ডিটরিষ বললে, জানো মামু, আমাদের বিশ্বাস প্রাচ্যদেশীয়রা বড়ই সিরিয়াস। সর্বক্ষণ শুমড়ো মুখ করে লর্ড বুদ্ধের মতো আসন নিয়ে শুধু আত্মচিন্তা মোক্ষানুসন্ধান করে। তারাও যে রসিকতা করে এ কথা ৯৯.৯% জর্মন কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। অথচ তোমার এই বন্ধুটির রসিকতাটি শুধু যে রসিকতা তাই নয়। ওতে গভীর দর্শনও রয়েছে। মডার্ন আর্কিটেকচার সম্বন্ধে মাত্র ওই একটি দেশলাই দিয়ে তিনি তার তাচ্ছিল্য সিনিসিজমসহ প্রকাশ করলেন কী সাতিশয় সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে। ভদ্রলোক কি তোমার মতো লেখেন-টেখেন– লিতেরাত্যের?।
আমি বললুম, তওবা, তওবা! ভদ্রলোক ছিলেন আমাদের ফরেন অফিসের ডেপুটি মিনিস্টার; পণ্ডিত নেহরুর সহকর্মী। খুব বেশিদিন কাজ করেননি। ওইসব দার্শনিক সিনি রসিকতা তিনি সর্বজনসমক্ষে প্রকাশ করতেন তার ভিন্ন ভিন্ন সহকর্মী মন্ত্রীদের সম্বন্ধে। ঠিক পপুলার হওয়ার পন্থা এটা নয়– কী বলো? কাজেই তিনি যখন ফরেন অফিস থেকে বিদায় নিলেন তখন আমি বলেছিলুম, তিনি মন্ত্রীমণ্ডলী থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিদায় নেবার সময় উল্লাসে নৃত্য করলেন এবং মন্ত্রীমণ্ডলীও তার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে উল্লাসে নৃত্য করলেন।
ডিটরিষ চুপ। আমি একটু অবাক হলুম। সে তো সব সময়ই জুম্মাফিক উত্তর দিতে পারে।
সে বললে, আমার অবস্থাও তাই। যে অফিসে আমি কাজ করি সেটা থেকে বেরুতে পারলে আমিও খুশি হই; ওরাও খুশি হয়।
.
০৮.
ওই তো সামনে গোডেসবের্গ। ডিটরিষ শুধোলে, মামু, পিসি বলছিল তুমি নাকি এই টাউনটাকে জর্মনির সর্ব জায়গার চেয়ে বেশি ভালোবাস? কেন বলো তো।
আমি মুচকি হেসে কইলুম, যদি বলি তোর পিসির সঙ্গে হেথায় আমার প্রথম প্রণয় হয়েছিল বলে?
ডি। ধ্যত! আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করেছি, লিজেল পিসির ধ্যানধর্ম শুধু কাজ আর কাজ। ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া। এবং সে বইগুলোও দারুণ সিরিয়াস। বড় পিসি বরঞ্চ মাঝে মাঝে হালকা জিনিস পড়ত। কিন্তু ছোট পিসি ওসবের ধার ধারত না। সে যেত প্রতি প্রভাতে ট্রামে চড়ে বন শহরে যেখানে সে চাকরি করত।
আমি। সেই সূত্রেই তো আমাদের পরিচয়। আমো ওই সকাল আটটা পনেরোর ট্রামে বন্ যেতুম। আমরা আর সবাই দু তিনটে সিঁড়ি বেয়ে ট্রামে উঠতুম। আর লিজেল পিসি ডান হাতে একখানা বই আর বাঁ হাতে ট্রামের গায়ে সামান্যতম ভর করে সিঁড়িগুলোকে তাচ্ছিলি করে এক লঞ্চে উঠত ট্রামের পাটাতনে। উঠেই একগাল হেসে ডাইনে-বাঁয়ে সমুখ পানে তাকিয়ে বলত শুটেন মরগেন সুপ্রভাত। ওর ওই লম্ফ মেরে ওঠার কৌশল দেখে আমি মনে মনে বলতুম, একদম টম বয়! ওর উচিত ছিল মার্কিন মুল্লুকে কাউ বয় হয়ে জন্ম নেবার। অথবা ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন গুরুদেবের ভাষায়।
গোডেসবের্গ তখন অতি ক্ষুদ্র শহর। সবাই সবাইকে চেনে। কিন্তু আসল কথা, ওই আটটা পনেরোর ট্রামে থাকত পনেরো আনা কাচ্চাবাচ্চা। ইস্কুলে যাচ্ছে বন শহরে। এরা সবাই জানত যে লিজেল পিসির, অবশ্য কখনও তিনি পিসি খেতাব পাননি, কাছে আছে লেবেনচুস, দু একটা আপেল, হয়তো নবাগত মার্কিন চুইংগাম, মাঝে-মধ্যে চকলেট। কাজেই বাচ্চারা সমস্বরে, কোরাস কণ্ঠে বলত, অন্তত বার তিনেক সুপ্রভাত–। তার পর সবাই তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়াত। সবাই বলত, প্লিজ, এজ্ঞে, এই এখানে বসুন।
আমি বললুম, বুঝলি ডিটরিষ, তোর পিসি লিজেল ছিল আমাদের হিরইন অব দ্য প্লে। তবে ঠিকই বলেছিস ও কখনও প্রেম-ফ্রেমের ধার ধারত না। আমি দু একবার তার সঙ্গে হাফাহাফি ফ্লার্ট করতে গিয়ে চড় খেয়েছি। অথচ আমাদের মধ্যে প্রতিবন্ধুত্ব ছিল গভীর। আমাকে কত কী-না খাইয়েছে ওই অল্প বয়সেই বেশ দু পয়সা কামাত বলে। তখনকার দিনে ছিল– এখনও নিশ্চয়ই আছে– একরকমের বেশ মোটা চকলেট– ভিতরে কন্যাক। বড় আক্রা। কিন্তু খেতে– ওহ! কী বলব–মুখে ফেলে সামান্য একটু চাপ দাও। ব্যস হয়ে গেল। ভিজে ভিজে চকলেট আর তরল কন্যা মিশে গিয়ে, দ্যাখ তো না দ্যাখ, চলে গেল একদম পেটের পাতালে। কিন্তু যাবার সময় ওই যে কন্যাক– তোরা যাকে বলিস ব্র্যানটভাইন, ইংরেজিতে ব্র্যান্ডি, নাড়িভূঁড়ির প্রতিটি মিলিমিটার মধুর মধুর চুলবুলিয়ে বুঝিয়ে দিত, যাচ্ছেন কোন মহারাজ!… আর মনের মিলের কথা যদি তুলিস তবে বলব, লিজেল ছিল বড়ই লিবরেল। তাই যদিও নাৎসিরা তখনও ক্ষমতা পায়নি কিন্তু রাস্তাঘাটে দাবড়াতে আরম্ভ করেছে- পিসি সেটা আদৌ পছন্দ করত না। আমিও না। কিন্তু সত্যি বলতে কি, ইংরেজ যে ইতোমধ্যেই হিটলার বাবদে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সেটা আমার চিত্তে পুলক জাগাত। পিসিও সেটা জানত। ভারতবর্ষের পরাধীনতার কথা উঠলেই সে ব্যথা পেত। বলত, ও কথা থাক না। ওরকম দরদী মেয়ে চিনতে পারার সৌভাগ্য আমি ইহসংসারে অতি অল্পই পেয়েছি।
হঠাৎ লক্ষ করলুম ভাগিনা ডিটরিষ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছে। শুধোলুম, কী হল রে? তুই কি পরশুদিনের হাওয়া খেতে চলে গিয়েছিস?
কেমন যেন বিষপ্ত কণ্ঠে ভেজা ভেজা গলায় সে বললে, মামা, তুমি বোধহয় জানো না, আমার বাবা অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে ওপারে চলে গেল কী করে।
ডিটরিষের এখন যৌবনকাল। তার বাপ কেন, ঠাকুন্দাও বেঁচে থাকলে আশ্চর্য হবার মতো কিছু ছিল না। বললুম, আমি তো জানিনে ভাই। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আবার হচ্ছেও না। কারণ তোর গলাটা কী রকম যেন ভারী ভারী শোনাচ্ছে।