(১) এ তো বড় আশ্চর্য! ষাট বছর বয়সের প্রাচীন প্রিয়ার অভিসারে যাচ্ছে এই নাগর।
কিংবা
(২) এর এক-প্রিয়া-নিষ্ঠতাকে তো ধন্যি মানতে হয়। (রামচন্দ্রকে বলা হয় একদারনিষ্ঠ।)
ইতোমধ্যে কর্তা বললেন, সে কী কথা! আপনি আসবেন না, সে তো হতেই পারে না। আপনার ভাষায়ই বলি আপনার মতো মিউজিয়ম পিস আমাদের কর্তাব্যক্তিদের গুণীজ্ঞানীদের দেখাতে পারব না, সে কি একটা কাজের কথা হল? ওনাদের অনেকেই ভাবেন, আমাদের আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট স্টিফটুঙ বুঝি পরশু দিনের বাচ্চা অথচ আমাদের প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন কবে সেই ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে– অবশ্য যুদ্ধের ফলস্বরূপ জর্মনি যখন তছনছ হয়ে গেল তখন কয়েক বৎসর প্রতিষ্ঠান দেউলে হয়ে রইল। এদের আমি দোষ দিইনে– সব জর্মনই তো ঐতিহাসিক মমজেন হয় না। অতএব চল্লিশ বছরের পূর্বেকার জলজ্যান্ত একজন বৃত্তিধারীকে যদি ওদের সামনে তুলে ধরতে পারি, তখন হুজুরদের পেত্যয় যাবে–
আমি মনে মনে বললুম, ঈশ্বর রক্ষতু। যাদুঘরে যে রকম পেডেস্টাইলের উপর গ্রিক মূর্তি খাড়া করে রাখে, সে রকম নয় তো! তা করুক, কিন্তু জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে লজ্জা নিবারণার্থে কুল্লে একখানা ডুমুরপাতা পরিয়ে দিলেই তো চিত্তির–
কর্তা বলে যেতে লাগলেন, আপনি পরবের সময় কন্টিনেন্টে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা সানন্দে আপনাকে একখানা রিটার্ন টিকিট পাঠিয়ে দেব। এখানে হোটেলের ব্যবস্থা, যানবাহন সবই তো আমরা করে থাকি। তার পর আপনি ফিরে যাবেন আপন মোকামে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন, আপনি কি মাত্র তিনটি দিনও শেয়ার করতে পারবেন না… আচ্ছা, তবে এখন চলুন আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে।
বড্ডই নেমকহারামি হয়। তদুপরি এরা আমাকে দুই যুগ পরে আবার নেমক দিতে চায়। একদা যে প্রতিষ্ঠান যে জর্মন জাত এই তরুণকে স্কলারশিপ-নেমক দিয়েছিল, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদেরকে নিরাশ করি কী প্রকারে?
আমি সকৃতজ্ঞ পরিপূর্ণ সম্মতি জানালুম।
***
রেস্তোরাঁটি সাদামাঠা, নিরিবিলি, ছোটখাটো, ঘরোয়া। ব্যান্ডবাদ্যি, জ্যাজম্যাজিক, খাপসুরুৎ তরুণীদের ঝামেলা, কোনও উৎপাতই নেই। বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে এ রেস্তোরাঁতে আসেন নিকটস্থ আপিস-দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। তার অন্যতম প্রধান কারণ মেনু (খাদ্যনির্ঘন্ট) দেখেই আমার চক্ষুস্থির। তৃরিতেই হিসাব করে দেখলুম এখানে অতি সাধারণ লাঞ্চ খেতে হলেই নিদেন পনেরো মার্ক লাগার কথা। আমাদের হিসাবে তিনখানা করকরে দশ টাকার নোট। অবশ্য গচ্চাটা আমাকে দিতে হবে না। কারণ ওঁরা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। এবং এ দেশের রেস্তোরাঁতে যে ব্যক্তি অর্ডার দিল সেই পেমেন্ট করবে– যে খেলো তার কোনও দায় নেই।
কিন্তু এ স্থলে সেটা তো কোনও কাজের কথা নয়।
যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন তারা আমাকে মেনু এগিয়ে দিয়ে বলেছেন, কী খাবেন, বলুন। আমি কি তখন তাদের ঘাড় মটকাব!
আমি শুধোলুম, আপনারা কি এই রেস্তোরাঁতেই প্রতিদিন লাঞ্চ খেতে আসেন?
এজ্ঞে হ্যাঁ।
কী খান, মানে, কোন কোন পদ?
সুপ মাংস আর পুডিং। কখনও-বা আইসক্রিম– তবে সেটা বেশিরভাগ গ্রীষ্মকালে। মাঝে-মধ্যে শীতকালেও।
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, শীতকালে আইসক্রিম।
তখন আমার মনে পড়ল আমরাও তো দারুণ গরমের দিনে গরমোতর চা খাই তবে এরাই-বা শীতকালে আইসক্রিম খাবে না কেন?
আমি অতিশয় সাদামাঠা লাঞ্চ অর্ডার দিলুম। যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তার গলা মটকাতে নেই।
.
১৫.
আহারাদির কেচ্ছা শুরু হলেই আমি যে বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই আমার সম্বন্ধে সে বদনাম এতই দীর্ঘকালের যে তার সাফাই এখন বেবাক তামাদি– ইংরেজি আইনের ভাষায় টাইম-বার না কী যেন বলে হয়ে গিয়েছে। তাই পাঠক ধর্মাবতারের সমুখে করজোড়ে স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি দোষী, অপরাধ করেছি।
কিন্তু আমি জাতক্রিমিনাল। আমার মিত্র এবং পৃষ্ঠপোষক জেল সুপারিনটেনডেন্ট তার একাধিক প্রামাণিক পুস্তকে লিখেছেন, এই বঙ্গদেশে জাতক্রিমিনাল হয় না। হুঃ! আমি জাতক্রিমিনাল সেটা জানার পূর্বেই তিনি এসব দায়িত্বহীন বাক্যবিন্যাস করেছেন। তাই আমি আবার সেই লাঞ্চের বর্ণনা পুনরায় দেব।
সুপ আমি বড্ড বেশি একটা ভালোবাসিনে।
এ বাবদে কিন্তু আমি সমুদ্রে বেলাভূমিতে সম্পূর্ণ একাকী নুড়ি নই। ডাচেস অব উইন্ডসর (উচ্চারণ নাকি উইনজার) অতি উত্তম রান্নাবান্না করতে পারেন। তা সে অনেকেই পারেন। কিন্তু তিনি আরেকটি ব্যাপারে অসাধাণ হুনুরি। ভোজনটি কী প্রকারে কমপোজ করতে হবে– এ তত্ত্বটি তিনি খুব ভালো করে জানেন।
অপরাধ নেবেন না। আমরা বাঙালি মাত্রই ভাবি ভোজনে যত বেশি পদ দেওয়া হয় ততই তার খানদানিত্ব বেড়ে যায়। তিন রকমের ডাল, পাঁচ রকমের চচ্চড়ি, তিন রকমের মাছ, দু-তিন রকমের মাংস, চিনিপাতা দই আর কত হরেক রকমের মিষ্টি তার হিসাব নাই-বা দিলুম।
আর প্রায় সবকটাই অখ্যাদ্য। কারণ, এতগুলো পদের জন্য তো এতগুলো উনুন করা যায় না, গোটা দশেক পাঁচক ডাকা যায় না। অতএব বেগুনভাজা মেগনেলিয়ার আইসক্রিমের মতো হিম, চিনিপাতা দই পাঞ্জাব মেলের এনজিনের মতো গরম, লুচি কুকুরের জিতের মতো চ্যাপটা, লম্বা, খেতে গেলে রবারের মতো। আজকাল আবার ফ্যাশন হয়েছে ঘি-ভাত বা পোলাওয়ের বদলে চীনা ফ্রাইড রাইস। চীনারা র উচ্চারণ করতে পারে না। অতএব বলে স্লাইড লাইস–অর্থাৎ ভাজা উকুন। তা সে যে উচ্চারণই করুক আমার তাতে কানাকড়ি মাত্র আপত্তি নেই। শুনেছি, মহাকবি শেক্সপিয়ার বলেছেন, গোলাপে যে নামে ডাকো গন্ধ বিতরে। তাই ফ্রাইড রাইস বলুন বা ফ্লাইড লাইসই বলুন–সোওয়াদটি উত্তম হলেই হল। কিন্তু আজকালকার কেটারাররা (হে ভগবান, এই সম্প্রদায়কে বিনষ্ট করার জন্য আমি চেঙ্গিস খান হতে রাজি আছি) নেটিভ পাঁচক দিয়ে ফ্লাইড লাইস নির্মাণ করেন। সত্য সত্য তিন সত্য বলছি, সে মহামূল্য সম্পদ জিহ্বা স্পর্শ করার পূর্বেই আপনি বুঝে যাবেন এই অভূতপূর্ব বস্তু উকুন ভাজা। আলবৎ, আমি নতমস্তকে স্বীকার করছি, উকুন ভাজা আমি এই কেটারার সম্প্রদায়ের অবদান– মেহেরবানির পূর্বে কখনও খাইনি। তাই গোড়াতেই বলেছি, আমরা মেনু কম্পোজ করতে জানিনে।