জর্মনিতে ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান ইত্যাদির চর্চা অর্থাৎ ইন্ডলজি কতখানি প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে সে সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা বাংলাতে আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকাহিনী তার জন্য প্রশস্ত স্থান নয়, কিন্তু এ সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান না থাকলে জর্মন দেশবৃত্তান্তের একটা বিরাট মহৎ দিক অবহেলিত হয়, এবং দ্বিতীয়ত আমার ছাত্রজীবনের প্রায় চার বৎসর সেখানে কাটিয়েছি বলে একাধিক জর্মন সংস্কৃতজ্ঞের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য আমার হয় এবং ভ্রমণকাহিনীতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ইচ্ছা-অনিচ্ছায় প্রকাশিত হবে বলে এসব পণ্ডিত এবং তাঁদের সাধনা সম্বন্ধে এই সুযোগে যা না বললে নিতান্তই চলে না সেইটুকু বলে রাখি। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি, ভবিষ্যতে আমি এ প্রলোভন সম্বরণ করব।
ইভলজি আরম্ভ করেন ইংরেজরাই অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। জোনস, কোব্রুক, উইলসন এর প্রতিষ্ঠাতা। এর পরই ফ্রান্সে সিলভেসূত্র দ্য সাসি এ চর্চা আরম্ভ করেন। সঙ্গে সঙ্গে জর্মনিতে সেটা ব্যাপকতরভাবে আরম্ভ হয়। জর্মন পণ্ডিত শ্লেগেলই সর্বপ্রথম এ চর্চার ব্যাপকতা এবং কীভাবে একে অগ্রসর হতে হবে তার কর্মসূচি তার পুস্তক ঝুবার ডি স্পাখে উনট ভাইজহাইটডের ইভার (ভারতীয় ভাষা ও মনীষা:) ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন। এর কয়েক বৎসর পরেই জর্মন পণ্ডিত বপু সংস্কৃত ধাতুরূপের সঙ্গে গ্রিক, লাতিন এবং প্রাচীন জর্মন ধাতুর তুলনা করে সপ্রমাণ করেন যে, ভবিষ্যতে আর্যগোষ্ঠীর যে কোনও ভাষার মূলে পৌঁছতে হলে সংস্কৃত ভাষা অপরিহার্য। বস্তুত তিনিই প্রথম তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের কেন্দ্রভূমিতে যে সংস্কৃতকে স্থাপনা করলেন এখনও সে সেখানেই আছে। তারই দু বৎসর পরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জর্মনির বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংস্কৃত অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হয় এবং ওই কর্মে নিয়োজিত হন পূর্বোল্লিখিত ফ্রিডরিষ শ্লেগেলের ভ্রাতা ভিলহেলম শ্লেগেল। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে বপু বার্লিনে নিযুক্ত হলেন।
ভারতবর্ষে তখন সংস্কৃত চর্চার কী দুর্দিন!
শ্লেগেল ভ্রাতৃদ্বয়, বপ যে শুধু ভারতীয় ব্যাকরণ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন তাই নয়, তারা তখন সংস্কৃত সাহিত্যের রসের দিক অনুবাদের মাধ্যমে জর্মনিতে পরিবেশন করতে আরম্ভ করেছেন। ফলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ল জর্মন সাহিত্যে। কবিগুরু গ্যোটে শকুন্তলার অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ। তিনি তখন যা বলেছিলেন তাই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন প্রায় একশো বছর পরে। তিনি লিখলেন :
য়ুরোপের কবিগুরু গ্যোটে একটিমাত্র শ্লোকে শকুন্তলার সমালোচনা লিখিয়াছেন, তিনি কাব্যকে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন করেন নাই। তাহার শ্লোকটি একটি দীপবর্তিকার শিখার ন্যায় ক্ষুদ্র, কিন্তু তাহা দীপশিখার মতোই সমগ্র শকুন্তলাকে এক মুহূর্তে উদ্ভাসিত করিয়া দেখাইবার উপায়। তিনি এক কথায় বলিয়াছিলেন, কেহ যদি তরুণ বৎসরের ফুল, কেহ যদি মর্ত্য ও স্বর্গ একত্র দেখিতে চায়, তবে শকুন্তলায় তাহা পাইবে।
এবং প্রবন্ধ শেষ করতে গিয়ে লিখলেন :
গ্যোটের সমালোচনার অনুসরণ করিয়া পুনর্বার বলি, শকুন্তলায় আরম্ভের তরুণ সৌন্দর্য মঙ্গলময় পরম পরিণতিতে সফলতা লাভ করিয়া মর্তকে স্বর্গের সহিত সম্মিলিত করিয়া দিয়াছে।
গ্যোটের মতো কবি যখন সংস্কৃত নাটক পড়ে উচ্ছ্বসিত তখন অন্য কবিরা যে উৎসাহিত হবেন সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। গীতিকাব্যের রাজা হাইনে তখন দুঃখ-বেদনায় কাতর হলেই স্বপ্ন দেখতে লাগতেন সেই আনন্দনিকেতন, সেই স্বপ্নের ভুবন ভারতবর্ষ শেলি কিটস বায়রন যে অবস্থায় স্বপ্ন দেখতেন গ্রিসের।
গঙ্গার পার- মধুর গন্ধ ত্রিভুবন আলো ভরা
কত না বিরাট বনস্পতিরে ধরে।
পুরুষ রমণী সুন্দর আর শান্ত প্রকৃতিধরা
নতজানু হয়ে শতদলে পূজা করে।
আম্ গাঙেস ডুফটেট লয়েস্টটস
উনটু রিজেনবয়মে ব্ল্যুয়েন,
উনট শ্যোনে স্টিলে মেনশেন্।
ফর লটসব্লুমেন ক্লিয়েন।
গঙ্গানদীতে আমি পদ্মফুল ফুটতে দেখিনি। কিন্তু এ তো স্বপ্নরাজ্য। এর কিছুটা সত্য কিছুটা কল্পনা। তাই পূর্ব-বাংলার কবিও মধ্য আরবের মরুভূমির ভিতর দিয়ে তার নায়িকা লায়লাকে যখন মজনুর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন তখন তিনি যাচ্ছেন নৌকোয় চড়ে! এবং শুধু কি তাই? তিনি বিলের জল থেকে সেই আরবদেশে–কুমুদকহার তুলে তুলে খোঁপায় খুঁজছেন!
হাইনে জাত-ধর্মে ইহুদি। তার ধমনিতে আর্যরক্ত নেই। কিন্তু আর্যজর্মানিতে তখন ভারতীয় আর্যের প্রতি যে সমবেদনা, গৌরবানুভূতির প্লাবন আরম্ভ হয়েছে তাতে তিনিও নিজকে ভাসিয়ে দিলেন। তাঁর বহু কবিতায় কখনও প্রচ্ছন্ন, কভু-বা প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি আকুল ব্যাকুল হৃদয়াবেগ (জর্মন ভাষায় এই হৃদয়াবেগের নাম শুয়ের্মেরাই)।
ওই সময়ে ভারতের প্রতি জর্মনির কতখানি শুয়ের্মেরাই (ইংরেজিতেও এর প্রতিশব্দ নেই- ফেনাটিক এনথুসিয়েজম-এর অনেকটা কাছাকাছি) তার কয়েকটি উদাহরণ দিই।
ভারতবর্ষে যখন কেউ জর্মন ভাষা শিখতে আরম্ভ করে তখন সাধারণত তাকে যে প্রথম ক্ষুদ্র উপন্যাস পড়তে দেওয়া হয় তার নাম ইমেজে। আমিও এই বই পূৰ্বোল্লিখিতা শ্রীযুক্তা ক্ৰামরিষের কাছে পড়ি। তাতে জর্মন বাচ্চাদের খেলাধুলোর একটি বর্ণনা আছে। তারা সবাই মিলে একটা ঠেলাগাড়ি তৈরি করে তার উপর কেউ-বা চাপছে, কেউ-বা দিচ্ছে ঠেলা। আর সবাই মিলে একসঙ্গে প্রাণপণ চেঁচাচ্ছে :