুতু করে আপনার ভোজনযন্ত্রটিকে ন সিকে মোলায়েম করে তোলেন (ইংরেজিতে একেই বলে মলিকল করেন) তবে কী হবে? আপনি যতই চেষ্টা দিন না কেন, আপন বাড়িতে তৈরি মশলা বিবর্জিত রান্নামাত্রই খাব তথাপি ইহসংসারে বহুবিধ ফাড়া-গর্দিশ আছে যার কারণে আপনাকে হয়তো কোনও রেস্তোরাঁতে এক বেলা খেতে হল। কিংবা মনে করুন, আপনি নিমন্ত্রিত হলেন। শক্তসমত্ত জোয়ান আপনি। কী করে বলবেন আপনি ডায়েটে আছেন? ওদিকে রেস্তোরাঁ বলুন, ইয়ার বখশির বাড়িই বলুন সর্বত্রই সর্বজন শনৈঃ শনৈঃ গরম মশলার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। পরের দিন আপনি কাৎ। অতএব আমাদের সবজান্তা বলছেন, কিছু কিছু মশলা খেয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা করে ফেলাই ভালো।

কিন্তু মশলাপুরাণ এখানেই সমাপ্ত নয়। সেটা পরে হবে।

ইতোমধ্যে আমি দুম করে প্রেমে পড়ে গেলুম।

কবিগুরু গেয়েছেন:

যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তবু মনে রেখো।

কিন্তু এ আশা রাখেননি, সেই প্রথম প্রিয়াই পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসবে। আমার কপাল ভালো।

লাঞ্চ সেরে মৃদুমন্থরে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসেই দেখি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে যে মেয়েটি বসেছিল সে জ্বলজ্বল করে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমার দুশমনরা তো জানেনই, এস্তেক পোস্তরাও জানেন, আমি কন্দর্পকিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাইনি। তদুপরি বয়স যা হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে কাঠাকালি বিঘেকালি বিস্তর আঁক কষাকষি করতে হয়। সর্বশেষে সেটা ভগ্নাংশে না ত্রৈরাশিকে দিতে হবে তার জন্য প্লাশেৎ মারফত ঈশ্বর সুকুমার রায়কে নন্দনকানন থেকে এই য ব ন ভূমিতে নামাতে হবে!

অবশ্য লক্ষ করেছিলুম, আমি ওর দিকে তাকালেই সে ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। রোমান্টিক হবার চেষ্টাতে বলেছিলুম, মেয়েটি। কিন্তু তার বয়স হবে নিদেন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ– এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে। বিদগ্ধ পাঠকের অতি অবশ্যই স্মরণে আসবে, বৃদ্ধ চাটুয্যে মশাই যখন প্রেমের গল্প অবতারণা করতে যাচ্ছে তখন এক চ্যাংড়া বক্রোক্তি করে বলেছিল, চাটুয্যে মশাই প্রেমের কী-বা জানেন। মুখে যে কটা দাঁত যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছে তাই নিয়ে প্রেম!

চাটুয্যে মশাই দারুণ চটিতং হয়ে যা বলেছিলেন তার মোদ্দা : ওরে মূর্খ! প্রেম কি চিবিয়ে খাবার বস্তু যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস! প্রেম হয় হৃদয়ে!… একদম খাঁটি কথা। ভলতের, গ্যোটে, আনাতোল ফ্রাঁস, হাইনে আমৃত্যু বিস্তর বিস্তরবার ফটু ফট করে নয়া নয়া স্ত্রী পরীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন। এই সোনার বাঙলাতেও দু একটি উত্তম দৃষ্টান্ত আছে। তা হলে আমিই-বা এমন কি ব্রহ্মহত্যা করেছি যে ফুট করে প্রেমে পড়ব না।

বললে পেত্যয় যাবেন না, অকস্মাৎ একই মুহূর্তে একে অন্যকে চিনে গেলুম। যেন আকাশে বিদ্যুৎ বহ্নি পরিচয় গেল লেখি।

একসঙ্গে আমি চেঁচালুম লটে।

সে চেঁচালে হ্যার সায়েড।

তার পর চরম নির্লজ্জার মতো সেই প্রশস্ত দিবালোকে সর্বজন সমক্ষে আমাকে জাবড়ে ধরে দুই গালে ঝপাঝপ এক হর বা দুই টন চুমো খেল।

সুশীল পাঠক, সচ্চরিত্র পাঠিকা, মায় দেশের মরালিটি রক্ষিণী বিধবা পদীপিসি এতক্ষণে একবাক্যে নিশ্চয়ই নাসিকা কুঞ্চিত করে দ্যা, ছ্যা বলতে আরম্ভ করেছেন। আমি দোষ দিচ্ছিনে। এ-স্থলে আম্বো তাই করতুম– যদি-না নাটকের হেরোইন আমার প্রিয়া লটে (তোলা নাম শার্লট) হত। বাকিটা খুলে কই।

ওর বয়স যখন নয়-দশ, আমার বয়স ছাব্বিশ। আমি বাস করতুম ছোট গোডেসবের্গ টাউনের উত্তরতম প্রান্তে লটেদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি। ওদের পাশে থাকত দুই বোন গ্রেটেক্যাটে। আরও গোটা পাঁচেক মেয়ে তাদের বাড়ির পরে। কারওই বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়।

লটে ছিল সবচেয়ে ছোট।

আমার জীবনের প্রথম প্রিয়া।

আর সব কটা মেয়ে এ তথ্যটা জানত এবং হয়তো অতি সামান্য কিছুটা হিংসে হিংসে ভাব পোষণ করত। ওদের আশ্চর্য বোধ হত হয়তো, যে লটে তো ওদের তুলনায় এমন কিছু শুলেবাকাওলি নয় যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে আমি এরই প্রেমে মজে যাব। এটা অবশ্য আমি বাড়িয়ে বলছি। প্রেমে মজার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স ছাব্বিশ, ওর নয় কি দশ।

আসলে ব্যাপারটি কী জানেন? জর্মনদের ভিতরে যে চুল অতিশয় বিরল, লটের ছিল সেই চুল। দাঁড়কাকের মতো মিশমিশে কালো একমাথা চুল। ঠিক আমার মা-বোনদের চুলের মতো। ওর চুলের দিকে তাকালেই আমার মা-বোনদের কথা, দেশের কথা মনে পড়ত। আর লটে ছিল আমার বোনদের মতো সত্যই বড় লাজুক। সক্কলের সামনে, নিজের থেকে, আমার সঙ্গে কখনও কথা বলত না।

আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একচিলতে গলি। সেখানে রোজ দুপুর একটা-দুটোয় আমরা ফুটবল খেলতুম। আমার বিশ্বাস তুমি পাঠক, আমাদের সে টিমের নাম জানো না। আমিও অপরাধ নেব না। আমরা যে আইএফএ শিলডে লড়াই দেবার জন্য সে আমলে ভারতবর্ষে আসিনি তার মাত্র দুটি কারণ ছিল। পয়লা: অতখানি জাহাজ ভাড়ার রেস্ত আমাদের ছিল না। এবং দোসরা : আমাদের কাইজার টিম-এ পুরো এগারো জন মেম্বর ছিলেন না। আমরা ছিলুম মাত্র আষ্টো জন। তৃতীয়ত, যেটা অবশ্য আমাদের ফেভারেই যায়, আমাদের ফুটবলটি ছিল অনেকটা বাতাবি নেবুর মতো। ওরকম ফুটবল দিয়ে কি সমদ, কি জুম্মাখান কখনও প্যাটার্ন-উইভিং ড্রিবলিং উজিং ডাকিঙের সুযোগ পাননি।

হায়, হায়! এ জীবনটা শুধু সুযোগের অবহেলা করে করেই কেটে যায়। এসব আত্মচিন্তা যে তখন করেছিলুম তা নয়।

চল্লিশ বছর পর পুনরায় এই প্রথম আমাদের পুনর্মিলন। লটে হঠাৎ শুধাল, হার সায়েড! তুমি বিয়ে করেছ?

শুনেছি ইহুদিরা নিতান্ত গঙ্গাযাত্রার জ্যান্ত মড়া না হলে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন শুধিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দেয়। আমি শুধলুম, তুই?

খলখল করে হেসে উঠল।

কেন? আমার আঙুলে এনগেজমেন্ট রিং, বিয়ের আংটি দুটোই এখনও তোমার চোখে পড়েনি। আমি তো দিদিমা হয়ে গিয়েছি। চলো আমাদের বাড়ি।

আমি সাক্ষাৎ যমদর্শনের ন্যায় ভীত চকিত সন্ত্রাসগত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলুম, সে যদি আমায় ঠ্যাঙায়?

দুটি মিষ্টিমধুর ঠোঁটের উপর অতিশয় নির্মল মৃদু হাসি এঁকে নিয়ে বললে, বটে! আমার জীবনের প্রথম প্রিয়কে সে প্যাদাবে? তা হলে সেই হালুঙ্কেটাকে আমি ডিভোর্স করব না?

তওবা, তওবা!

Exit mobile version