কিন্তু মশলাপুরাণ এখানেই সমাপ্ত নয়। সেটা পরে হবে।
ইতোমধ্যে আমি দুম করে প্রেমে পড়ে গেলুম।
কবিগুরু গেয়েছেন:
যদি পুরাতন প্রেম
ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে
তবু মনে রেখো।
কিন্তু এ আশা রাখেননি, সেই প্রথম প্রিয়াই পুনরায় তাঁর কাছে ফিরে আসবে। আমার কপাল ভালো।
লাঞ্চ সেরে মৃদুমন্থরে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে বসেই দেখি বেঞ্চির অন্য প্রান্তে যে মেয়েটি বসেছিল সে জ্বলজ্বল করে আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমার দুশমনরা তো জানেনই, এস্তেক পোস্তরাও জানেন, আমি কন্দর্পকিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে জন্মাইনি। তদুপরি বয়স যা হয়েছে তার হিসাব নিতে গেলে কাঠাকালি বিঘেকালি বিস্তর আঁক কষাকষি করতে হয়। সর্বশেষে সেটা ভগ্নাংশে না ত্রৈরাশিকে দিতে হবে তার জন্য প্লাশেৎ মারফত ঈশ্বর সুকুমার রায়কে নন্দনকানন থেকে এই য ব ন ভূমিতে নামাতে হবে!
অবশ্য লক্ষ করেছিলুম, আমি ওর দিকে তাকালেই সে ঝটিতি ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। রোমান্টিক হবার চেষ্টাতে বলেছিলুম, মেয়েটি। কিন্তু তার বয়স হবে নিদেন চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ– এমনকি পঞ্চাশও হতে পারে। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে। বিদগ্ধ পাঠকের অতি অবশ্যই স্মরণে আসবে, বৃদ্ধ চাটুয্যে মশাই যখন প্রেমের গল্প অবতারণা করতে যাচ্ছে তখন এক চ্যাংড়া বক্রোক্তি করে বলেছিল, চাটুয্যে মশাই প্রেমের কী-বা জানেন। মুখে যে কটা দাঁত যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছে তাই নিয়ে প্রেম!
চাটুয্যে মশাই দারুণ চটিতং হয়ে যা বলেছিলেন তার মোদ্দা : ওরে মূর্খ! প্রেম কি চিবিয়ে খাবার বস্তু যে দাঁতের খবর নিচ্ছিস! প্রেম হয় হৃদয়ে!… একদম খাঁটি কথা। ভলতের, গ্যোটে, আনাতোল ফ্রাঁস, হাইনে আমৃত্যু বিস্তর বিস্তরবার ফটু ফট করে নয়া নয়া স্ত্রী পরীর সঙ্গে প্রেমে পড়েছেন। এই সোনার বাঙলাতেও দু একটি উত্তম দৃষ্টান্ত আছে। তা হলে আমিই-বা এমন কি ব্রহ্মহত্যা করেছি যে ফুট করে প্রেমে পড়ব না।
বললে পেত্যয় যাবেন না, অকস্মাৎ একই মুহূর্তে একে অন্যকে চিনে গেলুম। যেন আকাশে বিদ্যুৎ বহ্নি পরিচয় গেল লেখি।
একসঙ্গে আমি চেঁচালুম লটে।
সে চেঁচালে হ্যার সায়েড।
তার পর চরম নির্লজ্জার মতো সেই প্রশস্ত দিবালোকে সর্বজন সমক্ষে আমাকে জাবড়ে ধরে দুই গালে ঝপাঝপ এক হর বা দুই টন চুমো খেল।
সুশীল পাঠক, সচ্চরিত্র পাঠিকা, মায় দেশের মরালিটি রক্ষিণী বিধবা পদীপিসি এতক্ষণে একবাক্যে নিশ্চয়ই নাসিকা কুঞ্চিত করে দ্যা, ছ্যা বলতে আরম্ভ করেছেন। আমি দোষ দিচ্ছিনে। এ-স্থলে আম্বো তাই করতুম– যদি-না নাটকের হেরোইন আমার প্রিয়া লটে (তোলা নাম শার্লট) হত। বাকিটা খুলে কই।
ওর বয়স যখন নয়-দশ, আমার বয়স ছাব্বিশ। আমি বাস করতুম ছোট গোডেসবের্গ টাউনের উত্তরতম প্রান্তে লটেদের বাড়ির ঠিক মুখোমুখি। ওদের পাশে থাকত দুই বোন গ্রেটেক্যাটে। আরও গোটা পাঁচেক মেয়ে তাদের বাড়ির পরে। কারওই বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়।
লটে ছিল সবচেয়ে ছোট।
আমার জীবনের প্রথম প্রিয়া।
আর সব কটা মেয়ে এ তথ্যটা জানত এবং হয়তো অতি সামান্য কিছুটা হিংসে হিংসে ভাব পোষণ করত। ওদের আশ্চর্য বোধ হত হয়তো, যে লটে তো ওদের তুলনায় এমন কিছু শুলেবাকাওলি নয় যে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এসে আমি এরই প্রেমে মজে যাব। এটা অবশ্য আমি বাড়িয়ে বলছি। প্রেমে মজার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমার বয়স ছাব্বিশ, ওর নয় কি দশ।
আসলে ব্যাপারটি কী জানেন? জর্মনদের ভিতরে যে চুল অতিশয় বিরল, লটের ছিল সেই চুল। দাঁড়কাকের মতো মিশমিশে কালো একমাথা চুল। ঠিক আমার মা-বোনদের চুলের মতো। ওর চুলের দিকে তাকালেই আমার মা-বোনদের কথা, দেশের কথা মনে পড়ত। আর লটে ছিল আমার বোনদের মতো সত্যই বড় লাজুক। সক্কলের সামনে, নিজের থেকে, আমার সঙ্গে কখনও কথা বলত না।
আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একচিলতে গলি। সেখানে রোজ দুপুর একটা-দুটোয় আমরা ফুটবল খেলতুম। আমার বিশ্বাস তুমি পাঠক, আমাদের সে টিমের নাম জানো না। আমিও অপরাধ নেব না। আমরা যে আইএফএ শিলডে লড়াই দেবার জন্য সে আমলে ভারতবর্ষে আসিনি তার মাত্র দুটি কারণ ছিল। পয়লা: অতখানি জাহাজ ভাড়ার রেস্ত আমাদের ছিল না। এবং দোসরা : আমাদের কাইজার টিম-এ পুরো এগারো জন মেম্বর ছিলেন না। আমরা ছিলুম মাত্র আষ্টো জন। তৃতীয়ত, যেটা অবশ্য আমাদের ফেভারেই যায়, আমাদের ফুটবলটি ছিল অনেকটা বাতাবি নেবুর মতো। ওরকম ফুটবল দিয়ে কি সমদ, কি জুম্মাখান কখনও প্যাটার্ন-উইভিং ড্রিবলিং উজিং ডাকিঙের সুযোগ পাননি।
হায়, হায়! এ জীবনটা শুধু সুযোগের অবহেলা করে করেই কেটে যায়। এসব আত্মচিন্তা যে তখন করেছিলুম তা নয়।
চল্লিশ বছর পর পুনরায় এই প্রথম আমাদের পুনর্মিলন। লটে হঠাৎ শুধাল, হার সায়েড! তুমি বিয়ে করেছ?
শুনেছি ইহুদিরা নিতান্ত গঙ্গাযাত্রার জ্যান্ত মড়া না হলে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন শুধিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা দেয়। আমি শুধলুম, তুই?
খলখল করে হেসে উঠল।
কেন? আমার আঙুলে এনগেজমেন্ট রিং, বিয়ের আংটি দুটোই এখনও তোমার চোখে পড়েনি। আমি তো দিদিমা হয়ে গিয়েছি। চলো আমাদের বাড়ি।