.
ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি–অর্থাৎ ইংরেজ বাড়িঘর ছিমছাম রাখে, হিন্দু মেয়েরা জামা-কাপড় (বিশেষ করে গয়না-গাটি) পরে ভালো, আর মুসলমানের কুলে পয়সা যায় তার হাঁড়িতে, উত্তম আহারাদি করে তার দিন কাটে। তাই ব্রিামদা একদিন আপন মনে প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, মুসলমানদের ভিতর এত শিক্ষাভাব কেন? তার পর আপন মনেই উত্তর দিয়েছেন, যেখানে শিককাবাব বেশি সেখানে শিক্ষাভাব তো হবেই।
বিবিসির অন্যতম বাঙালি মুসলমান কর্মী আমাকে বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন সম্বন্ধে প্রশ্ন শোধাননি, জর্মন প্রেসিডেন্ট হয়েসের আসন্ন লন্ডনাগমনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমার সুপক্ক মতামত জানতে চাননি, এমনকি ইংরেজ নারীর নমনীয়তা কমনীয়তা সম্বন্ধেও তিনি উদাসীন। আমাকে শুধালেন, আহারাদি?
আমি বললুম, ইংরেজের তো বাড়ি; দুনিয়ার হাঁড়ির খবর রেখেও তার হাঁড়ি শূন্যই থেকে গেছে।
তার পর বিজ্ঞভাবে মাথা নেড়ে জর্মন অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে আরম্ভ করলুম, নরমানরা আলবিয়ন ভূমি জয় করার ফলে ধর্ম, রাজনীতি তথা সাহিত্যজগতে যেসব বহুবিধ ঘূর্ণিবাত্য, ভূমিকম্প, প্লাবনান্দোলন আরম্ভ হয়েছিল তদ্বিষয়ে বহুতর পুস্তক, সংখ্যাতীত প্রবন্ধ এবং ভূরি ভূরি গবেষণামূলক কোষ লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওহহা হতোস্মি, ইহলোক-লোক উভয় লোকের সঙ্গমভূমি এই যে উদর (পিতৃলোকের একমাত্র কাম্য পিণ্ড, এ তথ্য কুলাঙ্গারও স্মরণ রাখে।) তদ্বিষয়ে অতিশয় যৎসামান্য স্মৃতিশ্রুতি বর্তমান। পরম মনস্তাপের বিষয় অদ্যাবধি আলবিয়ন ভূমির শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায় এই সর্বোত্তম সনাতন মার্গ সম্বন্ধে সম্যক সংবিদিত হয়নি।
কর্মী বললেন, বাংলা অভিধান হাতের কাছে নেই।
ত্রিতাল থেকে একতালে যাওয়া অশাস্ত্রীয়। কিন্তু শাস্ত্র মেনে কী হবে? পূর্বেই নিবেদন করেছি, রবীন্দ্রনাথের সর্বশাস্ত্রসম্মত মানবধর্ম শ্বেতভূমিতে অনাদৃত।
আমি বললুম, নরমানরা আসার পূর্বে এদেশের লোক বোধহয় কাঁচা মাংস খেত। এই দেখুন জ্যান্ত ভেড়ার নাম ইংরেজিতে শিপ, তার মাংস রান্না করে খেতে হলে সেটা হয়ে যায় মটন। শিপ শব্দ খাস ইংরেজি, মটন শব্দ ফরাসি, নরমান যা খুশি বলতে পারেন; কাউ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (তোবা, তোবা)! ফরাসি শব্দ বি; কাফ ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে ফরাসি শব্দ ভিল; ঠিক সেইরকম সুয়াইন ইংরেজি কিন্তু খেতে হলে (রাম রাম)! ফরাসি শব্দ পোর্ক; ইংরেজি ডিয়ার ফরাসি ভেনজন ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি যেসব রসবস্তু দিয়ে এগুলোকে সুস্বাদু করা হয়, যথা সস, সেভারি, ভিনিগার, মায়োনেজ, সেগুলোও ফরাসি শব্দ। খাবার মেনু ফরাসি; তার প্রধান ভাগ অরদ্যভ্র (অবতরণিকা), কসমে-পতাজ (শুরুয়া বিভাগ), আঁত্রে (প্রবেশ), পিয়েস দ্য রেজিসাস (পিস্ অব রেজিসটেনস্ অর্থাৎ প্রধান খাদ্য যা দিয়ে পেট ভরাবে), স্যালাড, ডেসের (ফলমূল, মিষ্টি), সেভরি (শেষ চাট) সবই ফরাসি। আর পদগুলোর নাম, কসমে জ্বলেয়্যন, পটাজ ও ফেরমিয়ে (চাষাদের(!) সুপ), অমলেট ওর্জেব (পেঁয়াজ পুদিনার অমলেট) এখানেও দেখুন এগ ইংরেজি শব্দ কিন্তু অমলেট ফরাসি। এসব আরম্ভ করলে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। আশু ইংলগামী এর কটিঙটা রাখলে উপকৃত হবেন; আমাকে নিমন্ত্রণ করে সঙ্গে নিয়ে গেলে আরও বেশি উপকৃত হবেন; কারণ যেগুলোর নাম করলুম এগুলো ভোজনতীর্থের বিখ্যাত কাশী বৃন্দাবন হিংলাজ গোটাটি করে নিয়ে যেতে হয় হাতে ধরে)।
এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। মহানগরী কলকাতার হিন্দুসন্তান যখন পোশাকি মাংস খায় তখন সে ভাত খায় না, সে তখন বেরোয় খানা খেতে এবং যবনের হাতে কিন্তু স্বেচ্ছায়। কোর্মা, কালিয়া, বিরিয়ানি, কাবাব, দোলমা এবং সবকটি শব্দই বিদেশি; বাংলা প্রতিশব্দ নেই। চপ, কাটলেট, অমলেটও বিদেশি শব্দ। তফাৎ এই যে ইংরেজিগুলো হিন্দু হেঁশেলে ঢুকেছে, মুসলমানিগুলো ঢুকতে পারেনি। তার কারণ, মুসলমানিগুলো রান্না একটু বেশি শক্ত।
শেষোক্তগুলো কলকাতার মুসলমানরাও খেতে শিখেছেন।
এক মুসলমান গেছেন হোটেলে। বয় এক কাটলেস লে আও।
হুজুর আজ মিট-লেস।
সায়েব বললেন, কুছ পরোয়া নাহি; সো হি লাও।
সায়েব ভেবেছেন মিট লেস (দিন) বুঝি কাটলেসের এক নবীন সংস্করণ।
মূল কথায় ফিরে যাই।
নরমান জয়ের পর ক্রমে ক্রমে যেসব বিদেশি খাদ্যরাজি বিলাতে প্রবর্তিত হল, তার ইতিহাস এখনও আমার চোখে পড়েনি– পক্ষান্তরে ফরাসি খাদ্যের সর্বাঙ্গসুন্দর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে উত্তম উত্তম পুস্তক দেখেছি। শুনেছি, মহামান্যবর স্বর্গীয় আগা খান এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভোজনরসিক ছিলেন। তাঁর নাকি একখানি বিশাল বিরাট এটলাস ছিল। তাতে পৃথিবীর কোন জায়গায় কোন সময় কোন খাদ্য উত্তমরূপে প্রস্তুত হয় সেগুলো চিহ্নিত ছিল। এ পৃথিবীর সব খাদ্যই যখন তিনি একাধিকবার খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন তখন নতুন রসের সন্ধানে অন্যলোকে চলে গেলেন। আমার হাজার আপমোস তাঁর সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি বলে।
তা সে যাই হোক, একথা, মোটামুটি বলা যেতে পারে বর্বর ইংরেজি রান্নার প্রতীক ছিল ক্রুয়েট স্ট্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি। এতে থাকত সিরকা, অলিভ তেল, উস্টার সস আর সরষে। নুন গোলমরিচ তো আছেই। বস্তুত এর কোনও একটা কিংবা একাধিক বস্তু না মিশিয়ে অধিকাংশই খাওয়া যেত না। নিতান্ত খরগোশ গোত্রজাতরাই ইংরেজের স্যালাড কচর কচর করে চিবুতে পারত। পার্ক সার্কাসের রদ্দিতম ধনে কিংবা পুদিনা স্যালাড এর তুলনায় অমৃতগন্ধী মধুমঞ্জরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেপাইরা ট্রেঞ্চে শুয়ে শুয়ে অখাদ্য খেয়ে খেয়ে স্বপ্ন দেখত, ছুটিতে প্যারিসে ছিমছাম রেস্তোরাঁয় করকরে টেবিলক্লথগুলো ছোট্ট টেবিলের উপর মেডফুড–অর্থাৎ তৈরি খাবারের; ইংরেজি ধরনে নুন লঙ্কা তেল সস মিশিয়ে খেতে হয় না, ফরাসি শে এসব বস্তু রান্নাঘরেই পরিপাটিরূপে তৈরি করে দিয়েছে আমাদের মা-মাসিরা যেরকম মাছের ঝোল কিংবা চালতের অম্বল করে দেন। তারই ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজি রান্নার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন হয়। সেইটে আমি চোখে দেখি ১৯৩০ সালে। অখাদ্য লেগেছিল কারণ, সদ্য গিয়েছি লন্ডনে– প্যারিস থেকে।