তা হলে শুনুন, আপনাকে পুরো ফিরিস্তি দিচ্ছি। যদিও আমি ওই যন্ত্রটির পূজারি নই। পুরনো ফিল্ম, নয়া থিয়েটার, গর্ভপাতের সেমিনার আলোচনা, পাদ্রিদের বক্তৃতা (এ দুটো তিনি ঠিক পর পর বলেছিলেন সেটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে), রাজনৈতিকদের সঙ্গে ইন্টারভ, খেলা, কাবারে, ইতালি ভ্রমণ, চন্দ্রাভিযান, ভিয়েতনাম থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন, পার্লামেন্টে হার ভিলি ব্রান্ট ও হার শেলের বক্তৃতা এবং সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে ওই একই কেচ্ছা, একই অন্তহীন খাড়াবড়িহোড়বড়িখাড়া (তিনি জর্মনে বলেছিলেন একই ইতিহাস–ডি জেলবে গেশিষটে)। সর্ববস্তু কুচি কুচি করে পরিবেশন। পরের দিনই ভুলে যাবেন, আগের দিন কী দেখেছিলেন– মনের ওপর কোনও দাগ কাটে না। পক্ষান্তরে দেখুন, বই পড়ার ব্যাপারে আপনি আপনার রুচিমতো বই বেছে নিচ্ছেন।
ইতোমধ্যে আমাদের বাস কতবার যে কত ট্রাফিক জ্যামে কত মিনিট দাঁড়িয়েছে তার হিসাব আমি রাখিনি। অথচ এদেশের রিকশা, ঠ্যালা, গরুর গাড়ি এমন কোনও কিছুই নেই যে-সব হযবরল আমাদের কলকাতাতে নিত্য নিত্য ট্রাফিক জ্যাম জমাতে কখনও স্বেচ্ছায় কখনও অনিচ্ছায় বিশ্ববিজয়ী প্রতিষ্ঠান।
ভদ্রলোক বাইরের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওই দেখুন, আরেক উকট নেশা। মোটর, মোটর, মোটর। প্রত্যেক জর্মনের একখানা মোটরগাড়ি চাই। জর্মন মাত্রই মোটরের পূজারি।
আমার কেমন যেন মনে হল, আমরা বোধহয় বন্ শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে গিয়েছি। কিছুটা চেনাচেনা ঠেকছে, আবার অচেনাও বটে। অথচ একদা এ শহর আমি আমার হাতের তেলোর চেয়ে বেশি চিনতুম।
আমি ভদ্রলোককে আমার সমস্যা সমাধান করতে অনুরোধ জানালে তিনি বললেন, এটা বনই বটে। তবে এ অঞ্চলটা গত যুদ্ধে এমনই বোমারু মার খেয়েছিল যে এটাকে নতুন করে গড়া হয়েছে। তবে শহরের মধ্যিখানটা প্রায় পূর্বেরই মতো মেরামত করে বানানো। আসল কথা কী জানেন, বমিঙের ফলে ঘিঞ্জি পাড়াগুলো যে নষ্ট হয়ে গেল সেগুলোকে ভালো করে, নতুন করে প্ল্যান মাফিক বানাবার চান্সটা আমরা মিস করছি। তবে এই যে বললুম, শহরের মাঝখানটা মোটামুটি আগেরই মতো–হার্ট অব দি সিটি– আর জানেন তো পুরনো হার্টের জায়গায় নতুন হার্ট বসানো মুশকিল। এই ধরুন লুটভি ফান বেটোফেন–
আমি বললুম, ওই নামটার ঠিক উচ্চারণটা আমি আজও জানিনে।
হেসে বললেন, ওই তো ফেললেন বিপদে। মাঝখানে Vanটা যে খাঁটি জর্মন নয় তা তো বুঝতেই পারছেন। ওঁরা প্রাচীন দিনের ফ্ল্যামিশ। তখন তারা ভান না ফান উচ্চারণ করত কে জানে– অন্তত আমি জানিনে–
আমি বললুম, থাক, থাক। এবারে যা বলছিলেন তাই বলুন।
সেই বেটোফেনের বাড়ি যদি বোমাতে চুরমার হয়ে যেত তবে সেখানে তো একটা পিরামিড গড়া যেত না।
এমনকি তাজমহলও না।
***
দুম করে গাড়ি থেমে গেল। এ কি? ও। মোকামে পৌঁছে গিয়েছি। অর্থাৎ বন শহরে। এবং সবচেয়ে প্রাণাভিরাম নয়নানন্দদান দৃশ্য যে পরিবারে উঠব তারই একটি জোয়ান ছেলে ডিটরিষ উলানোফস্কি প্রবলবেগে হাত নাড়াচ্ছে। মুখে তিন গাল হাসি। পাশে দাঁড়িয়ে তার ফুটফুটে বউ। সে রুমাল দুলোচ্ছে।
.
০৬.
লক্ষ্মী ছেলে ডিটরিষ। তার মাঝারি সাইজের মোটরখানা এনেছে। আমার কোনও আপত্তি না শুনে বললে, আমি মালপত্রগুলো তুলে নিচ্ছি। আপনি ততক্ষণ বউয়ের সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিন। ও তো আপনাকে চেনে না। মেয়েটিকে বাড়ির কুশলাদি শুধোলুম। কিন্তু বড় লাজুক মেয়ে কয়েকদিন আগে দেশ পত্রিকায় যে সিগারেট-মুখী মডার্ন মেয়ের ছবি বেরিয়েছে তার ঠিক উল্টোটি। কোনও প্রশ্ন শুধোয় না। শুধু উত্তর দেয়। শেষটায় বোধহয় সেটা আবছা আবছা অনুভব করে একটি মাত্র প্রশ্ন শুধোলে, বন কি খুব বদলে গেছে? আমি অবশ্য প্রাচীন দিনের বন চিনিনে। আমার বাড়ি ছিল ক্যোনিষবের্গে।
সর্বনাশ! এবং পাঠক সাবধান।
ক্যোনিষবের্গ শহরটি এখন বোধহয় পোলান্ডের অধীন! ওইসব অঞ্চল থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী বাস্তুহারা সর্বহারা হয়ে পশ্চিমে জর্মনিতে এসেছে। তাদের বেশিরভাগই সে সব দুঃখের কাহিনী ভুলে যেতে চায়। কাজেই সাবধান! ওসব বাবদে ওদের কিছু জিগ্যেস করো না।
তবে এ তত্ত্বও অতিশয় সত্য যে মৌকামাফিক দরদ-দিলে যদি আপনি কিছু শুনতে চান তখন অনেক লোকেই, বিশেষ করে রমণীরা অনর্গল অবাধগতিতে সবকিছু বলে ফেলে যেন মনের বোঝা নামাতে চায়। বিশেষ করে বিদেশির সামনে। সে দু দিন বাদেই আপন দেশে চলে যাবে। ও যা বলেছিল সেটা নিয়ে খামোখা কোনও ঘোটলার সৃষ্টি হবে না। আমি তাই বেমালুম চেপে গিয়ে বললুম, ও! ক্যোনিষবের্গ। যেখানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কাট জন্মে ছিলেন। এবং শুনেছি তিনি নাকি ওই শহরের বারো না চোদ্দ মাইলের বাইরে কখনও বেরোননি। শহরটাকে এতই ভালোবাসতেন। ইতোমধ্যে ডিটরিষ স্টিয়ারিঙে বসে গেছে। এবং আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেছে। বললে, ভালোবাসতেন না কচু। আসলে সব দার্শনিকই হাড়-আলসে। আমি বললুম, সে কথা থাক। তোর বউ শুধপাচ্ছিল, বন্ শহরটা কি খুব বদলে গেছে? তারই উত্তরটা দিই। বদলেছে, বদলায়ওনি।
তুমি, মামা, চিরকালই হেঁয়ালিতে কথা কও–
আমি বললুম, থাক, বাবা থাক। বাস্-এ এক বৃদ্ধ বিষয়টির অবতারণা করতে না করতেই মোকামে পৌঁছে গেলাম। আর এ তাবৎ দেখেছিই-বা কী?