আমার জন্মভূমি সোনার দেশ ভারতবর্ষে অবশ্য ভিন্ন ব্যবস্থা। তার সম্বন্ধে অন্য গল্প আছে। সেটা কিন্তু বাজারে চালু হয়নি। আকাশবাণীতে সামান্য যেটুকু প্রোগ্রাম পায় তা-ও কাটা যাবার ভয়ে সে গল্পটি কেউ বলতে চায় না, শুনলেও ভুলে যেতে চায়।
এটম বম পড়লে কী কী কাণ্ড হতে পারে তারই রগরগে বর্ণনা শুনে এক নিরীহ বঙ্গসন্তান তার বৈজ্ঞানিক বন্ধুকে শুধালে, এসব কি সত্যি?
এক দম! বরঞ্চ কমিয়ে সুমিয়ে বলেছে।
তা হলে উপায়? দূর-দূরান্তে, লড়াইয়ের আওতার বাইরে কোনও নির্জন দ্বীপে চলে গেলে হয় না?
হয়। কিন্তু এদেশের সরকার এটম বমের বিরুদ্ধে উত্তম ব্যবস্থা করেছেন। বম ফাটার সম্ভাবনা দেখলেই, আকাশবাণীর কোনও স্টুডিয়োতে ঢুকে পড়ো। সেখানে কোনও রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি নেই।
আমি অবশ্য মৌলানা সাদীর মতো দেনাদারকে পাকড়াবার জন্য বিবিসিতে যাইনি। আমি গিয়েছিলুম আপন ঋণ শোধ করতে। পূর্বেই বলেছি, একদা আমি বেতারে বাঁধা ছিলুম। সে সুবাদে দু একজন কর্মীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এমনকি দহরম-মহরম হয়। দেশে নিষ্কর্মা বিবেচিত হওয়ার পর বিবিসি এদের লুফে নিয়েছে পাড়ার মেধো ওপাড়ার মধুসূদন তুচ্ছার্থে বলা হয়, এখানে কিন্তু সত্যই।
জর্মনির জন্য বিবিসি যে জর্মন প্রোগ্রাম করে তারই বড় কর্তা আসলে ভিয়েনাবাসী জর্মনভাষী ড, ভলফের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে আমাদের সিনহা (আসলে সাদামাটা কায়েতের পো সিঙ্গি, নিতান্ত সম্মানার্থে সিংহ, কিন্তু ছোকরা হামেশাই একটু সায়েবি ঘেঁষা ছিল বলে আমরা বাংলাতে কথা কইবার সময়ও সিনহা বলতুম)। লোকটি অসাধারণ পণ্ডিত এবং সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর দৈনন্দিন সর্ব সমস্যা সম্বন্ধে অহরহ সচেতন। এ সমন্বয় সচরাচর চোখে পড়ে না।
আশকথা পাশকথার পর আমিই বললুম, বিবিসির জর্মন কর্মচারীদের উচ্চারণ জর্মনি থেকে সম্প্রসারিত খাস জর্মন বেতারবাণীর চেয়ে ভালো। প্রিয় অসত্য আমি যে একেবারেই বলিনে তা নয়, কিন্তু প্রিয় সত্য বলবার সুযোগ পেলে আত্মপ্রসাদ হয় ঢের ঢের বেশি।
হিটলার বরিশালের লোক। অর্থাৎ বরিশালের লোক কলকাতার ভাষা বলতে গেলে যে রকম তার কথায় আড় থেকে যায়, হিটলারের পোশাকি জৰ্মনে তেমনি শুধু আড় নয়, তার জন্মভূমি অস্ত্রীয় উপভাষার বোটকা গন্ধ পাওয়া যেত। হিটলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও যাননি, শিক্ষিত আচার্য পণ্ডিতদের তিনি দু চোখে দেখতে পারতেন না, তদুপরি নতুন ভাষা বাবদে তিনি ছিলেন মোল আনা অগা। (মুসসোলিনি চমৎকার জর্মন বলতে পারতেন এবং একমাত্র তার সঙ্গেই কথা কইতে তাঁর দোভাষীর প্রয়োজন হত না। ওদিকে আবার স্তালিনের রুশ উচ্চারণে ককেশাসের শুরুভার ছিল বলে তিনি লেকচরবাজি করতে ভালোবাসতেন না কিন্তু এৎস্কি ছিলেন বহু ভাষায় অসাধারণ পণ্ডিত। কাজেই এসব উল্টোপাল্টা নমুনা থেকে আমি কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পারিনি। হিটলার যখন রাজ-রাজেশ্বর হয়ে গেলেন তখন যে তার চেলাচামুণ্ডারা শুধু তার উচ্চারণ নকল করতে আরম্ভ করলেন তাই নয়, তারই মতো কর্কশ গলায় (হিটলার টনৃসিলে ভুগতেন) দাবড়ে দাবড়ে কথা বলতে আরম্ভ করলেন– এক গ্যোবেলস্ ছাড়া। জর্মনির খানদানি শিক্ষিত পরিবারে যে ঋজু, স্বচ্ছ, চাঁচাছোলা উচ্চারণ প্রচলিত ছিল, অধ্যাপকরা যে ভাষায় কথা বলতেন, থিয়েটার-অপেরাতে যে উচ্চারণ আদর্শ বলে ধরা হত, সেটা লোপ পাবার উপক্রম করল। যুদ্ধ লাগার পূর্বে এবং পরে যারা লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে বিবিসির জর্মন সেকশনের ভার নিল তারা প্রধানত ওইসব শ্রেণির বুদ্ধিজীবী। আজকের দিনে যারা হিটলারি রাজত্বের বারো বৎসরের দুঃস্বপ্ন যত তাড়াতাড়ি পারে ভুলে যেতে চায় তবু পুরনো দিনের অভ্যেস অত সহজে যাবে কেন?
তাই বিবিসি-র জর্মন উচ্চারণ এখন খাস জর্মনির চেয়ে খানদানি।
অভ্যাস যে সহজে যেতে চায় না তার উদাহরণ যত্রতত্র সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। বাঙলা দেশ থেকেই তার একটা অতি সাধারণ উদাহরণ দিয়ে আরম্ভ করি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে কাপড়ের কী অনটন পড়েছিল সে কথা আমরা ভুলিনি। তারই ফলে পাঞ্জাবির ঝুল কমে কমে প্রায় গেঞ্জির মতো কোমরে উঠে গিয়েছিল। তার পর লড়াই শেষ হওয়ার পর যখন বাজারে আর আদ্দির অভাব রইল না, তখনও কিন্তু স্কুল আর নামে না। ইতোমধ্যে ওইটেই হয়ে গিয়েছে ফ্যাশান!
ইংলন্ডেও তাই। সেই যে যুদ্ধের সময় কাপড়ের অভাবে মেয়েরা অল্প ঘেরের স্কার্ট বানাতে বাধ্য হয়েছিল আজ সেটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং তার ঘের এতই মারাত্মক রকমের অল্প যে বাসের পাদানিতে পা ভোলা যায় না। বাসের হ্যাঁন্ডিল ধরে মেম সায়েবদের লাফ দিয়ে একসঙ্গে দু পা তুলে বাসে উঠতে হয়। আমারই চোখের সামনে একদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। একটু ফুল সিম্ (আজকাল মোটা বলা অসভ্যতা– সেটা সংস্কৃত পদ্ধতিতে ফুল স্লিম বলাটা যে আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন তাঁকে বার বার নমস্কার!) মহিলা বাসে উঠতে গিয়ে লাফ না দিয়ে পুরুষদের মতো পা তুলতেই চড়চড় করে স্কার্টটি প্রায় ই-পার উস্-পার!
যাদের কম ঘেরের লুঙ্গি পরার অভ্যাস আছে তাদের নিশ্চয়ই এ অভিজ্ঞতাটি একাধিকবার হয়েছে প্রধানত লুঙ্গির বার্ধক্যে।