পিছনে আবার একটা কুকুর। মনিবের সেই মেলগাড়ির তেজে চলার সঙ্গে পাল্লা রাখতে গিয়ে এই শীতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অতিশয় অপ্রিয়দর্শন। ডাহুন্ট না কী যেন নাম। পিপের মতো দেহ। মনে হয় যেন দুটো কুকুর জুড়ে একটা বানানো হয়েছে। অথচ আস্তে আস্তে চললে একেও হয়তো মন্দ দেখাত না।
সবশুদ্ধ জড়িয়ে মুড়িয়ে যাকে বলে কাল্ট অব দি আগলি অর্থাৎ কুৎসিত ধর্ম। মডার্ন কবিতা। যার বিষয়বস্তু, ডাস্টবিন, পচা ইঁদুর, মরা ব্যাঙ।
বিরক্তি হয়নি, দুঃখ হয়েছিল। আসলে এরা তো কুৎসিত নয়। এসব গায়ে পড়ে করা। দেশকালপাত্র।
বাঁচালে। হাওয়াটা বন্ধ হয়েছে। ওই হাওয়াটাই যত অনর্থের মূল। উনি বন্ধ হলে বেশ ওম ওম ভাবটা জমে আসে। বেঞ্চির হেলানে মাথাটা চিত করে আকাশমুখো করলুম। ধুপ করে হ্যাটটা পড়ে গেল। তা পড়ক। বন্ধ চোখে লাগল রোদের কুসুম কুসুম পরশ। দেশে গরমের দিনে চোখে ঠাণ্ডা জল দিলে যে রকম আরাম বোধ হয়। হাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে পোড়া ট্রেলের গন্ধও নাকে আসছে না। এদেশের লোকের বোধহয় অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। আমি তো সর্বক্ষণ হাতে-গোঁফে চামেলি ঘষি। ভাগ্যিস খানিকটে আতর সুটকেসের পকেটে করে অজানতে চলে এসেছে। এদেশের ও দ্য কলোন লেভেন্ডার ছিটোলে শীতটা যেন আরও ছমছম করে ওঠে।
এবার হেমন্তটা এই পোড়া লন্ডনেও হেমন্ত বলেই ঠেকছে। কাল গিয়েছিলুম মোটরে করে লন্ডনের উত্তরে, গ্রামাঞ্চলে মাইল বিশেক দূরে। তখন চোখে পড়েছিল সত্যকার হেমন্ত।
হেমন্ত নিয়ে এ সংসারের সব কবিই বিপদগ্রস্ত হয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বোধহয় শ দেড়েক গান রচেছেন বর্ষা নিয়ে। হেমন্ত নিয়ে পাঁচটি হয় কি না হয়। কবিগুরু কালিদাস পর্যন্ত ঋতুসংহারে হেমন্তের বন্দনা করতে গিয়ে যা রচেছেন তার তুলনায় তার বর্ষা বর্ণন শতগুণে শ্রেয়। তবু তার কলম জোরদার। হেমন্ত ঋতুতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন তিনি মানসযাত্রী হংস ক্রৌঞ্চমিথুন আর মাটির দিকে দেখেছেন পরিকু শস্যে গ্রামের প্রত্যন্ত প্রদেশ পরিপূর্ণ। হেমন্তের সেই সফল শান্তির পূর্ণতা দেখে প্রার্থনা করেছেন;
বহুগুণরমণীয়ো যোষিতাং চিত্তহারী
পরিণতবহুশালিব্যাকুলগ্রামসীমা।
সততমতিমনোজ্ঞঃ ক্রৌঞ্চমালাপরীতঃ।
প্রদিশতু হিমযুক্তঃ কাল এষ সুখং বঃ ॥
হঠাৎ শুনি ধমকের শব্দ। রমণীকণ্ঠে।
শিক্ষিত ভদ্রলোকের ইংরেজিই ভালো করে বুঝিনে, ককনি বোঝা আমার কর্ম নয়। তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে ডান দিকে একটি পেরেম্বুলেটর। তার পিছনে একটি ছোট্ট বাচ্চা। চলি চলি পা-পা করে গোলদিঘিতে ক্ষুদে একটি রবারের নৌকা ভাসাবার চেষ্টা করছে। ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটা বার বার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে তার আয়া অসহিষ্ণু হয়ে লাগিয়েছে তাকে এক বিকট ধমক। সে ধমকের ধাক্কায় রাজ-পাতি সব হাঁস প্যাক প্যাক করে পালাচ্ছে, নৌকোটা পর্যন্ত ডুবুডুবু!
শুনেছিলুম, এ দেশে বাচ্চাদের ধমক দেওয়া হয় না। দেশের এক অতি আধুনিক পরিবার। সেখানে অতিথি এলে এক ছেলে পিঠে পিন ফুটাত, অন্য ছেলে কাঁচ কাঁচ করে কাঁচি দিয়ে তার টাইটি কাটতে আরম্ভ করত। ধমক দিতে গেলে বাপ-মা অতিথিকে বিলেতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
ফের ঘাড় ঝুলিয়ে দিলুম বেঞ্চির হেলানে, মুখ তুলে দিলুম আকাশের দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বললুম, হায় পেস্তালৎসি, হায় রে ফ্র্যোবেল, কোথায় তুমি ফ্রয়েট! এই ককনি রমণীকে পর্যন্ত তালিম দিয়ে শাবুদ করতে পারনি!
এবারে শুনি বাঁ দিক থেকে, বেগি পান্। মানে? ওহ্বেগ ইয়োর পার্ডন! হকচকিয়ে চোখ খুলে দেখি, আমার অজানতে এক ভদ্রলোক বেঞ্চির অন্য প্রান্তে আসন নিয়েছেন।
সুন্দর চেহারা। ঢেউ খেলানো সোনালি ব্লন্ড চুল হাওয়াতে অল্প উস্কোখুস্কো। নাকটি খাঁটি রোমান, ব্রিজের চিহ্নমাত্র নেই। মুখের রঙ পুরনো হাতির দাঁতের মতো। শুধু গাল দুটিতে অতি অল্প গোলাপির ছোঁয়া লেগেছে। একটুখানি গোঁফ মাথার চুলের চেয়ে এক পোঁচ বেশি সোনালি।
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে না। আমি কিছু বলিনি। তার পর আমতা আমতা করে বললুম, আমি শুধু পেস্তালৎসির কথা স্মরণ করছিলুম।
হাত দু খানি জানুর উপর ভারি শান্তভাবে রাখা, যেন রেমব্রান্টের ছবিতে আঁকা। সরু লম্বা লম্বা। নখে লালের আভাস। চমৎকার মেনিকোর করা। বয়স ৩০/৩৫। ঠিক বলতে পারব না। সায়েব-সুবোদের বয়েস আমি অনুমান করতে পারিনে।
এবারে আমার পালা। সায়েব কী যেন বললে। বুঝতে না পেরে বললুম, বেগি পান। সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বুঝে গেলুম বলেছে, থ্যাঙ্ক গড় ধরনের কিছু একটা। কিন্তু তখন তো আর বেগ ইয়োর পার্ডনটা ফের বেগ করে ফেরত নেওয়া যায় না।
পাশে বেঞ্চির উপর অত্যুকৃষ্ট শোলার হ্যাট, তার ভিতরে দু খানা দস্তানা। পরনে হেরিং মাছের কাঁটার নকশা কাটা নতুন স্যুট। শক্ত কলার, ডোরাকাটা টাই– কোনও পাবলিক স্কুলের নিশানমারা হতেও পারে কফের বোম ঝিনুকের, মাঝখানে কী একটা ঝকঝকরছে। পায়ে ছুঁচলো কালো জুতো। এবং বিশ্বাস করবেন না, তার উপর স্প্যাট!
ত্রিশ বৎসর পূর্বে এ রকম বেশভূষা মাঝে-মধ্যে দেখেছি। বইয়ে বর্ণনা পড়েছি। এ কি বিংশ শতাব্দীর রিপ ভান উইনল?
তখন মনে পড়ল কেনসিংটন গার্ডেনের আশেপাশে থাকেন এদেশের খান্দানিরা। কাশ্মীরের বর্ণনা দিতে গিয়ে হিন্দি কবি গেয়েছেন,