সেই চিকেন আমরা দুই পুরুষ্ট পাঠায় দেড় বেলায় শেষ করি!
তারই স্মরণে অতখানি অর্ডার না করে যৎসামান্যের হুকুম দিলুম।
চতুর্দিক তাকিয়ে দেখি, সবাই গোরার পাল। একটিমাত্র ভারতীয়ও নেই। মেনুর দিকে নজর যেতেই কারণটা বুঝতে পারলুম। এক-একটি পদের যা দাম তাই দিয়ে যে কোনও লন্ডনবাসী ভারতীয় ছাত্রের আড়াইখানা পুরো লাঞ্চ হয়! মুদ্রার মতো পিসটন না থাকলে এরা এখানে আসতে পারে না।
বিলেতফের্তা বাঙালিদের নিয়ে দেশে বহু আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এককালে এদের অনেকেই আর দিশি ডালভাত ধুতি-চাদরে ফিরতেন না। তার পর বিশেষ করে চিত্তরঞ্জন দাস যে ভেল্কিবাজি দেখালেন তা দেখে আর বিলিতিয়ানা করার সাহস অল্প সায়েবেরই রইল। কিন্তু যেসব ইংরেজ এদেশে বহু বছর কাটিয়ে বিলেত ফিরে যায় তাদের সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে শুনেছি, ড্রাইভার রাখার মতো পয়সা ছিল না বলে লর্ড রোনালড়শেকে ট্রামে-বাসে দেখা যেত। এদের সম্বন্ধে সবচেয়ে ভালো লিখেছেন উডহাইস। তার ধারণা এদের মাথায় ছিট ধরে। কেউ কেউ নাকি ডিনার আরম্ভ করে পুডিং দিয়ে ও শেষ করে সুপ দিয়ে!
তবে একথা বিলক্ষণ জানি এদেশ থেকে তারা দুটো অভ্যাস নিয়ে যায়। স্নান করা ও মশলাদার খাদ্য খাওয়া। এই যে আজ ইংল্যান্ড-জর্মানিতে বাথরুমের ছড়াছড়ি না হোক, ব্যবস্থাটা অন্তত আছে (জর্মনিতে মনিসিপালিটির আইন হয়েছে, কটা শোবার ঘর হলে কটা বাথরুম অবশ্য তৈরি করতে হবে) তার প্রধান বাহক চা-বাগানের ইংরেজ। আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা, তার সময়ে অর্থাৎ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত অক্সফোর্ডে নাকি মাত্র দুটি বাথরুম ছিল। তাই নিয়ে এক বাগিচার সায়েবের ছেলে কর্তৃপক্ষকে ফরিয়াদ জানালে তাঁদের একজন বলেন, তোমরা তো এখানে একনাগাড়ে থাক ছ হপ্তা (তখন বোধহয় এক টার্ম বলতে ওই সময়ই বোঝাত); ছুটিতে বাড়ি ফিরে চান করলেই পার।
অর্থাৎ ছ সপ্তাহে একটা স্নানই ইংরেজ বাচ্চার জন্য যথেষ্ট। ধেড়েদের জন্য বোধহয় ছ বছরে একটা! ফরাসিরা তো শুনেছি চান করে নদীতে আত্মহত্যা করার সময়।
কেন? তারা তাদের কলোনি ইন্দোচীনে চান করতে শিখল না কেন?– এখনও তো ফ্রান্সের চৌদ্দ আনা বাড়িতে চানের ঘর নেই। বলতে পারব না। তবে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের কাছে শুনেছি, তিনি চীন দেশের বিরাট নদী দিয়ে জাহাজে করে গিয়েছেন কিন্তু কোনও চীনাকে নদীর জলে স্নান করতে দেখেননি।
আর এদেশের মশলামাখা রান্না খেয়ে ইংরেজের স্বভাব এমন বিগড়ে যায় যে, দেশে ফিরে তাকে যেতে হয় ভারতীয় রেস্তোরাঁতে। এদের পয়সাও প্রচুর; তাই বোধহয় খাস করে এদেরই জন্য এই তালু-পোড়া দামের রেস্তোরাঁ!
ইংরেজের যে কটি প্যারা স–যথা উস্টার, এইচ বি– এগুলো নাকি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষেই তৈরি হয়েছিল। এগুলো বানাতে যেসব মশলার প্রয়োজন হয়, সেগুলো যে ইয়োরোপে গজায়
সেকথা ভালো করেই জানি। এমনকি আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে যেসব তরকারি গজায় সেগুলো আপন দেশে গজাতে পারে না বলে সাউথ অ্যামেরিকা থেকে আনিয়ে খায়। ঠিক বলতে পারব না, তবে বেগুন খেতে শিখেছে বোধহয় মাত্র ত্রিশ বৎসর।
আবার বলছি, সব তত্ত্বের মাহাত্ম আমার বহু পাঠক দেবেন না। কিন্তু আমি সাধারণ জিনিসের খেই ধরে তত্ত্বচিন্তা করতে ভালোবাসি। যেমন ইংরেজ বেগুন খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু সেটা খায় সেদ্ধ করে যতদূর সম্ভব বিস্বাদ বানিয়ে। বেগুন-পোড়া যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিণতি, সে তত্ত্ব এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। ঠিক তেমনি মার্কিন জাত রেড ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে মুড়ি খেতে শিখেছে বটে, কিন্তু তেল পেঁয়াজকুচি (পাপরভাজা বাদ দিন) দিয়ে খেতে শেখেনি।
আমি শুধু ভাবি ওসব সামান্য জিনিস আবিষ্কার করতে মানুষের কত শত বৎসর লাগে।
ফার্পোতে যখন কেউ বাঁ হাতে ছুরি নেয় তখন তার কামেল বন্ধুরা ফিসফিস্ করে ভুল বাৎলে দেয়। এখানে দেখি উল্ট-পুরাণ। পোলাও খেয়ে যাচ্ছে তো খেয়েই যাচ্ছে। মাংসের কারিটা পাশে পড়ে আছে। মেশাবার কথা মাথায় আসেনি। কাবাব খাচ্ছে তো খাচ্ছেই– পাশে চাপাতি পড়ে পড়ে জুড়িয়ে হিম হয়ে গেল। ওকিব-হালরা তখন ফিসফিস করে অ্যামেচারদের তালিম দিয়ে দুরস্ত করার চেষ্টা করছেন।
এইবারে রসভঙ্গ করতে হল। আর চেপে রাখতে পারলুম না।
রান্না পছন্দ হল না।
মাদ্রাজি মশলা দিয়ে মোগলাই খানা এই আমি প্রথম খেলুম। এ যে সিমেন্ট দিয়ে তাজমহল বানানো, কিংবা মাইকেলি অমিত্রাক্ষরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া, অথবা মাদ্রাজি মোগলাই মালমশলাই থাক– দক্ষিণের রাজগোপাল-আচারীকে উত্তরের চোগা চাকি না পরানো।
কিন্তু তবু খেতে খুব মন্দ না। এত হাড্ডিসার মুরগি ভেজাল দালা দিয়ে রান্না নয়। মুরগিটা যেন চর্বিওলা খাসি আর যে মাখন দিয়ে রান্না করা হয়েছে সেটা এদেশে সত্যযুগে পাওয়া যেত। দেশে থাকতে আমি তো একবার প্রস্তাব করেছিলুম, কোনওগতিকে একটুখানি খাঁটি গাওয়া ঘি যোগাড় করে মিউজিয়ামে রাখার জন্য যাতে করে ভবিষ্যদ্বংশীয়রা জানতে পারে এককালে বাঙলা দেশের লোক কী খেত।
তখন প্রায় রাত দুপুর। রাস্তায় বেরিয়ে পিকাডেলি। সচরাচর যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো ব্যবসা বলা হয়, তার সঙ্গে সেখানে মুখোমুখি মোলাকাত।