কিন্তু মার্কিন টাইম কাগজে বেরিয়েছে ও বিলেতেও বেরিয়েছে। তার পর সন্দ করে কোন পিচেশ!
.
কলোন অ্যারপোর্টে নেমে দেখি, দুটো স্যুটকেসের একটা আমার নেই। ছুট ছুট দে ছুট, সেই ঘরের দিকে যেখানে হারানো-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে তড়িঘড়ি ফরিয়াদ জানাতে হয়। নইলে চিত্তির। অবশ্য এরা নিজের থেকেই হয়তো দু-পাঁচ দিনের ভিতরই আমার বেওয়ারিশ জাদুকে খুঁজে পাবেন, কিন্তু আমি কোন মোকামে আস্তানা গাড়ব, তার ঠিকানাটা এদের না দিলে মাল হস্তগত হবে কী বলে? সেটা তখন তার মালিককে হারাবে। কোনও এক গ্রিক দার্শনিক নাকি বলেছেন একই নদীতে তুমি দু বার আঙুল ডোবাতে পারবে না, একই শিখায় দুবার আঙুল পোড়াতে পারবে না। কারণ প্রত্যেকটি বস্তু প্রতি মুহূর্ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানলুম। কিন্তু একই স্যুটকেস নিশ্চয়ই দু বার, দুবার কেন, দু শো বার হারাতে কোনও বাধা নেই। অতি অবশ্য কবিগুরু বলেছেন, তোমায় নতুন করে পাব বলেই হারাই ক্ষণেক্ষণ/ও মোর ভালোবাসার ধন!! কিন্তু প্রশ্ন, এটা কি হারানো বাক্সের বেলাও খাটে?
আপিসঘরটি প্রমাণ সাইজের চেয়েও বৃহদায়তন। ভিতরে ফুটফুটে মেমসায়েব বসে আছেন। আমার লাগেজ টিকেট দেখাতেই তিনি মুচকি হেসে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, ওটা খোওয়া যাবে না। কিন্তু বলুন তো ওটার ভিতরে কী কী আছে?
সর্বনাশ। সে কি আমি জানি? প্যাকিং করেছে আমার এক তালেবর ভাতিজা মুখুজ্যে। তার বাপ প্রতি বৎসর নিদেন তিনবার ইয়োরোপ-আমেরিকা যেতেন। সে নিখুঁত প্যাকিং করে দিত। আমার বেলা এ বারে করেছে নিখুঁততর। কোন বাক্সে কী মাল রেখেছে কী করে জানব!
কিন্তু মিসি-বাবা সদয়া। পীড়াপীড়ি করলেন না। আমার ঠিকানাটি টুকে নিলেন। আর ইতোমধ্যে বার বার বলছেন, অ্যার ইন্ডিয়া বলুন, লুট-হানজা বলুন, সুইস অ্যার বলুন কোনও লাইনেই কোনও লাগেজ খোওয়া যায় না। আপনি পেয়ে যাবেনই যাবেন।
আমি মনে মনে বললুম, বট্ট্যে! বেরোবার সময় তাকে বিস্তর ধন্যবাদ জানিয়ে সবিনয়ে বললুম, গ্রেডিগেস ফ্রলাইন (সদয়া কুমারী)! একটি প্রশ্ন শুধোতে পারি কি?
সুমধুর হাস্যসহ, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
আমি বললাম, তাবৎ হারানো মালই যদি ফিরে পাওয়া যায়, তবে এ হেন বিরাট আপিস আপনারা করেছেন কেন? আমি তো শুনেছি, কলোন অ্যারপোর্টের প্রতিটি ইঞ্চির জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা ছাড়তে হয়।
প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা না করেই এক লক্ষে দফতর থেকে বেরিয়ে মাল-সামান নিয়ে উঠলুম বিরাট এক বাস-এ।
***
বাঁচলুম, বাবা, বাঁচলুম। প্লেনের গর্ভ থেকে বেরিয়ে খোলামেলায় এসে বাঁচলুম। বাসটি যদিও পর্বতপ্রমাণ, সাগর করিবে গ্রাস হয় অনুমান, তবু চলছে যেন রোলস রইস রইস খানদানি গতিতে, মৃদু মধুরে। কবিগুরু গেয়েছিলেন, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসার ঘায়ে– আমি গাইলুম, বাঁচালে তুমি মোরে ভালো বাস-এর ছায়ে।
আহা কী মধুর অপরাহ্নের সূর্যরশি। কখনও মেঘমায়ায়, কখনও আলোছায়ায়। দু-দিকের গাছ-পাতার উপর সে রশ্মি কভু-বা মেঘের ভিতর দিয়ে আলতো আলতো হাত বুলিয়ে যায়, কভু-বা রুদ্রদীপ্ত হয়ে প্রচণ্ড আলিঙ্গন করে। ওই হোথায় দেখছি, বুড়ো চাষা ঘাসের উপর শুয়ে আছে, চোখের উপর টুপি ঢেকে। তার সবুজ পাতলুন যেন ঘাসের ঝিলিমিলির সঙ্গে একতালে যায় মিলি। এদেশের নবান্ন হতে এখনও বেশ কিছুদিন বাকি আছে। চতুর্দিকে অল্পবিস্তর ফসল কাটা হচ্ছে। আজ রোববার। রাইনল্যান্ডের লোক বেশিরভাগই ক্যাথলিক। তাদের অধিকাংশই সেদিন সর্বকর্ম ক্ষান্ত দেয়। তাই খেতখামারে তেমন ভিড় নেই। আমিও মোকামে পৌঁছুতে পারলে বাঁচি। ইংরেজিতে প্রবাদ এ সিনার হ্যাঁজ নো সনডে। পাপীর রোববার নেই। আমি তো তেমন পাপিষ্ঠ নই!!
বাস মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রামের ভিতর দিয়ে যায়। সেখানেও রাস্তা নির্জন। বাচ্চাকাচ্চারা কোথায়? তারা তো ক্লাইপে বা সুধালয়ে যায় না সেখানে অবশ্যই আজ জোর কারবার, বেজায় ভিড়। আমার পাশের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে ছিলেন। তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে বললুম, স্যর, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে আমি এসব গ্রামের ভিতর দিয়ে গিয়েছি। তখন তো ছেলে-মেয়েরা রাস্তার উপর রোল-স্কেটিঙ করত, দড়ি নিয়ে নাচত, এমনকি ফুটবলও খেলত। ওরা সব গেল কোথায়?
বৃদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, একাধিক উত্তর হয়তো আছে। চট করে যেটা মনে আসছে সেটা বলতে গেলে বলি, বন্ধ ঘরে টেলিভিশন দেখছে।
আমি একটু ঘাড় চুলকে বললুম, যদি কিছু অপরাধ না নেন স্যর, তবে শুধাব, এটা কি সর্বাংশ ভালো? ফারসিতে একটি দোহা আছে :
হর চে কুনি ব খুদ কুনি
খাঁ খুব কুনি, খা বদ কুনি।
যা করবে স্বয়ং করবে।
ভালো করো কিংবা মন্দই কর।
এই যে প্যাসিভভাবে বসে বসে টেলি দেখা তার চেয়ে রাস্তায় অ্যাকটিভভাবে খেলাধুলো করা কি অনেক বেশি কাম্য নয়?
গুণী এবারে চিন্তা না করেই বললেন, নিশ্চয়ই। অবশ্য ব্যত্যয়ও আছে। যেমন মনে করুন, আমরা যখন মোৎসার্ট বা শপা শুনি তখন তো আমরা প্যাসিভ। আর তাই-বা বলি কী করে? বেটোফেনকে গ্রহণ করা তো প্যাসিভ নয়। ভেরি ভেরি অ্যাকটিভ কর্ম! কী পরিমাণ কনসানট্রেশন তখন করতে হয়, চিন্তা করুন তো। কিন্তু বাচ্চাদের কথা বাদ দিন কটা বয়স্ক লোকই-বা সে জিনিস করে?