নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েন্!
ভারত চলো, ভারত চলো!
ঠেলাগাড়ি চড়ে চড়েই তারা ভারতবর্ষে পৌঁছবে!
কবিরা শিশুপ্রকৃতি ধরেন, এবং শিশুরাও কবিপ্রকৃতি ধরে। দু জনারই বাস কল্পনারাজ্যে।
কিন্তু প্রশ্ন, তারা নাখ ইন্ডিয়েন, নাখ ইন্ডিয়েনই করছে কেন, না আমেরিকা কিংবা নাখ চীনা চেঁচাচ্ছে না কেন? জর্মনির কাচ্চাবাচ্চাদের ভিতরও তখন এই শুয়ের্মেরাই ছড়িয়ে পড়েছে। এ বইয়ের প্রকাশ ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে।
ওই সময়ে ইয়োরোপে যেসব পণ্ডিত বেদ চর্চায় মত্ত তাদের তিনজনই জর্মন : বেনাই, ম্যাকমুলার এবং ভেবার। ম্যাকমুলারকে সবাই চেনেন, ভেবারের লেখার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র সুপরিচিত ছিলেন, কিন্তু কেনফাই সামবেদের অনুবাদ করেছিলেন বলেই বোধহয় অতখানি খ্যাতি পাননি। তবে জর্মনির শিশুসাহিত্যে তিনি সম্রাট। তার পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ প্রাতঃস্মরণীয়।
কাজ তখন এত এগিয়ে গিয়েছে যে একখানা সর্বাঙ্গসুন্দর সংস্কৃত-জর্মন অভিধান না হলে আর চলে না। দুই জন পণ্ডিত ব্যোটলি ও রোট তখন যে অভিধান প্রস্তুত করলেন সেটি প্রকাশিত হল রুশ সম্রাটের অর্থসাহায্যে সাত ভলুমে, ১৮৫২-৭৫ খ্রিস্টাব্দে।
এ অভিধান অতুলনীয়। কিয়দ্দিন পূর্বে পরলোকগত পণ্ডিতবর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ই আমার জানামতে একমাত্র বাংলা আভিধানিক যিনি তার বঙ্গীয় শব্দকোষ রচনাকালে এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।
ওই শুন দিশে দিশে তোমা লাগি
কাঁদিছে ক্রন্দসী।
এ স্থলে ক্রন্দসী শব্দের অর্থ কী? ভাসা ভাসাভাবে অনেকেই ভাবেন, ওই চতুর্দিকে কান্নাকাটি হচ্ছে, আর কি। অন্যায়টাই-বা কী? স্বয়ং নজরুল ইসলাম লিখেছেন, কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের কোষ অনবদ্য। তাতেও দেখবেন, সংস্কৃত অভিধানে পাই নাই, কিন্তু রোদসী পাইয়াছি। তার অনুকরণে অনুপ্রাসানুরোধে (!) ক্রন্দসী। কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক উদ্ভাবিত (!) এবং বাংলায় প্রথম ব্যবহৃত। কিন্তু এতখানি বলার পর জ্ঞানেন্দ্রমোহন প্রকৃত কোষকারের ন্যায় অর্থটি দিয়েছেন ঠিক। আকাশ ও পৃথিবী; স্বর্গমর্ত।
ব্যোটলিঙ্ক-রোটের সংস্কৃত-জর্মন অভিধানখানার প্রসঙ্গ উঠেছে বলেই এ উদাহরণটির প্রয়োজন হল। এ অভিধান জর্মন দেশ ও বাংলার যোগসেতু।
একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেলে পাঠক অপরাধ নেবেন না।
ছেলেবেলায় আমার মনে ধোকা লাগে ক্রন্দসী শব্দ নিয়ে। সবে শান্তিনিকেতনে এসেছি। দূর থেকে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছি। শুনে ভয় পেয়েছি, তিনি নাকি বিশ বছর ধরে একখানা বাংলা অভিধান লিখছেন। বিশ বছর ধরে বাংলা-সংস্কৃত নয়, গ্রিক নয়, বাংলা অভিধান- বি…শ বছর ধরে! তখনও জানতুম না তার পরও তিনি আরও প্রায় বিশ বছর খাটবেন।
তাঁকে গিয়ে শুধাতে তিনি বড় আনন্দিত হলেন– আমি ভয় পেয়েছিলুম, তিনি বিরক্ত হতে পারেন। একাধিক বাংলা অভিধান দেখালেন যাতে শব্দটা নেই। তার পর ব্যোটলিঙ্ক রোট পড়তে পড়তে বললেন, এইবারে দেখ, জর্মনরা কী বলে। তাতে দেখি, ডি টোবেন্ডেন শ্লাখটরাইয়েন, অর্থাৎ যে দুই সৈন্যবাহিনী হুঙ্কার করছে। হরিবাবু বললেন, ঠিক, অর্থাৎ দুই পক্ষ- তার মানে উর্বশীর জন্য দু পক্ষই কাঁদছে। কিন্তু তার পরেও এগোতে হয়। ঋগ্বেদের এই ২, ১২, ৮–এর টীকা দিতে গিয়ে সায়ণাচার্য ক্রন্দসী শব্দের অর্থ করেছেন স্বর্গমর্ত।
উর্বশী কবিতায় রবীন্দ্রনাথও ক্রন্দসী শব্দ স্বর্গ ও মর্ত্য এই মর্মে ব্যবহার করেছেন। কারণ স্বর্গে দেবতা এবং মর্তের মানব দুই-ই যে তার প্রেমাকাভী, তার বর্ণনা তিনি এ কবিতায় দিয়েছেন।
এ স্থলে আর এগোবার দরকার নেই। জর্মনিতে ফিরে যাবার পূর্বে উল্লেখ করি হরিচরণ তার সফল শব্দকোষ ব্যোটলিঙ্ক-রোটকৃত অভিধানের প্যাটার্নে নির্মাণ করেছেন।
এ অভিধান জর্মনিতে প্রসার লাভ করার ফলে সে দেশে ভারতীয় জ্ঞান-চর্চা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলল এবং তারই ফলে তার পরিমাণ এমনই বিরাট রূপ এগিয়ে ধরল যে, ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিতদের হাতে সমর্পণ করতে হল। জর্মন পণ্ডিত ব্যুলার তখন এক বিরাট পুস্তকের পরিকল্পনা করলেন। আর্য-প্রাচ্যতত্ত্বের পরিকল্পনা–এন্টরিশ ডের ইন্ডো-আরিশেন ফিললগি উন্ট আলটের টুমসকুন্ডে নামে এ বই পরিচিত। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এর প্রথম ভলুম বেরোয়; এ যাবৎ কুড়ি ভলুম বেরিয়েছে। প্রধানত কিলহন, ডার্স, ভাকেরনাগেল এবং আরও অসংখ্য পণ্ডিত এতে সাহায্য করেন।
এর পর আর হিসাব রাখা যায় না।
কারণ এতদিন ছিল ব্যাকরণ, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন নিয়ে চর্চা; তার পর আরম্ভ হল ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য, নৃত্য, হস্তশিল্প, সঙ্গীত- আরও কত কী নিয়ে আলোচনা। শিট সায়েব তো একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন কামসূত্র নিয়ে। ব্যোটলিঙ্কের অভিধানে কামসূত্রের টেকনিকাল শব্দ বাদ পড়ে গিয়েছিল– শিট সে অভিধানের প্রয়োজন খণ্ড প্রণয়নকালে এত বেশি কামসূত্রীয় শব্দ প্রবেশ করিয়ে দিলেন যে, তাই নিয়ে পণ্ডিতমহলে নানা রকমের শ্রুতিমধুর মন্তব্য শোনা গেল। কৌটিল্য নিয়ে কী মাতামাতি! আর, আমি দেখেছি আমারই চোখের সামনে এক জর্মন মহিলা সপ্তাহে তিন দিন করে তিনটি বচ্ছর এলেন অধ্যাপক কিফেলের কাছে অষ্টাঙ্গের জর্মন অনুবাদে সাহায্যের জন্যে। তার পূর্বে তিনি মেডিকেল কলেজ পাস করে ওই বিষয়ে বোধহয় ডক্টরেটও নিয়েছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত ক বছর খেটেছিলেন বলতে পারব না। যে ডক্টর জাওয়ারব্রুখের কাহিনী পঞ্চম জর্জের অপারেশন প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি, তিনি পর্যন্ত ক্যানসারের গবেষণা আরম্ভ করার পূর্বে জর্মন ইন্ডলজিস্টের কাছ থেকে শুনে নিয়েছিলেন, ভারতীয় বৈদ্যরাজগণ এই মারাত্মক ব্যাধি সম্বন্ধে কোন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, কোন চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন।