এবং সবচেয়ে মারাত্মক তত্ত্ব শুনেছি কোনও কোনও কলেজের ছোকরার কাছে। বিয়ার নাকি মদ নয়, ওতে নাকি নেশা হয় না, ও বস্তু খেলে নাকি পরীক্ষার পড়া করার সুবিধে!
বটে! বিয়ারে নেশা হয় না? লন্ডন-প্যারিসে রাস্তায় যারা মাতলামো করে তারা কী খায়? কোকা কোলা? অগা আর কারে কয়! ওদের পনেরো আনা বিয়ার খেয়েই মাতাল হয়। আমাকে ওসব বল না; ঠাকুরমাকে ডিম চোষা শেখাতে হবে না।
মূল ফার্সিতে আছে,
গর দস্ত দহজমগজ-ই-গদুম্
নানি,
ওয়াজ ময় দো মনি জু গোসফন্দি
রানি,
ওয়ানগাহ মন্ ওয়া তো নিশতে
দর ওয়েরানি
আয়েশি বোদ আন্ ন্ হ হ।
সুলতানি
এর ইংরেজি–
Here with a loaf of bread
beneath the bough,
A flask of wine, a book of
verse and Thou
Beside me singing in the
Wilderness
And Wilderness is Paradise
enow.
(ফিটসজেরাল্ড)
তার বাংলা—
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে
শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে, ছন্দ গেঁথে
দিনটা যায়।
মৌন ভাঙি তার পাশেতে গুঞ্জে
তব মঞ্জু সুর–
সেই তো, সখী, স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর।– (কান্তি ঘোষ)
কিংবা
বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি
পাই যদি একখানি
পাই যদি এক পাত্র মদিরা আর।
যদি তুমি রানি
সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া
গাহো গো মধুর গান
বিজন হইবে স্বর্গে আমার
তৃপ্তি লভিবে প্রাণ। (সত্যেন দত্ত)
যার প্রাণে যা চায় তিনি সেইভাবে অনুবাদ করেছেন। খৈয়ামের খড়বাঁশের কাঠামোর উপর যে যার আপন মানসমূর্তি স্বপ্নপ্রতিমা গড়েছেন; আসলে কিন্তু আছে,
উত্তম ময়দার তৈরি রুটি যদি
হাতে থাকে,
আর যদি থাকে দু মণ মদ এবং
বাচ্চা ভেড়ার আস্ত একখানা ঠ্যাং (রান),
ঘুঘু-চরা পোড়া বাড়িতে কাছাকাছি বসে
তুমি আমি দু জনা।
সে আনন্দ বহু সুলতানেরও ভাগ্যে।
জোটে না।
খৈয়াম এ কবিতায় কবিত্ব করেননি। তিনি সাদামাটা ভাষায় বলেছেন, তার কী কী চাই। মোলায়েম কবিতায় বিলকুল অচল হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভেড়ার একখানা আস্ত ঠ্যাং (রান্ কথাটা আসলে ফারসি এবং তিনি ইটি এ স্থলে নির্ভয়ে ব্যবহার করেছেন) অর্ডার দিয়েছেন এবং পাছে নেশা জমবার আগে মদ ফুরিয়ে যায় তাই পাক্কা দু মণ খাঁটি চেয়েছেন। এবং লক্ষ করার বিষয় তিনি কবিতার বই আদপেই চাননি। যে জিনিস যে পারে সেটা সে চায় না। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে যে দড়ির উপর নাচতে পারে সে প্রিয়াকে নিয়ে বোটানিক্সে পিকনিক করতে যাওয়ার সময় ডাণ্ডা-দড়ি বগলে করে নিয়ে যায় না। এবং আসল কথাটা দুই বাঙালি অনুবাদকই ঘুলিয়ে ফেলেছেন। খৈয়াম বলেছেন, যা সব চাইলুম তা পেলে আমি জাহান্নামেও যেতে রাজি আছি; ওরকম জাহান্নাম রাজা-বাদশার কপালেও জোটে না।
যে ইরান-সন্তান চতুষ্পদীটির ফরাসি অনুবাদ করেছেন তিনি মূলতত্ত্বটি ধরতে পেরেছেন বলে খৈয়ামের প্রতি অবিচার করেননি।
Pour celui qui possede un
morceau de bon pain.
Un gigot de mouton, un grand
flacon de vin,
Vivre avec une belle au milieu
des ruines,
Vaut mieux que dun Empire
etre le souverain. —(এতেসসাম-জাদে)
কিন্তু আমার মূল বক্তব্য এখানে তা নয়।
আমি বলতে চাই, কবিতা বা অন্য কোনও বস্তু অনুবাদ করার সময় এ শুচিবাই কেন? কেন লোকে ধরে নেয় যে কাব্যে ভেড়ার ঠ্যাং চলতে পারে না। ইংরেজ এ শুচিবাই শিখেছে গ্রিকদের কাছে। তাদের ভিনাস মূর্তি দেখে এক সরলা নিগ্রো রমণী শুধিয়েছিল, শরীরের নিচের আধা সম্বন্ধে মেয়েটার অত লজ্জা কেন? ওটা ছালা দিয়ে ঢেকেছে কেন?
যুগে যুগে রুচি বদলায়। অনুবাদ করার সময় যদি আপন যুগের রুচি দিয়ে পূর্ববর্তী যুগের রুচির ওপর সেন্সর চালাই তবে কবির প্রতি তো অবিচার করা হয়ই, পরবর্তী যুগের রসিকজনের প্রতিও অমর্যাদা দেখানো হয়। কোনারকের মন্দির বহু সায়েসুবোর রুচিতে বাধে। তাই বলে আমরা তো আর মূর্তিগুলোর মুণ্ডু বাইরে রেখে বাকি ধড় কম্বল-চাপা দিয়ে রাখিনে।
ওমরের স্মরণে আমি একখানা পুরো রানই অর্ডার করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, পরশু রাতের শিক্ষা।
তখন সন্ধে আটটা। দেশের হিসাবে রাত দেড়টা। সবে এদেশে এসেছি; শরীরটা এদেশের টাইমে ধাতস্থ হয়নি। ভাতিজাকে বললুম, বাবাজি, আমি আর বেরুচ্ছিনে। তুমি আলুসেদ্ধ ফেদ্দ কিছু একটা নিয়ে এস–রুটি-মাখন ঘরেই আছে। তাই দিয়ে দিব্য চলে যাবে।
মুখুজ্যে মশাই যখন ফিরে এলেন তখন দেখি তার হাতে এক ঢাউস খলতে বাঙাল দেশে বলে ঢোঙ্কা।
মিনির মতো সরল চিত্তে শুধালুম, এর ভিতর কী, হাতি?
বললে, সব্বনাশ হয়েছে, স্যার।
এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুখুজ্যের সব্বনাশটা খাস কলকাত্তাই। মোকামে পৌঁছে যখন দেখলে তার বহু পয়সার মাল শান্তিনিকেতনের একটা ডকুমেন্টরি ফিলম বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে, তখন টুথব্রাশমুস্টাসে হাত বুলিয়ে বলে, যাকগে, আবার যখন পাতলুনের পকেট খুঁজে পায় না তখন বলে, সব্বনাশ হয়েছে।
আমি তার সব্বনাশে বিলক্ষণ অভ্যস্ত বলে হাই তুলতে তুলতে নিশ্চিন্ত মনে শুধালুম, কী সব্বনাশ হয়েছে। দেশলাই খুঁজে পাচ্ছ না?
কী করে জানব বলুন এদেশে মুরগির সাইজ হয় দেশের খাসির? আপনি তো আলুসেদ্ধ চেয়েছিলেন রেস্তোরাঁওলা বললে, কাবার। আমি বললুম, আলুসেদ্ধ নেই তো নেই চিকেনসেদ্ধ দাও। ভাগ্যিস হাফ-এ-চিকেন বলেছিলুম, তাই রক্ষে। দেখুন।