ব্যাক-গ্যামনের সুবাদে একটা কথা বলে নিই। মিশরে ওই খেলাতে পয়েন্ট গোনা হয় ফারসিতে– আরবিতে নয়। আমরা যে রকম টেনিস খেলার সময় থার্টি ফর্টি, লাভ ফিফটিন, থার্টি অল বলি– ত্রিশ-চল্লিশ,, ভালোবাসার পনেরো বা ত্রিশ সমস্ত বলিনে। ফারসিতে নম্বর গোনা থেকে বোঝা যায় খেলাটা আসলে ইরান থেকে মিশরে গিয়েছে। ঠিক তেমনি বাঙলা দেশের একাধিক গ্রাম্য খেলাতে দেখেছি, নম্বর গোনা হয় কিছু জানা-কিছু অজানা ভাষায় পুরোপুরি বাংলায় নয়। এগুলো তবে কোন ভাষা থেকে এসেছে। আমার বিশ্বাস, সত্যকার রিসার্চ করলে তার থেকে বেরুবে আর্যরা বাঙলা দেশে এসে কোন জাতি-উপজাতির সংস্পর্শে এসেছিল। অনেক পণ্ডিত বলেন, সিঁথির সিঁদুর আমরা সাঁওতালদের কাছ থেকে নিয়েছি। আমার বিশ্বাস, খেলার নম্বরের অনুসন্ধান করলে আরও বেশি তথ্য এবং তত্ত্ব বেরুবে। মমগ্রজ গ্রামের অবাংলা নাম নিয়ে বহু বত্সর খেটে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন আর্যভাষীরা কোন কোন উপজাতির সংস্রবে এসেছিল। তার ওসব লেখা কেউ পড়ে না। গবেষণা বলতে বাঙলা দেশে বোঝায়, তিনখানা বই পড়ে চতুর্থ বই লেখা। অর্থাৎ একখানা বই থেকে গা-মারা চুরি; তিনখানা বই থেকে চুরি-করা গবেষণা।
বেশি হাঁটাহাঁটি করলে পাছে ভগবান আসছে জন্মে ডাকহরকরা বানিয়ে দেয় তাই গোলদিঘির কাছে এসে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লুম। পুকুরের জল স্বচ্ছ কালো। চতুর্দিকে অনেকখানি ভোলা বলে জোর বাতাস শুকনো পাতা পুকুরের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে নিজেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে এক পাড়ে জড়ো করছে। মালী সেখানে দাঁড়িয়ে লম্বা আঁকশি দিয়ে টেনে এনে পুকুর সাফ রাখছে। একপাল পাতিহাঁস ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে। বাতাস হাড়ে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে, স্বচ্ছ কালো জলের দিকে তাকিয়ে সে শীত যেন তার চরমে পৌঁছচ্ছে আর আহাম্মুকের মতো ভাবছি, হাঁসগুলো ওই হিমে থাকে কী করে? উত্তর সরল; হিমালয়ের সরোবরে যখন থাকতে পারে তখন এখানেই-বা থাকতে পারবে না কেন? কিন্তু চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না।
হঠাৎ একটা ধেড়ে রাজহাঁস বিরাট দুটো পাখা এলোপাতাড়ি থাবড়াথাবড়ি করে পড়ি পড়ি হয়ে হয়ে ধপ করে নামল পাতিগুলোর মাঝখানে। তারা ভয় পেয়ে প্যাক প্যাক। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কী দরকার ছিল এদের এই শান্তিভঙ্গ করার? রাজহাঁসটা ভেবেছে, পাতিগুলি এতক্ষণ ধরে ওই কোণে যখন জটলা পাকাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই ভালো খাবারের সন্ধান পেয়েছে।
তাই হবে। নিশ্চয়ই তাই। ইয়োরোপের পাতিজাতগুলো যখন এশিয়া-আফ্রিকায় খাবার পেয়ে জটলা পাকাল তখন ধেড়ে ইংরেজ তাদের তাড়িয়ে দিয়ে রাজ্য বিস্তার করল। সাধে কি আর বিষ্ণুশর্মা এসপ বলেছেন, পশুপক্ষীর কাছ থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করতে হয়। কিন্তু তাই করে কতকগুলো জাত যে পশুর মতো আচরণ করলে, এবং এখনও করছে, তার কী?
আচ্ছা, যদি খুব শীত পড়ে আর পুকুরের জল জমে যায়। আমি স্বচক্ষে রাইনের মতো নদী পর্যন্ত জমে যেতে দেখেছি তা হলে এ হাঁসগুলো যায় কোথায়? কোথায় যেন পড়েছি, কবি দুঃখ করে বলছেন, আমি মানস সরোবরে যেন ডানা ভাঙা রাজহাঁস। চতুর্দিকের জল জমে গিয়ে বরফ হয়ে হয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, শেষটায় আমাকে পিষে মারবে। আমার সঙ্গী-সাথিরা অনেকদিন হল দক্ষিণে চলে গিয়েছে। আমার যাবার উপায় নেই। হায়, আমাদের সক্কলেরই তাই। কারও পা খোঁড়া, কারও ডানা ভাঙা, কারও প্রিয়া পালিয়ে গিয়েছে, কাউকে-বা সরকার জেলে পুরে দিয়েছে– সবাই যেন বলছে, পিছিয়ে পড়েছি আমি, যাব যে কী করে!
এদের জন্য নিশ্চয়ই কোনও ব্যবস্থা আছে। লন্ডন তো আর দেদ্দেড়ে গ্রাম নয় যে, হাঁসগুলো গোলাবাড়ির খামারঘরে গিয়ে আশ্রয় নেবে। পশুপ্রীতি ইংরেজের যথেষ্ট আছে। মিশর পরাধীন থাকাকালীন এক ইংরেজ হাকিম যখন এক মিশরি খচ্চরওলাকে জরিমানা করে জন্তুটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দেওয়ার জন্য–তখন সে মনের দুঃখে বলেছিল, আমি তো জানতুম না রে খচ্চর, আদালতে তোর এক দরদী ভাই রয়েছে।
সামনে দিয়ে একটি মেমসায়েব চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে দেশের মা-মাসিরা দেখতে পেলে বলতেন, হুনোমুখো। না, পরনে সে স্কার্ট নয়, যা পরে বাসে উঠতে গেলে ছিঁড়ে যায়। এর প্রনে হুবহু চীনা পাতলুন। ক্লাইভ স্ট্রিটে বিস্তর দেখেছি। তবে চামড়ার সঙ্গে সেঁটে টাইট, মে-র-কেটে পায়ের ডিম ছাড়ায় কি না-ছাড়ায়, আর লাল সবুজের মারাত্মক চেক। শিলওয়ার বুঝি, বড়ি মোরি–অর্থাৎ ঢিলে পাজামা বুঝি, চীনে পাজামা বোঝাও অসম্ভব নয়, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া পাজামা পরলে রমণীদেহের কোন সৌন্দর্যের কী যে খোলতাই হয় সেটা আদপেই বুঝতে পারলুম না। আর শরীরটাই-না কী বাহারে! বার তিনেক না ঘোরালে বোঝা যায় না কোনটা সামনের দিক, কোনটা পিছন। যেন মডার্ন পেন্টিং। গ্যালারিতে দেখে আমাদের মতো বেকুবদের মনে সন্দেহ জাগে উল্টো টাঙায়নি তো?
যৌবনে কুক্কুরী ধন্যা। যুবতী কখনও কুৎসিত হয় না। তবে যার যেটা মানায় তাকে সেটা পরতে হয়। আজকাল তো আরও কত সব কল বেরিয়েছে, শুনতে পাই। তা না হয় নাই-বা হল। একটু ফোলা ফাপার জামা-কাপড়ও তো আছে। সাড়ে বাইশ-গজি শিলওয়ার নাই-বা হল।