এ দেশের আলিপুর কতখানি নির্ভরযোগ্য! দেশে থাকতে আবহাওয়ার বিলিতি এক ওঝার এক বিবৃতি পড়েছিলুম। তিনি কলকাতায় এসে বেশ মুরুব্বিয়ানার সুরে বললেন, তোমাদের দেশে এখনও আবহাওয়া যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করার মতো ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে দফতর নেই বলে প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পার না। আমরা কিন্তু বিলেতে মোটামুটি পারি।
এর পরীক্ষা হাতেনাতে হয়ে গেল।
একদিন ঘুম দেরিতে ভাঙায় বেতার-রিপোর্টটা শুনতে পাইনি। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় বাড়ির বুড়ি ঝিয়ের সঙ্গে দেখা- তার এক হাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অন্য হাতে বালতি। শুধালাম, বেতারে আবহাওয়ার বাণী কিছু শুনেছ?
একগাল হেসে বললে, এবারে যা আবহাওয়া বলে সেই পাবের বুড়ির মতো অনেক কথাই বললে– ইস্তেক এটম বম্ যে এসব গড়বড়ের প্রধান কারণ সেটা বলতেও ভুলল না।
সর্বশেষে বললে, যেন সবকিছু যথেষ্ট বরবাদ হয়নি বলে শেষমেশ এলেন ঝড়, গে। ওহ, তার কী দাপট!
আমি শুধালাম, আবহাওয়া দফতর সতর্ক করে না, ওয়ার্নিং দেয়নি?
গম্ভীরভাবে বললে, ইয়েস স্যর, আফটারওয়ার্ডস, ঝড়ের পরে দিয়েছিল।
রসবোধ আছে বৈকি।
কিন্তু মোদ্দা কথায় ফিরে যাই। আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার পূর্বে বেতারে হয় ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা উপাসনা। সাতসকালে ওটাও সেই অন্যলোকে কবে কথা তুমি রবে নিরুত্তর গোছের। কিন্তু পাছে আবহাওয়া মিস্ করি তাই সেটা শুনতে হত।
সর্বপ্রথম যেটা কানে ঠেকে সেটা পাদরি সায়েবের ভাষা।
একদা ধর্ম প্রভাব করত সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত তাবৎ রসপ্রকাশ প্রচেষ্টাকে– এখনও করে। একথা ফলাও করে বোঝাবার কিছুমাত্র দরকার নেই কারণ বহু শতাব্দী ধরে রিলিজিয়াস আর্টের সাধনা করার পর মানুষ এই সবে সেকুলার আর্ট আরম্ভ করেছে।
এখন আরম্ভ হয়েছে উল্টো টান। এখন ধর্মযাজকরা আপন-আপন ভাষা সরল, প্রাঞ্জল, ওজস্বিনী, মর্মস্পর্শী করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য থেকে বচনভঙ্গী ধার নিচ্ছেন। আজকের দিনের জীবন যে চরম মূল্যে বিশ্বাস হারিয়ে দেউলে হয়ে গিয়েছে তারই বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পাদরি সায়েব যখন ভোরবেলা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আমার কেমন যেন আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল, কোথায় যেন এটা পড়েছি। তারই সন্ধানে যখন আমার মন আর স্মৃতিশক্তি লুকোচুরি খেলছে তখন, ও হরি, পাদরি সায়েবই মাইকের উপর হাঁড়ি ফাটালেন। বললেন, আজকের দিনের দুনিয়া দেউলে; সর্বভুবন এখন এক বিরাট ওয়েস্টল্যান্ড।
কবিতাটি আমি মাত্র একবার পড়েছি, তা-ও বহু বৎসর পূর্বে এবং সে-ও খামচে খামচে, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে স্কিপ করে করে, কারণ ও কবিতায় একাধিক ভাষায় যে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ভাষা শেখাতে অগা এক-ভাষা-নিষ্ঠ (মনোগ্নট) ইংরেজকে তাক লাগাবার কিশোরসুলভ প্রচেষ্টা আছে, তা দেখে আমি বে-এক্তেয়ার হব কেন আমি তো এ সব-কটা ভাষা এলিয়টের মতোই বিলক্ষণ মিসান্ডারস্টেন্ড করতে পারি। কাজেই কবিতাটি স্মরণ করতে যদি সময় লেগে থাকে তা হলে আশা করি, যাদের কাছে ওই কবিতা রামায়ণ মহাভারতের চেয়েও প্রণম্য তারা অপরাধ নেবেন না।
ইংলন্ডের প্রার্থনার কথা ওঠাতে যদি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এস্থলে কিঞ্চিৎ বাক্যবিন্যাস করি তবে, বিবেচনা করি, সেটা নিতান্ত বেখাপ্পা শোনাবে না, এবং সে-বাসনা যে আমার কিঞ্চিৎ আছেও; সেটা অস্বীকার করব না, কিন্তু তা হলে মূল বক্তব্য থেকে অনেকখানি দূরে চলে যাব বলে পাঠক হয়তো ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠবেন। তাই শুধু এই প্রশ্নই শুধাই, ভোরবেলার পাদরি সায়েব বেছে বেছে আমাদের এলিয়ট সাহেবকেই স্মরণ করলেন কেন?
মার্কিন মুলুকের লেখককে ইংরেজ সহজে কল্কে দেয় না, কাজেই এই কল্কে পাওয়ার জন্য এলিয়টকে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বহু জায়গায় বিস্তর কল্কে পাওয়ার পর ইংলন্ডের কনসারভেটিভ পার্টিতেও তো জাতে উঠবার জন্য তিনি লিখলেন দি লিটারেচার অব পলিটিক্স–টি এস এলিয়ট ও এম কর্তৃক লিখিত; রাইট অনরেবল স্যর এন্টনি ইডন, কে জি; এম সি; এম পি কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত। এরকম ব্যাপার যে ইংলন্ডে হতে পারে আমি জানতুম না। আজ যদি শ্রদ্ধেয় পরশুরাম শ্রীরাজশেখর বসু রায়সাহেব কর্তৃক লিখিত এবং শ্রীযুক্ত ভূতনাথ ভড় রায়বাহাদুর, বিধানসভার সদস্য, কাইসার-ই হিন্দ দ্বিতীয় শ্রেণি মেডলপ্রাপ্ত কর্তৃক ভূমিকা সম্বলিত পুস্তক প্রকাশ করেন তবে যে রকম বিস্মিত এবং বিরক্ত হব। সাহিত্যজগতে (এলিয়ট যে পলিটিশিয়ান নন, সে সবাই জানে) তিনি তার ও. এম উপাধিটি উল্লেখ করতে ভুললেন না, আর ইডন তো সালঙ্কার থাকবেনই। মুসলমান বলে আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে অনুমান করি চাঁড়াল যদি পৈতে পেয়ে যায়, (স্বগুণেই বলছি) তবে বোধহয় সে সেটা সর্বক্ষণ মাথায় জড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়! আশা করি, এর পর যখন বাংলার সাহিত্যিকরা রাজনীতিকদের দাওয়াত করে, সভাপতি বানিয়ে, তাদের দিয়ে সাহিত্য অথবা সাহিত্যিকদের চরিত্রের আনাড়ি সমালোচনা করাবেন, তখন শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ অনাদৃত খাঁটি সাহিত্যিকরা অহেতুক উষ্ণ গোসূসা প্রদর্শন করবেন না। এদের গুরুঠাকুর মহামান্যবর এলিয়ট সাহেব– এঁরা তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন মাত্র।