ঘটনাটা নিত্যি নিত্যি এ দেশে হয় কি না বলতে পারব না, কারণ যে কটি লোক কাণ্ডটা দেখলে তারা মৃদু হাস্য করা দূরে থাক, তাদের নয়নের উদাস দৃষ্টি যেন সঙ্গে সঙ্গে উদাসতর হয়ে গেল। আমিও ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ শহুরে হয়ে গিয়েছি। মাথা নিচু করে গভীর মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজে বরিলের বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই সই পড়তে লাগলুম।
ঘটনাটি প্রচুর ধ্বনি ও ব্যঞ্জনা সহকারে এক ইংরেজ বন্ধুকে যখন বাখানিয়া বললুম, তখন তিনি বললেন, কেন, এ ব্যাপার তো এখন ক্লাসিসের পর্যায়ে উঠে গেছে। শোনো এক কনি আর এক কনিকে উপদেশ দিচ্ছে, মিলের শেয়ার না কিনতে। কী হবে কিনে? কাপড়ের এখন আর কতখানি প্রয়োজন? এই দেখ না, আমি আমার স্ত্রীর গেল বছরের স্কার্ট দিয়ে নেকটাই বানিয়েছি, আর তিনি আমার গেল বছরের টাই দিয়ে এ বছরের স্কার্ট বানিয়েছেন।
কিন্তু এহ বাহ্য। এসব জিনিস দিয়ে ইংরেজ চরিত্রের অদল-বদল হয়েছে কি না সে কথা বলা অসম্ভব না হলেও কঠিন। এক মার্কিন সেপাই যুদ্ধের সময় বাঙলা দেশের ভিতর দিয়ে যাবার সময় দেখে, যেখানেই পুকুর কাটা হয়েছে সেখানেই পুকুরের মাঝখানে মাটির কোনিকাল থাম রাখা হয়েছে। আসলে এটা কতখানি মাটি কাটা হয়েছে তার মাপ রাখবার জন্য এবং মাটি-কাটাদের মজুরি চুকিয়ে দেবার পর এ থামগুলোও কেটে ফেলা হয় কিন্তু মার্কিন তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখলে, বাঙলা দেশের লোকই সবচেয়ে বেশি শিবলিঙ্গ পুজো করে। এন্তের পয়সা খরচ করে বিরাট বিরাট পুকুর খুঁড়ে মাঝখানে শিবলিঙ্গ স্থাপনা করে।
এটা শুনে আমার মনে শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। না হলে ক্লিয়াপাত্রার নিডল (অবিলিস্ক) ইয়োরোপে যে সম্মানের সঙ্গে রাখা হয়েছে তার থেকে মীমাংসা করে আমিও বলে দিতাম, ইয়োরোপেও লিঙ্গপূজা হয়।
যতই খবরের কাগজ পড়ি, রেডিয়ো শুনি, টেলিভিশন দেখি, পাবে কথাবার্তা কই, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লাঞ্চ-ডিনার খাই, মোটরে করে গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যাই, ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে অবরে সবরে রসালাপ করি (তার সুযোগ বিস্তর, কারণ ট্রাফিক জ্যামের ঠেলায় ঘাটে ঘাটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়) বাকা নয়নে সবকিছু দেখি, খাড়া কানে অধর্মাচরণে অন্য লোকের কথাবার্তা শুনি ততই মনে হয়, সেই পুরনো ফরাসি প্রবাদ, প্ল্যু সা শাঁজ প্ল্যু সে লা মেম শোজ (দি মোর ইট চেঞ্জেস, দি মোর ইট ইজ দি সে থিং), খোল-নলচে বদলেও সেই পুরনো হুঁকো।
এই যে জর্মনির হাতে ইংরেজ বেধড়ক বম্ খেল, কই, কথায় কথায় তো জর্মনিকে কটুবাক্য করে না; দু এক জায়গায় যে কালোয়-ধলায় মারামারি হচ্ছে, কই সাধারণ ইংরেজ তো সাদার পিছনে দাঁড়ায়নি; উল্টো প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এমনকি শুনতে পেলুম পার্লিমেন্টে নাকি কে যেন বিল আনবেন, যেসব হোটেল-ওলা কালো-ধলায় ফারাক করে তাদের সায়েস্তা করবার জন্য; নানা প্রকার আমদানি-রপ্তানির ওপর যদিও বাধ্য হয়ে কিছু কিছু আইন জারি করতে হচ্ছে তবু তো ইংরেজ আরও কয়েকটা জাত নিয়ে একটা খোলা বাজার তৈরি করার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগেছে। ত্রিশ বছর আগেও মনে হয়েছে, এখনও মনে হল, ইংলন্ডে কনসারভেটিভও লিবরেল, লেবারও লিবরেল হয়ে গিয়েছে। তাই বোধহয় খাস লিবারেল দলের জেল্লাই সেখানে কমে গিয়েছে। যে দেশের সবাই ভাত খায় সেখানে তো আর ভাতখেকোদের আলাদা হোটেল হয় না।
তাই তাজ্জব মানি, এলিয়ট এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন কী করে।
সিনহা না ভলফ শুধিয়েছিলেন সে কথাটা মনে নেই।
আজ যখন অ্যারোপ্লেনে করে অষ্টপ্রহরে কলকাতা থেকে লন্ডনে যেতে পারি, প্যারিসের লোক আর কয়েকদিনের ভিতরেই দেশে খাবে ব্রেকফাস্টনিউইয়র্কে খাবে লাঞ্চ, সর্বদেশের ভৌগোলিক গণ্ডি যায় যায়, শঙ্কর দর্শন আলোচনা করতে হলে প্লাতোর উল্লেখ না করলে সমালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, ক্রোচের সমালোচনায় অভিনব গুপ্তের নামোল্লেখ অভিনব বলে মনে হয় না, লন্ডন পাউন্ডের দাম কমালে আর পাঁচটা দেশ পড়িমরি হয়ে সেই কর্ম করে, জর্মনিতে নতুন দাওয়াই বেরোলে সেটা কলকাতার কালোবাজারে ঢোকে সাত দিনের ভিতর, বিলিতি ফিরে মরমিয়া কেঁই কেঁই সুরের দিশি ভেজাল হন্টরওয়ালিতে শোনা যায় পক্ষাধিক কালে, তখন শুনতে হবে খ্রিস্টধর্মের, একমাত্র খ্রিস্টধর্মের তা-ও চার্চ অব ইংলন্ডের খ্রিস্টধর্মের জয়গান? সেইটে বারণ না করলে পৃথিবীর আদর্শ সমাজে আমাদের স্থান নেই?
কারণ এলিয়ট অতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আমাকে যদি ধর্মান্ধ বলা হয় তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। যদি খ্রিস্টীয় সমাজই চাও তবে তাতে মেলা স্বাধীন পন্থা, স্বাধীন মতবাদের ঝামেলা লাগালে চলবে না (ইউ ক্যানোট এলাও কনজেরিজ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট সেকটস)। ইংলন্ডের নৈতিক পন্থা, এবং বৈদেশিক নীতি ঠিক করে দেবে চার্চই। আর তার আদর্শ রাষ্ট্রে ইহুদিদের সংখ্যা যে অতিশয় সীমাবদ্ধ থাকবে সে কথা তো পূর্বেই নিবেদন করেছি। (এখানে বলে দেওয়া ভালো আমি পাপী; সে আদর্শ সমাজে স্থান চাইনে; আমি শুধু তার বাঙালি শিষ্যদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলুম।)
আমি তো আশা করেছিলুম, ভৌগোলিক গণ্ডি যখন জেরিকের দেয়ালের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে তখন শিক্ষিত মানুষ সেই ধর্মেরই অনুসন্ধান করবে যে ধর্ম তার বিরাট বাহু মেলে সবাইকে আলিঙ্গন করতে চায়। আমার তো মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ যখন ইংলন্ডে মানবধর্মের জয়গান গেয়েছিলেন তখন তিনি বলদের সামনে বেদপাঠ কিংবা মোষের সামনে বীণা বাজাননি।