য়হি স্বর্গ সুরলোক
মহি সুরকানন সুন্দর।
মহা অমরোকা ওক,
মহা কহি বসত পুরন্দর ॥
এইটেই স্বর্গসুরলোক, এইখানেই কোথাও পুরন্দর বাস করেন।
শুনেছি, এরই আশপাশে চার্চিল থাকেন, এপস্টাইন বাস করেন।
তবে ইনি খান্দানি লোক। কাজকর্ম নেই। অবেলায় পার্কে রোদ মারতে বেরিয়েছেন।
ছিঃ। তখন দেখি তার বাঁ দিকে একটা ক্রাচ– খোঁড়ারা যার উপর ভর দিয়ে হাঁটে। নিজের মনকে কষে কান মলে দিলুম- উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ না করে মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য।
বললেন, পেস্তালৎসি কিন্তু শেষ বয়সে আপন মত অনেকখানি পরিবর্তন করেছিলেন। বলতেন, বাচ্চাদের বড় বেশি যা-তা করতে দিতে নেই।
আমি অবাক। আমি তো শুনেছি ইংরেজ অচেনার সঙ্গে কথা কয় না। ইনি আবার খান্দানি।
ভদ্রলোক কিন্তু পাঁচ সিকে সপ্রতিভ। কঞ্জুস যে রকম চুনের কৌটো থেকে খুঁটে খুঁটে শেষ রত্তি বের করে, ইনি ঠিক তেমনি দুটি নীল চোখ দিয়ে আমার চোখ দুটি খুঁটে খুঁটে শেষ চিন্তা বের করে নিচ্ছেন।
বললেন, সে আমি বেশ জানি, প্রাচ্যদেশীয়দের সঙ্গে বিনা পরিচয়েই কথা আরম্ভ করা যায়। মুখে অল্প অল্প হাসি-খুশির ভাব।
আমি শুধালুম, আপনি কি অনেক প্রাচ্যদেশীয়দের চেনেন?
বললেন, আদপেই না। আপনিই প্রথম।
আমি বললুম, সে কী? এখন তো লন্ডনে বিদেশিই বেশি বলে মনে হয়। আমি তো ভেবেছিলুম পাছে এদের ঠেলায় খাস লন্ডনবাসীরা শহরছাড়া হয় তাই ম্যাকমিলানকে প্রস্তাব করে পাঠাব কাঁটার তার দিয়ে দিয়ে লন্ডনের আদিবাসীদের জন্য (আমি এবরোজিনালস শব্দটি প্রয়োগ করেছিলুম) আলাদা মহল্লা করে দেবার জন্য। সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে, প্রাণীদের খাবার দেওয়া বারণ। হুকুম অমান্য করলে এক পৌন্ড জরিমানা। কী বলেন?
বললেন, খাঁটি কথা। আমাদের পাড়া তো যায়-যায়।
ইচ্ছে হচ্ছিল শুধাই কোন পাড়া। কিন্তু ইনি যখন প্রাচ্য কায়দায় বিনা পরিচয়ে আলাপ আরম্ভ করেছেন, তখন আমার উচিত প্রতীচ্য কায়দা অনুসরণ করা।
বললুম, কলকাতায় তো তাই হয়েছে। আমরা কলকাতার আদিবাসীদের কোণঠাসা করে এনেছি।
তিনি শুধালেন, আমরা মানে কারা?
এ তো তোফা ব্যবস্থা। উনি প্রাচ্য পদ্ধতিতে দিব্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যাচ্ছেন, আর আমি নেটিভ ছুরি-কাটা নিয়ে আনাড়ির মতো কিছুই মুখে তুলতে পারছিনে। ঠিকই তো। সেই কথামালার গল্প। বক তার লম্বা ঠোঁট চালিয়ে কুঁজো থেকে টপাটপ খাবার তুলে নিচ্ছে। আর আমি খেঁকশেয়ালটার মতো শুধু কুঁজোটার গা চাটছি। আর ব্যবস্থাটা করেছে বই।
কিন্তু হলে কী হয়? ইংরেজের বাচ্চা। বেশিক্ষণ প্রশ্ন শুধোবে কী করে? অনভ্যাসের ফোঁটা নয়, অনভ্যাসের লাল লঙ্কা। খাবে কতক্ষণ!
আমি বললাম, আমি শিক্ষাবিদ নই, তবু জানতে ইচ্ছা করে এ দেশের শিক্ষিত পরিবারে বাচ্চারা কতটুকু যাচ্ছেতাই করার সুযোগ পেয়েছে!
এবারে ইংরেজের ইংরেজিপনা আরম্ভ হল। অনেকগুলি সবৃজনকটিভ মুড ব্যবহার করতে পেরে ভদ্রলোক যেন বেঁচে গেলেন। ওই মুডটাই ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, কারণ এতে প্রকাশ পায় অনিশ্চয়তা। শুড উডের ছড়াছড়ি– আই শুড সে, ইট উড় অ্যাপিয়ার, ওয়ান মাইট থিন থাকলেই বুঝতে হবে ইংরেজ পাকাপাকি কিছু বলতে চায় না, কিংবা ভদ্রতা প্রকাশ করতে চায়– ফাউলার যা বলুন, বলুন। আমরা এ জিনিসটেই প্রকাশ করি অতীতকাল দিয়ে। শ্বশুরমশাই যখন জিগ্যেস করেন, তা হলে বাবাজি আসছ কবে? আমরা ঘাড় নিচু করে বলি, আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলুম ভাদ্র মাসে এলেই ভালো হয়। আসলে কিন্তু বলতে চাই, আমি ভাবছি…। তা বলিনে; অতীতে ফেললে বিনয় প্রকাশ হয় অনিশ্চয়তাও বোঝানো হয়, অর্থাৎ শ্বশুরমশাই ইচ্ছে করলেই আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা নাকচ করে দিতে পারেন।
ইংরেজ বললেন, অন্য লোকে যে আমাদের দ্বীপবাসী বলে সেটা কিছু মিথ্যে নয়! ওই পেস্তালৎসি, ফ্ল্যোবেলের কথা বলছিলেন না? এদের তত্ত্বকথা সর্বজনমান্য হয়ে গেলেও আমরা সেগুলো গ্রহণ করি সকলের পরে। চ্যানেলের ওপার থেকে যা কিছু আসে তাই যেন আমরা একটু সন্দেহের চোখে দেখি। আর গ্রহণ করলেও সমাজের সব শ্রেণি একই সময়ে নেয় না। আমাদের বাড়িতে কিছু মনে করবেন না, একটু ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে–
আমি বললুম, প্রাচ্য পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত হওয়াটাই রেওয়াজ।
ধন্যবাদ। আমাদের বাড়িতে এখনও প্রাচীন পন্থা চালু। দুনিয়ার আর সর্বত্র সেন্ট্রাল হিটিঙ কিংবা ইলেকট্রিক দিয়ে ঘর গরম করা হয়, আমাদের বাড়িতে এখনও লগ ফাইয়ার –কাঠের আগুন। ওহ্! একটা ঘটনা মনে পড়ল। আপনি জাওয়ার ডাক্তারের কথা শুনেছেন?
যদিও লোকটি অতিশয় ভদ্র, মাত্রাধিক দ্ৰ বললেও ভুল বলা হবে না, তবু একটু বিরক্ত হলুম। এই ইংরেজরা কি আমাদের এতই অগা মনে করে বললুম, সেই যিনি সর্বপ্রথম ফুসফুসের অপারেশন আরম্ভ করেন?
ইংরেজের তারিফ করতে হয় মানুষের গলা থেকে মনের ভাব চট করে বুঝে নেয়। ভদ্রলোক বার বার মাফ চাইতে আরম্ভ করলেন। আমিও একটু লজ্জা পেলুম।
বললেন, হাজারটা ইংরেজের একটা ইংরেজও ওঁর নাম জানে না। তাই আপনাকে জিগ্যেস করেছিলুম।
আমিও ভদ্রতা করে বললুম, আমিও জানতুম না যদি না এক জর্মন ডাক্তারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না হত। তার পর কী বলছিলেন, বলুন।
১৯২৮-এ যখন পঞ্চম জর্জের শক্ত ব্যামো হয়, তখন তাঁর কাছে ইংরেজ ডাক্তাররা পাঠালে রাজার এক্স-রে ছবি। ওঁর মতামত জানতে চাইলে–বুকে অপারেশন করা হবে, না শুধু ফুটো করলেই হবে, না ড্রেন করতে হবে, না কী? এবং এ কথাও জাওয়ার বুঝে গেলেন যে, আর যা হয় হোক, কোনও বিদেশি সার্জনকে দিয়ে রাজার অপারেশন করা চলবে না। ইংরেজ ডাক্তারগোষ্ঠী তা হলে আপন দেশে মুখ দেখাতে পারবে না।