সাহিত্যজগতে কন্ধে পেয়েই এলিয়ট সন্তুষ্ট নন। তিনি আরও বহু কল্কে বহু জায়গায় পেয়েছেন। কিন্তু ইংলন্ডের সর্বোচ্চ এবং সর্বশেষ কল্কে ধর্মচক্রে কে না জানে সে দেশের রাজা বা রানির অন্যতম উঁদরেল উপাধি ডিফেন্ডার অব ফেৎ? স্বয়ং পোপ ইটি অষ্টম হেনরিকে দিয়েছিলেন। সেখানে কল্কে পাওয়া চাই-ই চাই।
এলিয়ট তার ধর্মবিশ্বাস পরিষ্কার ভাষাতেই প্রকাশ করেছেন সেটা তার কবিতার মতো তেষট্টি রকমের বোঝা এবং বোঝানো যায় না, এই রক্ষে। পাসকাল সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধর্মগুলোর ভিতর খ্রিস্টধর্ম, এবং তার ভিতরে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মই জগৎ এবং বিশেষ করে আধ্যাত্মজগতের সমস্যা এবং কার্যকারণ সর্বোত্তমভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে (টু অ্যাকাউন্ট, মোস্ট সেটিসফেকটরিলি ফর দি ওয়ার্লড অ্যান্ড স্পেশালি দি মরাল ওয়ার্ল্ড উইদিন)। যিশুখ্রিস্ট যে জলকে মদ্যরূপে পরিবর্তিত করেছিলেন, মৃতজনে প্রাণ দিয়েছিলেন এসব অলৌকিক কার্যকলাপে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি অ্যাংলো ক্যাথলিক গির্জায় (বিলাতের সরকারি, রাজরানির প্রতিষ্ঠান) গিয়ে পুজোপাঠ করেন, মন্ত্রপূত রুটি এবং মদের মাধ্যমে খ্রিস্টের সঙ্গে অশরীরীভাবে হরিহরাত্ম হন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাতে কারও কোনও আপত্তি থাকার নয়। আমাদের মডার্ন কবিরাও হয়তো ইতু ঘেঁটুর পুজো করেন, নজরুল ইসলাম আজ যদি মোল্লার কাছ থেকে পানি-পড়া তাবিজ-কবজ নিয়ে ব্যামো সারাতে চান তবে আমরা উল্লাসই অনুভব করব– ডাক্তার-কবরেজ তো হার মেনেছেন কিন্তু এ বাবদে একটা প্রশ্ন স্বভাবতই উদয় হয়।
গোঁড়া ক্যাথলিকরা বিশ্বাস করেন, অ-খ্রিস্টানরা অনন্ত নরকের আগুনে জ্বলবে। গোড়া মুসলমানরা অতখানি ঠিক করেন না তাদের মতে কোনও অনৈসলামিক ধর্মের মূলতত্ত্ব (ফান্ডামেন্টালস্) যদি ইসলামের সঙ্গে মেলে তবে সে ধর্মের লোক স্বর্গে না গেলেও অনন্ত নরকে জ্বলবে না। এখন প্রশ্ন এলিয়ট কি বিশ্বাস করেন, তাঁর বাঙালি হিন্দু-মুসলমান চেলারা অনন্ত নরকের আগুনে রোস্ট মটন কিংবা তন্দুরি মুরগি ভাজা হবে, যারা তাঁর সঙ্গরস পেয়েছেন তারা যদি বাৎলে দেন, তবে উপকৃত হব।
কিন্তু ইহুদিদের সম্বন্ধে এলিয়ট তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। পাঠক স্মরণ রাখবেন, ইহুদির ধর্মগ্রন্থ প্রাচীন নিয়ম (ওল্ড টেসটামেন্ট) খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থও বটে এবং খ্রিস্টানদের একেশ্বরবাদ, প্রতিমাবর্জন, স্বৰ্গনরক, শেষ বিচার, গির্জার প্রার্থনা-পদ্ধতি ইহুদিদের কাছ থেকে নেওয়া, এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট ইহুদিসন্তান– মথিলিখিত সুসমাচারের আরম্ভই যিশুর কুলজি নিয়ে; তিনি ইহুদিদের বংশপিতা আব্রাহামের (ইব্রাহিমের) বংশধর।
এলিয়ট আদর্শ সমাজব্যবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, যে সে আদর্শ সমাজে রক্ত ও ধর্ম এই দুয়ে মিলে মুক্তচিন্তাশীল ইহুদিদের (আদর্শ সমাজে) বেশি সংখ্যায় থাকা অবাঞ্ছনীয়।
(Reasons of race and religion combine to make any large number of free-thinking Jews undesirable)
সোজা বাংলায় প্রকাশ করতে গেলে দাঁড়ায় :- যেমন মনে করুন রবীন্দ্রনাথ যদি বলে যেতেন, পারসিদের ধর্ম এবং রক্ত আলাদা (এবং এটাও লক্ষণীয় যে, ইহুদি ও পারসি উভয় সম্প্রদায়ই বিত্তশালী); এ দুয়ে মিলে গিয়ে এমনই এক বিপর্যয় ঘটেছে যে এদের থেকে বেশি লোক ভারতীয় সমাজে থাকুক এটা বাঞ্ছনীয় নয়!!!
অ্যান্টনি ইডনের ভূমিকাসম্বলিত এলিয়টের যে লিটারেচার অব পলিটিকস্ বইয়ের পূর্বে উল্লেখ করেছি তাতে এলিয়ট চারজন কন্সারভেটিভ সাহিত্যিকের উল্লেখ করেন; বলিং, বার্ক, কোলরিজ এবং ডিজ্বরেলি। ডিজরেলির কথা বলতে গিয়ে এলিয়ট বলেছেন, হ্যাঁ, ইনি (এখানে বোধহয় এলিয়ট একটু থেমে গিয়ে মৃদু গলাখাকারি দিয়েছিলেন) একটা সাদামাটা পাস পেতে পারেন মাত্র; আমি অবশ্য গির্জার সদস্য গ্ল্যাডস্টনকেই পছন্দ করি বেশি।
সমালোচক উইলসন কাষ্ঠহাসি হেসে এ স্থলে বলেছেন, হ্যাঁ, একজন মুক্তচিন্তাশীল ইহুদি চললেও চলতে পারে, অবশ্য তিনি যদি কনসারভেটিভের স্বার্থে কাজ করেন।
অনেকটা রবিঠাকুর যেন বলেছেন, নৌরজী চললেও চলতে পারেন; আমি কিন্তু গোড়া টিলককেই পছন্দ করি।
এ-আলোচনা উঠেছিল যখন বিবিসি দর্শনে যাই-হাজার হোক এ-জীবনের চারটি বছর দিশি বেতারে নষ্ট করেছি তো!
.
পারস্যে প্রখ্যাত কবি মুশাররফ উদ্দীন বিন্ মুসলিহ উদ্দীন শেখ সাদীকে একদিন দেখা গেল ভর সন্ধেবেলা গোরস্তানের দেউড়ির সামনে। এ সময়টা মৃতের সদ্গতি-প্রত্যাশাকামী উপাসনার জন্য প্রশস্ত নয়; তাই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কবির এক বন্ধু তাকে দেখতে পেয়ে শুধালেন, অবেলায় এখানে কী করছেন, শেখ সায়েব? দীর্ঘ দাড়ি দুলিয়ে, দীর্ঘতর নিশ্বাস ফেলে বৃদ্ধ বললেন, আর বলল না ভাই, গেরো, গেরো। জানো তো অমুককে। আমার কাছ থেকে একশো তুমান ধার নিয়েছিল বছরটাক হয়ে গেল। ফেরত পাইনে। পাড়ায় পাড়ায় খেদিয়ে বেরিয়েও তাকে ধরতে পাইনে। তখন আমার গুরুভাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছে এখানে এসে অপেক্ষা করতে। গোরস্তানে নাকি সবাইকে একদিন আসতে হয়।
বিবিসি লন্ডন তথা ইংলন্ড, এমনকি লন্ডনাগত বিদেশি গুণী-জ্ঞানীর জ্যান্ত গোরস্তান। গাইয়ে, বাজিয়ে, নাট্যকার, বক্তৃতাবাজ, পাহাড়-চড়নে-ওলা, চোরের সেরা, ডাকাতের-বাড়া (এরাও ইন্টারভু দেয়) হেন প্রাণী নেই যে এখানে একদিন না একদিন না-আসে।