বিজনেস ইজ বিজনেস–তাই সুইসরা পর্যন্ত তাদের রান্নাতে প্রাচ্যদেশীয় মশলা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে।
আমার কাছে একখানা সুইস সাপ্তাহিক আসে। তার কলেবর প্রায় ষাট পৃষ্ঠা। একদা কেউ ল্যাটে এলে আমরা ঠাট্টা করে বলতুম কী বেরাদর, কেপ অব গুড হোপ হয়ে এলে নাকি?– সুয়েজ কানাল যখন রয়েছে। এখন কিন্তু এটা আর মস্করা নয়। অ্যার মেলের কথা অবশ্য ভিন্ন। কিন্তু ষাট পৃষ্ঠা বপুধারী পত্রিকা তো আর অ্যার মেলে পাঠানো যায় না। খর্চা যা পড়বে সেটা সাপ্তাহিকের দাম ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দিতে বলে লড়কে সে, লড়কার গু ভারী বাচ্চাটার ওজনের চাইতে তার মলের ওজন বেশি।
সেই পত্রিকার একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগ আছে। কেউ শুধোল, মাংস আলু তরকারিসহ নির্মিত ভোজনের মেন তিশ (পিয়েস দ্য রেজিসাস) খাওয়ার পর যেটুকু তলানি সম্ (শুকনো ঝোল, কলকাত্তাইয়ারা কাইও বলে থাকে) পড়ে থাকে তার উপর পাউরুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে কাঁটা দিয়ে সেগুলো নাড়িয়ে চাড়িয়ে চেটেপুটে খাওয়াটা কি প্রতোকোলসম্মত– এটিকেট মাফিক, বেয়াদবি অভদ্রস্থতা নয় তো!
উত্তর : পৃথিবীতে এখন এমনই নিদারুণ খাদ্যাভাব যে ওই সসটুকু ফেলে দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই (অবশ্য তার সঙ্গে রুটির টুকরোগুলোও যে গেল সে বাবদে বিচক্ষণ উত্তরদাতা কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। কারণ রুটিটি পরের ভোজনেও কাজে লাগত কিংবা গরিব-দুঃখীকে বিলিয়ে দেওয়া যেত— এঁটো প্লেটের তলানি সস তো পরবর্তী ভোজনের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যায় না, কিংবা গরিব-দুঃখীকেও বিলানো যায় না– লেখক) তার পর তিনি বলছেন, কিন্তু আপনি যদি নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও যান তবে এই কার্পণ্যটি করবেন না। তার মানে আপনার বাড়ির বাইরের এটিকেট যেন বাড়ির ভিতরের চেয়ে ভালো হয়। আমি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নমত ধরি। আমার মতে বাড়ির এটিকেট, আদবকায়দা যেন বাইরের চাইতে ঢের ঢের ভালো হয়।
প্রশ্ন: কোহিনূর প্রস্তর কোন ভাষার শব্দ?
উত্তর : ফারসি।
(সম্পূর্ণ ভুল নয়। কোহ= পাহাড়–ফার্সিতে যেমন কাবুলের উত্তর দিকে কোহিস্তান রয়েছে [ আমার সখা আব্দার রহমান ওই কোহিস্তানের লোক] কিন্তু কোহ-ই-নূরের নূর শব্দটি ন সিকে আরবি। খাঁটি ফারসিতে যদি বলতেই হয় তবে নূর-এর বদলে রওশন বা রোশনি বাংলায় রোশনাই] ব্যবহার করে বলতে হয় কোহ-ই-রওশন। শুদ্ধ আরবিতে বলতে হলে জবলুন (পাহাড়) নূর।… কিন্তু এ রকম বর্ণসঙ্কর সমাস সর্বত্রই হয়ে থাকে। দিল্লীশ্বর ইত্যাদি।)।
প্রশ্ন : আমার বয়স বত্রিশ; আমি বিধবা। আমার মোললা বছরের ছেলের একটি সতেরো বছরের ভেরি ডিয়ার ক্লাসফ্রেন্ড প্রায়ই আমাদের এখানে আসে। কিন্তু কিছুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা জমাবার চেষ্টা করছে। আমি করি কী?
উত্তর : আপনি ওকে সঙ্গোপনে নিয়ে গিয়ে বলুন, তুমি তোমার অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে প্রেমট্রেম করো। আমি তোমার মায়ের বয়সী। তোমার বয়েসী মেয়ের তো কোনও অভাব নেই। কিন্তু, আমার মনে হয়, ছেলেটার বোধহয় মাদার কমপ্লেকস আছে– অতি অল্প বয়সেই তার মা গত হন। কাজেই সে একটি মায়ের সন্ধানে আছে– তার পর আরও নানাপ্রকারের হাবিজাবি ছিল।
এ উত্তর যে কোনও গো-গর্দভ দিতে পারত।
কিন্তু এ প্রশ্নোত্তরমালা নিতান্তই অবতরণিকা মাত্র।
***
কয়েক মাস পূর্বে মনে হল– একটি প্রাচীনপন্থী মহিলা–প্রশ্ন শুধোলেন : আজকালকার ছেলে-ছোকরা এমনকি মেয়েরাও বড় বেশি মশলাদার খানা খাচ্ছে। আমি গ্রামাঞ্চলে থাকি। সেদিন বাধ্য হয়ে আমাকে শহরে যেতে হয়। যদি জানতুম, শহরের মাই লর্ড রেস্তোরাঁওয়ালারা কী জঘন্য ঝাল, মাস্টার্ড (আমাদের কাসুন্দো– লেখক) আর মা মেরিই জানেন কী সব বিদকুটে বিদকুটে বিজাতীয় মশলা দিয়ে যাবতীয় রান্না করেন, তবে কি আমি সে রেস্তোরাঁয় যেতুম! এক চামচ সুপ মুখে ঢালা মাত্রই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত হতে লাগল। আমার কপালে সেই শীতকালে, ঘাম জমতে লাগল। মনে হল, আমার জিভে যেন কেউ আগুন ঠেলে দিয়েছে। আমার চোখ থেকে যা জল বেরুতে আরম্ভ করল সেটা দেখে আমার কাছেরই একটি সহৃদয় প্রাইভিট শুধাল মাদাম, আমি বহু দেশ-বিদেশ দেখেছি যেখানে টিয়ার গ্যাস ছাড়া হয়; কিন্তু আমাদের এই সুইটজারল্যান্ডে তো কখনও দেখিনি। শোকাতুরা হয়ে কান্না করলে রমণীর চোখে অশ্রুজল বেরোয়, এটা তো তা নয়।
একদা সুইস কাগজে প্রশ্ন বেরোল: এই যে আমরা প্রতিদিন আমাদের রান্নাতে মশলার পর মশলা বাড়িয়েই চলেছি এটা কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো?
সেই সবজান্তা উত্তরিলা :
মাত্রা মেনে খেলে কোনও আপত্তি নেই। কোনও বস্তুরই বাড়াবাড়ি করতে নেই। (মরে যাই! এই ধরনের মহামূল্যবান উপদেশ পাড়ার পদীপিসি, ইস্কুলবয় সবাই দিতে পারে– লেখক)। তার পর সবজান্তা বলছেন, ডাক্তারদেরও আধুনিক অভিমত, মেকদার মাফিক মশলাদার খাদ্য ভোজনস্পৃহা আহাররুচি বৃদ্ধি করে। তদুপরি আরেকটা গুরুত্বব্যঞ্জক তত্ত্ব আছে। আপনি যদি আপনার ভোজন ব্যাপারে সর্বক্ষণ এটা খাব না ওটা ছোঁব না– এ রকম পুতুপুতু করে আপনার ভোজনযন্ত্রটিকে ন সিকে মোলায়েম করে তোলেন (ইংরেজিতে একেই বলে মলিকল করেন) তবে কী হবে? আপনি যতই চেষ্টা দিন না কেন, আপন বাড়িতে তৈরি মশলা বিবর্জিত রান্নামাত্রই খাব তথাপি ইহসংসারে বহুবিধ ফাড়া-গর্দিশ আছে যার কারণে আপনাকে হয়তো কোনও রেস্তোরাঁতে এক বেলা খেতে হল। কিংবা মনে করুন, আপনি নিমন্ত্রিত হলেন। শক্তসমত্ত জোয়ান আপনি। কী করে বলবেন আপনি ডায়েটে আছেন? ওদিকে রেস্তোরাঁ বলুন, ইয়ার বখশির বাড়িই বলুন সর্বত্রই সর্বজন শনৈঃ শনৈঃ গরম মশলার মাত্রা বাড়িয়ে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। পরের দিন আপনি কাৎ। অতএব আমাদের সবজান্তা বলছেন, কিছু কিছু মশলা খেয়ে নেওয়ার অভ্যাসটা করে ফেলাই ভালো।