এ ব্যবসা সম্বন্ধে লিখব কি না মন স্থির করতে পারছিনে।
.
শ্যামবাজারের মামা নাকি হেদো না পেরিয়ে দু বছরে তিন লাখ টাকা খুঁকে দেওয়ার পর বিলেতগামী ভাগনেকে সদুপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাবি বাবা, সেই জল, সেই ঘাস, সেই গাছ। ওগুলো দেখবার জন্য আবার বিদেশ যাবি কেন?
আমাদের গ্রামের ভিতর যখন প্রথম ইঞ্জিন এসে রাতের বাসা বাঁধল, তখন ছেলেবুড়ো সবাই হদ্দমুদ্দ হয়ে সেই কলের গাড়ি দেখতে গেল। ফিরে এসে সবাই যখন ইঞ্জিনের প্রশংসায় অষ্টপ্রহর পঞ্চমুখ তখন মুরুব্বি কলিমুল্লা বলেছিলেন, যা বল যা কও, উই আমাদের আগুন উই আমাদের জল ছাড়া বাবুদের চলে না। আকাষ্টা পবনের নৌকোই বানাও, আর চিল্লীমারা ইঞ্জিলই বানাও সেই আগুন, সেই জল।
এ তো সাধারণ লোকের কথা। স্বয়ং বাইবেল বলেছেন, সেই ঋষির মুখ দিয়েই, যিনি ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি হতে সদুপদেশ দিয়েছেন, যা ছিল তাই হবে, যা করা হয়ে গিয়েছে তা আবার করা হবে; এ সংসারে নতুন কিছু নেই।
বেশিরভাগ লোক দেশভ্রমণে যায় নতুন কিছু দেখবার জন্য। এবং গিয়ে দেখে সেই জল, সেই ঘাস। আবার অন্য অনেক লোক বিদেশে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দেশের সন্ধানে লেগে যায়। প্যারিস গিয়ে খবর নেয়, সেখানে আপন দেশের কেউ আছে কি না। তাকে খুঁজে বের করে শুধায়, রাইস-কারি কোথায় পাওয়া যায়? সেই খেয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতে বেরুতে বলে, চলো, দাদা, চট করে মোড়ের যদুর দোকান হয়ে যাই।– পাড়ার যদুর পান বিখ্যাত।
আমি দেশভ্রমণে উপকারিতার চেয়ে অপকারিতাই দেখতে পাই বেশি। সে বিষয়ে অন্যত্র সবিস্তর আলোচনা করেছি। তবে এ বাবদে বলতে পারি, ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সবকিছু পুরনো হলেও নতুন। বিলেতের ঘাস ঘাস, কিন্তু সে ঘাস আমাদের ঘাসের মতো ঘন সবুজ নয়, একটুখানি ফিকে, কেমন যেন হলদে ভাগটা বেশি। গাছপালার তো কথাই নেই। জলের স্বাদও অন্যরকম। একমাত্র আগুনে আগুনে কোনও পার্থক্য দেখিনি। তাই বোধহয় পৃথিবীতে অগ্নি-উপাসকের সংখ্যা এখনও প্রচুর।
সেটা অবশ্য প্রথম যৌবনের প্রথম সফরে লক্ষ করিনি।
প্রথমবারের কথা বলছি।
একটানা জর্মনিতে থাকার পর অচেনা জিনিস দেখে দেখে যখন মন ক্লান্ত তখন গিয়েছি নেপলসে– জাহাজে করে দেশে ফিরব বলে। জাহাজ লেট। দু দিনের তরে সেই নির্বান্ধব বন্দরে আটকা পড়ে গেলুম। নিতান্ত কোনও কিছু করবার ছিল না বলে গেলুম পম্পেই দেখতে (এ স্থলে কিঞ্চিৎ অবান্তর এবং নিছক ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও বলি, আমি স্বেচ্ছায় কেবলমাত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কখনও বাড়ি থেকে বেরুইনি– বেরিয়েছি প্রয়োজনের তাগিদে। মাত্র একবার আমি কাইরো থেকে স্বেচ্ছায় পুণ্যভূমি প্যালেস্টাইন দেখতে গিয়েছিলুম। সেখানে ইহুদি খ্রিস্টান ও মুসলমানের সঙ্গম। ধর্মচর্চাতে আচরণে নয় আমার চিরকালের শখ)।
পম্পেই মধ্য কিংবা দক্ষিণ ইতালিতেও বলতে পারেন। আবহাওয়া একটুখানি গরম।
পম্পেই টিলার নিচে বাস থামতে হঠাৎ দেখি সামনে একবন করবী গাছ।
ওহ্! সে কী আনন্দ হয়েছিল! এ-জীবনে প্রথম যে গাছ চিনতে শিখি সেটি করবী। আমাদের দেশে বলে ঘণ্টাফুল। মা আমায় চিনিয়ে দিয়েছিল। তার পর যখন তিনখানা বই পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে, তখন চাচা বললেন, করবী আর কবরীতে যেন গোবলেট না পাকাই। তার পর নিজের থেকেই শিখলুম, করবী পাঁচ রকমের হয়;– শ্বেত, পীত, রক্ত, কৃষ্ণ এবং পাটল– কৃষ্ণকরবী এখনও দেখিনি। সর্বশেষে শান্তিনিকেতনে ছাত্রাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মুখে শুনলাম যক্ষপুরী। পরে তার নাম হল রক্তকরবী। এখন শিখলুম, ইতালির ভাষাতে ওলে-আন্দ্রো।
এ ফুলটি তাই কত স্মৃতি-বিস্মৃতিতে বিজড়িত। বিস্মৃতি বলার কারণ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলুম, ছেলেবেলায় নানুরে চণ্ডীদাসের ভিটে দেখতে গিয়ে পেলুম ডাকবাংলোর একপাশে অজস্র করবীগাছ– এই শুকনো খোয়াই-ডাঙার দেশ বীরভূমে।
কিন্তু করবীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের দীর্ঘ ফিরিস্তিতে কার কোন কৌতূহল? কৌতূহল তখনই হয় যখন কেউ সেই পম্পেইতে হঠাৎ দেখা করবীকে নৈর্ব্যক্তিক স্তরে তুলে রস স্বরূপে প্রকাশ করতে পারে। যেমন রবীন্দ্রনাথ দেশে বসেই গাইলেন,
আবেশ লাগে বনে
শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে–
সঙ্গে সঙ্গে রসের মাধ্যমে করবী এসে আমাদের হৃদয় দখল করে বসে। সার্থক ভ্রমণকাহিনী-লেখক তাই নতুন পুরাতন উভয় অভিজ্ঞতাকে সমাহিত চিত্তে স্মরণ করে রসম্বরূপ প্রকাশ করেন। ভ্রমণ উপলক্ষ মাত্র।
কিংবা হয়তো তথ্য পরিবেশন করেন। সেটা যদি রসরূপে প্রকাশিত হয়, তবে আরও ভালো। কিন্তু রস নেই, এবং তদুপরি যদি সে তথ্য কারও কোনও কাজে না লাগে তবে সেটা বলে কী লাভ আমি ঠিক বুঝতে পারিনে। কাবুলের অনৈসর্গিক যৌন সম্পর্কের কাহিনী এদেশে কেউ কেউ শুনেছেন, সেখানে অল্পবিস্তর গণিকাবৃত্তিও আছে, কিন্তু সেসব তথ্য কারও কোনও কাজে লাগবে বলে আমার মনে হয়নি। এই নিয়ে আমার চারবার ইউরোপ যাওয়া হয়। গণিকাবৃত্তি চোখে পড়ার কথা। এ নিয়ে সে দেশের ছাত্রসমাজে নানা আলোচনাও হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা আইন ও ডাক্তারি পড়ে। সেগুলো অনেক সময় শুনতে হয়। সতীর্থরা হয়তো-বা জিগ্যেস করে বসে, তোমাদের দেশে কী রকম?
তবু এ সম্বন্ধে আমি কোনও কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যার পর হয়তো অল্পকিছু বলার সময় এসেছে।