গত বৎসর হঠাৎ খবর এল সরকার সোনাগাছির (কথাটা আসলে সোনাগাজী হুতোমে আছে) গণিকাদের প্রতি আদেশ করেছেন, তারা যেন ওপাড়া ছেড়ে চলে যায়।
তা হলে প্রথম প্রশ্ন, তারা যাবে কোথায়? তারা যদি দ্রপাড়াতে একজন কিংবা দু জনে মিলে ঘর ভাড়া নেয়, তবে সরকার কোন আইনে তাদের ধরবেন, কিংবা যে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকার কোনও মোকদ্দমা আনবেন কি না, এসব কথা খবরের কাগজে ভালো করে বেরোয়নি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এরা উদ্বাস্তু হয়ে বেশি ভাড়া দিতে রাজি হবে, এবং কলকাতাতেও লোভী বাড়িওলার অভাব নেই। প্রায় ঠিক এই ধরনের একটা ব্যাপার ঘটে কিছুদিন পূর্বে দিল্লি শহরে। সরকার আইন করে রেস্তোরাঁ এবং মদের দোকানে মদ, অর্থাৎ প্রকাশ্যে মদ্যপান বারণ করে দিলেন, কিন্তু দোকানে মদ কিনে বাড়িতে গিয়ে খাওয়া নিষিদ্ধ করলেন না। ফলে যে পাপকর্ম সে বাইরে করত, পুত্রকন্যা জানতে পারত না, সেইটে অনেক বাড়ির ভিতরে আরম্ভ হয়ে গেল। ফলে পুত্র এবং কোনও কোনও স্থলে কন্যা যদি মদ খেতে শেখে, তবে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। আমি সমাজসংস্কারক নই তবু তখন কাগজে লিখেছিলুম, মদ্যপান এদেশে এখনও এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি যার জন্য জুজুর ভয় দেখাতে হবে। আসল প্রয়োজন, যেন নতুন কনভার্ট না হয়, অর্থাৎ আজকের ছেলে-ছোকরারা যেন মদ খেতে না শেখে। যে রকম আফিঙের বেলায় নতুন পারমিট না দেওয়ার ফলে আসাম থেকে আফিঙ খাওয়া উঠে যাচ্ছে। দোকানে মদ না খেতে পেয়ে কর্তা যদি বাড়িতে মদ খেতে আরম্ভ করেন, তবে তো কনভার্টের সংখ্যা বাড়বে! এ বাবদে বিধানবাবু সাউথ ক্লাব থেকে মদ তুলে দিয়ে অতি উত্তম কর্ম করেছেন। ছেলে-ছোকরারা সেখানে যেত টেনিস খেলতে। বারে যেত শরবৎ খেতে। শরবৎ থেকে শরাব প্রয়াণ কঠিন কর্ম নয়– দুটো শব্দই আরবি শারাবা = পান করা থেকে এসেছে।
এসব অবান্তর নয়। সরকার যদি মনে করে থাকেন যে, সোনাগাছি-বাসিন্দাদের ভিটেছাড়া করতে পারলেই সর্ব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তবে তাঁরা মারাত্মক ভুল করছেন। ভদ্র গৃহস্থ উদ্বাস্তুদের নিয়েই আমরা কী রকম হিমসিম খাচ্ছি সেটা শেয়ালদাতে নেমেও স্পষ্ট বোঝা যায়। এত সহজে এ সমস্যার সমাধান হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, দীর্ঘতম পন্থা অনুসরণ করলেই স্বল্পতম সময়ে পৌঁছান যায়। এটা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না বলা কঠিন, কারণ গোল্ডেন রুল ইজ দ্যাট দেয়ার ইজ নো গোল্ডেন রুল, কিন্তু সচরাচর যে ব্যবসাকে সংসারের প্রাচীনতম ব্যবসা বলে বহু পণ্ডিত স্বীকার করে নিয়েছেন তার ওষুধ একটি বাড়িতেই হয়ে যাবে এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
আসলে আমরা বিলেতের অনুকরণ করছি। বিলেত ব্রথেল বা গণিকালয় তুলে দিয়েছে, আমরাও দিয়েছি। ফলে লন্ডনের গণিকারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ছড়ায়নি। বোঝা গেল, ওষুধ না ধরাতেই আমরা উপকৃত হয়েছি বেশি।
এ স্থলে একটি কথা না বললে কলকাতার প্রতি অবিচার করা হবে।
কলকাতার আপনজন না হয়েও আমি তার শত দোষ স্বীকার করি। কলকাতার শিশুরা সস্তায় খাঁটি দুধ পায় না, রোগীরা হাসপাতালে স্থান পায় না, ওষুধ কালোবাজারে ঢুকেছে, ভেজালের অন্ত নেই, এরকম অবর্ণনীয় নোংরা শহর ত্রিভুবনে নেই, ট্রাম-বাসে পায়লোয়ানরাই শুধু উঠতে পারে, শেয়ালদা-হাওড়াতে ট্রেন যা লেট হয়, তা-ও পানচুয়ালি হয় না– অবস্থা অবর্ণনীয়।
কিন্তু এই যে কলকাতা শহরে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত– এত বেশি পুরুষ এবং এত কম মেয়ে– অনুপাত পৃথিবীর কোনও বড় শহরই দেখাতে পারবে না। এটা কিছু গর্বের বিষয় নয়, কিন্তু আমি বিদেশ থেকে ফিরে বার বার গর্ব অনুভব করেছি যে, এ শহরের লোক যৌনক্ষুধা সম্বন্ধে কতখানি অচেতন, কিংবা তারা সুযোগ পায়নি, সেটা কেন তৈরি করেনি, তা জানিনে।
ইয়োরোপে যখনই যুদ্ধের ফলে বা কোনও কারণে স্ত্রী-পুরুষের অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায় এবং বিদেশি সৈন্যের মিত্র বা শত্রুভাবে আগমন হয়, সঙ্গে সঙ্গে জারজ সন্তানের সংখ্যা যে কী অসম্ভব রকম বেড়ে যায়, তা দেখে সমাজসেবীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এবারে সে সংখ্যা এমনই হিসাবের বাইরে চলে গেল যে শেষটায় পাদ্রিসায়েবরাই প্রস্তাব করলেন জারজ শিশুদের যেন সমাজ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠান আইনত ন্যায্য বলে স্বীকার করে নেয়।
শান্তির সময়েও এরকম ধারা হয়। উত্তর ইয়োরোপের কোনও একটি দেশে অনুপাত অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়ায় দেখা গেল বহু পুরুষ একটি স্ত্রী এবং একটি করে রক্ষিতা পুষছে। রক্ষিতা বলা ভুল, কারণ এ রমণী ভদ্রঘরের মেয়ে, বেশ্যাবৃত্তি কখনও করেনি, তার প্রতিপালকের সঙ্গে তার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, তার পুত্রকন্যা আছে, সমাজে সে অপমানিতা নয়। অনেক স্থলে তার আসল স্ত্রী এ রমণীর খবর জানেন, এবং কোনও কোনও স্থলে পালা-পরবে দুই পরিবার একত্র হয়ে আনন্দোল্লাস করেন। বস্তুত আমাদের দেশে কোনও পুরুষের যদি দুই স্ত্রী থাকে এবং তারা যদি ভিন্ন ভিন্ন বাড়িতে থাকে তা হলে সচরাচর হয়ে থাকে।
কোনও কোনও বুদ্ধিমান সমাজসেবী তাই প্রস্তাব করেছেন, এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার চেয়ে ঢের ভালো নয়, এইসব লোকদের আইনত দুটি বিয়ে করার অধিকার দেওয়া। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে এক স্ত্রীর জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ বেআইনি– তাকে তালাক না দিয়ে। ক্যাথলিক ধর্মে আবার ঠিক তালাকের ব্যবস্থাও নেই সেখানে প্রমাণ করতে হয়, বিবাহের আচার-অনুষ্ঠানের ত্রুটি থাকায় বিয়েটা আদপেই হয়নি। ধর্মের অনুশাসন এড়াবার জন্যে কেউ কেউ তার সুবিধে নিয়ে থাকেন।