রসিকতা নয়, একটুখানি সবুর করুন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলায়ই মুখুজ্যের বয়সীই তার এক ইংরেজ বন্ধু এসে উপস্থিত। ছোকরা খাঁটি ইংরেজ, লড়াইয়ের সময় ভারতবর্ষে এসেছিল, এ দেশটাকে এতই ভালোবেসে ফেললে যে শেষ পর্যন্ত দিশি মেম নিয়ে বিলেতে গেল। বললে, এদেশের লোক ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এমনি অগা যে, সেদিন এক গবেট বিবিসিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললে, ভারতবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ লোক বাইরে শোয়। আমি ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে বিবিসিতে কড়া চিঠি লিখেছি।
আমি বললুম, এতে চটবার কী আছে? কথাটা তো সত্যি। গরমের দেশের লোক ১১৪ ডিগ্রিতে সর্বাঙ্গে কম্বল জড়িয়ে ঘরের ভেতর শোবে নাকি? তোমাদের দেশের লোক মাইনাস দশ ডিগ্রিতে যদি বাইরে শোয় তবে মরে যাবে। আমাদের দেশের লোক গরমে ঘরের ভিতর দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে না বটে, কিন্তু সারা রাত এপাশ-ওপাশ করে কাটাতে হবে। হিট হার্টস, কোল্ড কিলস।
এই কোল্ড কিলস নিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্য সভ্যতার পার্থক্য, বটগাছতলা আর হোটেলের পার্থক্য।
গরমের দেশে জীবন ধারণের জন্য অত্যধিক সাজ-সরঞ্জাম আসবাবপত্রের প্রয়োজন হয় না; পক্ষান্তরে শীতের দেশে পাকাঁপোক্ত ঘরবাড়ি চাই, মেঝেতে শোয়া যায় না; লেপ-কম্বল গদি-বালিশ চাই। শীতের ছ মাস শাক-সবজি ফলমূল কিছুই ফলে না, ছ মাসের তরে মাংসের শুঁটকি জমিয়ে রাখতে হয়; আমরা দিন আনি দিন খাই, ছ মাসের খাবার-দাবার জমিয়ে রাখার কথা শুনলে নাভিশ্বাস ওঠে। ছ মাসের খাবার কিনতে গেলে বেশকিছু রেস্তোর প্রয়োজন।
তাই বোধহয় ইয়োরোপীয়রা একদিন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ডাকাতি করতে প্রাচ্য দেশে এসেছিল। আজ ডেনমার্ক, জর্মনি, নরওয়ে, সুইডেনের খাবার-দাবার ব্যবসা-বাণিজ্য করেই চলে। ডাকাতিতে জিতেছিল ইংরেজ। আজ সে সব লুণ্ঠনভূমি কজা থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে। চার্চিল ব্রিটিশ রাজত্বের লিকুইডেটর হতে চাননি; আজকের শাসনকর্তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় হতে হচ্ছে। ওদিকে খাওয়া-দাওয়া থাকা-পরার মান অনেকখানি উঁচু হয়ে গিয়েছে সেটাকে বজায় রাখা যায় কী প্রকারে? আজ না হয় রইল, ভবিষ্যতে হবে কী? সেকুরিটি কোথায়?
এই সেকুরিটি নিয়েই যত শিরঃপীড়া।
সমসাময়িক ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় অল্প। তবে সমঝদারদের মুখে শুনেছি, সেখানেও নাকি গুণীজ্ঞানীরা প্রাণপণ সেকুরিটি খুঁজছেন। ধর্মে বিশ্বাস নেই, আদর্শবাদ গেছে, চরমমূল্য পরমসম্পদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আদৌ আছে কি না তাই নিয়ে গভীর সন্দেহ–সেই প্রাচীন ওয়েস্টল্যান্ড নাকি আরও বিস্তীর্ণ হয়ে সর্বব্যাপী সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে।
তবে কি কার্ল মার্কসের নীতিই ঠিক? দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অভাব-অনটন উপস্থিত হলে সাহিত্যে সেটা প্রতিবিম্বিত হবেই হবে?
তা সে যা হোক, কিন্তু এই সেকুরিটির ব্যাপার আরেক সূত্রে উঠল।
বিদ্যাসাগরকে যে ইংরেজ মহিলা স্ত্রী-শিক্ষার প্রচার-প্রসারে প্রচুর সাহায্য করেন, তাঁরই এক নিকট-আত্মীয়ের সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হল লন্ডনে। নাম কার্পেন্টার। ইনি জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন ভারতবর্ষে। আমি তাঁকে যখন একবার কলকাতাতে শুধাই তিনি কি মিস কার্পেন্টারের কোনও আত্মীয় হন, তখন উত্তরে তিনি বলেন, আমার ঠাকুরদার বোন। তার পর হেসে বলেছিলেন, আমি কিন্তু তাঁর মতো টাকা ছড়াতে আসিনি; তারই কিছুটা কুড়িয়ে নিতে এসেছি।
তিনি নিমন্ত্রণ করে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় মূর পদ্ধতিতে তৈরি বিরিয়ানি (সে কথা পরে হবে) খাওয়াচ্ছিলেন। কথায় কথায় তাকে শুধালাম, এই যে সাদায়-কালোয় দ্বন্দ্ব লেগেছে এদেশে, তার মূল কারণ কী?
তিনি এক কথায় বললেন, গার্লস।
আমি অন্যত্র শুনেছিলুম চিপ লেবার অর্থাৎ কালারা কম মজুরিতে কাজ করতে তৈরি। ম্যানেজাররা তাই তাদের চায়। ইংরেজ মজুর তাই চটে গেছে।
তা হলে গার্লস এল কোত্থেকে?
আসলে দুটোই এক জিনিস।
নিগ্রোদের কথা বলতে পারব না– সিলেট-নোয়াখালির খালাসিদের কথা জানি। তাদের অনেকেই লন্ডনে এসে অন্য খালাসিদের জন্য রাইস-কারির দোকান খোলে। বাঙালি ছাত্রেরাও সেখানে মাঝে মাঝে গোয়ালন্দ চাঁদপুরি জাহাজের রাইস-কারি খাবার জন্য যায়।
গিয়ে দেখবেন মিশকালো খালাসির ইংরেজ বউ! দু জনাই খদ্দেরকে খাবার দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সেই সিলেটি আছমৎ উল্লা বউকে ডেকে খাস সিলটিতে বলছে, ওগো ডুরা (ডোরা), সাবরে আরক কট্টা মুরগির সালন দে (সায়েবকে আরেক কটোরা-বাটি মুরগির ঝোল দে)!
মেমসাহেব সিলেটি শিখে নিয়েছে! কারণ আছমৎ ইংরেজিটা রপ্ত করতে পারেননি।
এখানে প্রশ্ন, এই মেমটি আছমৎ উল্লাকে বিয়ে করল কেন?
সেকুরিটি।
আছমৎ উল্লা মদ খায় না। তাই মাতাল হয়ে বউকে মারপিট করে না এবং তার চেয়েও বড় কথা মদ খেয়ে টাকা ওড়ায় না। রেসে যায় না, তিন পাত্তি তাস খেলেও সর্বস্বান্ত হয় না। সন্ধ্যার পর বাড়িতেই থাকে। এই হল এক নম্বর।
দুই নম্বর বিয়ের পর (আগেও ভোরা ছাড়া) অন্য রমণীর দিকে প্রেমের বাণ হানে না।
এই দুটি সেকুরিটি রমণী মাত্রই খোঁজে। অন্যান্য ছোটখাটো কারণের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই– বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে, কান্নাকাটি করলে বউকে ধমক দিয়ে ড্রইংরুমে লেপকম্বল নিয়ে শুতে চলে যায় না। আছমৎ উল্লার দেশের কুঁড়েঘরে তারা দশজন শুতো, তার দাদার কাচ্চা-বাচ্চা সে সামলেছে, পরিবার বেসামাল বড় ছিল বলেই তো দু মুঠো ভাতের জন্য সে এদেশে এসেছে।