খাবার নষ্ট হয়ে যায় সহজেই, কিন্তু মদ একবার বোতলে পুরলেই হল। তাই খাবারের চেয়ে মদ জুটত সহজে অন্তত আমার বেলা তাই হয়েছে। সেই যে অভ্যেসটা হয়ে গেল সেটা আর গেল না। এই দেখুন হাত কাঁপছে। গণ্ডাখানেক খাওয়ার পর হাত দড়ো হবে। আর নাই-বা হল দড়ো। কদিনই-বা বাঁচার আর বাকি আছে!
কিন্তু যে কথা বলছিলুম, আমাদের মতো বুড়িদের দেখে দেখে ছুঁড়িরাও মদ খেতে শিখেছে। দোষটা তো আমাদেরই।
বুড়ি থামলেন। খোলা দরজা দিয়ে চোখে পড়ল বৃষ্টি নেমেছে। দেশের মতো গামলা-ঢালা বর্ষণ নয়– সে বস্তু এদেশে কখনও দেখিনি। ঝিরঝিরে ফিনফিনে। তারই ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আরও যেন ঠাণ্ডা হয়ে পাবে ঢুকে আমার হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। ওদের অভ্যাস আছে, বুড়ি পর্যন্ত বিচলিত হল না, কেউ দরজা বন্ধ করে দেবার কথা চিন্তাও করলে না।
পূর্বেই বলেছি বুড়িরা দেখে কম, বোঝে বেশি। বললেন, বাবাজি এদেশে এলেন অক্টোবর মাসে, যেটা কি না ইংলন্ডের ওয়েটেসট মথ, বৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। অবশ্য এ বছর আবহাওয়ার কোনও জমা-খরচ পাওয়া গেল না– তেষট্টি বছরের ভিতর এ রকম ধারা কখনও হতে দেখিনি! যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন ঝা ঝা রোদ্দুর, আর যখন রোদ্দুর হওয়ার কথা, ফসল কাটার সময়, তখন হল বৃষ্টি। এ রকম হলে এদেশ থেকে চাষবাসের যেটুকু আছে তা-ও উঠে যাবে।
আমি বললুম, এই অনিশ্চয়তার জন্যই গত একশো বছর ধরে এদেশে গমের চাষ কমে গিয়েছে– কোথায় যেন পড়েছি।
বুড়ি বললেন, এবারের সঙ্গে কিন্তু আদপেই তার তুলনা হয় না। সবাই বলে এটম বম নিয়ে মাতামাতি করার ফলে। হবেও বা। আপনাদের দেশেও তো শুনেছি এবারে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল,– বিস্তর গর্মি, অল্প বৃষ্টি।
একটু আরাম বোধ করলুম। তা হলে বুড়ি এখনও খবরের কাগজটা অন্তত পড়ে। জীবনে আঁকড়ে ধরার মতো অন্তত কিছু একটা আছে। বললুম, সে কথা আর তুলবেন না, ম্যাডাম। দিনের পর দিন ঝাড়া দুটি মাস ধরে ১১৪ ডিগ্রির ১১৪ ন্যাজওলা ক্যাট অ নাইন টেলসের চাবুক খেয়ে পিঠে ঘা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই ঠাণ্ডায় সে কথা ভাবতে চিত্তে পুলক লাগে, দেহ কদমফুলের মতো—
সে আবার কী ফুল?
খাইছে। এ যেন লন্ডন শহরে মুখুজ্যের বটগাছ সন্ধান করার মতো। বললুম, ম্যাডাম, সে তো বোঝানো অসম্ভব। এদেশের কোনও ফুল তার কাছ ঘেঁষেও যায় না। বোঝাতে গেলে সেই অন্ধের বক খাওয়ার মতো হবে। অন্ধকে শুধালে দুধ খাবে? দুধ কী রকম? সাদা। সাদা কী রকম? বকের মতো। বক কী রকম? লোকটা তার কনুই থেকে বক দেখানোর বাঁকানো হাতের আঙুল পর্যন্ত অন্ধের হাতে বুলিয়ে দিল। অন্ধ ভয় পেয়ে বললে, বাপ! ও আমি খেতে পারব না আমার গলা দিয়ে ঢুকবে না।
তার পর বললুম, কিন্তু ম্যাডাম, আপনি যে বললেন, হুঁড়িরা আপনাদের অনুকরণে মদ খেতে শিখেছে এ কথাটা আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে না। আমার মনে হয়, যারা মদ খায় তাদের অধিকাংশই দুরন্ত দৌড়-ঝাঁপটার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই ওই কর্ম করে। চাষাবাদের কাজ টিমেতেতালা; তারা মদ খায় কম। কারখানার কাজ জলদ তেতাল; তারা খায় বেশি। আগে শুধু পুরুষেরা যেসব ধুন্দুমারের কাজ করত এখন মেয়েরাও সে-সব কাজ করছে বলে তাদেরও একটু-আধটু পান করতে হচ্ছে। কিন্তু এটাও বলে রাখছি, এ রেওয়াজ বেশিদিন থাকবে না?
কেন?
আমি বিজ্ঞের ন্যায় বললুম, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পড়িনি, আমি নিজে কোথাও দেখিনি মদ নিয়ে মেয়েদের বাড়াবাড়ি করতে– ও বস্তু যেখানে জলের মতো সস্তা সেখানেও। তার কারণ মেয়েদের বাচ্চা প্রসব করতে হয়। প্রকৃতি চায় না মদের বাড়াবাড়ি করে মেয়েরা স্বাস্থ্য নষ্ট করুক। এবং শেষ কথা পুরুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের আবার ঘরকন্নার দিকে ফিরে যেতে হবে।
বুড়ি বললেন, কী জানি? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তাই হয়েছিল বটে, কিন্তু এবার কি তারা যে স্বাধীনতা পেয়েছে সেটা আর ছেড়ে দেবে? সেবারে শুধু তারা পুরুষের কাজ করার অধিকার পেয়েছিল, এবারে তার টাকা ওড়াবার অধিকারও তারা পেয়েছে যে। এই যে তারা পাবে আসে, সেটা কেন? পুরুষের মতো আড্ডা জমাতে তারাও শিখে গিয়েছে।
আমি শুধালুম, বাড়িতে মদ খাওয়া তো অনেক সস্তা!
বুড়ি আনমনে বললেন, অনেক। কিন্তু বাড়িতে আমার আর কে আছে? কর্তা তো আগেই গেছেন। ছেলেটাও ফ্রান্সের আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ হল।
তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন– গলায় নেশার চিহ্নমাত্র নেই–কিন্তু জানেন, আমি তার আশা এখনও ছাড়তে পারিনি। হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পাব মা। শেষে ঘুম ভাঙতেই শুনি, পাশের বাড়ির লক্ষ্মীছাড়া রেডিয়োটা ধর্মসঙ্গীত গাইছে।
মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর
অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।
কোথায় ব্রাহ্মমুহূর্তে প্রসন্নমনে জানালা দিয়ে সবুজ গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সবুজ প্রাণশক্তি আহরণ করব, তা না, তখন স্মরণ করিয়ে দিলে শেষের দিনের কথা। ঘুম তো এক রকমের মৃত্যু, সেই মৃত্যুর থেকে উঠে শুনতে হয় বিভীষিকাময় আরেক মৃত্যুর কথা– তা-ও বিটকেল গানে গানে!
এখানে সকালবেলা খাটের পাশে রেডিয়োটা চালিয়ে দিই আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী শোনার জন্য। এ-দেশে সেটা জানার বড়ই প্রয়োজন। বৃষ্টি হলেই গেছি–বুড়ো হাড় নিয়ে রাস্তাঘাটে ফু, নিউমোনিয়া কুড়োতে ভয় করে। রোদের সামান্যতম আশা পেলে মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে।