হঠাৎ একদিন দেখি বেশ ঝরঝরে শরীর তার। একটু শীর্ণ হয়েছে। দুই স্ফীত স্তনভার বইতে পারছে না। মরিয়া হয়ে তাকে আমি হাতছানি দিয়ে ডাকি। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে চিনতে পেরেছে এমন কোনো লক্ষণ দেখা গেল না তার মধ্যে। চিনতে পারলেই বা কি? নিস্পৃহ নিরাসক্ত চোখে আমার দিতে চাইলো সে। সেই বিশাল দুটি চোখ একটু গর্তে বসে গেছে। বিচ্ছিরি ব্যাপার, ঠিক তখুনি আমার কান্না এলো–এমন অসম্ভব ভাবপ্রবণতায় নিজের ওপরেই আমি জ্বলে উঠি। গলায় বাষ্প ফেনিয়ে উঠতে উঠতে আবার নিচে নেমে যায়। কেউ যেন শুনতে না পায়, দেখতেও যেন না পায়, আমি এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নিচু গলায় ফিসফিশ করে জিজ্ঞেস করি বাচ্চা হয়েছিলো তোর, তার কি হলো রে?
তার সেই নিচু কর্কশ গলায় সে বলে, নাইখো।
কেন, কোথায় দিয়েছিস তাকে? কঠিন গলায় আমি বলি। আমার হঠাৎ রাগ হয়ে যায়।
কিছুমাত্র পরিবর্তন নেই তার মধ্যে। ঠিক আগের কথাটিই আবার বলে, নাইখো।
কোথায় কাকে দেয় সে সন্তান? দেবতাদের শাপমুক্ত করছে নাকি? আয়েশা ধীর পায়ে গাছতলার দিকে ফিরে যায়।
তিনবারের বার সে গর্ভধারণ করেছে জানতে পেরে আমি বাসায় ফিরে এসে আমার ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েটিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকি। আমার স্ত্রী কাছে এসে বলেন, ও আবার কি ঢং!
আমি চোখ মুছতে মুছতে বলি, ওকে তো কোনোদিন আদর করি না।
কচি বেলায় হাত মুঠো করে আমার বুকে ঘুমোত, গান শুনতে শুনতে কাঁধে মাথা রাখতে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গেছে।
আমার স্ত্রীর চোখেও হঠাৎ জল চলে এলো। মেয়েকে ধমকে উঠে বললেন, যা এখান থেকে। মেয়েটা হকচকিয়ে চলে যায়।
এবার দেখি আয়েশার শরীররটা ভেঙে যাচ্ছে। এ সেই রকমের ভাঙা যাতে মনে হয় ভাঙার ব্যপারটা শেষ হলে শরীরের টুকরোগুলো এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে। চারদিক থেকে কুড়িয়ে এনে জোড়াতালি দিতে গেলে হয়তো দেখা যাবে পা বা কার হাড় নিয়ে চুষছে একটা কুকুর। কোথাও যায় না সে। গর্ভের অসম্ভব ভার নিয়ে বৃত্তাকার রাস্তা ধরে ধারপায়ে শুধু হেঁটেই চলে। চোখে তার নিস্পৃহ অবজ্ঞা মেশানো দৃষ্টি।
আমার স্ত্রীকে কখনো তার কথা বলি না। আমি হঠাৎ জেগে উঠে দেখেছি আমার মুখের দিকে তিনি অপলক চেয়ে আছেন। আমার চোখ খুলে গেলেই তিনি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে মুখ ফিরিয়ে নেন?
প্রসবের সময় আসন্ন হয়ে এলে একদিন আয়েশাকে দেখি তার সেই পছন্দের জামগাছের তলায় চিৎ হয়ে নিস্পন্দ শুয়ে আছে বাতাসে ফঁপিয়ে ভোলা মশারির মতো ফুলে ফোলা আছে তার পেট। মাটি রং-এর পাতলা ঘেঁড়া শাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে কিন্তু সব ঢাকেনি। এই পেটের বোঝা খালাস হয়ে গেলেই এতটুকু সময় নষ্ট না করে সে তার জরায়ুতে নিযুক্ত করে নেবে আর একটি ডিম্বকোষ। আজ তার এই বিশাল গর্ভগৃহ দেখে মনে হয়, একটিমাত্র সন্তানের জন্য জায়গাটি বড়ো বড়ো—হয়তো ওখানে শত কলসীতে ভরা আছে একশো সন্তান। পিতৃহীন জারজেরা মায়ের হয়ে অধিকার নেবে মাটির।
আর একবার মাত্র আয়েশাকে দেখেছি। তারপরে আর কখনো নয়। একটা ইটের ভাঙা পাঁচিলের উপর সে বসে আছে। পাতলা তামাটে চামড়া দিয়ে আগাগোড়া। মোড়া। কিন্তু চামড়াটা এবার মাপে বড়ো হয়েছে। কনুইয়ের কাছে ময়লা ন্যাকড়ার একফালি ঝুলে আছে—গলার কাছে কয়েকটা ভাজ, বুকের উপর ন্যস্ত আছে একটু। কালো কোঁচকানো দুটো ধারালো ফালি আর বাকি বাড়তিটা ঝুলে আছে তার নিতম্বের নিচে। বাংলাদেশের ম্যাশের মত খাঁজকাটা, ভাজ করা, তীব্র ধারালো। এবার কিছুতেই ওর চোখ দেখতে পাই না। কপালের নিচে দুটি বড়ো বড়ো কালো গর্ত, সেখানটায় এমন অন্ধকার যে কিছু দেখতে পাওয়া গেল না। সরু শীর্ণ হাত তুলে সে আকাশে দাগ কেটে দেয়, তারপর হাত নামিয়ে হিংস্র নখরসহ তার ধাতব আঙুলগুলো দিয়ে কঠিন আক্রোশে মাথা চুলকোতে তাকে।
আমি দেখি আকাশ বুজোতে বুজোতে অন্ধকার নেমে আসছে। তার মধ্যে সে হারিয়ে যাবার আগেও আমি দ্রুত পায়ে এই পরিশুদ্ধ জননীর কাছে গিয়ে জিগগেস করি, মা, এবার তোর কি হলো? তার জনহীন জন্মার সে সম্পূর্ণ খোলা রেখেছে।