কেন্দ্র থেকে সারি সারি হয়ে দেয়াল অবধি বেরিয়েছে পাঠকদের আসনপঙক্তি। উপরের কাঁচ দিয়ে যে আলো আসছে সেটুকু যথেষ্ট নয় বলে টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প। পাঠকদের অনেকেই পরেছেন কপালের উপরে রবারে বাধা শেড়–টেনিস খেলোয়াড়দের মতো। সামান্য পাতা উল্টোনোর শব্দ, পাশের ভদ্রলোকের কলমের অতি অল্প খসখস। আর কোনও শব্দ কোনও দিক দিয়ে আসছে না। অখণ্ড মনোযোগের পরিপূর্ণ অবকাশ।
এ জায়গা মানুষকে কাজ করতে শেখায়। আপনি হয়তো এলেন নটা পনেরো মিনিটে। এসে দেখেন আপনার পাশের ভদ্রলোক যেভাবে কাজ করছেন তার থেকে মনে হয়, তিনি অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। তার পর দশটা এগারোটা বারোটা একটা অবধি তিনি আর ঘাড় তোলেন না। আপনার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছে। তার পায়নি। আপনারও রোখ চেপে গেল। উনি না উঠলে আপনিও উঠবেন না। ইতোমধ্যে বাইরে গিয়ে বার বার সিগারেট খাবার ইচ্ছে হয়েছে সেটাও চেপে গিয়েছেন। দুটোর সময় উনি উঠলেন। আপনি যখন সাত তাড়াতাড়িতে চা-রুটি খেয়ে ফিরলেন, তিনি তখন ঘাড় গুঁজে ফের কাজে ডুব মেরেছেন। বোঝা গেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি সঙ্গে আনা দু খানা স্যান্ডউইচ খেয়েই কাজ সেরেছেন। তার পর তিনি উঠলেন পাঠাগার বন্ধ হওয়ার সময়।
এরকম যদি একটা লোক পাশে বসে কাজ করে তবে কার না মাথায় খুন চাপে। কিছুদিনের ভিতর দেখতে পাবেন, আপনিও দিব্য নটা ছটা করে যাচ্ছেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, কোনও ক্লান্তি আসছে না।
একেবারে কেন্দ্রে বসতেন একটি অতিশয় ছোটখাটো বৃদ্ধ। পরনে মর্নিং স্যুট। লম্বা দাড়ি। আবার মাথায় টপ হ্যাট! ঘরের ভিতরে ইংরাজ হ্যাট পরে না। এঁকে কিন্তু কখনও হ্যাটটি নামাতে দেখি না। বোধহয় হ্যাঁটের সামনের দিকটা দিয়ে তিনি শেডের কাজ চালিয়ে নিতেন।
সিন্ধি-গুজরাতিতে মেশানো কয়েকখানি ধর্মগ্রন্থের সন্ধান না পেয়ে তার কাছে গেলুম। তিন মিনিটের ভিতর তিনি ক্যাটালগের ঠিক জায়গা বের করে দিলেন, এবং এটাও বললেন, বোধহয় ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে এ সম্বন্ধে আরও বই আছে।
পরে এক ভারতীয়ের মুখে শুনলুম, হেন বই লাইব্রেরিতে নেই যার হদিশ তার অজানা। মিউজিয়মের চায়ের ঘরে কথা হচ্ছিল। লাইব্রেরির দেশবিদেশের পাকা গাহক কয়েকজন ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলেন।
.
এই অশ্রান্ত অজস্র পরিশ্রম আর নিষ্ঠার শেষ কোথায়, ফল কী? এদের সকলের বই কি জনসমাজে সম্মান পায়? বহু পরিশ্রমের পর যখন বই সম্মান পায় না তখন লেখকের মনে কী চিন্তার উদয় হয়? তিনি কি আবার নতুন করে কাজ আরম্ভ করেন, না ভগ্নহৃদয়ে শয্যাগ্রহণ করেন।
এর উত্তর দেবে কে?
শুধু এইটুকু জানি, মিউজিয়ম এ নিয়ে মাথা ঘামাক আর না-ই ঘামাক, সে সাদরে বংশপরম্পরাকে জ্ঞানের সন্ধানে সাহায্য করছে, আর পাঠাগারের কেন্দ্রটি বিশ্বের সর্বজ্ঞানের কেন্দ্র না থোক, অন্যতম কেন্দ্র।
ইংরেজকে এখানে নমস্কার।
বিশ্বজনের কাছে ভারতবর্ষ অপরিচিত দেশ নয়। প্রাচীন যুগে সে অপরিচিত ছিল না, এ যুগেও নয়। মাঝখানে কিছুদিনের জন্য অল্পসংখ্যক স্বার্থান্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ভারতবর্ষের সম্বন্ধে প্রচার করেন যে, যদিও এদেশ একদা সভ্যতা-সংস্কৃতির সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল আজ তার সর্বলোপ পেয়েছে এবং বৈদেশিক শাসন ভিন্ন এর পুনর্জীবন লাভের অন্য কোনও পন্থা নেই। এ কুৎসা প্রচারের ফলে প্রাচ্য-প্রতীচ্য উভয় মহাদেশেই বিস্তর কুফল ফলেছিল, এখনও কিছু কিছু ফলছে। এর জন্য সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই স্বল্পসংখ্যক সাম্রাজ্যবাদীদের দেশই। কিন্তু এ স্থলে স্মরণ রাখা কর্তব্য, সে দেশের মনীষীগণও তাই নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মাত্র একটি দেশ ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কখনও তার ভক্তিশ্রদ্ধা হারায়নি। সে দেশ জর্মনি। এদেশের গুণীজ্ঞানীরা সে তত্ত্ব অবগত আছেন। আমাদের কবি মধুসূদন একশো বছর পূর্বে লন্ডনে থাকাকালীন জর্মন পণ্ডিত গল্টকারের সঙ্গে দেখা করতে যান; এমনকি যে স্বল্পসংখ্যক জর্মন পণ্ডিতের মতবাদ আমাদের সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র ভ্রমাত্মক বলে মনে করেছেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি আপন যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছেন। পরবর্তী যুগে আমাদের শিক্ষাচার্য রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় শাস্ত্র গবেষণার জন্য জর্মন পণ্ডিত ইউনটার-নিসকে নিমন্ত্রণ করে বিশ্বভারতীতে নিয়ে আসেন; তখনই অপরিচিতা শ্রীমতী ক্ৰামরিশ তাঁরই সৌজন্যে বিশ্বভারতীতে ভারতীয় কলাচর্চার সুযোগ পান।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এদেশের জনসাধারণ জর্মনির খবর পেল দুই অশুভ যোগাযোগের ফলে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবাসী জর্মনি সম্বন্ধে নানা অতিরঞ্জিত কাহিনী শুনে ঈষৎ পথভ্রান্ত হয়েছে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। এদেশের পণ্ডিতসমাজেও জর্মন ভাষা সুপ্রচলিত নয় বলে ভারতবর্ষীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা জর্মনিতে কীভাবে হয়, তার কতখানি উন্নতি হয়েছে, সে বিষয় বাংলায় অনূদিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। যেসব বাঙালি বিপ্লবী জর্মনিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা সুস্পষ্ট কারণবশত এদেশে প্রসার লাভ করতে পারেনি।
ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান কলা-দর্শন সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার জন্য ইয়োরোপে যে শব্দটি প্রচলিত তার নাম ইভলজি– জর্মন উচ্চারণ ইন্ডলগি। শব্দটি অর্বাচীন ও গ্রিক গোত্রীয় (অবশ্য এর প্রথমাংশ ইন্দস শব্দটি মূলে ভারতীয়) এবং জর্মনির শিক্ষিতজন মাত্রই এটির বহুল প্রয়োগ করে থাকেন; ইংলন্ডের পণ্ডিতসমাজে এটি কখনও কখনও ব্যবহৃত হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় শব্দটি নেই, জর্মন সাইক্লোপিডিয়ায় নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ আছে।