এর জন্য কে দায়ী বলা কঠিন। কিন্তু যেই হোক, কিংবা যারাই হোন, এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, চোর-পুলিশের বাতাবরণে আর যা হয় হোক, জ্ঞানসঞ্চয় বিদ্যার্জন হয় না। তবে এর ব্যত্যয়ও আছে। এবং আমার বিশ্বাস, আমরা উন্নতির দিকেই চলেছি।
ব্রিটিশ মিউজিয়মে কাউকে যে সন্দেহের চোখে দেখা হয় না তার প্রধান কারণ প্রায় সবাই বয়স্ক, অনেকেই পণ্ডিতরূপে বিশ্ববরেণ্য। এখানে কাজ করতে হলে সহজে অনুমতি পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ মিউজিয়মের কর্তারা যে ডগ অ্যান্ড দি ম্যানেজার, অর্থাৎ আমি খাব না, তোকেও খেতে দেব না নীতি অবলম্বন করেন তা নয়। তাঁদের বক্তব্য, সাধারণ রিসার্চ, যেমন মনে করুন ডক্টরেটের কাজ করার জন্য লন্ডনে আরও বিস্তর লাইব্রেরি রয়েছে। সেখানে ভিড় কম, ও রিসার্চ একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে আপনি আপনার বই পেয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি। যেমন মনে করুন, আপনি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই আপনি আপনার প্রয়োজনীয় বই পেয়ে যাবেন। কিন্তু যেখানে গবেষণা একাধিক বিষয়বস্তু ছাড়িয়ে যায় সেখানে স্পেশেলাইজড লাইব্রেরি কুলিয়ে উঠতে পারে না– তখন ব্রিটিশ মিউজিয়ম আপনাকে স্বাগতম জানায়।
এবং সবচেয়ে বড় কথা– পৃথিবীর সর্ব জায়গা থেকে এত সব নামকরা পণ্ডিত এখানে আসেন যে, মিউজিয়ম তাঁদের নিরাশ করে অপেক্ষাকৃত, কিংবা সম্পূর্ণ অজানা গবেষককে স্থান দিতে চায় না– কারণ পাঠাগারের সাইজ দশ ডবল করে দিলেও সে তার মোহাকৃষ্ট গবেষকদের স্থান কুলান করতে পারবে না।
মিউজিয়মের চায়ের স্টলে একজন পণ্ডিতের সঙ্গে আলাপ হয়।
তিনি বললেন, রিডিং রুমে ঢুকেই একজন নিগ্রো ভদ্রলোককে লক্ষ করেছেন কি? আবলুসের মতো রঙ আর বরফের মতো সাদা চুল? নাগাড়ে বিশ বছর ধরে ওই আসনে বসে কাজ করে যাচ্ছেন।
আমি বললুম, আপনি ক বছর ধরে?
তিনি যেন একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, সামান্য। পনেরো হবে। আমার চেয়ে যারা ঢের প্রবীণ তাঁদের কাছে শোনা।
আমি শুধালুম, ইনি কী কাজ করছেন?
হাবশি মুল্লুকে খ্রিস্টধর্মের অভ্যুদয় কিংবা ওরই কাছাকাছি কিছু একটা। হিব্রু, আরাহময়িক, আহমরিক, সিরিয়াক এসব তাবৎ ভাষায় লেখা বই ঘাঁটতে হলে এখানে না এসে তো উপায় নেই।
আমি সামান্য যে ক দিন কাজ করেছিলুম সে কদিন নিগ্রো ভদ্রলোকের নিষ্ঠা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি। নটার সময় কাটায় কাটায় তাকে আসন নিতে দেখেছি এবং উঠতেন ছটার সময়। এর ভিতরে আসন ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকলে আমার অজানতে। আর দেড়টা থেকে দুটো অবধি চেয়ারের হেলানে মাথা দিয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নিতেন।
লিখতেন অল্পই। পড়তেন বেশি। চিন্তা করতেন তারও বেশি। দু একবার চোখাচোখি হয়েছে। তিনি যেন আমাকে দেখতেই পাননি। চোখ দুটি কোন অসীম ভাবনার গভীর অতলে ডুবে আছে আমি জানব কী করে? কিংবা তিনি হয়তো ছবি দেখছেন, সেই আদিম আবিসিনিয়ান সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন খ্রিস্টের দূত, শান্তির বাণী বহন করে। তখন তাঁদের সভ্যতা সংস্কৃতি কোন স্তরে ছিল, খ্রিস্টের বাণী তারা কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন– তারই ছবি দেখছেন। যেখানে ছবি অসম্পূর্ণ কিংবা ঝাপসা সেটাকে সম্পূর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর করার জন্য এই সাধনা।
তাঁর বই লেখা শেষ হয়েছিল কি না, প্রকাশিত হলে কজন লোক সেটি পড়েছিল, বুঝবার মতো শক্তি কজন পাঠকের ছিল তা-ও জানিনে। কারণ এরকম নিষ্ঠাবান সাধক পাঠাগারের অনেকেই।
এ স্থলে পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমি সেখানে ঠাই পেলুম কী করে? কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, আমি পণ্ডিত নই।
জর্মনিতে পড়াশোনা করার সময় আমার কয়েকখানা বইয়ের প্রয়োজন হয়। সেদেশে সেগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না বলে অধ্যাপক বললেন, ব্রিটিশ মিউজিয়মে যাও; সেই সুযোগে লন্ডনও দেখা হয়ে যায়।
তিনি নিজে প্রায়ই লন্ডনে এসে কাজ করে যেতেন। মিউজিয়মের কর্তারা ভালো করেই জানতেন, পণ্ডিতসমাজে তার স্থান কতখানি উঁচুতে। তিনি যখন পরিচয়পত্র দিয়ে পাঠালেন তখন এঁরা আর কোনও প্রশ্ন শুধালেন না।
কিন্তু বার বার লজ্জা অনুভব করেছি।
প্রথম মুশকিল আসন নিয়ে। কোনও আসনে কেউ বসছেন বিশ বছর ধরে, কেউ ত্রিশ বছর ধরে। ঠিক সেদিনটাই হয়তো তিনি তখনও আসেননি। আপনি না জেনে বসে গেলেন তারই আসনে– কারণ কোনও চেয়ার কারও জন্য রিজার্ভ করা হয় না। তিনি খানিকক্ষণ পরে এসে আপনাকে ওই চেয়ারে দেখে চলে গেলেন কিছু না বলে। অন্য জায়গায় বসে তিনি ঠিক আরাম পেলেন না। আপনি কিন্তু জানতেই পেলেন না।
পরের দিন গিয়ে দেখলেন, অন্য কে একজন– তিনিই হবেন– ওই আসনে বসে আছেন। আপনি নতুন আসনের সন্ধানে বেরোলেন।
এসব বুঝতে বুঝতে কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। যখন বুঝলুম, তখন শরণাপন্ন হলুম এক কর্মচারীর। তিনি অনেক ঘাড় চুলকে আমাকে একটি আসন দেখিয়ে বললেন, এ চেয়ারটায় এক ভদ্রলোক বসছেন দশ বৎসর ধরে।
আমি বললুম, থাক্ থাক্।
তিনি বললেন, তবে মাসখানেক ধরে তিনি আসছেন না।
আমি বললুম, তা হলে উপস্থিত এখানেই বসি। কিন্তু তিনি এলে আমায় বলে দেবেন কি?
বিরাট গোল ঘর! মাঝখানে চক্রাকারে সাজানো ক্যাটালগ। আর একেবারে কেন্দ্রে বসে কয়েকজন কর্মচারী। এঁদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বড় একটা হয় না। বই আসে-যায় কলের মতো।