আমি বললুম, মানছি, কিন্তু দেখুন গ্রিস, রোম এবং আমার দেশ ভারতবর্ষেও তো কলকারখানা নির্মিত হওয়ার বহু পূর্বে উত্তমোত্তম কাব্য রচিত হয়েছিল এবং সেগুলোতেও বিস্তর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক বর্ণনা আছে। তবে কেন-_
এসব কথাবার্তা যেন ওই চেয়ারে বসে কানে শুনতে পাচ্ছি। কত বৎসর হয়ে গেছে। এমন সময় লিজেল আমার মাথায় মারল একটা গাট্টা। আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বিশেষ করে তার ঠাকুরমার ছবিটি।
কী খাবে বলছিলে?
আমি আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলুম, আমি তো কিছুই বলিনি।
তবে চলো, তুমি যে সুপ পছন্দ করতে সেই সুপই করেছি– অর্থাৎ পি সুপ (কলাইশুটির সুপ)- এবারে বলো তুমি কী খাবে? তুমি যা খেতে চাও তার জন্য মাছ, মাংস ক্রিম আছে।
আমি বললুম, দিদি, সুপ ছাড়া আমার অন্য কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই। আর এই জর্নিতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড়।… তবে কি না আমি বঙ্গসন্তান। হেথায় ডান পাশে রাইন নদী। সে নদীর উত্তম উত্তম মাছ খেয়েছি কত বৎসর ধরে। তারই যদি একটা কিছু–
বেচারি লিজেল!
শুকনো মুখে বললে, রাইনে তো আজকাল আর সে মাছ নেই।
আমি শুধোলুম, কেন?
বললে, রাইন নদের জাহাজের সংখ্যা বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছে। তাদের পোড়ানো তেল তারা ওই নদীতে ছাড়ে। ফলে নদীর জল এমনই বিষে মেশা হয়ে গিয়েছে যে, মাছগুলো প্রায় আর নেই। আমার কাছে যেসব মাছ আছে সেগুলো টিনের মাছ।
আমি বললুম, তা হলে থাক।
.
১০.
বিনু যখন সোয়ামির সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিল তখন বললে, আহা ওরা কেমন সুখে আছে। আমরাও ভাবি ইংরেজ ফরাসি জর্মন জাত কী রকম সুখে আছে। কিন্তু ওদের দুঃখও আছে। তবে আমাদের মতো ওদের দুঃখ ঠিক একই প্রকারের নয়। ওরা খেতে পায়, আশ্রয় আছে। তৎসত্ত্বেও ওদের দুঃখ আছে।
লিজেলদের বাড়ি প্রায় দুশো বছরের পুরনো। সে আমলে স্টিল-সিমেন্টের ব্যাপার ছিল না। বাড়িটা মোটামুটি কাঠের তৈরি। দুশো বছর পর ছাদটা নেমে আসছে। এটাকে বাড়া রাখা যায় কী প্রকারে।
আমি জিগ্যেস করলুম, লিজেল, এটাকে কি মেরামত করা যায় না?
লিজেল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, শুধু ছাদ নয়, দেয়ালগুলো ঝুরঝুরে হয়ে এসেছে। এ বাড়ি মেরামত করতে হলে কুড়ি হাজার মার্ক (আমাদের হিসাবে চল্লিশ হাজার টাকারও বেশি) লাগবে। বাবা গেছেন, আমার কোনও ভাইও নেই। খেতখামার দেখবে কে? আপেলবাগানটা পর্যন্ত বেচে দিয়েছি। তাই স্থির করেছি বাড়িটা সরকারকে দিয়ে দেব। ওরা সব পুরনো বাড়ির কিছু কিছু বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কারণ এ বাড়িটির স্টাইল এক্কেবারে খাঁটি রাইনল্যান্ডের।
আমি বললুম, এটা মর্টগেজ করে টাকাটা তোলো না কেন?
লিজেল বললে, যে টাকাটা কখনও শোধ করতে পারব না সে টাকা ধার করব কী করে!
আমার মনে গভীর দুঃখ হল। বাড়িটি সত্যিই ভারি সুন্দর। শুধু বাড়িটি নয়, তার পেছনে রয়েছে ফল-ফুলের বাগান, তরিতরকারির ব্যবস্থা, কুয়ো, হ্যান্ডপাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে উত্তম ব্যবস্থা। খেতখামার গেছে যাক। ওদের আপেলবাগান এই অঞ্চলে বৃহত্তম এবং শ্রেষ্ঠতমও ছিল। সে-ও গেছে যাক। কিন্তু এই সুন্দর বাড়িটি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, এটা আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে চাইল না।
ইতোমধ্যে লিজেলের ঘোট বোন মারিয়ানা এল। তিন বোনের ওই একমাত্র যার বিয়ে হয়েছিল। যে ডিটরিষ আমাকে নিয়ে যাবার জন্য বন-এ এসেছিল তার মা। ছেলের বাড়ি দু মিনিটের রাস্তা। সেখানে বউ নিয়ে থাকে।
মারিয়ানা বিধবা। প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে তার বিয়ে হয়। বরটি ছিল খাসা ছোকরা কিন্তু…
এ বাড়ির তিন বোনের কেউই নাৎসি ছিল না। এরা সবাই ধর্মভীরু ক্যাথলিক। ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে হয়তো ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। হয়তো করেনি। যাই হোক, যাই থাক, তাই বলে দীর্ঘ, সুদীর্ঘ, সেই ঘটনার দু হাজার বছর পর ওদের দোকানপাট, ভজনালয়, ওদের লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দেবে (মহাকবি হাইনরিষ হাইনের কবিতাও বাদ যায়নি), ইহুদি ডাক্তার, উকিল প্রাকটিস করতে পারবে না– এটা ওরা গ্রহণ করতে পারেনি। এটা ১৯৩৪ সালের কথা। তখনও কনসানট্রেশন ক্যাম্প আরম্ভ হয়নি। যখন আরম্ভ হল তখন আমি দেশে। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। চিঠি-চাপাটির গমনাগমন সম্পূর্ণ রুদ্ধ। কিন্তু আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ ছিল না যে লিজেদের পরিবার এ প্রকারের নিষ্ঠুর নরহত্যা শুধু যে ঘৃণার চোখে দেখবে তাই নয়, এরা যে এর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছে না সেটা তাদের মনকে বিকল করে দেবে। … এ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি জর্মনি যাই; তখন লিজেল আমাকে বলেছিল, ডু হালুঝে, তুই তো ভালো করেই চিনিস, আমাদের এই মুফেনডার্ফ গ্রাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের না হোক, জর্মনির ক্ষুদ্রতম গ্রাম। সেই হিসেবে আমরা প্রখ্যাততম গ্রাম। এখানে মাত্র একটা-দুটো ইহুদি পরিবার ছিল। দিদি সময়মতো ওদেরকে সুইটজারল্যান্ডে পাচার করে দিয়েছিল।
এবারে আরম্ভ হবে ট্রাজেডি।
মারিয়ানা বড় সরলা। এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাত না। অবশ্য সে-ও ছিল আর দুই দিদির মতো পরদুঃখকাতর।
বিয়ে করে বসল এক প্রচণ্ড পাঁড় নাসিকে। কেন করল এ মুখকে শুধোবেন না। মেয়েরা কেন কার প্রেমে পড়ে, কেন কাকে বিয়ে করে– এ নিগূঢ় তত্ত্ব দেবতারাও আবিষ্কার করতে পারেননি।