তা সে থাক, তা সে যাক্। পরনিন্দা মহাপাপ। এখানেই ক্ষান্ত দিই। বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই খিটখিটে হয়ে যায়।
পুরনো কথায় ফিরে যাই। ডাচেস অব উইনজার নাকি তার লাঞ্চ ডিনারে নিমন্ত্রিতজনকে কখনও সুপ পরিবেশন করেন না। অতিশয় অভিজ্ঞতালব্ধ তাঁর বক্তব্য : এই যে বাবুরা এখন ডিনার খেতে যাবেন তার আগে তেনারা গিলেছেন গ্যালন গ্যালন ককটেল হুইস্কি। জালা জালা সেরি, পোর্ট। সক্কলেরই পেট তরল বস্তুতে টইটম্বুর ছয়লাপও বলতে পারেন। ডাচেসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত সুচিন্তিত অভিমত : এর পরেও যদি হুজুররা তরল দ্রব্য সুপ পেটে ঢোকান তবে, তার পর আর রোস্ট ইত্যাদি নিরেট সলিড দ্রব্য খাবেন কী প্রকারে? তাই তার ডিনারে নো সুপ! অবশ্য ডাচেস সহৃদয়া মহিলা। কাজেই যারা নিতান্তই সুপাসক্ত তাদের জন্য সুপ আসে। ওদেরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তিনিও মাঝে মাঝে দু চার চামচ সুপ গলাতে ঢালেন।
অতএব আমাকেও নিতান্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য হুমবল্ট স্টিফটুঙ্গ প্রদত্ত লাঞ্চে কিঞ্চিৎ সুপ সেবন করতে হল।
বাহ! উত্তম সুপ! ব্যাপারটা তাহলে ভালো করে বুঝিয়ে বলি।
যেসব দেশের কলোনি নেই– বিশেষত ভারত, সিংহল কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় তারা গরম মশলা পাবে কোত্থেকে? কেনার জন্য অত রেস্ত কোথায়? শত শত বৎসর ধরে তাদের ছোঁকছোঁকানি শুধু গোলমরিচের জন্য! শুনেছি ভাস্কো দা গামা ওই গোলমরিচের জন্য অশেষ ক্লেশ করে দক্ষিণ ভারতে এসেছিলেন। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, কলমস নাকি ওই একই মতলব নিয়ে সাপ খুঁজতে গিয়ে কেঁচো পেয়ে গেলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন। এর পর ইয়োরোপীয়রা দক্ষিণ আমেরিকায় ঝাল লাল লঙ্কা আবিষ্কার করল, কিন্তু ওটা ওদের ঠিক পছন্দ হল না! যদ্যপি আমরা ভারতীয়রা সেটি পরমানন্দে আলিঙ্গন করে গ্রহণ করলুম।
ইতিহাস দীর্ঘতর করব না।
ইতোমধ্যে জর্মনির এতই ধনদৌলত বেড়ে গিয়েছে যে, এখন সে শুধু কালা মরিচ কিনেই পরিতৃপ্ত নয়– এখন সে কেনে দুনিয়ার যত মশলা। বিশেষ করে কারি পাউডার আর লবঙ্গ, এলাচি, ধনে ইত্যাদির তো কথাই নেই। তবে কি না আমি কন্টিনেন্টের কুত্রপি কাঁচা সবুজ ধনেপাতা দেখিনি। কিন্তু ভয় নেই, কিংবা ভয় হয়তো সেখানেই। যেদিন কন্টিনেন্টের কুবের সন্তানরা ধনেপাতা-লঙ্কা-তেঙুল তেলের চাটনির সোয়াদটি বুঝে যাবেন সেদিন হবে আমাদের সর্বনাশ। হাওয়াই জাহাজের কল্যাণে কুল্লে ধনেপাতা হিল্লি-দিল্লি হয়ে চলে যাবেন কাঁহা কাঁহা মুলুকে। এটা তো এমন কিছু নয়া অভিজ্ঞতা নয়। ভারত-বাঙলা দেশের বহু জায়গাতেই আজ আপনি আর চিংড়ি মাছ পাবেন না। টিনে ভর্তি হয়ে তারা আপনার উদরে না এসে সাধনোচিত ধামে (অর্থাৎ কন্টিনেন্টে- যেখানে চিংড়ি মাছ কেন, সর্বভারতীয় যুবকই যেতে চায়) প্রস্থান করেন। একমাত্র কোলাব্যাঙ সম্বন্ধেই আমাদের কোনও দুঃখ নেই। যাক যত খুশি যাক। ওটা ফরাসিদের বড়ই প্রিয় খাদ্য। তবে কি না বাঙালোর থেকে তারস্বরে এক ভদ্রলোকে প্রতিবাদ করেছেন : পাইকিরি হিসেবে এভাবে কোলাব্যাঙ বিদেশে রফতানি করায় ওই অঞ্চলে মশার উৎপাত দুর্দান্তরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ওই কোলাব্যাঙরাই মশার ডিম খেয়ে তাদের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করত।
এটা অবশ্যই একটা সমস্যা দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমার ভাবনা কী? আমার তো একটা মশারি আছে।
.
গুরমে ভোজনরসিকরা বলেন সুইটজারল্যান্ডের জর্মনভাষী অঞ্চলের খাদ্যই সবচেয়ে ভোতা। অথচ নেপোলিয়ন না কে যেন বলেছেন, ইংরেজ এ নেশন অব শপকিপারজ (অবশ্য ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে সাকী নামক ছদ্মনামের এক অতিশয় সুরসিক ইংরেজ লেখক বলেন, আমরা এখন এ নেশন অব শপলিফটারজ অর্থাৎ লেখক বলেন, আমরা এখন দোকানের ভিড়ে চটসে এটা-ওটা চুরি করতে ওস্তাদ) এবং সুইসরা এ নেশন অব হোটেলকিপারস। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাবৎ ইয়োরোপে সুইসরাই পরিচ্ছন্নতম হোটেল রাখে। কিন্তু প্রশ্ন : তোমরা হোটেল-রেস্তোরাঁ যতই সাফসুতরো রাখো না কেন, তোমার রেস্তোরাঁর সুপে ব্লন্ড, ব্রুনেট, কালো চুল না পাওয়া গেলেও (দিনের পর দিন তিন রঙের চুল আবিষ্কার করতে করতে আমার এক মিত্র–সুইটজারল্যান্ডে নয়, অন্য এক নোংরা দেশের হোটেলে একদিন ম্যানেজারকে শুধোলেন, আপনার রান্নাঘরে তিনটি পাচিকা আছেন; না? একজনের চুল ব্লভ, অন্য জনের নেট এবং তেসরা জনের কালো। নয় কি? ম্যানেজার তো থ! এই ভদ্রলোকই কি তবে শার্লক হোমসের বড় ভাই মাইক্রফট হোমস? সবিনয়ে তথ্যটা স্বীকার করে শুধোলে, স্যর, আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমাদের রসুইখানায় কখনও পদার্পণ করেননি! বন্ধু বললেন, সুপে কোনও দিন ব্লন্ড, কখনও-বা নেট এবং কালো চুল পাই– কালোটাই পাতলা সুপে চোখে পড়ে বেশি। এ তত্ত্বে পৌঁছবার জন্য তো দেকার্ত কান্ট-এর দর্শন প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি ওই কালো চুলউলিকে যদি দয়া করে বলে দেন, সে যেন আর পাঁচটা হোটেলের পাঁচজন পাঁচকের মাথায় যে রকম টাইট সাদা টুপি পরা থাকে ওইরকম কোনও একটা ব্যবহার করে। আমার মনে হয় ওর মাথায় দুর্দান্ত খুসকি–পাঠক অপরাধ নেবেন না, এ কেচ্ছাটা বলার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলুম না।) সুন্ধুমাত্র সুইস হোটেলের সুপমধ্যে হরেকরকম্বা চুল নেই বলেই যে দুনিয়ার লোক হদ্দমু হয়ে সে দেশে আসবে এ-ও কি কখনও সম্ভব? আমার সোনার দেশ পুবপচ্ছিমওতর বাঙলায় সুপ তৈরি হয় না। অতএব প্লাটিনাম ব্লন্ড, সাদামাটা ব্লন্ড, চেশমাট ব্রাউন, মোলায়েম ব্রাউন, কালো-মিশকালো কোনও রঙের কোনও চুলের কথাই ওঠে না। মোটেই মা রাধে না, তার তপ্ত আর পান্তা। কিংবা বলতে পারেন, হাওয়ার গোড়ায় রশি বাধার মতো। তাই বলে কি মার্কিন-সুইস টুরিস্ট এ দেশে আসে না।