চুমোচুমি আলিঙ্গনের পর ছোকরা শুধালে, তোমরা সবাই এ রকম লম্বা লম্বা দাড়ি রেখেছ কেন? এই বুঝি ফ্যাশান!
জ্যাঠা বিড়বিড় করে বললেন, ফ্যাশান না কচু। তুই যে পালাবার সময় ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গেলি!
বুড়ি আরেক ঢোক জিন্ খেয়ে হেসে বললেন, আমার পিতৃভূমি স্কটল্যান্ডে; কাজেই আমার অজানা নয় যে সেখানে কুল্লে পরিবার এক ব্লেডে দাড়ি কামায়। কিন্তু ত্রিশ বছর–?
আমি বললুম, ঠিক বলেছেন, ম্যাডাম। আমি ত্রিশ বছর পূর্বে লন্ডন ছাড়ার সময় আমার ব্লেডখানা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম কিন্তু তাই বলে লন্ডনের লোক দাড়ি কামানো বন্ধ করে দেয়নি। ইস্তেক গোঁফ পর্যন্ত কামিয়ে ফেলেছে।
মানে?
মানে মেয়েদের রাজত্ব। আমার ভাইপো এই প্রথম লন্ডনে এসেছে। তার কাছে সবকিছুই নতুন ঠেকছে। সে আজ সকালে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর বললে, ফোর টু ওয়ান অর্থাৎ রাস্তা দিয়ে যদি চারটে মেয়ে চলে যায়, তবে একটা ছেলে। আমি অবশ্য বললুম, এখন আপিস, আদালত, দোকান-পাট খোলা, সেখানে পুরুষরা কাজ করছে। অন্য সময় শুনলে হয়তো অন্য রেশিয়ে বেরোবে। সে বললে, ওসব জায়গায় তো মেয়েরাই বেশি। নিতান্ত বাস আর ট্যাক্সি মেয়েরা চালাচ্ছে না। (পরে অবশ্য ফ্রান্স না জর্মনি কোথায় যেন তা-ও দেখেছি)।।
তার পর বললুম, এক-একটা লড়াই লাগে আর মেয়েদের পায়ের শিকলি খোলার সঙ্গে সঙ্গে মনের শিকলিও খুলে যায়।
মানে?
আমি বললুম, বেশি দূরে যাওয়ার কী প্রয়োজন? ওই বারের দিকে তাকিয়ে দেখুন না। ত্রিশ বছর আগে উড়ুক্কু বয়সের মেয়েদের দুপুরবেলা বারে মাল গিলতে দেখেছেন?
বুড়ি একটু লজ্জিত নয়নে আমার দিকে তাকালেন।
আমি তাতে পেলুম আরও লজ্জা। আবার বাঙাল-পনা করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি বললুম, না, না, এতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তার পর অস্বস্তির কুয়াশা কাটাবার জন্য হাসির রোদ ফুটিয়ে বললুম, সবাই কি ত্রিশ বছরের দাড়ি নিয়ে বসে থাকবে? সময়ের সঙ্গে কদম কদম এগিয়ে যেতে হয়।
বুড়ি যেন আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন, এ জন্য আমরাই দায়ী। তবে শুনুন।
এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে লন্ডনের উপর কী রকম বোমা পড়েছে তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। কয়েক বছর আগে এলেও দেখতে পেতেন লন্ডনের সর্বাঙ্গে তার জখমের দাগ। এখনও কোনও কোনও জায়গায় আছে নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু ওসব বাইরের জিনিস। আজ যদি ভূমিকম্পে লন্ডনের আধখানা তলিয়ে যায় তবে তাই নিয়ে বাকি জীবন মাথা থাবড়াব নাকি?
কিন্তু মাটির তলার ঘর সেলারে বসে প্রতি বোমা পড়ার সময় ভয়ে-আতঙ্কে যে রকম কেঁপেছি সেটা হাড়গুলোকে নরম করে দিয়ে গিয়েছে, সে আর সারবার নয়। বম্বিং-এর পর রাস্তায় বেরিয়ে মড়া দেখেছি, জখমিদের কাতর আর্তনাদ শুনেছি— বুকের ওপর তার দাগ সে-ও কখনও মুছে যাবে না। আমার ফ্ল্যাটটা বহুদিন টিকেছিল– অনেককে তাতে আশ্রয় দেবার সুযোগ পেয়েছি, দু চার দিন থেকে তারা অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে, কেউ-বা বেশি দিন থেকেছে। একদিন এক মর-মর বুড়োকে আশ্রয় দিলুম। তাকে নিয়ে কী করব সেই কথা ভাবতে ভাবতে যখন কুড়ি ফিরছি তখন জর্মন বারের বাঁশি বাজল। ঘণ্টাখানেক মাটির নিচের আশ্রয়ে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন দেখি স্বয়ং ভগবান আমার সমস্যাটির শেষ সমাধান করে দিয়েছেন। বাড়িটি নেই। সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও গেছে। একটুখানি থেমে বললেন, পরে অবশ্য লাশটা পাওয়া গিয়েছিল।
বুড়ির জিন ততক্ষণে ফুরিয়ে গিয়েছে। কাপড়-চোপড় দেখে মনে হল অবস্থাও খুব ভালো নয়। ফ্রকে হাঁটুর কাছটায় আনাড়ি কিংবা বুড়ো হাতের একটুখানি রিপুও দেখতে পেলুম। এবার কিন্তু বাঁকাচোখে।
এখখুনি আসছি বলে বারে গিয়ে একটা জিন নিয়ে এলুম।
মনে মনে বললুম, সদাশয় ভারত সরকারের যে কটি পাউন্ড ভারতীয় মুদ্রা মারফত কিনতে দিয়েছেন তা দিয়ে এ রকম করলে আর কদিন চলবে? কিন্তু তাই বলে তো আর ছোটলোকামি করা যায় না। আমার ক্যাশিয়ার মুখুজ্যেও পই পই করে বলেছে, কিপ্টেমি করা চলবে না; পাউন্ড যদি ফুরিয়ে যায় তবে তদণ্ডেই দেশে ফিরে যাবে– ফিরতি টিকিট তো কাটাই আছে।
বুড়ি বললেন, না, না। আপনি আবার কেন– আমি এমনিতেই অনেকগুলি খাই।
আমি হেসে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি; একটুখানি পরখ করব না। যদিও স্কচ ছোঁয়ার মতো মিলিয়ন নিয়ে আসিনি।
বুড়ি বললেন, তখনই আমার নার্ভস যায়। অনেকেরই যায়। তার পর ফিসফিস করে বললেন, চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন না, আমার বয়সী ক গণ্ডা বুড়ি মদ গিলছে।
খাবার জোটে না, অহরহ বোমা পড়ছে, কানের পর্দা শব্দের হাতুড়ি পেটা খেয়ে খেয়ে যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে– লক্ষ করেননি, অনেকেরই কান খারাপ হয়ে গিয়েছে, সবাই একটুখানি চেঁচিয়ে কথা কয় (আমি অবশ্য করিনি– তবে কথাটা সম্পূর্ণ ভুল না-ও হতে পারে)- দিনরাত কেটে যাচ্ছে, চোখের পাতায় ঘুম নেই, এমন সময় পাশের বাড়ি উড়ে যাওয়ার পর তাদের সেলার থেকে বেরুল এক গুদোম মদ।
আগের থেকেই নার্ভস ঠাণ্ডা করার জন্য ধরেছিলুম সিগারেট, এখন পেলুম ফ্রি মদ। মদ খেলে আরেকটা সুবিধে। ক্ষিদেটা ভুলে থাকা যায়, আর, নেশাটা ভালো করে চড়লে দিব্য ঘুমানোও যায় বোমা ফাটার শব্দ সত্ত্বেও।