ইনভেশনের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বসংসারের জাত-বেজাত জড়ো করা হল ইংলন্ডে–আলেকজান্ডারের সময় মেসিডোনিয়ায় কিংবা রোমের মধ্যাহ্ন দীপ্তির সময়ও এ শহরে বোধহয় এরকম সাড়ে বত্রিশ ভাজা কখনও হয়নি। ফলে লন্ডনের রান্না আপাদমস্তক বদলে গিয়েছে।
সেইটে চাখলুম ৫৮-এ।
সবকিছু বেবাক বদলে গিয়েছে। ইস্তেক ক্রুয়েট তার মালমসলাসুদ্ধ গায়েব। যেদিন নুন লঙ্কার শিশিও যাবে, সেদিনই ইংরেজি রান্না তার চরম মোক্ষে পৌঁছবে। কে না জানে, ভালো রাঁধুনি কাউকে ফালতু নুন নিতে দেখলে বেদনা পায়। প্যারিসে শোনা যায়, ভোজরাজ সম্রাট আগা খান এক বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় মনের ভুলে একটু ফালতু নুন নিয়েছিল বলে রেস্তোরাঁর রাঁধুনি দুঃখে আত্মহত্যা করে। ইংলন্ডে এখন পাঁচকই রান্নাঘরে আহারাদি তৈরি করে। গাহককে ডাইনিং হলে টেবিলের উপর পি সি সরকারের মতো নিপুণ যাদুকরি হস্তে সিরকা সস ঢেলে কাঁচাসে মালকে সুস্বাদু করতে হয় না। পৃথিবীর আর পাঁচটা জাত– মায় বান্টু হটেনটট– এতকাল যা করে আসছে।
এবং জাত-বেজাতের নতুন নতুন পদও তার রান্নাঘরে ঢুকতে দিয়েছে।
ত্রিশ বছর আগে রাইস-কারি খেতে হলে আপনাকে লিভিংস্টোনের মতো ছ মাসের চালচিড়ে পুরনো ধুতিতে বেঁধে বেরোতে হত তারই আবিষ্কারে। বহু বাজে লোক কর্তৃক বেপথে চালিত হয়ে, বহু পুলিশমেনের সক্রিয় সহযোগিতার ফলে, অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জিয়া আপনি যখন মোকামে পৌঁছতেন তখন রাইস-কারি খতম! সেই লক্ষ্মীছাড়া বিফস্টেক খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। মনে পড়ত সেই গরিব মোল্লার কাহিনী। চেয়ে-চিন্তে অতি কষ্টে খেয়ার একটি পয়সা যোগাড় করে সে যখন ওপারে ফাতেহার (শ্রাদ্ধের) ভোজে পৌঁছল তখন সবকিছু ফুরিয়ে গিয়েছে। মেহমানকে তো আর অভুক্ত ফেরানো যায় না– তাড়াতাড়ি ভাত আর মসুর ডাল সেদ্ধ করে তাকে খাওয়ানো হল। মনের দুঃখে সে বললে, ওরে ডাল, আমি না হয় খেয়ার পয়সা ধার করে যোগাড় করলুম; তুই পেলি কোথায়? আপনিও স্টেককে শুধাবেন, এ পথ তুই পেলি কোন পুলিশকে শুধিয়ে?
একদম পয়লা নম্বরি হোটেলে অর্থাৎ যেখানে গ্রস্টারের ডুক, কেন্টের ডাচেস খেতে যান– আমি যাইনি। তার অধিকাংশই দামের ঠেলায় ফাঁকা। বিরাট হলের এখানে দু জন ওখানে চারজন লোক খাচ্ছে, আর বেকার ওয়েটারগুলো ইভনিং ড্রেস পরে হেথা-হোথা জটলা পাকাচ্ছে, বাড়িটা যেন খা খা করছে–এমন জায়গায় খেয়ে সুখ নেই। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল চ্যারিটি ম্যাচে যদি গিয়ে দেখেন মাত্র আপনি আর ওপাড়ার গোবর্ধন উপস্থিত, আর কেউ নেই, তখন কি খেলা দেখাটা জমে? অবশ্য যেখানে এমন ভিড় যে পলায়মান বয়ের কাছাতে হ্যাঁচকা টান না দেওয়া পর্যন্ত একটা হাফ-সিঙ্গিল চা জোটে না সেখানেও গব্বযন্ত্রণা। বাচ্চা এবং চা আসি আসি করে না এলে কী পীড়া তা শুধু পোয়াতি আর গাহকরাই জানে।
অতএব যেতে হয় দুই নম্বরি হোটেলে। এবং সেখানেও হরবকৎ রাইস-কারি পাবেন– পয়লা নম্বরিতে পান আর না-ই পান। আর কোনও কোনও রেস্তোরাঁয় লেখা আছে পাটনা রাইস! পাটনা রাইসের প্রতি এ দুর্বলতা কেন? রাষ্ট্রপতির শহর বলে?
আর যারা খাচ্ছে তারা বাঙালি নয়, ভারতীয় নয়–দুনিয়ার চিড়িয়া।
এইসব খাস বিলিতি রেস্তোরাঁতেই যদি রাইস-কারি জামাইয়ের কদর পাচ্ছে তবে তার আপন বাড়িতে অবস্থাটা কী রকম?
সে এক অভিজ্ঞতা।
লন্ডনের বুকের উপর তবে ঠিক বড় রাস্তায় নয়। ভালোই, হট্টগোল কম। এই আমাদের বড়বাজারে যতখানি। তবে বড় রাস্তায় গোলমাল কত? মুখুজ্যেকে শোধাবেন। সে বেচারি ঘুমুতে পারত না!
ইয়া লম্বা, উর্দি পরা মাথায় পাঠানি পাগড়ি, ছ ফুটি দারোয়ান। যেখানে হ্যাট রেনকোট ছাড়তে হয় সেখানেও তদ্বৎ। ঢুকেই লাউঞ্জ ককটেলটা-আসটা খাবার জন্য; ভাগ্যিস ওটা মুরারজি ভাই চালান না। সাজসজ্জা পুরা ভারতীয়। হেথায় নটরাজের ব্রোঞ্জ, হোথায় পেতলের ভারতীয় অ্যাসট্রে, আরও এটা সেটা, ধূপকাঠিও জ্বলছে।
এগিয়ে এলেন খাপসুরৎ শ্যামাঙ্গী, পরনে মুর্শিদাবাদি, চুলে তেল পড়েছে মেমেদের শনপাটের মতো স্নেহহীন নন– খোঁপাটিও নসিকে বাঙালোরি, ব্লাউজ ব্লাউজেরই কাজ করছে চোলির প্রক্সি দিচ্ছে না– চোখেমুখে খুশি, ভারি চটপটে। একটা নমস্তে ভি পেশ করলে।
বাহ্! এ তো বেড়ে ব্যবস্থা।
গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।
তা হলে উত্তম আহারাদি হবে।
ফরাসি গুণী রশফুকোল বলেছেন, আহার প্রয়োজনীয় বটে; কিন্তু রসিকজনের মতো আহার করা আর্ট। ভোভানার্গ বলেছেন, মহৎ চিন্তা পেটের ভিতর থেকে আসে। গ্রিক দার্শনিক এপিকুর বলেছেন, প্রকৃতিদত্ত বুদ্ধিবৃত্তি উত্তম কর্মে নিযুক্ত করবে এবং সুবুদ্ধিমানের মতো পরিপাটি আহার করবে। এবং ইলেসিয়াসের মাধ্যমে নমস্য বাইবেল গ্রন্থ অনুশাসন দিয়েছেন, পান, আহার ও আনন্দ করার (ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড বি মেরি) চেয়ে মহত্তর কর্ম ত্রিভুবনে নেই।
আর মলিয়ের যখন বলেন, আমরা বাঁচার জন্য খাই; খাওয়ার জন্য বাঁচিনে, তখন তিনি বর্বর জনসুলভ প্রলাপবাক্য ব্যবহার করেছেন। আমরা খাওয়ার জন্য বাঁচি, বাঁচার জন্য খাই না! ভোজনাদি সম্বন্ধে আমি আলোচনা আরম্ভ করলেই কোনও কোনও উন্নাসিক পাঠক বিরক্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, এসব কথা তো আগেও যেন শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। উত্তরে নিবেদন, সব কথা শোনেননি; আর শুনে থাকলেই-বা কী? পুরনো জিনিসের পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে নিটশে একদা লিখেছেন, এ কথা আমি পূর্বেই বলেছি, কিন্তু মানুষ শোনা কথাই শুনতে চায়, জানা কথাই বিশ্বাস করে।