ডিজেলকে বললুম, দিদি, এসব জিনিস ওই বড় টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখ। আর খবর দে ডিটরিষ ও তার বউকে। মারিয়ানা আর তুই তো আছিসই। যার যা পছন্দ তুলে নেবে।
লিজেল বললে, এটা কি ঠিক হচ্ছে এখান থেকে তুই যাবি ডুসলডফেঁসেখানে তোর বন্ধু পাউল আর বউ রয়েছে। তার পর যাবি হামবার্গে; সেখানে তোর বান্ধবীর (তিনি গত হয়েছেন। তিনটি মেয়ে রয়েছেন। তার পর যাবি স্টুটগার্ট-এ। সেখানে রয়েছেন তোর ফার্স্ট লভ। এখানেই যদি ভালো ভালো সওগাত বিলিয়ে দিস তবে ওরা পাবে কী?…
একেই বঙ্গভাষায় বলে পাকা গৃহিণী। কোন গয়না কে পাবে জানে।
.
১২.
গডেসবের্গ সত্যই বড় সুন্দর। এ শহরের সৌন্দর্য আমাকে বার বার আহ্বান করেছে। রাস্তাগুলো খুবই নির্জন। এতই নির্জন যে পথে কারও সঙ্গে দেখা হলে, সে সম্পূর্ণ অচেনা হলেও আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, গুটেন টাহ। আপনিও তাই বলবেন। রাস্তার দু পাশে ছোট ছোট গেরস্তবাড়ি। সবাই বাড়ির সামনে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে তাতে ফুল ফুটিয়েছে। যদি কোনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ফুলগুলোর দিকে মুগ্ধনয়নে তাকিয়ে থাকেন তবে প্রায়ই বাড়ির কর্তা, কিংবা গিন্নি, কিংবা তাদের ছেলে-মেয়ের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনার সঙ্গে কথা জুড়ে বসবে। শেষটায় বলবে, আপনিও আমাদেরই একজন; কিছু ফুলটুল চাই? বলুন না, কোনগুলো পছন্দ হয়েছে। তার পর একগাল হেসে হয়তো বলবে, প্রেমে পড়েছেন নাকি? তা হলে লাল ফুল। হাসপাতালে রুগী দেখতে যাচ্ছেন নাকি, তা হলে সাদা ফুল। আমি একবার শুধিয়েছিলাম, আর যদি আমার প্রিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে থাকে, তা হলে কী ফুল পাঠাব? যাকে শুধিয়েছিলাম তিনি তখন দু গাল হেসে বলেছিলেন, সবুজ ফুল। সবুজ ঈর্ষার রঙ। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, সবুজ ফুল তো এদেশে দেখিনি কখনও। আমাদের দেশেও সবুজ ফুল একেবারেই বিরল। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও। কিন্তু আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সবুজ ফুল আছে। আমি এখুনি এনে দিচ্ছি। ও মশাই, দাঁড়ান, আমার সবুজ ফুলের তেমন কোনও প্রয়োজন নেই– ও মশাই–
কিন্তু কে-বা শোনে কার কথা!
মিনিট দুই যেতে না যেতেই সেই মহাত্মার পুনরাবির্ভাব। হাতে একটি সবুজ গোলাপ। চোখেমুখে যে আনন্দ তার থেকে মনে হল তিনি যেন বাকিংহাম প্রাসাদ কিংবা কুতুব মিনার কিংবা উভয়ই কুড়িয়ে এনেছেন। আমি বিস্তর ধন্যবাদ, ডাঙ্কে শ্যোন, ডাঙ্কে রেষট শ্যোন বলৈ অজস্র ধন্যবাদ জানালুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির দরজা খুলে গেল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের একটি মহিলা ডেকে বললেন, ওগো তোমার কফি।
হঠাৎ আমাকে দেখে কেমন যেন চুপসে গেলেন।
ভদ্রলোক বললেন, চলুন না। এক পাত্র কফি হেঁ হেঁ—
আমি বললুম, কিন্তু আপনার গৃহিণী?
না, না, না– আপনি চিন্তা করবেন না। আমার গৃহিণী খাণ্ডারিণী নয়। অবশ্য সে আপনাকে কখনও দেখেনি। চলুন চলুন।
বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক আমাকে কফি টেবিলের পাশে সযত্নে বসিয়ে বললেন, আপনাকে চল্লিশ বৎসর পূর্বে কত-না দেখেছি। আমার বয়েস তখন চৌদ্দ-পনের। কিন্তু ভয়ে আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারিনি
আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী?
এজ্ঞে আমি জানতুম, আপনি ইন্ডিয়ান। আর ইন্ডিয়ানরা সব ফিলসফার। তারা যত্রতত্র যার তার সঙ্গে কথা কয় না। তাই আপনি ধীরে ধীরে পা ফেলে যেতেন রাইন নদের পারে। আমি কত-না দিন আপনার পিছন পিছন গিয়েছি। আপনি একটি বেঞ্চিতে বসে রাইনের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতেন। তখন কি আর বিরক্ত করা যায়?
আমি বললুম, ব্রাদার, এটা বড় ভুল করেছ। তখন আমার সঙ্গে কথা কইলে বড়ই খুশি হতুম।
ইতোমধ্যে বাড়ির গৃহিণী কেক ইত্যাদি নিয়ে এসে আমাদের টেবিলে রাখলেন। তার গাল দুটো আরও লাল হয়ে গিয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে এবং তিনি হাঁপাচ্ছেন। অর্থাৎ এ পাড়ায় কোনও কেকের দোকান নেই বলে তিনি কুড়ি কুড়ি মিনিটের রাস্তা ঠেঙিয়ে কেক টার্ট নিয়ে এসেছেন।
এ স্থলে যে কোনও ভদ্রসন্তান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাফ চাইত। বলত, এ সবের কী প্রয়োজন ছিল? কিন্তু আমি চাইনি, আমাকে বেয়াদব মূর্খ যা খুশি বলতে পারেন।
আমি শুধু আমার পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তাঁর কপালটি মুছে দিলুম।
.
১৩.
ভ্রমণকাহিনী লিখতে লিখতে মানুষ আশকথা পাশকথার উত্থাপন করে। গুণীরা বলেন এটা কিছু দুষ্কর্ম নয়। সদর রাস্তা ছেড়ে পথিক যদি পথের ভুলে আশপথ পাশপথ, না যায় তবে অচেনা ফুলের নয়া নয়া পাখির সঙ্গে তার পরিচয় হবে কী প্রকারে? কবিগুরুও বলেছেন,
যে পথিক পথের ভুলে,
এল আমার প্রাণের কূলে—
অর্থাৎ প্রণয় পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমি যদি মাঝে-মধ্যে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি তবে সহৃদয় পাঠক অপরাধ নেবেন না।
***
আলেকজান্ডার ফন হুমবল্টের নাম কে না শুনেছে? নেপোলিয়ন, গ্যোটে, শিলারের সমসাময়িক। দুই কবির সঙ্গে তাঁর ভাবের আদান-প্রদান হত। এবং অনেকেই বলেন, ওই সময়ে পাশ্চাত্য মহাদেশগুলোতে নেপোলিয়নের পরেই ছিল হুমবল্টের সুখ্যাতি। আসলে তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিক এবং পর্যটক– ওদিকে কাব্য দর্শন অলঙ্কারশাস্ত্রের সঙ্গেও সুপরিচিত।
কিন্তু তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া আমার শক্তির বাইরে এবং সে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এ লেখাটি আরম্ভও করিনি।