আমি বললুম, আশ্চর্য! আমাদের গান্ধীকে তো ইংরেজ ডাক্তারই অপারেশন করেছিল।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, গল্পটা এখানেই শেষ নয়। কয়েক দিন পর ডাচেস অব কনোট না কেন্ট, কার জানি শক্ত ব্যামো হয়েছে। জাওয়ারব্রুখকে প্লেনে করে এখন তো প্লেন ডাল-ভাত– লন্ডন আনানো হল। অর্থাৎ ডাচেসের বেলা জর্মন ডাক্তার চললে চলতেও পারে, রাজার বেলা নয়!
আমি বললুম, বা রে!
বললেন, এখানেও শেষ নয়। জাওয়াব্রুখ তো রুগীর ঘরে ঢুকে রেগে কাই। এ রুগী তো ভয়ে কাঁপছে না, কাঁপছে শীতে। রুগীর লেপ তো লেপ নয়, ভিজে কাঁথা। বললেন, এ ঘরে রুগীর চিকিৎসা চলবে না। বেশ চড়া গলাতেই নাকি বলেছিলেন, মানুষ থাকার উপযোগী এবং ভদ্র (রিজনেবল) ঘরে ওঁকে নাকি নিয়ে যেতে হবে। একে জর্মন, তায় ডাক্তার– চড়া গলাতে বলবেই তো। তখন আরম্ভ হল তুলকালাম কাণ্ড। বহু হট্টগোলের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য ঘরে সেখানে একটি ইলেকট্রিক হিটার কোনও গতিকে লাগানো হল।
ডাক্তার কী বললেন, জানেন? বললেন, কিছু হয়নি; কালই সেরে যাবেন। এবং সেরে গেলেন।
আমি বললুম আশ্চর্য।
তিনি বললেন, এ-ও শেষ নয়। পরদিন ডুক দিলেন ডাক্তারকে বিরাট ভোজ। তার পরিচিত লাট-বেলাট সবাইকে নেমন্তন্ন করা হল। স্বয়ং ডাচেস সেরে উঠে ব্যানকুয়েটে বসলেন। চার্চিলও ছিলেন। তার পর কী কাণ্ড হল জানেন?
ভোজ খেয়ে হোটেলে ফিরে এসে জাওয়ার দেখেন সেখানে আরেক কাণ্ড। চেনা আধা-চেনা যে তাঁকে দেখে সেই মাথা নিচু করে বাও করে। ওয়েটার, ম্যানেজার সবাই তাঁর পিছনে পিছনে ছুটছে। হুজুরের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো, হুজুরের কী চাই? ডাক্তার তো অবাক। ডাচেসের জন্য গরম ঘরের ব্যবস্থা করেই এতখানি?
আসলে তা নয়। শোবার ঘরে গিয়ে ডাক্তার দেখেন, তার টেবিলের উপর সন্ধ্যাবেলাকার কাগজ। তাতে মোটা মোটা হরফে লেখা জর্মনির ডাক্তার জাওয়ারব্রুখ রাজাকে আজ সন্ধ্যায় অপারেশন করলেন! খবরের কাগজ সবকিছু জানে কি না! জাওয়ারব্রু লন্ডনে, ওই সময়ে, টায়টায়।
আমি আবার বললুম, আশ্চর্য! জাওয়ার প্রতিবাদ করলেন না?
তিনি বললেন, পরের দিন ভোরেই তাকে প্লেনে তুলে দেওয়া হল– এ্যারপোর্টে ডুক ডাচেস সবাই উপস্থিত। হৈহৈ-রৈরৈ। দেশে গিয়ে দেখেন, ইতোমধ্যে মার্কিন কাগজগুলো বলতে আরম্ভ করেছে, জাওয়ার অস্তর করার জন্য এক মিলিয়ন পৌন্ড পেয়েছেন! জর্মন কাগজরা আত্মম্ভরিতায় ফেটে যাবার উপক্রম। জাওয়ারব্রুখ একে ওঁকে জিগ্যেস করলেন, কী করা উচিত। সবাই বলে এই ডামাডোলের বাজারে কেউ তোমার প্রতিবাদ (দেমাতি) শুনবে না। চেপে যাও।
তার পর! ঠিক সেই সময়ে এক তাগড়া লম্বাচৌড়া নার্স এসে উপস্থিত। তাকে তুলে ধরল। তিনি ক্রাচ তুলে নিয়ে একদিকে ধরলেন, অন্যদিকে ভর করলেন নার্স। সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বারোটার ঘন্টা। বললেন, ও রেভোয়া–অর্থাৎ আবার দেখা হবে। গুড বাই নয়। তার অর্থ অন্য।
কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন জাগল, জাওয়ার কি জানতেন তাঁকে ডাচেসের বাড়িতে আনা হয়েছিল তার অসুখের ভান করে। ওই সময়ে তিনি যেন লন্ডনে হাতের কাছে থাকেন। অপারেশনে যদি গণ্ডগোল হয়, তাকে তখখুনি ডেকে পাঠাবার জন্য।
যাকগে। কালই তো জর্মনি যাচ্ছি। আমার বন্ধু পাউলকে শুধাব! সে গুণী, সব জানে।
.
বহু চেষ্টা করেও লন্ডনের সঙ্গে দোস্তি জমাতে পারলুম না। পূর্বেও পারিনি। কারণ অনুসন্ধান করে আশ্চর্য বোধ হয়েছে, যে শহরকে দশ-এগারো বছর বয়স থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মারফতে চিনতে শিখেছি তার সঙ্গে হৃদ্যতা হয় না কেন? বোধহয় ইংরেজ এদেশে রাজত্ব করেছে বলে। বোধহয় বহুকাল ইংরেজের গোলামি করেছি তার প্রতি রাগটা যেন যেতে চায় না। তার সদগুণ দেখলে রাগটা আরও যেন বেড়ে যায়। তখন মনে হয়, এর সঙ্গে দোস্তিটা জমাতে পারলে জীবনটা আরও মধুময় হতে পারত।
কিন্তু আমি তো এ ফরিয়াদে একা নই। ফরাসিরা তো ইংরেজকে সোজাসুজি অনেক কথা বলে। মাদাম টাবউই বই লিখেছিলেন– পারফিডিয়াস এলবিয়ন অর আঁতাৎকর্দিয়াল। জর্মন, হাঙ্গেরিয়ান এবং অন্যান্য জাত অত কড়াভাবে কথাটা বলেনি বটে, কিন্তু ইংরেজের প্রকৃতি যে আর পাঁচটা জাতের মতো নয় সে কথা সবাই স্বীকার করে নেয়। কেউ ব্যঙ্গ করেছে, কেউ সহিষ্ণুতার সদয় হাসি হেসেছে। এ শুধু টুরিস্টদের সাধারণ অভিজ্ঞতা নয়, হাইনে, ভলতেয়ার, জোলার মতো বিচক্ষণ মহাজনরা যা বলে গেছেন সে তো কিছু ঝেড়ে ফেলে দেবার মতো নয়।
কিন্তু একটি কথা সবাই স্বীকার করেছেন। শেকসপিয়ারের মতো কৰি হয় না, ইসকিলাস, দান্তে, গ্যোটে এঁদের কারও চেয়ে ইনি কম নন। আর এর মহত্ত্ব এমনই বিরাট যে, তাঁকে নকল পর্যন্ত করার সাহস কারও হয় না।
কিন্তু এ তত্ত্ব নিয়ে অত্যধিক বাক্যব্যয় আমি করতে যাব কেন?
আমাকে যে জিনিস সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে সেইটে বলে প্লেনে উঠি।
.
ব্রিটিশ মিউজিয়মের পাঠাগার। অনেক দেশে বিস্তর পুস্তকাগারে ঢুকেছি। থানাতেও দু-একবার গিয়েছি। দুটোতে কোনও পার্থক্য লক্ষ করতে পারিনি। আমি যেন চোর। বই সরাবার মতলব ভিন্ন আমার অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে এটা কেউই যেন বিশ্বাস করতে চায় না। কার্ড দেখানো থেকে আরম্ভ করে বই ফেরত দিয়ে বেরোবার পরও মনে হয় পিঠের উপর ওদের চোখগুলো যেন সার্জেনের তুরপুনের মতো কুরে কুরে ঢুকছে।