একদম খাঁটি কথা। আমাদের মোহর বিবি, কণিকা ব্যানার্জিকে যখন শুধাই, সেই রেকর্ডে দেওয়া তোমার গান ওগো তুমি পঞ্চদশী ফের বেতারে গাইলে কেন? ওটা তো ইচ্ছে করলেই রেকর্ড বাজিয়ে আবার শোনা যায়, তখন সে বলে, কী করব, সৈয়দা লোকে যে পুরনো গানই শুনতে চায়। বুঝলুম, বাচ্চাদের কাছে নতুন গল্প বলতে চাইলে তারা যে রকম চেঁচিয়ে ওঠে, না, মামা কালকের সেই বাঘের গল্পটা বল।
দ্বিতীয়ত, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার রচনা বাঙলা দেশে অজরামর হয়ে থাকবে না, আমার রসনির্মাণপ্রচেষ্টা বাণী-সরস্বতীর অঙ্গদে কুন্তলে মাল্যরূপে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে না, কিন্তু এ কথা স্থির-নিশ্চয় জানি, এই বঙ্গসন্তানদের যেদিন কাণ্ডজ্ঞান সম্যক প্রস্ফুরিত হবে, যেদিন তারা ভারতনাট্যম, পিকাসো, সিংহেন্দ্র মাধ্যম কিংবা ভালুকপঞ্চমীর পশ্চাদ্ধাবন কর্ম বর্বরস্য শক্তিক্ষয় বলে সুষ্ঠুরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে সেদিন সে উদমার্গের সন্ধানে নব নব অভিযানের পথে নিষ্ক্রান্ত হবেই হবে। আজ যে রকম চিৎ-জাগরিত বিহঙ্গকাকলির ন্যায় কোনও কোনও বিদ্বজ্জন চৈতন্যচরিতামৃতের ভোজনামৃত খাদ্য-নিঘণ্ট অধ্যয়ন করতে করতে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করেন কিমাশ্চর্য! ছানার সন্দেশের উল্লেখ তো কুত্রাপি নেই?–ঠিক সেইরূপ অম্মদ্দেশে যেদিন রাজত্মে রাজবর্ষে চিৎকার প্রতিধ্বনিত হবে, আমাদের দাবি মানতে হবে। ভোজনা মার্গের-গীতা রচনা কর! ইনকিলাব-জিন্দাবাদ! পেট-কিলাব-ঝাণ্ডা তোল! সেদিন, বলতে লজ্জা করছে, বিনয়ে বাধছে, সেদিন এই অধমের, হ্যাঁ, এই অধমের বইয়ের সন্ধানেই বেরুতে হবে বঙ্গের মামলার মমজেনকে। আফগানিস্তানের সর্বাঙ্গসুন্দর ইতিহাস নির্মাণে মল্লিখিত দেশে-বিদেশে ব্যবহৃত হবে কি না জানি না, কিন্তু এ বিষয়ে সূচ্যগ্রন সূতিক্ষেণ সন্দেহ নেই যে আজ আমরা যে রকম আমাদের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস রচনার সময় নিরপেক্ষ পর্যটক পরিদর্শক হিউয়েন সাঙের শরণাপন্ন হব, ঠিক সেই রকম ইংলন্ড-সন্তান যেদিন সভ্য হয়ে তার দেশের ভোজনেতিহাস লিপিবদ্ধ করবে সেদিন তাকে বেরোতে হবে– পুনরায় ব্রীড়িত হচ্ছি– এই আমারই বইয়ের সন্ধানে, রাখাল বাঁড়য্যেকে যে রকম মোন-জো-দড়ো সন্ধানে একদা বেরুতে হয়েছিল; আপনাদের রবিঠাকুরের চাঁদ উঠেছিল গগনের সন্ধানে দেশে কেউ আসবে না। রায়গুণাকর অন্নদাশঙ্করের রত্ন ও শ্রীমতীর জন্য তাঁর প্রকাশক মাত্র ইয়োরোপকে চ্যালেঞ্জ করেছে, আমার প্রকাশক বিশ্বভুবনকে ক্রৌঞ্চমুদ্রা প্রদর্শন করবে, কাজী সায়েবের ভাষায় (আল্লা তাঁর বিমারি বরবাদ করে জিন্দেগি দরাজ করুন।) ত্রিভুবনেশ্বরের সিংহাসন নিয়ে আকর্ষণ-বিপ্রকর্ষণ আরম্ভ করবে।
.
সেই রত্নসমা শ্রীমতী তো ফরাসিস পানীয়ের কথা ওঠাতে আরেকবার বিলক্ষণ বলে অন্তর্ধান করলেন; আমি ভাবলুম, ওই য যা। ব্যাকরণে বুঝি গলতি হয়ে গেল। এ যে সম্ভ্রান্ত ভারতীয় ভোজনালয়! এ সব বিদগ্ধ পানীয় বোধহয় এখানে নিষিদ্ধ। আবার বাঙাল বনে গেলুম নাকি?
নাহ! কোনও ভয় নেই। ভাতিজা, চ্যাংড়া মুখুজ্যে ঘটিস্য ঘটি। সে দেখি দিব্য তার টুথব্রাশ গোঁফে আঙুল বুলোতে বুলোতে নিশ্চিন্ত মনে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে– চোখদুটো যেন ব্লটিং পেপার– সবকিছু শুষে নিচ্ছে। পুরীর সমুদ্রপাড়ে ঢেউ দেখে অবনঠাকুর ভীত হয়ে পালাবার পথ খুঁজছিলেন, তখন তাঁর এক স্যানা বন্ধু তাঁকে বলেন, ভয় কিসের? সায়েব-সুবোরা তো চতুর্দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ তেমন কিছু বিপজ্জনক পরিস্থিতি হলে পুলিশ আগেই তাদের খবর দিতেন, তারাও কাটতেন।
যাক। এদেশে আনকোরা আগত মুখুজ্যে যখন নিশ্চিন্ত তবে আর আমার ভয় কী? তখন কি আর ছাই জানতুম, সে আমারই ভরসায় নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে।
কিন্তু, সায়েব-সুবোরা তো রয়েছেনই। তেনারা তো পানীয় বেগর ভোজন করতে পারেন না।
এবং সাতিশয় উল্লাসের সঙ্গে লক্ষ করলুম, কোনও ভারতীয় লাউঞ্জে নেই। তারা নিশ্চয়ই মনুনিষিদ্ধ এই পানে লিপ্ত পাপবিদ্ধ হয় না। সোজা ডাইনিংরুমে ভোজন করতে গিয়েছে। তাদের চরিত্রবল দেখে উল্লাস বোধ করলুম।
ওদিকে দেখি শ্রীমতী অন্য খদ্দেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। ভারি বিরক্তিবোধ হল। এ যে দেখি হুবহু বাঙালি দোকানের মতো। আপনাকে জিনিস দেখাতে দেখাতে হঠাৎ অন্য খদ্দের ঢুকছে দেখে দিল ছুট তার দিকে আপনাকে ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলিয়ে রেখে, কিংবা যে রকম নির্মল সিদ্ধান্ত জানান যে আপনার পরীক্ষার ফল পরে বেরুবে!
নাহ্। আমারই ভুল। দেখি হেলে-দুলে একটি মোটাসোটা ভারিক্কি ধরনের লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এর গলায় গলাবন্ধ কোটের উপর ঝোলানো মসীকৃষ্ণ উপবীত ও তৎসংলগ্ন কুঞ্চিকা দেখে এর জাতগোত্র বুঝতে আমার কণামাত্র সময় লাগল না। যারা সংস্কৃতে লেখা প্রতিমালক্ষণ সংক্রান্ত অত্যুকৃষ্ট গ্রন্থরাজি অধ্যয়ন করেছেন তারাই জানেন, প্রতিমা দেখে কোনটা কোন দেব না দেবীর জানতে হলে স্মরণ রাখতে হয়, কোন দেবীর দক্ষিণ হস্তে কুবলয় বলয়, কার বাম হস্তে চক্র, কার মস্তকে উষ্ণীষ, কার পদে নূপুর।
কুঞ্চিকাসমন্বিত কৃষ্ণোপবীত ওয়াইন মাস্টারের লক্ষণ।
আপনি যদি চাষাড়ে হুইস্কি বিয়ার রাম জিন্ না খেয়ে উত্তম বিদগ্ধ ফরাসি কিংবা জর্মন অথবা ইতালীয় ওয়াইন খেতে চান তবে এই ভদ্রসন্তান আপনাকে পরম বান্ধবের ন্যায় তাবৎ সন্ধিসুড়ক বাতলে দেবেন। চাণক্য বলেছেন, ব্যসনে (এবং মদ্যপান ব্যসন-বিশেষ) যে সঙ্গে থাকে সে বান্ধব। ইনি তাই করে থাকেন। তবে চাণক্যের বান্ধব আপনাকে কোনওগতিকে ঠেকিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবার চেষ্টা করে; ইনি মোকা পেলে ওস্কাবার চেষ্টা করেন– এই যা তফাৎ।