অথচ ইয়োরোপে আমাদের বদনামের অন্ত নেই– আমরা বহুবিবাহে বিশ্বাস করি, আমরা হারেম পুষি।
দুশমন সকলেরই থাকে। খ্রিস্টের ছিল, সাতেসের ছিল। আমাদেরও আছে। ইয়োরোপেও আছে।
তাদেরই কেউ কেউ আপনাকে অপ্রস্তুত করার জন্যে পাঁচজনের সামনে শুধাবে, আপনাদের দেশে বহুবিবাহ প্রচলিত আছে– না?
আমি কোথায় না লজ্জা পাব, উল্টো একগাল হাসি। যেন বঙ্গ দু কান কাটা। বলি, বিলক্ষণ! একটা, দুটো, চারটে মুসলমান হলে– যত খুশি। আর হিন্দু হলে তো কথাই নেই। এক মুখুয্যের ছিল আটশো বাড়য্যের ছ শো, চাটুয্যের চারশো, বেচারি গাঙ্গুলির মাত্র আশি– ঘোষালের ফর্দটা জানা নেই। কায়েতরা অতখানি না, তবে তাঁরাও ছেড়ে কথা কননি। বার্নার্ড শ এ-ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
তার পর হঠাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলি, এ ব্যবস্থা অতি অল্পকাল স্থায়ী ছিল। আসলে ভারতের শতকরা নিরানব্বইজন লোক একটিমাত্র স্ত্রীলোকের সংস্পর্শে আসে। যদিও একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অধিকার আইনত তার ষোল আনা আছে।
তার পর ধীরে ধীরে রসকষহীন অতি শুকনো গলায় বলি, এবারে আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনাদের দেশে কজন লোক একদারনিষ্ঠ হয়ে, অর্থাৎ বিবাহের পূর্বে বা পরে অন্য কোনও কুমারী বা বিবাহিতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে না এসে জীবন কাটায়? যদিও একাধিক স্ত্রীগমনের অধিকার আইনত আপনাদের নেই।
.
যেন ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজের নিচে দিয়ে যাচ্ছি। এই বিশাল উন্নতশির দেউড়ি যেন স্থপতি ইচ্ছে করেই এমনভাবে বানিয়েছেন যে, নিচে দিয়ে যাবার সময় মানুষ বুঝতে পারে সে কত নগণ্য।
কেনসিংটন গার্ডেনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। গাছগুলো এমনি বিরাট, এমনি উঁচু যে, যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বুলন্দ দরওয়াজার কথা। সেখানেও শীতের প্রভাতে কাঁপতে কাঁপতে ঢুকেছিলাম; এখানেও হেমন্তের শীতে জবুথবু হয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি।
আকাশে একরত্তি মেঘ নেই, বাতাসে এক ফোঁটা হিম নেই–সূর্যদেব তাঁর ভাণ্ডার উজাড় করে স্বর্ণরৌদ্র ঢেলে দিয়েছেন কিন্তু শীতের দাপট কমাতে পারেননি। পার্ক থেকেই দেখতে পাচ্ছি, বয়স্করা ওভারকোট পরেছে। কাল বৃষ্টি নেমেছিল– তখন জওয়ানরা পর্যন্ত কাঁধ কুঁচিয়ে, মাথা নিচু করে, হ্যাট সামনের দিকে নামিয়ে দিয়ে হনহন করে চলেছিল গায়ের গরম বাড়াবার জন্য। মেয়েরা কী করে হাঁটু পর্যন্ত ওইটুকু সিল্কের মোজা পরে শীত ভাঙায় সে এক সমস্যা। প্যারিসে দেখেছি, পেভমেন্টে যারা পুরনো বই বিক্রি করে তাদের কোনওপ্রকারের আশ্রয় নেই বলে দোকানের সামনে ঘন ঘন পায়চারি করে, আর দুই বাহু প্রসারিত, ডান হাত শরীরের বাঁ দিকে আর বাঁ হাত ডান দিকে থাবড়ায়। মাঝে মাঝে হাতের তেলো গরম করার জন্য দু হাত আঁজলা করে মুখ দিয়ে জোর ফুঁ দেয়।
কাল রাতের বৃষ্টি না আজ ভোরের হিমে গাছের পাতা সব ভেজা। সেগুনকাঠের পাতার মতো তারা ওজনে ভারী– সারা গ্রীষ্মকাল রোদ আর জল খেয়ে খেয়ে তারা যেন পেটের অসুখ করে কেউ হলদে, কেউ ফিকে, কেউ-বা কালো হয়ে গিয়েছে। আর কেউ টকটকে লাল শুনেছি, ঠিক মরার সময় কোনও কোনও মানুষের সব রক্ত এসে মুখে জড়ো হয়। টুপ করে কখনও এক ফোঁটা জল এসে নাকের উপর পড়ে, কখনও-বা হাতের উপর। কী ঠাণ্ডা। সঙ্গে সঙ্গে অতি নিঃশব্দে দুটি লাল পাতা।
দু দিকে সবুজ ঘাসের লন। ঠিক সবুজ বলা চলে না। নীলের ভাগটা কম, হলদেটাই বেশি। এখন না হয় হেমন্তের প্রথম শীতে তারা ফিকে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ভরগ্রীষ্মকালেও আমি ইউরোপে কখনও দেশের কালো-সবুজ দেখিনি। আর ঘাসগুলোই-বা কী অভদ্র রকমের লম্বা আর মোটা! একে তো তাদের যত্ন নেওয়া হয় প্রচুর তার ওপর বোধহয় এদের মাড়িয়ে পায়চারি করা বারণ বলে কী রকম উদ্ধতভাবে মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। এরাও ভেজা। গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে না। দেশে শীতের সকালে নৌকো দিয়ে যাবার সময় যে রকম ভিজে শাপলাপাতায় হাত দিতে গা কিরকির করে।
দু দিকে সবুজ লনের মাঝখানে কালো পিচের রাস্তা। ছোট্ট, এক ফালি। এঁকেবেঁকে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে চলে গিয়েছে বিরাট হাইড-পার্কে, বাঁ দিকে গিয়েছে এ বাগানেরই গোলদিঘির দিকে। সেই ফালি রাস্তাটুকু আবার নিয়েছে নানা রঙের মোজায়িক, কেটেছে ঝরা পাতার আলপনা। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য আলপনা এরকমের থাকে না। মুখে পাইপ, হলদে গোঁফওলা বুড়ো মালী এসে ঝাঁট দিয়ে সাফ করে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাসে আরেক প্রস্থ রঙিন পাতা ঝরে পড়ে আবার নতুন আলপনা আঁকা হয়।
বেলা এগারোটা। সমস্ত পার্কে মেরে কেটে দশ-বারো জন লোক হয় কি না হয়। শুনেছি আরও সকালে, ছুটির দিনে এবং গ্রীষ্মকালে বেশি ভিড় হয়। লন্ডন শহরের লোক যে কাজ করে, ছুটির দিন ছাড়া আলসেমি করে না, এ তত্ত্বটা এদের ফাঁকা পার্ক দেখলেই বোঝা যায়। ইতালিতে অন্য ব্যবস্থা। তাদের পার্ক সবসময়েই ভর্তি– অবশ্য সে দেশে টুরিস্টও যায় বেশি এবং তাদের পাবও সবসময়েই গুলজার। সকাল দশটাই হোক আর বিকেল চারটাই হোক– জোয়ান মদ্দেরা কাজকর্ম ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সস্তা লাল মদ খায় আর ব্যাক্-গ্যাম খেলে। এ খেলাটা আমি দেশে কখনও দেখিনি, অথচ ভূমধ্যসাগরের পাড়ে পাড়ে, ইতালি গ্রিস তুর্কি লেবানন প্যালেস্টাইন মিশর সর্বত্র প্রচলিত। তাই বোধহয় এরা কেউ দাবা খেলাতে নাম কিনতে পারেনি।