তুমি এইমাত্র বললে না, তুমি-পিসি দু জনাই নাৎসিদের পছন্দ করতে না। বস্তৃত পিসি পরিবারের কেউই নাৎসি ছিল না। যদিও আমি তোমার বান্ধবীকে পিসি বলে পরিচয় দিয়েছি, আসলে তিনি আমার মাসি। তারা তিন বোন। আমার মা সকলের ছোট। তিনি বিয়ে করলেন এক নাৎসিকে কট্টর নাৎসিকে। কেন করলেন জানিনে। প্রেমের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিল। বাড়ি গিয়ে তোমাকে তার ডাইরিটি দেখাব। আর চেহারাটি ছিল সুন্দর
বাধা দিয়ে বললুম, সে তোর চেহারা থেকেই বোঝা যায়।
থ্যাঙ্কউ। আর বাবা ছিল বড্ডই সদয় হৃদয়
ভাগিনা, কিছু মনে করো না। আমি মোটেই অবিশ্বাস করি না যে তোর পিতা অতিশয় করুণ হৃদয়, শান্তস্বভাব ধরতেন– তোর দুই মাসিই সে কথা আমাকে বারবার বলেছে। আবার বলছি কিছু মনে করো না, তা হলে তিনি নাসিদের কনসানট্রেশন ক্যাম্প সয়ে নিলেন কী করে?
ডিটরিষ চুপ মেরে গেল। কোনও উত্তর দেয় না। আমি এবার, বহুবারের পর আবার, বুঝলুম যে আমি একটা আস্ত গাড়োল। এ রকম একটা প্রশ্ন করাটা আমার মোটেই উচিত হয়নি, বললুম, ভাগিনা, আমি মাফ চাইছি। আমি আমার প্রশ্নটার কোনও জবাব চাইনে। ওটা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি।
ডিটরিষ বললে, না মামু। তুমি যা ভেবেছ তা নয়। আমি ভাবছিলুম, সত্যই তো, বাবা এগুলো বরদাস্ত করত কী করে? এবং আরও লক্ষ লক্ষ জর্মন? এই নিয়ে আমি অনেকবার বহু চিন্তা করেছি। তুমি জানো মার্কিনিংরেজ রুশ-ফরাসি নরেনবের্গ মোকদ্দমায় বার বার নাৎসিদের প্রশ্ন করেছে, তোমরা কি জানতে না যে হিটলার কনসানট্রেশন ক্যাম্পে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করছে? উত্তরে সবাই গাইগুই করেছে। সোজা উত্তর কেউই দেয়নি। জানো তো যুদ্ধের সময় কত সেনসর কত কড়াকড়ি। কে জানবে কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমার মনে হয়, আবার বলছি জানিনে, বাবার কানে কিছু কিছু পৌঁছেছিল। কিন্তু বাবা তখন উন্মত্ত। তিনি চান জর্মনির সর্বাধিকার। তার ডাইরিতে বারবার বহুবার লেখা আছে, ইংরেজ কে? সে যে বিরাট বিশ্ব শুষে খেতে চায় তাতে তার হক্কো কী? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানি, তারা যদি আমাদের কিংবা ফরাসিদের মতো কলচরড় জাত হত তবে আমরা এ নিয়ে কলই করতুম না। কিন্তু ইংরেজ জাতটাই তো বেনের জাত, তারা কলচারের কী বোঝে! ওদের না আছে মাইকেল এঞ্জেলো, না আছে বেটোফেন। আছে মাত্র শেকসপিয়ার। ওদের না আছে স্থাপত্য, না আছে ভাস্কর্য, না আছে–হঠাৎ বললে এই তো বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।
.
০৯.
–ডু হালুঙ্কে সোল্লাসে হুহুঙ্কার ছাড়ল শ্রীমতী লিজেল। তুই গুণ্ডা–
আমরা যেরকম কোনও দুরন্ত ছোট বাচ্চাকে আদর করে গুণ্ডা বলে থাকি, হালুঙ্কে তাই। শব্দটা চেক ভাষাতে জর্মনে প্রবেশ লাভ করেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখা হলেই লিজেল এইভাবেই আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
তার পর আমাকে জাবড়ে ধরে দু গালে দুটো চুমো খেল।
ডিটরিষ মারফত পাঠককে পূর্বেই বলেছি লিজেল ছিল ন-সিকে টম-বয়। বরং দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। তবে এটা হল কী প্রকারে? শুচিবায়ুগ্রস্ত পদীপিসিরা ক্ষণতরে ধৈর্য ধরুন। বুঝিয়ে বলছি। এই ষাট বছরে তার কি আর টমবয়তু আছে? এখন আমাকে জাবড়ে ধরে আলিঙ্গন করাতে সে শুধু তার অন্তরতম অভ্যর্থনা জানাল।
আমি মনে মনে বললুম, চল্লিশ বছর ল্যাটে, চল্লিশ বছর ল্যাটে। এই আলিঙ্গন-চুম্বন চল্লিশ বছর পূর্বে দিলেই পারতে, সুন্দরী। পরে তাকে খুলেও বলছিলুম।
ইতোমধ্যে ডিটরিষ আমতা আমতা করে বললে, আমরা তা হলে আসি। রাত্রের পার্টিতে দেখা হবে।
ওরা পাশেই থাকে। তিন মিনিটের রাস্তা। ওদের ভাব থেকে বুঝলুম, ওরা মনে করছে বিদ্যা ও সুন্দর যখন বহু বছর পর সম্মিলিত হয়ে গেছেন তখন ওদের কেটে পড়াই ভালো। আমাদের প্রেমটি যে চিরকালই নির্জলা জল ছিল সেটি হয়তো তারা গলা দিয়ে নাবাতে পারেনি– হজম করা তো দূরের কথা।
লিজেল আমাকে হাতে ধরে ড্রইংরুমের দিকে নিয়ে চলল। আমি বললুম, এ কী আদিখেতো! চল্লিশ বছর ধরে যখনই এ বাড়িতে এসেছি তখনই আমরা বসেছি বাবা, মা, বড়দি, তুমি, ছোড়দি রান্নাঘরে। অবিশ্যি মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আজ কেন এ ব্যত্যয়? তদুপরি বিরাট ড্রইংরুম। বাপস। তুই যদি এক কোণে বসিস আর আমি অন্য কোণে, তা হলে একে অন্যকে দেখবার তরে জোরদার প্রাশান মিলিটারি দুরবিনের দরকার হবে; কথা কইতে হলে আমাদের দেশের ডাকহরকরা, নিদেন একটা ট্রাংককল ফোন ব্যবস্থা, আর।
লিজেল সেই প্রাচীন দিনের মতো বললে, চোকোর চোককোর। তুই চিরকালই বড্ড বেশি বকর বকর করিস।
গতি পরিবর্তিত হল। আমরা শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরেই গেলুম।
.
কিচেনের এক প্রান্তে টেবিল, চতুর্দিকে খান ছয় চেয়ার। অন্য প্রান্তে দুটো গ্যাসউনুন, তৃতীয়টা কয়লার (সেটা খুব সম্ভব প্রাচীন দিনের ঐতিহ্য রক্ষার্থে)। দুই প্রান্তের মাঝখানে অন্তত দশ কদম ফাঁক। অর্থাৎ কিচেনটি তৈরি করা হয়েছে দরাজ হাতে। বস্তুত লিজেলের মা যখন রাঁধতেন তখন এ প্রান্ত থেকে আমাকে কিছু বলতে হলে বেশ গলা উঁচিয়ে কথা কইতে হত।
লিজেল একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, এটাতেই বস।
সত্যি বলছি, আমার চোখে জল এল। কী করে লিজেল মনে রেখেছে যে, চল্লিশ বৎসর পূর্বে (তিনি গত হয়েছেন বছর আটত্রিশেক হবে) তার পিতা আমাকে ওই চেয়ারটায় বসতে বলতেন। আমি জানতুম, কেন। জানালা দিয়ে, ওই চেয়ারটার দিকে দূর-দূরান্তরের দৃশ্য সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। পরে জানতে পেরেছিলুম, তিনি স্বয়ং ওই চেয়ারটিতে বসে আপন খেতখামারের দিকে এবং বিশেষ করে তার বিরাট আপেল বাগানের দিকে নজর রাখতেন– (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে আমাদের যেরকম আমবাগান)। অবশ্যই তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে ভালোবাসতেন। নইলে ওখানে বসতে বলবেন কেন? আমি তো সেখান থেকে তার খেতখামার, আপেলবাগান তদারকি করতে পারব না যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা তাঁর আপন মুনিষ না ভিনজন আমি ঠাহর করব কী প্রকারে? আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ? সে দিকে আমার কোনও চিত্তাকর্ষণ নেই। একদিন ওই শেষ কথাটি তাকে আস্তে আস্তে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে- যাতে অনন্যরা শুনতে না পায় তিনি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে অতিশয় সুন্দর স্মিতহাস্যে বললেন, তোমরা ইন্ডিয়ান। তোমাদের দেশে এখনও কলকারখানা হয়নি। তোমরা এখনও আছ প্রকৃতির শিশু। শিশু কি মায়ের সৌন্দর্য বোঝে না। সে শুধু তার মায়ের স্তনরস চায়– সেই স্তনদ্বয়ের সৌন্দর্য কি সে বুঝে? যেমন তার বাপ বোঝে? ঠিক এরকম তোমরা তোমাদের মা-জননী জন্মভূমিতে খেতখামার করে খাদ্যরস আহারাদি গ্রহণ করো। তোমরা কী করে বুঝবে, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে কী বোঝায়? সেটা শুধু হয় যখন মানুষ কলকারখানার গোলাম হয়। অর্থাৎ মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর, বড় হয়ে সে তার মাতৃদুগ্ধের মূল্য বুঝতে শেখে–।