তার পর যুদ্ধ লাগল। সেটা শেষ হল।
***
এইবারে মার্কিন-ইংরেজদের কৃপায় দেশের শাসনভার পেলে নাসিবৈরীরা। এঁরা খুঁজে খুঁজে বের করলেন নাৎসিদের। তখন আরম্ভ হল তাদের ওপর নির্যাতন। আজ ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তিন রাত্রির গারদে নির্জন কারাবাসের পর আপনাকে ছেড়ে দিল। আপনি ভাবলেন, যাক বাঁচা গেল। দশদিন যেতে না যেতে আবার ভোর চারটেয় আপনাকে গ্রেফতার করে ঠাসল গারদে। (এই যে আপনাকে ছেড়ে দিয়েছিল সেটা শুধু আপনার পিছনে গোয়েন্দা রেখে ধরবার জন্য কারা কারা আপনার সহকর্মী ছিল; কারণ স্বভাবতই আপনি তাদেরই সন্ধানে বেরোবেন। দ্বিতীয়ত এরা আপনার দরদী বন্ধু। আপনার দৈন্য-দুর্দিনে একমাত্র তারাই আপনাকে সাহায্য করবে– অবশ্য যদি তাদের দু পয়সা থাকে।…) এটা কিছু নবীন ইতিহাস নয়। আমাদের এই স্বদেশি আন্দোলনের সময়, পরবর্তী যুগে মহামান্য টেগার্ট সাহেবের আমলে
বারে বারে সহস্র বার হয়েছে এই খেলা।
দারুণ রাহু ভাবে তবু হবে না মোর বেলা ॥
সর্বশেষ মারিয়ানার স্বামীর তিন বছরের জেল হল। সেখানে যক্ষ্মা। বেরিয়ে এসে ছয় মাসের পরই ওপারে চলে গেল।
পাঠক ভাববেন না, আমি নাৎসিবৈরীদের দোষ দিচ্ছি।
বার বার শুধু আমার মনে আসছে : এদেশের প্রভু, প্রভু খ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন, ক্ষমা ক্ষমা, ক্ষমা।
জানি, মানুষ এত উঁচুতে উঠতে পারে না।
কিন্তু সেই চেষ্টাতে তো তার খ্রিষ্টত্ব, তার মনুষ্যত্ব।
.
১১.
হুররে, হুররে, হু্ররে।
কৈশোরে অবশ্য আমরা বলতাম, হিপস হিপস হুররে।
পুরোপাক্কা ক্রেডিট নিশ্চয়ই আর ইন্ডিয়া কোম্পানির। দীর্ঘ হাওয়াই মুসাফিরির পর অঘোরে ঘুমিয়েছিলাম সকাল আটটা অবধি। নিচে নামতেই লিজেন চেঁচিয়ে বললে, ভূ হালুঙ্কে। তোর হারানো সুটকেস ফিরে পাওয়া গিয়েছে।
কী করে জানলি?
আমাদের তো টেলিফোন নেই। চল্লিশ বছর আগে এই গডেসবের্গের যে বাড়িতে তুই বাস করতি তার টেলিফোন নম্বরটি তুই কলোনের হারানো প্রাপ্তির দফতরে সুবুদ্ধিমানের মতো দিয়ে এসেছিলি। আশ্চর্য! সে নম্বর তুই, পুতুপুতু করে এত বৎসর ধরে পুষে রেখেছিলি কী করে আর সেটা যে কলোনে সেই হারানো প্রাপ্তির দফতরে আপন স্মরণে এনে ওদের দিয়েছিলি সেটা আরও বিস্ময়জনক। তোর পেটে যে এত এলেম তা তো জানতুম না। আমি তো জানতুম তোর পশ্চাদ্দেশে টাইম বম রাখতে হয়। (আমরা বাংলায় বলি, পেটে বোম না মারলে কথা বেরোয় না), পিউজের হিসহিস শুনে তবে তোর বুদ্ধি খোলে। সে কথা থাক। কলোনের দফতর সেই নম্বরে ফোন করে, আর তোর সেই প্রাচীন দিনের ল্যান্ডলেডির মেয়ে আনা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল তুই আমাদের বাড়িতে উঠেছিস। তা ছাড়া যাবি আর কোন চুলোয়।
আনার বিয়ে হয়েছে এক যুগ আগে। ভাতার আর বাচ্চা দুটো রয়েছে। তাই সেখানে না উঠে আমাকে আপ্যায়িত করতে এসেছিস। ফের বলছি সে কথা থাক। আনা কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে।
আমি বাধা দিয়ে বললুম, হবে না কেন? আমি ওদের বাড়িতে ঝাড়া একটি বছর ছিলুম। আমার সঙ্গ পেয়েছে বিস্তর।
লিজেল আমার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে কোনও মন্তব্য না করে বললে, সে জানে আমাদের টেলিফোন নেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়ির মহিলার আছে। তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে তোর সুটকেসটি পাওয়া গিয়েছে এবং কলোন দফতরে জমা পড়েছে।
আমি বললুম, সর্বনাশ। আমাকে এখন ঠ্যাঙস ঠ্যাঙস করে যেতে হবে সেই ধেড়ধেড়ে গোবিন্দপুর কলোন? আধাখানা দিন তাতেই কেটে যাবে। হেথায় এসেছি ক দিনের তরে? তারও নিরেট চারটি ঘণ্টা মেরে দিয়েছে জুরিচ। কনেকশনে ছিল না বলে। আমি।
লিজেল বাধা দিয়ে বললে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে প্রাথমিক পরিচয়ে তোক যে একটা আকাট মূর্খ ঠাউরেছিলুম সেটা কিছু ভুল নয়, কলোনের দফতরে তোর প্র্যাকটিকাল বুদ্ধি ব্যত্যয়। অবশ্য আমি কখনও বলিনে একসেপশন ভজ দি রুল, আমি বলি ফুল ভজ দি একসেপশন। তোর সুটকেস তারাই এখানে পৌঁছে দেবে।
***
ওহ। কী আনন্দ, কাল রাত্রে ভয়ে ভয়ে আমি আমার হারিয়ে না যাওয়া বড় সুটকেসটি খুলিনি। যদি দেখি, এদের এবং আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের জন্য ছোটখাটো যেসব সওগাত এনেছি সেগুলো এই বড় সুটকেসটিতে নেই। এটাকেই নাকি বিদেশি ভাষায় বলে অসট্রিচ মনোবৃত্তি।
ইতোমধ্যে বাড়ির সদর দরজাতে ঘা পড়ল। লিজেল সেথায় গিয়ে কী যেন কথাবার্তা কইলে। মিনিট দুই পরে সেই হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়া সুটকেসটি নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে বললে, তোদের অ্যার কোম্পানি তো বেশ স্মার্ট : কমপিটেনট। এত তড়িঘড়ি হুলিয়া ছেড়ে বাক্সটাকে ঠিক ঠিক পকড় কর তোর কাছে পৌঁছে দিলে। আমার ছাতি সুশীল পাঠক, ইঞ্চি ছয় মাফ করবেন, আজকাল নাকি তাবৎ মাপ সেন্টিমিটার মিলিমিটারে বলতে হয়– অর্থাৎ ১৫ মিলিমিটার (কিংবা সেন্টিমিটারও হতে পারে আমার প্রিনস অব ওয়েলস অর্থাৎ বড় বাবাজি যে ইসকেলখানা রেখে দিয়ে চলে গিয়েছেন সেটাতে তার হদিস মেলে না) ফুলে উঠল।
***
বাকসোটা খুলে দেখি, আমার মিত্র মিত্র যেসব বস্তু খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে কিনে দিয়েছিল তার সবই রয়েছে (১) বারোখানা মুর্শিদাবাদি রেশমের স্কার্ফ, (২) উড়িষ্যার মোষের শিঙে তৈরি ছটি হাতি, (৩) পূর্ববৎ ওই দেশেরই তৈরি পিঠ চুলকানোর জন্য ইয়া লম্বা হাতল, (৪) দশ বান্ডিল বিড়ি (এগুলো অবশ্য লিজেল পরিবারের জন্য নয়, এগুলো আমার অন্য বন্ধুর জন্য), (৫) ভিন্ন ভিন্ন গরম মশলা এবং আচার (৬) বর্ধমানের রাজপরিবারের আমার একটি প্রিয় বান্ধবীর দেওয়া একখানি মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম স্কার্ফ (তার শর্ত ছিল সেটি যেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠা বান্ধবীকে দিই), (৭) তিনটি স্কার্ফ ক্লাস বেনারসি রেশমের টাই, কাশ্মিরের ম্যাংগো ডিজাইনের শালের মতো ওগুলো বর্ধমানেরই দেওয়া, (৮) দুই পৌন্ড দক্ষিণ ভারতের কফি ও পূর্ববৎ ওজনে দার্জিলিঙের চা… এবং একখানা বই ঠাকুর রামকৃষ্ণ সম্বন্ধে তার এক বিশেষ পূজারিণীর জন্য, তিনি বাস করেন সুইটজারল্যান্ডে। আর কী কী ছিল ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না। বেশ কিছু কান্দোও ছিল। এই ইয়োরোপিয়ানদের বড়ই দেমাক, তাদের মাস্টার্ড নিয়ে। দম্ভজনিত আমার উদ্দেশ্য ছিল, এদেরকে দেখানো যে আমাদের বাঙলা দেশের কাসুন্দো এ লাইনে অনির্বচনীয়, অতুলনীয়। পাউডার দিয়ে তৈরি ওদের মাস্টার্ড দু দিন যেতে না যেতেই মনে ধরে সবুজ হয়ে অখাদ্যে পরিবর্তিত হয়। আর আমাদের কাসুন্দো? মাসের পর মাস নির্বিকার ব্রহ্মের মতো অপরিবর্তনশীল।