***
বন শহরের নাম করলেই দেশি-বিদেশি সবাই বেটোফেনের নাম সঙ্গে সঙ্গে করে বটে, কিন্তু এ বৎসরে বিশেষভাবে করে। কারণ তাঁর দ্বিশত জন্মশতবার্ষিকী সম্মুখেই। ডিসেম্বর ১৯৭০-এ। এ শহর তাঁকে এতই সম্মান করে যে তার সুন্দর প্রতিমূর্তিটি তুলেছে তাদের বিরাটতম চত্বরে, তাদের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম না হলেও তারই কাছাকাছি প্রাচীন মনস্টার গির্জার পাশে। হয়তো তার অন্যতম কারণ, বেটোফেন ছিলেন সর্বান্তকরণে ঈশ্বরবিশ্বাসী। শুধু তাঁর সংগীত নয়, তাঁর বাক্যালাপে চিঠিপত্রে সর্বত্রই তাঁর ঈশ্বরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস, প্রভুর পদপ্রান্তে তার ঐকান্তিক আত্মনিবেদন বার বার স্বপ্রকাশ।
সেখান থেকে কয়েক মিনিটের রাস্তা– ছোট গলির ছোট্ট একটি বাড়ির ছোট্ট একটি কামরায়, যেখানে তার জন্ম হয়। বাড়ির নিচের তলায় বেটোফেন মিউজিয়ম। সেখানে তার ব্যবহৃত অনেক কিছুই আছে, যেমন ইয়াসনা পলিয়ানাতে তলস্তয়ের বৃহত্তর, সম্পূর্ণতর, কারণ সেটা দেড়শো বছর পরের কথা এবং অসম্পূর্ণতম রবীন্দ্রনাথের উত্তরায়ণে, যদ্যপি সেটা তলস্তয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে।…
কিন্তু সেখানে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বেটোফেনের কানের চোঙাগুলো। বত্রিশ বত্সর বয়স থেকেই তিনি ক্রমে ক্রমে কালা হতে আরম্ভ করলেন। বিধাতার এ কী লীলা! বীণাপাণির এই অংশাবতার আর তার বীণা শুনতে পান না। তখন তিনি আরম্ভ করলেন ওইসব কানের চোঙা ব্যবহার করতে। পাঠক, দেখতে পাবে, তার বধিরতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেমন বাড়তে লাগল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোঙার সাইজও বাড়তে লাগল। তাতে করে তার কোনও লাভ হয়েছিল কি না বলা কঠিন। তবে এটা জানি, তার কিছুকাল পরে, যখন তাঁর সঙ্গীতপ্রেমী কোনও সহচর বলতেন, বাহ্! কী মধুর সুরেলা বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে রাখাল ছেলেটি, আর তিনি কিছুই শুনতে পেতেন না তখন বেটোফেন বলতেন, তিনি তনুহর্তেই আত্মহত্যা করতেন যদি-না তাঁর বিশ্বাস থাকত যে সঙ্গীতে এখনও তার বহু কিছু দেবার আছে। আমাদের শ্রীরাধা যেরকম উদ্ধবকে বলেছিলেন, যদি-না আমার বিশ্বাস থাকত, প্রভু একদিন আমার কাছে ফিরে আসবেন, তা হলে বহু পূর্বেই আমার মৃত্যু হয়ে যেত। এবং সকলেই জানেন, বদ্ধ কালা হয়ে যাওয়ার পরও বেটোফেন মনে মনে সঙ্গীতের রূপটি ধারণ করে বহুবিধ স্বর্গীয় রচনা করে গেছেন। যেগুলো তিনি স্বকর্ণে শুনে যেতে পাননি। আমি যেন কোথায় পড়েছি, তিনি সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে করুণ আবেদন জানাচ্ছেন, প্রভু যেন তাঁকে একবারের মতো তার শ্রুতিশক্তি ফিরিয়ে দেন যাতে করে তিনি মাত্র একবারের তরে আপন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনে যেতে পান। তার পর তিনি সধন্যান্তঃকরণে পরলোকে যেতে প্রস্তুত।
চিন্তাসস্রাতে বাধা পড়ল। ডিটরিষ শুধাল, মামা, কথা কইছ না যে!
বললুম, আমি ভাবছিলুম বেটোফেনের কানের চোঙাগুলোর কথা। ওগুলো সত্যি কি তার কোনও কাজে লেগেছিল?
ডিটরিষ বললে, বলা শক্ত। কোনও কোনও আধাকালা একখানা কাগজের টুকরো দু পাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কাগজের বেশিরভাগটা মুখের বাইরে রাখে। ভাবে, ধ্বনিতরঙ্গ ওই কাগজকে ভাইব্রেট করে দাঁত হয়ে মগজে পৌঁছোয়, কিংবা কান হয়ে। কেউ-বা সামনের দু-পাটির চারটি দাঁত দিয়ে লম্বা একটা পেনসিল কামড়ে ধরে থাকে। কী ফল হয় না হয় কে বলবে?… আচ্ছা, মামু, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, কী রকম অদ্ভুত, প্রিমিটিভ মিনি সাইজের যন্ত্র দিয়ে তিনি তার বিচিত্র সঙ্গীত রচনা করেছিলেন? আমার কাছে আশ্চর্য লাগে।
আমি বললুম, কেন বত্স, ওই যে তোমার ছোট পিসি, যার সঙ্গে আমার চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব, লিজেল– দেখেছ, ঝড়তি-পড়তি কয়েক টুকরো লেটিসের পাতা, আড়াই ফোঁটা নেবুর রস আর তিন ফোঁটা তেল দিয়ে কীরকম সরেস স্যাল্যাড তৈরি করতে পারে? মুখে দিলে যেন মাখন!!… আর তোর-আমার মতো আনাড়িকে যাবতীয় মশলাসহ একটা মোলায়েম মুরগি দিলেও আমরা যা রাঁধব সেটা তুইও খেতে পারবিনে, আমিও না। পিসি লিজেল কী বলবে, জানিনে। অথচ জানিস ওই অভুক্ত মুরগিটি তাকে তখন দিয়ে দে। তিনি সেটাকে ছোট ছোট টুকরো করে যাকে ফরাসিরা বলে রাও ফাঁরা ফ্রিকা অর্থাৎ লম্বা লম্বা/ ফালি-ফালি করে কেটে, মুরগিটাতে আমরা যেসব বদ রান্নার ব্যামো চাপিয়েছিলুম সেগুলো রাইনের ওপারে পাঠিয়ে এ্যামন একটি রান্না করে দেবেন যে, প্যারিসের শ্যাফত আমরি আমরি বলতে বলতে তরিয়ে তরিয়ে খাবে… প্রকৃত গুণীজন যা কিছুর মাধ্যমে যা কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। আমাদের দেশে একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে। একতারা তার নাম। তাতে একটিমাত্র তার। তার দু দিকে দুটি ফ্লেক্সিবল বাঁশের কৌশল আছে। সে দুটোতে কখনও হাল্কা চাপ দিয়ে তার মাঝখানের তারটাকে প্লাক করে নাকি বিয়াল্লিশ না বাহান্নাটা নোট বের করা যায়। তবেই দ্যাখ। বেটোফেনের মতো কটা লোক পৃথিবীতে আসে আমাদের দেশেও গণ্ডায় গায় তানসেন জন্মায় না। যদিও আমাদের দেশ তোদর দেশের চেয়ে বিস্তর বিরাটতর, এবং সেখানে কলাচর্যা আরম্ভ হয়েছিল অন্তত চার হাজার বছর পূর্বে। এবং আমাদের কলাজগতে আমরা এখন সাহারাতে এবং–
ডিটরিষ বললে, তুমি আমাদের পার্লামেন্ট হাউসটা দেখবে না? রাইনের পারে। আমি একটু ঘুরপথে যাচ্ছি। সোজা পথে গেলে দু-পাঁচ মিনিট আগে বাড়ি পৌঁছতুম।