মৃত্যুঞ্জয় যে রকম কৈলাসে বিহার করেন, রাশান ডিকটেটর যে রকম ক্রেমলিনে বাস করেন, ভেজাল যে রকম খাদ্যে বিরাজ করেন, ওই ওয়াইন মাস্টারটি ঠিক তেমনি বিচরণ করেন অতিশয় পয়লানম্বরি খানদানি ভয়াঙ্কুর রেস্তোরাঁতে। ভয়াঙ্কুর বললুম ইচ্ছে করেই। এখানে অঙ্কুর পর্যন্ত বিনষ্ট হয়। ইনি আপনার সব অপহরণ করেন। পাতলুন বন্ধক দিয়ে বিল্ শোধ করতে হয়।
ভীতকণ্ঠে ভাতিজাকে শুধালুম, ওরে রেস্ত আছে তো?
ভিতরের বুক-পকেটের উপর থাবড়া মারার মুদ্রা দেখিয়ে বললে, কুছ পরোয়া নেই; আপনি চালান।
সোনার চাঁদ ছেলে। একেই বলে বান্ধব। ব্যসনে সঙ্গে থাকে।
এ জীবনে আর যদি কখনও চাকরি নিই তবে উমেদার হব এই ওয়াইন মাস্টারের চাকরির জন্য বেতারের কাজ হয়ে গিয়েছে, সেখানে শুধু খাপসুরৎ কলাবতীর ঝামেলা; তারা আমাকে যথেষ্ট কলচর বলে বিবেচনা করেন না।
খানদানি রেস্তোরাঁর চার ইঞ্চি পুরু মহামূল্যবান ইরানি গালচের উপর মৃদু পদসঞ্চরণ করে কাটবে আপনার জীবন– ভ্রমর যে রকম তঙ্গীর বিশ্বধরে পদক্ষেপ করে ঠিক সেই রকম (বিশ্বাস না হলে কালিদাস পশ্য) একজোড়া চার আউন্স ওজনের ইভনিং শুতে কেটে যাবে ঝাড়া দশটি বছর হাপসোল পর্যন্ত বদলাতে হবে না। এ টেবিলে গিয়ে কাউকে বলবেন, তিপানের নিরেনস্টাইনার- সে একটি স্বপ্ন! ১৯৫৩-এ সেখানকার আঙুর মোলায়েম রৌদ্রে যা রসে টইটম্বুর হয়েছিল, সে রকম ধারা আর কখনও হয়নি। তাই দিয়ে এ সুধা নির্মিত হয়েছে। কখনও-বা অন্য টেবিলে গিয়ে ফিসফিস করবেন, মাদাম, দেখুন, দেখুন এই শ্যাম্পেনের বুদ্বুদ কী রকম লক্ষ লক্ষ পরীর মতো সলোমনের বোতল-বদ্ধ জিনের ন্যায় নিষ্কৃতি পেয়ে লক্ষ লক্ষ হাওয়ার ডানা মেলে উর্ধপানে উড়ে যাচ্ছে। এ বস্তু গলা দিয়ে নাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও ইহলোকের সর্ববন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে নীলাম্বরের মর্মমাঝে উধাও হয়ে যাবেন। তার পর একটু মৃদু হাসি হেসে বলবেন, তাই, মাদাম, এ শ্যাম্পেন যিনি অর্ডার দেন তাঁর কাছ থেকে আমরা আগেভাগেই বিলটা আদায় করে নিই, অবশ্য; আপনাদের বেলা সে কথাই উঠছে না।
এ তো হল। তার পর আপনি ঘড়ি ঘড়ি বারে সেলারে গিয়ে তদারক করবেন, সর্ববস্তু রাজসিক পদ্ধতিতে প্রস্তুত রয়েছে কি না। রাঁধুনিকে যে রকম সে-সব জিনিস মাঝে মাঝে চেখে দেখতে হয় আপনাকেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে, অতিশয় অনিচ্ছায়–আমাদের বরকর্তারা যে রকম পণ নেন– অল্প-স্বল্প মাঝে-মধ্যে চেখে দেখতে হবে বইকি!
তা-ও হল। ওদিকে আপনাকে প্রতি শরতে ফ্রান্স যেতে হবে, সেখান থেকে নিলামে পানীয় কিনে সেলার পূর্ণ করার জন্য। আপনার কমিশনটা-আসটা ঠেকায় কে? আপনার ভারী ভারী গাহক খদ্দেরের বাড়ির জন্য তাদের প্রাইভেট অর্ডারও সাপ্লাই করবেন। তাতেই-বা কম কী? ওনরা হাত উপুড় করলেই আমাদের পর্বত-প্রমাণ।
আমাদের ওয়াইন মাস্টারটি এসে নমস্তে জানালেন। চমৎকার চেহারা। নেয়াপাতি ভুড়ি, চোখ দুটি জবাকুসুমশঙ্কাসং, যা হওয়ার কথা।
আমি সবিনয়ে বললুম, ত্রিশ বছর পরে এসেছি। ইতোমধ্যে একটা লড়াই হয়ে গিয়েছে। জর্মনরা ফ্রান্স ছাড়ার সময় প্যারিসের নত্র দাম গির্জে সঙ্গে নিয়ে যায়নি বটে, কিন্তু ফ্রান্সের সেলারে সেলারে ঢুকে তার উত্তম-অধম সর্বপানীয় খতম করে যায়। এখন যা ফ্রান্স-ইংলন্ডে পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আপনি পথপ্রদর্শন করুন। তবে এইটুকু বলতে পারি, বর্দো এবং শান্ত।
শান্ত মানে যে বস্তু সোডার মতো বুজবুজ করে না, তেলের মতো শুয়ে থাকে।
চাকুরে যে রকম পেনশনধারীকে খাতির করে, মাস্টার আমাকে সেই রকম কদর করল। আহা, এককালে লোকটা সবকিছু জানত। এখন না হয় আউট অব ডেট! ম্যাক্সমুলার নাকি আমাদের সংস্কৃত শিখে ভশচাযদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, হরিনাথ দে নাকি গ্রিক শিখে গ্রিকদের চিত্তহরণ করেন– এসব শোনা যায়, কিন্তু আমাদের এই পানের প্রভু দেখলুম সত্যিই পেটে এলেম ধরে। দেখলুম হেন পানীয় নেই, যার ঠিকুজিবুলজি তার বিদ্যাচৌহদ্দির বাইরে পড়ে। কবে কোন বৎসরে কোন গায়ের আঙুরে এ জিনিস তৈরি, সে বৎসর আঙুর পাকার সময় সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল না মেঘ ও রৌদ্র, না মোলায়েম মিঠে রোদ্দুরে ছিল, কার চাপযন্ত্রে তার রস বের করা হয়, তাই দিয়ে সবশুদ্ধ ক বোতল তৈরি হয়েছিল, তার কটা গেল মার্কিন মুলুকে কটা এল এ দেশে, এর বডি কী রকম, বুকে (bouquet)-টাই বা রমণীয় কি না– সব-কিছু জিহ্বাগ্রদর্পণে, এবং উভয়ার্থে।
নগণ্য ভারতীয় যে এই বিলিতি বিদ্যে এতখানি হাসিল করেছে তার কাছে মাসমুলারের সংস্কৃতজ্ঞান শিশু।
শুধালুম, ভদ্রে, এ কর্মে কতদিন ধরে আছেন?
সবিনয়ে বললে, আজ্ঞে পঞ্চাশ বছর পূর্বে যখন এ রেস্তোরাঁ খোলা হয় তখন থেকে। সে আমলের আর কেউ নেই।
তবে কি এসব জিনিস খেলে মানুষ দীর্ঘজীবী হয়? অর্থাৎ ওয়াইন– যে বস্তু আঙুরের রস দিয়ে তৈরি হয়েছে; হুইস্কি বিয়ারের কথা উঠছে না।
জানি রসভঙ্গ হবে, তবু হুইস্কি-ওয়াইন কোনও জিনিসই ভালো নয়। অতিশয় শীতের দেশে, কিংবা ডাক্তারের হুকুমে খাওয়া উচিত কি না, সে কথা আমি বলতে পারব না। অতখানি শীতের দেশে আমি কখনও যাইনি বিলেতে গরম দুধ, চা, কফি খেলেই চলে– আর অতখানি অসুস্থও আমি জীবনে কখনও হইনি। মদ্যপান করলে ভালো লেখা বেরোয় এ কথা আমি বিশ্বাস করিনে। মেঘনাদ কাব্য রচনার সময় মাইকেল ক্লান্তি দূর করার জন্য অল্প খেতেন, শেষের দিকে যখন মাত্রা বেড়ে গেল, তখন দু চার পাতা লেখার পরেই বেএক্তেয়ার হয়ে ঢলে পড়তেন– তাঁর গ্রন্থাবলি সে সব অসমাপ্ত লেখায় ভর্তি। এবং তার চেয়েও বড় কথা, আপনি-আমি মাইকেল নই। একখানা মেঘনাদ লিখুন; তার পর না হয় মদ খেয়ে লিভার পচান- কেউ আপত্তি করবে না।