কি বললে? আমাদেরই মেয়ের মতো? খেপে গেলে নাকি? একটা রাস্তার বদস্বভাব মেয়ে, জন্মের পর থেকে পুরুষসঙ্গ করছে
সেই হারামজাদা শুয়োরের দল, পুরুষ শুয়োরদের বুঝি কোন দোষ নেই রাগে চিৎকার করে আমি গলা চিরে ফেলি।
সে তত তোমরাই—স্ত্রী চেঁচিয়ে ওঠেন।
সে তো আমরাই—চকিতে একটা কঠিন সত্য লোহার শাবলের মতো কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত করে। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে আমি বলি, সে তো ঠিকই কিন্তু মেয়েটির দোষ কি?
আমার অত জজিয়ত্রি দরকার নেই–কালই আমি ওকে তাড়াব।
কি আশ্চর্য, একটা ঘোরের মধ্যে আমি বলে ফেলি, একটু সবুর করো, মানুষ আসা দেখতে দাও আমাকে।
কি ভেবে কেমন করে যে এই সস্তা সিনেমার ডায়লগটি বলে ফেলি জানি না। কিন্তু আমার স্ত্রী চুপ করে যায়। মেয়েটা থামে না, সিনেমা চলতে থাকে, মানুষ নিষ্পাপ নিষ্কলংক শিশু আসছে, সুস্থ সতেজ জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসবে মানুষ। সমস্ত পৃথিবীর অপেক্ষা তার জন্যে।
যেমন বলেছিলেন, আমার স্ত্রী পরের দিনই মেয়েটিকে তাড়িয়ে দিলেন না। তবে মেয়েটির প্রতি তার ব্যবহার খুবই কঠিন হয়ে উঠলো। ছোটোখাটো ত্রুটির জন্য নির্মম কথা শুনতে হতো তাকে। কিন্তু সে একটি কথারও জবাব দেয় না।
আমি ওকে খুব কাছ থেকে লক্ষ করতে থাকি। বলতে কি আমার স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত হতে লাগলো। চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই নির্জন জ্যোৎস্নারাতের স্তব্ধতার মধ্যে কান্নায় ভিতর থেকে ভরে উঠছে ধলেশ্বরী মধুমতী—নিষ্কলুষ রুপোর পাতের মতো ডিমে ভরা ইলিশের ঝক সমুদ্র থেকে ছুটে আসছে স্রোতের উজান বেয়ে—ডিম ছাড়তে পারার আগেই জালে আটকে তারা আছড়ে পড়ছে জেলেদের ডিঙি নৌকায়। ঝিকিয়ে উঠছে আবছা তরল অন্ধকারের মধ্যে। তাদের পুচ্ছ তাড়নার শব্দ উঠছে ছপ ছপ তারপর কানকো ফেটে গলগল করে কালচে-লাল রক্ত বেরিয়ে এসে ধুয়ে দিচ্ছে রুপোলি শরীর। চৌকো স্নাইডের মতো চারপাশ বাঁকা একটি করে ছিপ শব্দ করে সরে যায়। আমি চোখ খুলি। সামনের মাঠে দেখি শীতের শুকিয়ে ওঠা শাদা ঘাসের জমির একপাশ থেকে সবুজ ঘাস উঠে আসছে ঢেকে ফেলছে বিবর্ণ মাঠটা আর দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেহগনি গাছ, মোম দিয়ে মাজা ফিকে সবুজ পাতায় আগাগোড়া সাজানো।
কতোদিন কেটেছে এমন। মাস দুই হতে পারে। শেষে একদিন ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার স্ত্রী শান্ত নিচু কঠিন গলায় বললেন, ওকে আর রাখা যায় না?
আমি বলি, ঠিক বলেছ—আর একদিনও ওকে রাখা চলে না।
পরের দিন আয়েশা এলে আমার স্ত্রী বলেন, তোকে আর রাখতে পারছি না। নিজের জিনিসপত্র যা আছে নিয়ে চলে যা আমার বাড়ি থেকে। দূর হয়ে যা।
আয়েশা কোনো কথা না বলে নিজের ময়লা একটা শাড়ি, রং-জ্বলা একটা গামছা আর এমনি টুকিটাকি দু-চারটি জিনিস হাতে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ায়, তার সেই আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ মেলে সে বলে, যেচি, আমার এ মাসের যা পাওনা হয়েছে দিবেন না? স্ত্রী বলেন, এই তোর মাইনে; নে ধর আর এইটা তোকে দিলাম। আর কোনোদিন এদিকে আসবি না। তোকে যেন আর কোনদিন দেখতে না পাই। যা, মরগে উই—তীব্র রাগে কথা কটি বলে তিনি মেয়েটির হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়ে তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাড়ির বাইরে ঠেলে দেন।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটো সিঁড়ির দিকে যেতেই আমার স্ত্রীর অত্যন্ত দ্রুত, অত্যন্ত অস্থির হাতে খটাখট শব্দে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়েই ফিরে দাঁড়িয়ে চোখে আঁচল চাপা দেন। তাঁর মুখের উপর কেটে বসা কঠিন রেখাগুলি কিন্তু একটুও ভাঙে না—অথচ সামান্য নড়চড় হলেই নানা টুকরোয় যেন ছড়িয়ে পড়বে। ওঁর মুখ। তিনি ঘরের দিকে চলে গেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর উজ্জ্বল রোদের মধ্যে আয়েশা বেরিয়ে এলো। ছেঁড়া ময়লা শাড়ির ভিতর দিয়ে আগুনের শিখারমতো তার রূপ ঝলকাচ্ছে। অনেক বড়ো দেখাচ্ছে তাকে। শরীর ঢাকতে তার উজ্জ্বল ত্বক যেন একটু কম পড়েছিলো, সেজন্যে খুব টানটান। এখনো ঠিক বুঝা যায় না উষ্ণ রক্তের মধ্যে কি গভীর নিগ্নতায় নিশ্চিন্ত অন্ধকারে এই কুমারী জননীর সন্তান কতোটা বড়ো হয়েছে। আমি জানি বলেই আয়েশার ঈষৎ ভারি তলপেটটার আন্দাজ পাই।
আমাদের এদিকে আসে না বটে, তবে ওকে মাঝমাঝে রাস্তার কিনারা ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যেতে দেখি, দেখতে পাই গাছে ছায়ায় বসে নিরুদ্বেগে ময়লা আঁচল দিয়ে গাম মুছছে। পৃথিবীকে সে দেবে অমূল্য উপহার, গর্বে তৃপ্তিতে ভরে উঠেছে তার বুক, অবজ্ঞার চোখে সে চেয়ে আছে মানুষের ইর সংসারের দিকে। জানি এসব কিছু নয়, আমিও তৈরি করেছি দুস্পাঠ্য দুজ্ঞেয় অক্ষরমালা, যা কেবল আমিই পড়তে পারি। এইসব অক্ষর কি দাগে-ঢাকা, ক্ষয়-পাওয়া সুদূর অতীতের কোনো শিলালিপিতে ছিলো, নাকি আমিই তৈরি করে নিয়েছি?
দুটোই পাশাপাশি চলতে থাকে। কঠিন কঠোর কল্পনাহীন সত্তাহীন অর্থহীন ক্লান্তিকর বাস্তব আর ঠিক তার পাশে সৃষ্টি হতে থাকে অগ্নিগর্ভ সংকেত, দেখা দেয় সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্ম দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক জননী।
এরপর আবার একদিন আয়েশাকে দেখতে পেলাম বিরাট ধামার মতো পেট নিয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে চলেছে। কোনো বাড়িতে তো সে আর এখন ঢুকতে পারছে না। ও কি এখনো ওর মায়ের ঠেয়ে যায়? সেখানে কি ওর ঠাই মিলবে প্রসব হওয়ার জন্যে? নাকি সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে এক কুকুরীর সঙ্গে একই যন্ত্রণায় সে কারাবে?