যদি বলেন, কালচারল লেভেল কি এক? নিশ্চয়ই। ডোরা খানদানি ডিউকের মেয়ে নয়, সে এগজিসটেনশিয়ালিজম নিয়ে মাথা ঘামায় না, আর আমাদের আছমৎ উল্লাও জমিদারবাড়ির ছেলে নয়, সে যোগাযোগ পড়েনি।
যদি বলেন, সাদা মেয়ে কি কালোকে পছন্দ করে? উত্তরে বলি, আমাদের ভিতরে যে যত কালা সে-ই তো তত ফর্সা বউ খোঁজে। (এই সাদার তরে পাগলামি এদেশে খুব বেশিদিন হল আসেনি। দুশো বছর আগেকার লেখা বইয়ে ইয়োরোপীয় পর্যটকরাও লিখেছেন, ভারতীয়রা আমাদের ফর্সা রঙ দেখে বেদনাভরা কণ্ঠে শুধায় হায়, ভগবান এদের সবাইকে ধবলকুষ্ঠ দিয়েছেন কেন? কথাটা ঠিক। এদেশের দুই মহাপুরুষ কৃষ্ণ এবং রামের একজন কালো, অন্যজন নবজলধরশ্যাম।)।
এই সেকুরিটির অভাবই মদ্যপানের অন্যতম কারণ।
ইংলন্ডে যে মদ্যপান বেড়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কোনও দেশের গুণীজ্ঞানীরা কী ভাবেন, কী চিন্তা করেন, সে কথা জানবার জন্য সে দেশে যাবার কোনও প্রয়োজন আমি বড় একটা দেখিনে। আপন দেশে বসে বসে সে দেশের উত্তম অধম পুস্তক, মাসিক, খবরের কাগজ পড়লেই সে সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা জন্মে! কিন্তু সে দেশের টাঙ্গাওলা-বিড়িওলা ড্রাইভার-কারখানার মজুর কী ভাবে, কী চিন্তা করে সেটা জানতে হলে সে দেশে না গিয়ে উপায় নেই। কারণ তারা বই লেখে না, খবরের সম্পাদককে চিঠি লিখে নালিশ-ফরিয়াদ জানায় না। তাদের কান্নাকাটি গালমন্দ যা কিছু করার সবকিছুই তারা করে এদেশের চায়ের দোকানে, ওদেশে পাবে অর্থাৎ শরাবখানায়। আর শরাবখানায় মস্ত বড় একটা সুবিধা– আমাদের চায়ের দোকানেও তাই কারও সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে চাইলে সে খেঁকিয়ে ওঠে না; গুণীজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করতে হলে বিস্তর বয়নাক্কা, আত্মাবমাননাও তাতে কিঞ্চিৎ আছে কিংবা এ চিন্তা মনে উদয় হওয়া অসম্ভব নয়, আমি কে যে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে যাব?
কেনসিংটন গির্জার পাশে ছোট্ট একটি শরাবখানাতে এক কোণে বসেছি। প্রচণ্ড ভিড়। এমন সময় একটি বুড়ি বার থেকে এক গেলাস জিন কিনে এনে আমার পাশে বসতে গেলে তার হ্যান্ডব্যাগটি মাটিতে পড়ে গেল। সেটি কুড়িয়ে টেবিলের উপর রাখলুম। বুড়ি গলে গিয়ে থ্যাঙ্কয়ু থ্যাঙ্কয়ু বলে চেয়ারে বসে খানিকটে আমাকে শুনিয়ে খানিকটে আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগলেন, আজকালকার ছোঁড়াদের ভদ্রতা বলে কোনও জিনিস নেই, তবু বাকিটা তিনি আর শেষ করলেন না। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না তিনি কী বলতে চান। ছোঁড়াদের ভদ্রতা নেই কিন্তু আমার আছে, এ কী করে হয়, কারণ আমি ছোঁড়া নই। তবে বোধহয় বলতে চান ছোঁড়াদের নেই, কিন্তু এ বুড়োর (অর্থাৎ আমার) আছে। সেটা অনুমান করেও উল্লাস বোধ করি কী প্রকারে? আমি বুড়ো বটে কিন্তু থুথুরে বুড়ির কাছ থেকে সে তত্ত্ব শুনে তো আনন্দিত হওয়ার কথা নয়।
তা সে যাকগে। আমি তখন অবাক হয়ে বারের দিকে তাকিয়ে বার বার তাজ্জব মানছি। হরেক রকম চিড়িয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝপাঝপ বিয়ার, এল, জিন খাচ্ছে– এ কিছু নয়া তসবির নয়, কিন্তু আশ্চর্য, চব্বিশ-ছাব্বিশ বছরের মেয়েরা পর্যন্ত বারে কটাশ করে শিলিঙ রেখে অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে ঢাকাঢ়ক বিয়ার খেয়ে হুট করে বেরিয়ে যায়। যৌবনে যখন লন্ডন গিয়েছি, তখন দুপুরবেলা বারে একা একা খাওয়া মাথায় থাকুন, রাত্রে ডিনারের সময়ও কোনও ভদ্ৰমেয়ে তার বন্ধু বা আত্মীয়ের সঙ্গেও এসব জায়গায় আসতে ইতস্তত করত। নিতান্ত যেতে হলে যেত রেস্তোরাঁয় অর্থাৎ খাবারের জায়গায় যেখানে মদ্যপান করা হয় খাদ্যের অত্যাবশ্যক অঙ্গরূপে আমাদের গ্রামাঞ্চলে যে রকম শুধু জল খেতে দেয় না, সঙ্গে দুটি বাতাসা দেয়।
বুড়ো-বুড়িদের দৃষ্টিশক্তি কমে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বটাও সত্য যে, যা দেখে তার থেকে অর্থ বের করতে পারে সেই অনুপাতে অনেক বেশি। তাই সেই বুড়ি এক ঢোক জিন খেয়ে আমাকে শুধালে– (এ সব জায়গায় ইংরেজ লৌকিকতার বজ্ৰবাধন কিঞ্চিৎ ঢিলে হয়ে যায়) বাবাজি কি এদেশে এই প্রথম এলে?
বুঝলুম, বাঙালের হাইকোর্ট-দর্শন করে ঘটি যে রকম পত্রপাঠ ঠাহর করে নেয়, লোকটা বাঙাল; আর আমি তো আসলে বাঙাল; কলকাতায় যে রকম প্রথম হাইকোর্ট দেখেছিলুম এখানেও ঠিক তেমনি ক্যাবলাকান্তের মতো সবকিছু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছি। যতই পলস্তরা লাগাই-না কেন, সে বাঙালত্ব যাবে কোথায়? প্রতিজ্ঞা করলুম সাবধান হতে হবে। শহুরেদের মতো সবকিছু দেখব আড়নয়নে ব্রিামদার মতো বাঁকা চোখে।
অপরাধীর সুরে বললুম, তা ম্যাডাম, প্রায় তাই। ত্রিশ বছর পূর্বে এসেছিলুম, আর এই। লন্ডন ইতোমধ্যে পুনর্জন্ম না হোক, অধজন্ম তো লাভ করেছে।
বুড়ি মহা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলে কী? ত্রিশ বছর পরে। তা হলে তো এর কাছ থেকে অনেককিছু শোনা যাবে। অবশ্য উত্তেজনার কারণ জিনও হতে পারে।
.
সবে দাড়ি-গোঁফ কামাতে শিখেছে এক স্কচ ছোকরা বাড়ি থেকে পালিয়ে মার্কিন মুলুকে উধাও হয়। বহু পয়সা কামিয়ে ত্রিশ বছর পরে সে ফিরছে দেশে। বাড়ি ফেরার সময় এত দিন বাদে এই সে প্রথম চিঠি লিখেছে। স্টেশনে বাপ-চাচা-দাদা সবাই উপস্থিত, সবাই খুশি, প্রচুর পয়সা কামিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে।