ভারতীয় সঙ্গীত ও জর্মনি সঙ্গীত ভিন্ন ভিন্ন মার্গে চলে। তৎসত্ত্বেও ভারতীয় বিষয়বস্তু একাধিক সঙ্গীতকারকে ভারতীয় লাইট-মোতিফ জুটিয়েছে, তুলনাত্মক আলোচনা প্রচুর হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জনৈক মজুমদার এ সম্বন্ধে একখানি উচ্চাঙ্গের পুস্তক লিখে ডক্টরেট পান। পরম পরিতাপের বিষয় ওই যুদ্ধে তিনি তরুণ বয়সে প্রাণ হারান। বইখানির পাণ্ডুলিপি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এ যাবৎ সে বই কেন যে কোনও ভারতীয় বা ইংরেজি ভাষাতে অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি সে এক বিস্ময়।
মৃচ্ছকটিকা জর্মনদের প্রিয় নাট্য। তার একাধিক প্রাঞ্জল এবং মধুর জর্মন অনুবাদ আমি দেখেছি। এ নাট্যের ঘটনাপরম্পরার বিচিত্র ঘাতপ্রতিঘাত যে রকম জর্মন মনকে চলিত করে, ঠিক তেমনি তার গীতিরস–বিশেষ করে অকাল বর্ষায় বসন্তসেনার অভিসার ও দয়িত দরিদ্রচারুদত্তের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর উভয়ের সে বর্ষণবর্ণন জর্মন হৃদয়কে নাট্যগৃহে বহুবার উল্লসিত উদ্বেলিত করেছে। জর্মন ভাষা ইংরিজির তুলনায় অনেক বেশি গম্ভীর ও প্রাচীনত্ব (আরকাইক) ধরে বলে সে ভাষায় মূল সংস্কৃতের অনেকখানি স্বাদগন্ধ রক্ষা পায় এবং কাব্যরসাশ্রিত নাট্যরস সহজেই সে ভাষায় সঞ্চারিত হয়।
জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা জাতীয় জীবন– এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে তার সিংহাবলোকন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ জর্মনিতে যান। জর্মনি তখন মিত্রশক্তির পদদলিত, শব্দার্থে মর্মাহত। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, পরাজিতের সঙ্গীত। তখন জর্মনিতে যেরূপ হার্দিক অভিনন্দন পেয়েছিলেন সে রকম অন্যত্র কোথাও পাননি। সে কথার উল্লেখ তিনি নিজেই করে গিয়েছেন। আমি অন্যত্র একাধিকবার তার প্রতি জর্মন প্রীতির নিদর্শন বর্ণন করার চেষ্টা করেছি। এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
এতদিন জর্মনদের বিশ্বাস ছিল, ভারতবর্ষ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির উচ্চ শিখরে উঠেছিল বটে, কিন্তু বর্তমান যুগে সে দেশে শুধু ম্যালেরিয়া, গোখরো এবং ইংরেজ। (যদিও অবান্তর তবু বলে ফেলি; শেষের দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি বেইমান সেটা পশুবিদরা এযাবৎ স্থির করে উঠতে পারেননি) রবীন্দ্রনাথের আগমনে এবং দু তিন মাসের ভিতর তার লক্ষাধিক পুস্তক জনসমাজে প্রচারিত হওয়ার ফলে তথা ডাকঘর নাট্যরূপে দেখে তাদের ভুল ভাঙল। নবীন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাদের মনে কৌতূহল জাগল। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখানোর ব্যবস্থা হল। প্রথম অধ্যাপক ভাগনার অবশ্য বাংলা শিখেছিলেন নিজের চেষ্টাতেই। জর্মনিতে অনূদিত তার বাংলা-গল্প চয়নিকা বেঙ্গালিষে এরসেলুনে সম্বন্ধে আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং প্রগাঢ় প্রীতি সম্বন্ধে বার্লিনে প্রবাসী বাঙালি মাত্রই সচেতন ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর দরদটি কেমন যেন ভীতি-ভরা বলে আমার মনে হত। আমার মনে হত, বিশ্বসাহিত্যের অপরিচিত এই সাহিত্যের প্রতি তাঁর মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি (প্রায় শুয়ের্মেরাই বলা চলে) পাছে লোকে ভুল বোঝে, সেই ছলে পাছে লোকে সেটিকেও অনাদর করে ফেলে– এই ছিল তার ভয়। দুঃখিনী মা লাজুক ছেলেকে যে রকম পরবের বাড়িতে নিয়ে যেতে ভয় পায়। শোকের বিষয় এই বিষয় নিরীহ ভাবুকটিও মজুমদারের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরও জর্মনি অনেক ভারতীয় রাজদ্রোহীকে আশ্রয় দিয়েছে। এ সম্বন্ধে আমি বিশেষ কিছু জানিনে। তার কারণ এর সবকিছুটাই ঘটত লোকচক্ষুর অগোচরে। তবে শুনেছি ইংরেজ যখন জর্মনির ওপর চাপ আনত, কোনও ভারতীয় বিদ্রোহীকে সে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য, তখন জর্মন পুলিশ তাকে কাতর কণ্ঠে বলত, কেন বাপু একই ঠিকানায় বেশি দিন ধরে থাক? ইংরেজ খবর জেনে আমাদের ওপর চোটপাট করে তোমাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য। আজই বাড়ি বদলাও। আমরা বলব, তোমার ঠিকানা জানিনে এ কথাটি আমি শুনেছি, নেতা লালা হরকিষণ লালের ছেলে মনোমোহনলাল গাওবার কাছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিংবা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে আমার চেনার মধ্যে জর্মনিতে ছিলেন শ্রীযুক্ত সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও বীরেন সেন (এঁর পুরো নাম ও পদবি আমার ঠিক মনে নেই); এ সম্বন্ধে এঁরা সবিস্তর বলতে পারবেন এবং কিছু কিছু বলেছেনও। আর ছিলেন পরলোকগত মানবেন্দ্র রায়।
ভারতের প্রতি হিটলারের শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। তদুপরি জাপানকে হাতে আনবার জন্য তিনি চীন ভারত তাকে (প্রভাবভূমি বা স্ফিয়ার অব্ ইনফ্লুয়েন্স রূপে) দান করে বসেছিলেন বলে সুভাষচন্দ্রকে বাইরে আদর দেখিয়েও ঠিকমতো সাহায্য করেননি। সুভাষচন্দ্র যে অতিশয় তেজস্বী মহাবীর এবং সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ বিচক্ষণ কূটনীতিক ছিলেন সে কথা আমার মতো সামান্য প্রাণীর প্রশস্তি গেয়ে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি হিটলারের মনোভাব বুঝতে পেরে জাপান চলে যান। জাপানই যখন শেষমেশ ভারত আক্রমণ করবে, তখন জর্মনিতে বসে না থেকে জাপানে চলে যাওয়াই তো বিচক্ষণের কর্ম। এ সম্বন্ধে বাকি কথা প্রসঙ্গ এলে হবে।
জর্মন সাহিত্যদর্শন তথা তার জাতীয় জীবন–এ দুয়ের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতি-বৈদগ্ধের প্রভাব কতখানি হয়েছে, এ সম্বন্ধে আলোচনা করার অধিকার আমার নেই। আশা করি শাস্ত্ৰাধিকারী ভবিষ্যতে এ নিয়ে প্রামাণিক পুস্তক লিখবেন। উপস্থিত আমি মাত্র একটি উদাহরণ দিয়ে এ স্থলে ক্ষান্ত হই।